কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

সুন্নীদের দামেশক বিজয়: জেরুযালেমে বিজয়ে এক ধাপ এগিয়ে মুসলিম উম্মাহ

post title will place here

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ


আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর পূর্বে সিরিয়াতে আরব বসন্তের ঢেউ লাগে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আসাদ পরিবারের শাসনের বিরুদ্ধে সিরিয়ার মানুষ ফুঁসে উঠে। মিসর ও তিউনিসিয়ার মতো এখানে বিনা রক্তপাতে ফল নির্ধারণের মতো কিছুই ঘটেনি। লিবিয়ার মতো এখানকার বিদ্রোহ সশস্ত্র যুদ্ধে রূপান্তরিত হলেও সফলতা আসতে সময় হয়েছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। এক দশকের বেশি সময় যাবৎ চলমান গৃহযুদ্ধের পর গত ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং তারিখে বাশার আল-আসাদ দামেশক থেকে পালিয়ে গিয়ে রাশিয়াতে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৯৭১ থেকে ২০২৪ দীর্ঘ ৫৩ বছর যাবৎ সিরিয়া শাসন করে আসাদ পরিবার। তাদের এই দীর্ঘ শাসনে অন্যতম সহযোগী ছিল ইরান, রাশিয়া ও হিযবুল্লাহ। যারা অত্যধিক ইরানপ্রীতি দেখান, তারা গত ৫০ বছর হিযবুল্লাহ ও ইরান মিলে সিরিয়ার সুন্নী মুসলিমদের উপর কী পরিমাণ অত্যাচার করেছে তা অবশ্যই একবার পড়ে দেখবেন। আজকে আসাদের পতনে ইরান ও ইসরাঈল সমপরিমাণ ব্যথিত। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে আসাদের পতনের পর ৫০০-এর অধিক স্থাপনায় ইসরাঈল বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরাঈলের দাবি অনুযায়ী এই সমস্ত স্থানে অস্ত্রাগার ও গবেষণাগার ছিল। আসাদের হাতে এই অস্ত্রগুলো ইসরাঈলের জন্য নিরাপদ মনে হলেও মুজাহিদদের হাতে নিরাপদ মনে হচ্ছে না। বিজয়ী মুজাহিদগণ যেন শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে ব্যর্থ হন তার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে যাচ্ছে ইসরাঈল। সুতরাং সিরিয়াতে ইয়াহূদী ইসরাঈল ও শীআ ইরানের স্বার্থ একই। শুধু তাই নয়, হিযবুল্লার সহযোগিতায় আসাদের কারাগারে বহু কাসসাম ব্রিগেডের নেতা, বহু ফিলিস্তীনি মুজাহিদ বন্দি ছিল।
যাহোক, হাফিয আল-আসাদ ও বাশার আল-আসাদ পরিবারের এই দীর্ঘ শাসনের অবসান হয় এইচ.টি.এস বা হাইয়াত তাহরীর আশ-শাম-এর হাতে, যার নেতা আবূ মুহাম্মাদ আল-জোলানী। যিনি মূলত ১৯৮২ সালে সঊদী আরবের রিয়াদে জন্মগ্রহণ করা একজন সালাফী আক্বীদার অনুসারী ব্যক্তি। তার বাবা সঊদী আরবের তেল কোম্পানি আরামকোতে চাকরি করতেন। জোলান বা গোলান নামটি মূলত সিরিয়ার গোলান উপত্যকার দিকে নিসবাত করে বলা হয়ে থাকে। জোলানীর পরিবারের আদিভিটা গোলান উপত্যকায় ছিল। ইসরাঈল গোলান উপত্যকা দখলে নিলে তার পরিবার উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়।
যৌবনের শুরুতেই ২০০৩ সালে ইরাক-আমেরিকা যুদ্ধে আমেরিকার বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য বাগদাদ চলে যান। এমনকি সেই যুদ্ধে আমেরিকার হাতে ২০০৬ সালে গ্রেফতার হয়ে আবু গারীব ও ক্যাম্প বুযাসহ বিভিন্ন কারাগারে পাঁচ বছর বন্দী জীবনযাপন করেন। অতঃপর মুক্তি পেয়ে নিজ দেশে ফেরত আসেন এবং আসাদ-বিরোধী আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। আসাদ-বিরোধী আন্দোলন সশস্ত্র রূপ নিলে আল-কায়েদার সহযোগিতায় নুসরাহ ফ্রন্ট গড়ে তোলেন। শুরুতে কিছুদিন আইসিস বা দায়িশের সিরিয়া শাখা হিসেবে নুসরাহ পরিচালিত হতো। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে তিনি দায়িশ বা আইসিসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করত সরাসরি আল-কায়েদার নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির আনুগত্যে নুসরাহ পরিচালিত করেন। তারও কিছুদিন পরে ২০১৬ সালে তিনি আল-কায়েদার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নুসরাহ নাম পরিবর্তন করে জাবহাত ফাতহ আশ-শাম নামকরণ করেন।
ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে জাতীয়তাবাদী চেতনার একজন নেতা হিসেবে তুলে ধরতে থাকেন। ২০১৭ সালে আসাদ-বিরোধী অন্য সকল গ্রুপকে একত্রিত করে এইচ.টি.এস গড়ে তোলেন। গত ৪/৫ বছর যাবৎ তুরস্ক সীমান্তবর্তী ইদলিব অঞ্চলে তারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিল এবং শক্তি সঞ্চার করছিল। জোলানীর শাসনে ইদলিব অঞ্চল অতি দ্রুত উন্নতি লাভ করে। সেখানে উন্নতমানের মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও শপিংমল গড়ে উঠে। শান্তি-শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। যেখানে রাজধানী দামেশকে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না, সেখানে ইদলিবে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়। জোলানীর পক্ষ থেকে যে মুহাম্মাদ আল-বশির ইদলিবের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতেন তিনিই এখন সিরিয়ার অন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করছেন।
যাহোক, জোলানী যখন দেখলেন রাশিয়া ইউক্রেনে ব্যস্ত আর ইরান ও হিযবুল্লাহ লেবাননে ব্যস্ত; অন্যদিকে আমেরিকা ইসরাঈলে ও ইউক্রেনে ব্যস্ত, তখন তারা এটিকে তাদের জন্য মোক্ষম সুযোগ মনে করে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে তাদের অভিযান শুরু করে। সর্বপ্রথম তারা হালব বা আলেপ্পো নগরী বিজয় করে। অতঃপর হুমা ও হিমস হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে টানা ১১ দিনের অভিযানে অপ্রতিরোধ্য গতিতে দামেশক বিজয় করে। যদিও এখনো সিরিয়ার বিরাট একটি অংশ কুর্দি ওয়াইপিজি বা পিকেকের দখলে রয়েছে। বিজয়ী মুজাহিদগণ তাদের সাথে সমঝোতায় যাবে না তাদের সাথে যুদ্ধ করবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। সিরিয়ার বেশির ভাগ তেল খনি কুর্দিদের দখলে আর কুর্দিদের সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা ও ইসরাঈল। সুতরাং সিরিয়াকে একীভূত করা মুজাহিদদের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
যাহোক, এই বিজয় সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে আনন্দিত করে। বিশেষ করে লক্ষ লক্ষ সিরীয় শরণার্থী যারা আসাদের যুলুমে নিজ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তারা আজ দেশে ফেরার আনন্দে আত্মহারা। অসংখ্য বন্দী যারা বিভিন্ন কারাগারে বন্দী ছিলেন তারাও মুক্তির নিঃশ্বাস গ্রহণ করছেন। সিদনাইয়ার মতো ভয়ংকর পাতাল আয়নাঘর ভেঙে বের করা হচ্ছে কালের সাক্ষীদের। অসংখ্য মা ও বোন পিতৃপরিচয়হীন সন্তান নিয়ে কারাগার থেকে বের হচ্ছেন, যা সমগ্র পৃথিবীকে আসাদের লোমহর্ষক অত্যাচারের নির্মম দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছে।
সিরিয়ার এই বিজয় মুসলিম উম্মাহকে জেরুযালেম বিজয়ের আশ্বাস দিচ্ছে। সিরিয়া-সংক্রান্ত রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসংখ্য ভবিষ্যদ্বাণী নতুন করে আমাদের অনেক কিছু শিখাচ্ছে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সিরিয়ার জন্য বরকতের দু‘আ করেছেন। তিনি বলেন,اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي شَأْمِنَا اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي يَمَنِنَا ‘হে আল্লাহ! আমাদের সিরিয়ায় বরকত দাও। হে আল্লাহ! আমাদের ইয়ামানে বরকত দাও। এই দু‘আ তিনি তিনবার করেন (বুখারী, হা/৭০৯৪; মিশকাত হা/৬২৬২)। অন্যত্র রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, طُوبَى لِلشَّامِ قِيلَ وَلِمَ ذَلِكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ إِنَّ مَلَائِكَةَ الرَّحْمَنِ بَاسِطَةٌ أَجْنِحَتَهَا عَلَيْهَا ‘সিরিয়ার জন্য সুসংবাদ! জিজ্ঞেস করা হলো, কেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম? তিনি বলেন, কেননা আল্লাহর ফেরেশতাগণ এর উপর তাদের পাখা বিছিয়ে রাখে’ (আহমাদ, হা/২১৬৪৭; তিরমিযী, হা/৩৯৫৪; মিশকাত হা/৬২৬৪)। