اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
মসজিদ আল্লাহর ঘর (আল-জিন, ৭২/১৮) এবং তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও পছন্দনীয় স্থান (মুসলিম, হা/৬৭১)। সেকারণে তা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সকল নেককার মুমিনের নিকটও সর্বাধিক প্রিয় স্থান। ইসলামের সূচনা থেকেই মসজিদ শুধু ছালাত আদায়ের স্থান ছিল না, বরং এখানে সম্পাদিত হতো নানা ধরনের কর্মসূচী। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে বিভিন্ন বৈঠকের আয়োজন করতেন, প্রতিনিধি দলকে সংবর্ধনা জানাতেন। এখানেই চলত দারস-তাদরীসের কাজ। এখান থেকেই পরিচালিত হতো দাওয়াতী কার্যক্রম। বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিধি দল ও সৈন্যবাহিনী প্রেরণের কাজও হতো এখান থেকেই। এককথায় ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুই সম্পাদিত হতো মসজিদ থেকেই। সেজন্যই তো মদীনায় হিজরতের পর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন, এমনকি নিজ বাসগৃহ নির্মাণের আগেই। এরই ধারাবাহিকতায় যুগ যুগ ধরে মসজিদভিত্তিক নানা কর্মসূচীর মধ্যে বিভিন্নমুখী জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা হয়ে আসছিল, যা বহু দেশে এখনও বলবৎ থাকলেও আমাদের দেশে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কুরআন, হাদীছ, তাফসীর, ফিক্বহ, ফারায়েয, উছূলে ফিক্বহ, নাহু, ছরফ, বালাগাত, সাহিত্য ইত্যাদি মসজিদেই চর্চা হতো। সাথে সর্বোপরি শিষ্টাচার তো শিক্ষা দেওয়া হতোই। মসজিদভিত্তিক পড়ালেখা করেই বড় বড় আলেম-উলামা বের হতেন। বুঝা গেল, সমাজ সংস্কার ও আদর্শ প্রজন্ম গঠনে মসজিদের ভূমিকা অপরিসীম।
এদিকে এখন চলছে ওয়ায মাহফিলের মৌসুম। পুরো শীতকালজুড়েই দেশের গ্রাম-গঞ্জ-শহর সর্বত্র বিভিন্ন নামে আয়োজিত হয় এসব ওয়ায মাহফিল। জনগণের সার্বিক জীবনে এগুলোর প্রভাব অনেক। নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষায় এসব ইসলামী প্রোগ্রাম ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিন্তু বার্ষিক প্রোগ্রামের পেছনে যত খরচ ও শ্রম ব্যয় হয়, তার তুলনায় প্রভাব অনেক কম পড়ে। এর কারণ- (ক) হাতেগোনা কিছু মাহফিল ছাড়া বাকী সবগুলোতে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিখাদ আলোচনা হয় না। (খ) একদিনের ওয়ায জনগণ সারা বছরের জন্য ধরে রাখতে পারে না; ভুলে যায়। (গ) এসব মাহফিলে ২/৪টা বিষয়ে আলোচনা হয় আর ইসলামের অন্যান্য দিক অধরাই থেকে যায়। (ঘ) এখানে সাধারণত নিত্য প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে কথা হয় না এবং হাতেকলমে শেখানোর তেমন কোনো বন্দোবস্তও থাকে না। (ঙ) অনেক সময় ইন্তেযামিয়া কমিটির নিয়্যতে যেমন খুলূছিয়াত থাকে না, তেমনি কখনও কখনও বক্তা বা আলোচকের নিয়্যতেও গড়বড় লক্ষ্য করা যায়। (চ) বিপুল সংখ্যক শ্রোতা বক্তব্য উপভোগ করতে যায়, উপকার নিতে যায় না। এসব কারণে এসব প্রোগ্রামের পূর্ণ বরকত ও প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না।
সেকারণে এসব বার্ষিক মাহফিলের পাশাপাশি মসজিদভিত্তিক কর্মসূচী অবশ্যই হাতে নিতে হবে। আর সেজন্য যা যা করতে হবে- (১) প্রতিটি মসজিদে মক্তব চালু করতে হবে, যেখানে কুরআন মাজীদের পাশাপাশি হাতের লেখা, দু‘আ, আক্বীদা, আমল, শিষ্টাচার ইত্যাদি শেখা বাধ্যতামূলক থাকবে। সেজন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ইমাম যোগ্য হলে তাকে দিয়েও মক্তবের কাজগুলো করিয়ে নেওয়া যাবে। (২) যে যে লাইনেই লেখাপড়া করুক না কেন, প্রতিটি ছেলে-মেয়েকে মক্তবে পাঠানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। মেয়েদেরকে শিক্ষকের পরিবর্তে যোগ্য শিক্ষিকা দিয়ে পড়ানো বাঞ্ছনীয়। (৩) বড় ও বয়স্কদের দ্বীন শিক্ষার জন্য প্রতিটি মসজিদে যোগ্য ইমাম, খত্বীব ও দাঈ নিয়োগ দিতে হবে। যারা বিষয়ভিত্তিক তথ্যবহুল খুৎবা প্রদান করবেন। আক্বীদা ও আমল সম্পর্কিত বিভিন্ন বইয়ের উপর নিয়মিত দারস প্রদান করবেন। বিষয়ভিত্তিক সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক ওয়ায-নছীহত ও আলোচনার আয়োজন করবেন। মুছল্লীদের নিত্য প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল শেখাবেন এবং হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দিবেন। (৩) ইমাম ও খত্বীবগণের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে এ সেক্টরে যোগ্য মানুষগুলো আসেন এবং তারা এখানে পূর্ণ মনোযোগী হতে পারেন। একদিনের মাহফিলে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তার কিয়দংশ এ মহান লক্ষ্যে ব্যয় করলেই তা সম্ভব ইনশা-আল্লাহ। (৪) মসজিদে বা বাইরের ওয়ায মাহফিলে জনগণকে সালাফে ছালেহীনের বুঝনির্ভর কুরআন-হাদীছের বিশুদ্ধ জ্ঞান দিতে হবে; অন্য সবকিছু নিষিদ্ধ ও বর্জন করতে হবে। এসব বাস্তবায়ন করা গেলে প্রতিটি মসজিদ হয়ে উঠবে এক একটি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দেশের সর্বস্তরের জনগণ পাবে দ্বীনের আলো। গড়ে উঠবে একটি আদর্শ ও তাক্বওয়াবান প্রজন্ম, যারা বড় হয়ে ডাক্তার, প্রকৌশলী যা-ই হোক কেন আমানতদারিতার সাথে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করে যেতে পারবে। গড়ে উঠবে শান্তিময় পরিবার, সমাজ থেকে দূর হবে নানা অন্যায়-অনাচার।
মহান আল্লাহ তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!