কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কুরআনের আলোকে হাদীছের অপরিহার্যতা (পর্ব-৬)

post title will place here

(নভেম্বর’২৩ সংখ্যায় প্রকাশিতের পর)

শুধু শাব্দিক অর্থ দিয়ে কুরআন বুঝা অসম্ভব :

আধুনিক যুগের মুনকিরে হাদীছগণ হাদীছ দ্বারা কুরআন বুঝাকে অস্বীকার করে। নিজের মনমতো কুরআন বুঝতে চায়। তবে মজার বিষয় হচ্ছে নিজের মনমতো কুরআন বুঝতে গিয়েও তাদের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ তৈরি হয়েছে। তদের মধ্যে কেউ স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি দিয়ে কুরআন বুঝতে চায়, কেউ কুরআনের অন্যান্য আয়াতের সহযোগিতায় নিজের ইচ্ছামতো এক আয়াতকে আরেক আয়াতের সাথে মিলিয়ে কুরআন বুঝতে চায়, কেউ অভিধান দেখে শাব্দিক অর্থ অনুযায়ী কুরআন বুঝতে চায়, কেউ আবার বিজ্ঞান দিয়ে কুরআন বুঝতে চায়। ফলত, হাদীছ বাদ দিয়ে নিজের মনমতো কুরআন বুঝতে গিয়ে তারা আজ পর্যন্ত একমত হতে পারেনি এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত হতে পারবে না। নিম্নে তাদের মতভেদের কিছু নমুনা পেশ করা হলো—

(১) আব্দুল্লাহ চকড়ালবী কুরআন থেকে দলীল দিয়ে একের অধিক অতিরিক্ত বিবাহকে হারাম বলেছেন। তার দলীল হচ্ছে কুরআনের এই আয়াত, وَإِنْ أَرَدْتُمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَكَانَ زَوْجٍ ‘আর যদি তোমরা এক স্ত্রীর পরিবর্তে আরেক স্ত্রী গ্রহণ করতে চাও’ (আন-নিসা, ৪/২০)

এই আয়াতের শাব্দিক অনুবাদ গ্রহণ করে সে মনে করেছে এক স্ত্রীর সাথে আরেক স্ত্রী কখনোই গ্রহণ করা যায় না, বরং একজনের জায়গায় আরেকজনকে প্রতিস্থাপন করতে হয়। আর অতিরিক্ত বিবাহের কথা যেহেতু ইয়াতীম মেয়েদের বিবাহের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছে সেহেতু ইয়াতীম না হলে একের অধিক বিবাহ করা হারাম।[1]

(২) একদল মুনকিরে হাদীছ কুরআন থেকে নিজের মতো বুঝে সকল নবীকে মর্যাদাগতভাবে সমান দাবি করেছে।[2]

(৩) স্যার সৈয়দ আহমাদ কুরআন নিজের মতো বুঝে মু‘জিযা ও কবরের আযাবকে অস্বীকার করেছেন।

(৪) নিয়াজ ফতেহপুরী কুরআনে কোথাও পায়নি যে, কুরআন আল্লাহর বাণী। এজন্য সে কুরআনকে আল্লাহর বাণী মানে না।[3]

(৫) ড. গোলাম জিলানী বাররাক কুরআনকে নিজের মনমতো বুঝে বলেন, শুধু আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান থাকলেই জান্নাতে যাওয়া যাবে। রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনয়ন না করলেও হবে।[4]

(৬) হাফেয এনায়েতুল্লাহ আছারী বিনা পিতায় ঈসা আলাইহিস সালাম-এর সৃষ্টিকে অস্বীকার করেছেন।[5]

(৭) তিনি মি‘রাজও অস্বীকার করেছেন। তার মতে আক্বছা শব্দের শাব্দিক অর্থ দূরবর্তী মসজিদ অর্থাৎ মদীনা থেকে দূরের কোনো মসজিদ।

(৮) গোলাম আহমাদ পারভেজ বলেন, ঈসা আলাইহিস সালাম-এর পিতা ছিল। তার মা মারইয়াম বিবাহিত ছিলেন।[6] তার দাবি অনুযায়ী যাকে গীর্জার জন্য মানত করা হয় তার জন্য বিবাহ করা নিষিদ্ধ। মারইয়াম (আ.) সেই বিধান লঙ্ঘন করে বিবাহ করেছিলেন, তাই মানুষজন তার নিন্দা শুরু করেছিল। তিনি আরো দাবি করেন, মারইয়াম (আ.)-এর নিকট খাবার আসত মানে তাঁর নিকটে মানুষের হাদিয়া আসত।

(৯) হাদীছ অস্বীকারকারী সেই ব্যক্তির[7] নিকট ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি সবকিছুই শাব্দিক অর্থে প্রযোজ্য। তথা ছালাত মানে দু‘আ, ছিয়াম মানে বিরত থাকা, হজ্জ মানে নিয়্যত করা এবং যাকাত মানে বৃদ্ধি করা। হাদীছের সহযোগিতায় এই নামগুলোকে আমরা যে বিশেষ ইবাদতের জন্য পরিভাষিক অর্থে ব্যবহার করে থাকি, সে সেগুলো অস্বীকার করে থাকে।

হাদীছ ছাড়া শুধু শাব্দিক অর্থ দিয়ে কুরআন বুঝতে গেলে কী হতে পারে?

