اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
কেবল ইসলামই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকটি নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে। ইসলাম শুধু অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতাই দেয়নি; বরং তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক লেনদেন, সৌজন্যবোধ ও উঠা-বসার সুযোগও রেখেছে। কিন্তু তথাকথিত উন্নত সভ্যতার ধ্বজাধারীরা মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বুলি আওড়ালেও ধর্মের খোলসেই তারা মুসলিমদের উপর নানান নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া সবখানেই প্রায় একই ছবি দৃশ্যমান।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও এই তালিকার বাইরে নয়; বরং তালিকার শীর্ষের দেশসমূহের অন্যতম। সেখানে মুসলিমদের প্রতি নির্যাতনের ইতিহাস বহু পুরনো। ভারতে যুগের পর যুগ ধরে মুসলিমদের উপর নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। সংখ্যালঘু মুসলিমরা সেখানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। ভারতের মুসলিম নেতা তাজুদ্দীন আহমাদ ২০১৯ সালের ২ জুন দেশ পত্রিকায় ‘ঊষা-দিশাহারা নিবিড় তিমির আঁকা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘গো-রক্ষকদের তাণ্ডবে ভারতে কত সংখ্যালঘু মানুষের প্রাণ গেছে তার ইয়ত্তা নেই। আহার নিদ্রার মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে পাবলিক লিঞ্চিং’। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতন থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত মুসলিমদের জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির কিছু পূর্বে পাঞ্জাব অঞ্চলে যে ধর্মীয় দাঙ্গা বাঁধে, তাতে উভয় ধর্মের ২-৫ লক্ষ মানুষ নিহত হয়। পাক-ভারত আলাদা হলেও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বন্ধ হয়নি। এখনও মুসলিমরা প্রতিনিয়ত নানান বৈষম্য, শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত হাজার হাজার ছোট-বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। নিহত হয়েছেন হাজার হাজার মুসলিম। ১৯৯২ সালে চরমপস্থি হিন্দুদের আক্রমণে ভারতের বাবরী মসজিদটি ধ্বংস করা হয়। এর ফলে শুধু মুম্বাই ও দিল্লীতে ২০০০ মানুষের প্রাণ যায়। ভারতে বর্তমান বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুসলিম নির্যাতনের পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে গেছে। এ সরকারের ‘এক দেশ, এক জাতি, এক ধর্ম’ দর্শনই গোটা ভারতকে বেসামাল করে তুলেছে। ‘জয় শ্রীরাম’ ও ‘গো মাতা কি জয়’ শ্লোগান দিতে মুসলিমদের বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি এর কারণে নির্যাতন ও হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন বিজেপির ফাদার সংগঠন আরএসএস-এর দর্শন হলো- ‘সবার উপর গরু সত্য, তাহার উপর নেই’। তাদের মুখপত্র ‘স্বস্তিকা’য় বলা হয়েছে ‘ভারতের মুসলমানরা ধর্মের বিধান মেনে যদি গরু জবাই করেন, তাহলে গরু হত্যাকারীকে হত্যা করার অধিকার অন্যদের রয়েছে’। যাদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে গরুর মূল্য বেশি, তাদেরকে কি মানুষ বলা চলে? পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক মুহাম্মাদ আফরাজুলকে রাজস্থানে পুড়িয়ে মেরে ফেলা, গো-রক্ষকদের তাণ্ডবে পহেলু খান বা উমের খানদের মৃত্যু, হরিয়ানায় কিশোর জুনাইদ খানকে বন্ধুদের সামনেই ছুরিকাঘাত করে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা, ২০১৮ সালে ৩০ মার্চ মুহাম্মাদ ফরহাদ মালিকের হত্যা- এ জাতীয় বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী এখন ভারত। সাথে সিএএ, এনআরসি, ৩৭০ ধারা বিলোপের মাধ্যমে মুসলিমদের বিতাড়ন ও তাদের প্রতি অবিচারের মতো ইস্যু তো রয়েছেই। অথচ ভারতের মুসলিমরা সব সময়ই দেশপ্রেমিক।
