اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
পেঁয়াজের যে এত ঝাঁঝ হতে পারে, তা বাংলাদেশের মানুষ কখনও ভাবেনি। পেঁয়াজ নিয়ে দেশে ঘটে গেলো তুলকালাম কা-; ২৪০/২৫০ টাকা পর্যন্ত পেঁয়াজের কেজি, ভাবা যায়?! শুধু পেঁয়াজ নয়, বরং সবকিছুর মূল্যই ঊর্ধ্বমুখী; বাংলাদেশে শুধু নয়, সারা দুনিয়ায়। আমাদের সাধারণ লেখক-গবেষকগণ বিভিন্ন মিডিয়ায় মূল্যস্ফীতির বৈষয়িক বহু কারণ বিশ্লেষণ করলেও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণটা প্রায়শঃ এড়িয়ে যান। মহান আল্লাহ সবকিছুর তাক্বদীর নির্ধারণ করে দিয়েছেন, রিযিক্ব বণ্টন করে দিয়েছেন। আল্লাহর সৃষ্টিজগতের কোনো কিছুই তার ইচ্ছা ছাড়া সঙ্ঘটিত হয় না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাসও তার ইচ্ছাতেই হয়। মানুষের কর্মফলের কারণেই আল্লাহ তা করে থাকেন। তবে, ইসলামী শরী‘আত নানা কূট-কৌশল অবলম্বন করে মূল্যবৃদ্ধির সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। হাটে-বাজারে বিভিন্ন জায়গায় দালালি করে মূল্যবৃদ্ধি থেকে ইসলাম সতর্ক করেছে (বুখারী, হা/২১৪২)। নীচে মন্দ আর উপরে ভালোটা সাজিয়ে মূল্যবৃদ্ধির বদাভ্যাসকে ইসলাম সমর্থন জানায়নি (মুসলিম, হা/১০২)। চড়া মূল্যের আশায় গরু-ছাগলের বাটে দুধ জমিয়ে বেশী দামে বিক্রি করাকে ইসলাম মেনে নেয়নি (বুখারী, হা/২১৪৮)। কোনো মালের মালিকের কাছ থেকে বাজারের বাইরে গিয়ে পণ্য কিনতে নিষেধ করা হয়েছে (ঐ, হা/২১৫০)। কারণ এতে মূল্যস্ফীতি ঘটে এবং সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতা ঠকে যায়। মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতারণামূলক দালালি করে শহরবাসীকে গ্রামবাসীর পক্ষে বিক্রয় করতে নিষেধ করা হয়েছে (বুখারী/২১৪০)। মিথ্যা কথা বলে বা মিথ্যা শপথ করে মালের দাম বাড়াতে ইসলাম নিষেধ করেছে (মুসলিম/১৬০৭)। বরং এটাকে বরকত ও লাভ বিনষ্টকারী হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে (বুখারী, হা/২০৮৭; মুসলিম, হা/১৬০৬)। দাম বাড়ানোর লক্ষ্যে মওজুদদারকে ইসলাম পাপী বলেছে (মুসলিম, হা/১৬০৫)। ব্যবসায় যে কোনো ধোঁকাবাজি, ফাঁকিবাজিকে ইসলাম বরদাশত করেনি (মুসলিম, হা/১৫১৩)। এককথায় মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যার যেভাবে হস্তক্ষেপ থাকবে, তারই ঠিকানা হবে জাহান্নাম (আহমাদ, হা/২০৩১৩, সনদ ‘জাইয়্যেদ’)। বৈধ কারণে স্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হলে কারো কিছু করার নেই। বরং কারো কারসাজি ছাড়া স্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে তাতে হস্তক্ষেপ করতেও ইসলাম নিষেধ করেছে (আবুদাঊদ/৩৪৫১, ‘ছহীহ’)। তবে, ব্যবসায়ীদের কূটকৌশল হলে যরূরী অবস্থায় সরকার দর বেঁধে দিতে পারে।
মূল্যস্ফীতির বহু কারণ আছে। এর অন্যতম কয়েকটি হচ্ছে: (ক) আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। এই পৃথিবী একটি পরীক্ষাগার ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বান্দাকে ভালো-মন্দ দিয়ে পরীক্ষা করে থাকেন (আল-আম্বিয়া, ২১/৩৫)। এর মাধ্যমে তিনি তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন, পাপ মোচন করেন। ধৈর্য্যশীলদের পরখ করতে চান। (খ) আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি। যাবতীয় বালা-মুছীবত মানুষের