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,سَيَصِيرُ الْأَمْرُ إِلَى أَنْ تَكُونُوا جُنُودًا مُجَنَّدَةً جُنْدٌ بِالشَّامِ وَجُنْدٌ بِالْيَمَنِ وَجُنْدٌ بِالْعِرَاقِ قَالَ ابْنُ حَوَالَةَ خِرْ لِي يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنْ أَدْرَكْتُ ذَلِكَ فَقَالَ عَلَيْكَ بِالشَّامِ فَإِنَّهَا خِيرَةُ اللَّهِ مِنْ أَرْضِهِ يَجْتَبِي إِلَيْهَا خِيرَتَهُ مِنْ عِبَادِهِ فَأَمَّا إِنْ أَبَيْتُمْ فَعَلَيْكُمْ بِيَمَنِكُمْ وَاسْقُوا مِنْ غُدُرِكُمْ فَإِنَّ اللَّهَ تَوَكَّلَ لِي بِالشَّامِ وَأَهْلِهِ ‘পরিস্থিতি তার কাজের ধারা অনুযায়ী চলতে থাকবে, যতক্ষণ তোমরা তিনটি বাহিনীতে পরিণত না হও— একটি বাহিনী শামের, আরেকটি বাহিনী ইয়ামানের এবং অপরটি ইরাকের। ইবনে হাওয়ালাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! যদি আমি সেই দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকি তবে আমার জন্য একটি নির্ধারণ করে দিন। উত্তরে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমার শামে যাওয়া উচিত হবে। কারণ এটি আল্লাহর ভূমিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম এবং তাঁর সবচেয়ে ভালো বান্দারাই সেখানে জড়ো হবে। আর যদি তুমি তা না চাও তবে তোমার ইয়ামান যাওয়া উচিত এবং সেখানকার কূপ থেকে পানি পান করা উচিত। কারণ আল্লাহ আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি শাম এবং তার মানুষের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন’ (আবূ দাঊদ হা/২৪৮৩, মিশকাত হা/৬২৬৭)। তিনি আরও বলেন,إِنَّ فُسْطَاطَ الْمُسْلِمِينَ يَوْمَ الْمَلْحَمَةِ بِالْغُوطَةِ إِلَى جَانِبِ مَدِينَةٍ يُقَالُ لَهَا دِمَشْقُ مِنْ خَيْرِ مَدَائِنِ الشَّامِ ‘কুফফার-মুশরিকদের সাথে মহাযুদ্ধের দিন (ক্বিয়ামতের পূর্বের কোনো যুদ্ধ বা দাজ্জালের সাথে যে যুদ্ধ হবে) মুসলিমদের তাঁবু (ফিল্ড হেডকোয়ার্টার) ‘গুতা’ নামক স্থানে হবে, যা একটি শহরের পাশে অবস্থিত; যার নাম দিমাশক যা শাম বা সিরিয়ার শ্রেষ্ঠ নগরী’ (আবূ দাঊদ, হা/৪২৯৮; মিশকাত হা/৬২৭২)। উল্লেখ্য যে, ‘গুতা’ নামক জায়গাটা বর্তমানে সিরিয়ার রাজধানী দামেশক থেকে ৮ কি. মি. পূর্বে অবস্থিত। এখানকার মওসুম শুষ্ক ও গরম (মুহাম্মাদ আসেম উমার, তিসরী জঙ্গে আযীম আওর দাজ্জাল, (ফরিদ বুক ডিপো, দিল্লী), পৃ. ৬৯)।
উল্লিখিত হাদীছগুলো প্রমাণ করে শাম বা সিরিয়া একটি বরকতময় জায়গা। ক্বিয়ামতের পূর্বমূহুর্তের সকল ঘটনা শাম-কেন্দ্রিক ঘটবে। এই শামের রাজধানী দামেশকের কোনো এক মসজিদে ঈসা আলাইহিস সালাম আসমান থেকে অবতরণ করবেন। এখান থেকেই দাজ্জালকে হত্যা করার জন্য তিনি বের হবেন। এই জন্যই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন সমগ্র পৃথিবীতে ফেতনা ছড়িয়ে পড়বে তখন ঈমান শামে থাকবে (মুসনাদে আহমাদ, ৩৬/৬২)। তিনি আরও বলেন, যখন শামে ফেতনা ছড়িয়ে পড়বে তখন আর তোমাদের মধ্যে কোনো কল্যাণ থাকবে না। আর ক্বিয়ামত পর্যন্ত শামে একটি দল থাকবে যারা আল্লাহর রাস্তায় লড়াইরত থাকবে। কেউ তাদের ক্ষতি করতে চাইলেও ক্ষতি করতে পারবে না (তিরমিযী, হা/২১৯২)।
আমরা দু‘আ করি এবং আশা করি এই বিজয়ের মাধ্যমে মহান আল্লাহ জেরুযালেম বিজয়ের রাস্তাকে আমাদের জন্য সহজ করে দিবেন। অচিরেই ইসলামের পতাকা দিমাশক থেকে গিয়ে জেরুযালেমে স্থাপিত হবে ইনশা-আল্লাহ। (প্র. স.)

Magazine