বর্তমান এর সাথে যুক্ত হয়েছে ‘লাভ জিহাদ’ আইন। ভারতে মুসলিম ছেলের সাথে হিন্দু মেয়ের বিয়ে ও ধর্মান্তর ঠেকাতে নতুন এ আইন এনেছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো। মুসলিমরা পরিকল্পিতভাবে হিন্দু নারীদের বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করছে বলে ভারতের কট্টরপন্থি বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছিল। বিয়ের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত করার এ প্রক্রিয়াকে ‘লাভ জিহাদ’ বলে অ্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এ আইনে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। হিন্দু-মুসলিম বিয়ে আদৌ ইসলাম সমর্থিত কিনা- তা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। এখানকার প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, আইনের নামে এ নব্য হাতিয়ারের মাধ্যমে মুসলিমদের হয়রানি করা হচ্ছে, অযথা তাদের ধরপাকড় করা হচ্ছে। তাদের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। ‘লাভ জিহাদ’ আইন নামকরণের মাধ্যমে ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়া ‘জিহাদ’কে অবমাননার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। কয়েকটি রাজ্যের হাইকোর্ট এই আইনের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিভাজনের লক্ষ্যেই এই নতুন আইন প্রণয়ন করেছে ভারত সরকার। ভারতের তদন্ত সংস্থাগুলো এবং আদালত ‘লাভ জিহাদ’ তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেছে। লাভ জিহাদকে তারা মোদি সরকারের মুসলিম বিরোধী এজেন্ডা বলে আখ্যা দিয়েছে। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন বলেন, ‘...এই আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা উচিত। এটা খুবই বড় বিষয়। ...ফলে এমন আইন সংবিধানকেই অপমান করে’। কিন্তু এতো কিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আইনটি বাস্তবায়িত হচ্ছে; মুসলিমদের উপর নেমে আসছে জ্বালা-যন্ত্রণা।
৮ম শতাব্দীর প্রথম ভাগে ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মাদ বিন কাসেমের নেতৃত্বে আরব মুসলিমরা বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশ জয় করেন। সিন্ধু উমাইয়া খিলাফতের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশে পরিণত হয়। ১০ম শতাব্দীর প্রথম ভাগে গযনীর সুলতান মাহমূদ পাঞ্জাবকে গযনী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। সুলতান মাহমূদ বর্তমান ভারত ভূখণ্ডের বিভিন্ন স্থানে ১৭ বার অভিযান চালান। তবে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আরও সফলভাবে ভারতে অভিযান চালান মুহাম্মাদ ঘূরী। তার অভিযানের ফলে ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিন্দুরাজা পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করে ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয়। এখানে মুসলিম শাসন প্রায় ৭০০ বছর স্থায়ী হয়। মুসলিমরা তাদের সময়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আমেরিকার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক শেলডন পোলকের মতে, ‘মুসলিম শাসকরা জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করলে বর্তমান ভারতে একজনও হিন্দু থাকত না’। বর্তমান মুসলিমদের বিভিন্ন স্থাপনা, ঐতিহাসিক নিদর্শন, মুসলিম নাম, সংস্কৃতি আজও সেই দীর্ঘদিনের গৌরবোজ্জ্বল শাসন ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও সেখানে বিজেপি সরকারের রক্তচক্ষু পড়েছে; কিছু কিছু ঐতিহ্যের নাম-নিশানা মুছে ফেলার অপপ্রয়াস চলছে।
আজ ঘুমন্ত মুসলিমকে ওরাই জাগিয়ে তুলছে। ওরা আবারও মুসলিমদের হাতে ভারতবর্ষের পতাকা পতপত করে উড়ানোর পথ তৈরি করে দিচ্ছে। অত্যাচার যতই বাড়বে, মুহাম্মাদ বিন কাসেমের আগমন ঘণ্টা ততই বেজে উঠবে। মহান আল্লাহ ভারতের মাটিতে পুনরায় ইসলামের পতাকা উড্ডীন করে একটি শান্তি ও নিরাপত্তার ঈমানী সমাজ উপহার দিন। আমীন!