নিজ হাতের কামাই (আশ-শূরা, ৪২/৩০)। মানুষ যখন আল্লাহর দ্বীন থেকে সরে গিয়ে নানা পাপাচারে লিপ্ত হয়, ফরয-ওয়াজিবের তোয়াক্কা করে না, তখন আল্লাহ তাদের হুঁশ ফেরানোর জন্য বিভিন্ন শাস্তি দিয়ে থাকেন (আর-রূম, ৩০/৪১)। সেগুলোর মধ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিও একটি। (গ) দুনিয়া ও মালের প্রতি মানুষের অতিলোভ। এই লোভের কারণেই মাল কামাইয়ের বৈধ-অবৈধ সব পথই মানুষ অবলম্বন করে। এভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এই অর্থলিপ্সা মানুষকে ধ্বংস করে ছাড়ে (বুখারী/৩১৫৮)। (ঘ) কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজি। মূল্যবৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে তারা মওজুদদারি সহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য ইসলামে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। (ঙ) অশান্ত ও অস্থিতিশীল পরিবেশ-পরিস্থিতি। এমন পরিবেশে মূল্যস্ফীতি ঘটে। পক্ষান্তরে নিরাপদ জনপদে নেমে আসে অবারিত রিযিক্ব (আন-নাহল, ১৬/১১২)। (চ) যেসব পণ্য আমদানী করতে হয়, সেগুলোর আমদানী কমে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলেও স্বাভাবিকভাবে মূল্যস্ফীতি ঘটে।
এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয়: (১) আত্মসমালোচনা করে নিজেদের সংশোধন করতে হবে। (২) তওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। তার সাথে সম্পর্ক মযবূতম করতে হবে। (৩) ফরয-ওয়াজিব ঠিক মত আদায় করতে হবে। (৪) হারাম বিষয়সমূহ বর্জন করতে হবে। (৫) খরচে হিসেবী হতে হবে এবং অপচয় রোধ করতে হবে। (৬) অল্পে তুষ্ট থাকতে হবে। (৭) বিশেষ করে এ সময় দুঃস্থ, গরীবদের পাশে দাঁড়াতে হবে। (৮) নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে হবে, তাহলে আল্লাহ বাড়িয়ে দিবেন (ইবরাহীম, ১৪/৭)। (৯) আল্লাহর এই তাক্বদীরে ধৈর্য্যধারণ করতে হবে; বিরক্ত হওয়া যাবে না; বরং তার প্রতি সুধারণা রাখতে হবে। (১০) মূলস্ফীতিপরিস্থিতিকে মোক্বাবিলা করতে শিখতে হবে। কোনো কিছুর দাম বাড়লেই তা কিনে মওজূদ করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়া যাবে না। বরং তুলনামূলক কম কিনতে হবে। বিকল্প খুঁজতে হবে। অন্যথায় দাম আরো বাড়বে, কমবে না। (১১) মওজুদদারি বা অন্য কোনোভাবে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন বাজার অস্থিতিশীল না করতে পারে সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। (১২) দেশে বিশ্বস্ত, আমানতদার ও তাক্বওয়াবান ব্যবসায়ী কিভাবে তৈরি করা যায় তার যাবতীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। (১৩) কারো কারসাজিতে দাম বাড়লে যরূরী অবস্থায় সরকার মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। (১৪) দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের দমন ও বাজার তদারকি করতে সরকারকে বিশেষ টীম গঠন করতে হবে। (১৫) সরকারকে সারা বছরের নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির হিসাব কষে তা উৎপাদন ও আমদানীর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে। (১৬) সর্বোপরি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি থেকে রেহাই পাওয়া এবং বরকত বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!