আমাদের কাছে হাদীছ না থাকলে ইসলামের ইতিহাসের কোনো তথ্যও থাকবে না। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনীর সকল তথ্য আমাদের মাথা থেকে মুছে ফেলে সম্পূর্ণ খালি মাথায় কুরআন বুঝতে গেলে এবং শাব্দিক অর্থ করতে গেলে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে তার কিছু উদাহরণ নিম্নে পেশ করা হলো—

(১) পবিত্র কুরআনের সূরা আল-ফাতিহায় ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীম’ এর পরিচয়ে বলা হয়েছে ‘আনআমতা আলাইহিম’ তথা যাদের উপর মহান আল্লাহ দয়া করেছেন তাদের পথ। আর কুরআনে এই আয়াতের পর সর্বপ্রথম যেখানে ‘আনআমা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেটা বানূ ইসরাঈলের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,يَابَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا نِعْمَتِيَ الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ ‘হে বানূ ইসরাঈল! তোমরা স্মরণ করো আমার দয়ার কথা, যে দয়া আমি তোমাদের উপর করেছিলাম’ (আল-বাক্বারা, ২/৪০)

তথা মহান আল্লাহ বানূ ইসরাঈলের উপর দয়া করেছেন। আমাদের নিকট যদি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে ব্যাখ্যামূলক কোনো হাদীছ না থাকে, তাহলে আমরা এই ব্যাখ্যা করতে বাধ্য হব যে, বানূ ইসরাঈল ছিরাতে মুস্তাক্বীমের উপর আছে তথা ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানরা সঠিক পথে আছে, কেননা তাদের উপর দয়া করার কথা মহান আল্লাহ বলেছেন।

(২) সূরা আল-বাক্বারার শুরুতেই মহান আল্লাহ বলেন,ذَلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ ‘এই কিতাবে কোনো সন্দেহ নাই’ (আল-বাক্বারা, ২/২)। আমরা যদি কিতাবের শাব্দিক অর্থ করি তাহলে অর্থ হবে, এই লিখিত বস্তুর মধ্যে কোনো সন্দেহ নাই। সেক্ষেত্রে কুরআন লিখিতভাবে দুনিয়াতে আসার কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নাই। তাহলে এখানে কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য কী? আমরা যদি দেখি পবিত্র কুরআনে কিতাব শব্দটি আর কোথায় কোথায় ব্যবহৃত হয়েছে তাহলে আমরা দেখব—

(ক) এই আয়াতের পর সর্বপ্রথম মহান আল্লাহ মূসা আলাইহিস সালাম-এর তাওরাতের জন্য কিতাব শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আল্লাহর বাণী, وَإِذْ آتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ ‘আর স্মরণ করুন সেসময়ের কথা, যখন আমরা মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম’ (আল-বাক্বারা, ২/৫৩)

(খ) মানুষের আমলনামার জন্য আল্লাহ কিতাব শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ ‘আর যার ডান হাতে কিতাব তথা আমলনামা দেওয়া হবে’ (আল-হাক্কাহ, ৬৯/১৯; আল-ইনশিক্বাক্ব, ৮৪/৭)

(গ) নির্ধারিত সময় বুঝানোর জন্য কিতাব শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا ‘নিশ্চয় ছালাত মুমিনদের উপর নির্ধারিত সময়ে ফরয করা হয়েছে’ (আন-নিসা, ৪/১০৩)

এখানে ফরয অর্থে কিতাব শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

(ঘ) লাওহে মাহফূযের কিতাবকেও কুরআনে কিতাব বলা হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ ‘আর জমিনের অন্ধকারে থাকা দানা, কোনো শুকনা ও সতেজ বস্তু সবকিছুই স্পষ্ট কিতাবে লিখিত রয়েছে’ (আল-আনআম, ৬/৫৯)

আর আমরা জানি পৃথিবীর সকল খুঁটিনাটি লাওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

তাহলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে প্রদত্ত ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে শুধু কুরআন দিয়ে যদি কুরআনকে বুঝতে যাই অথবা শুধু শাব্দিক অর্থ দিয়ে কুরআনকে বুঝতে যাই, তাহলে সামান্য কিতাব দ্বারা কী উদ্দেশ্য হবে তা বুঝা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

(৩) আমরা যদি হাদীছ সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে দিই এবং সম্পূর্ণ খালি মাথায় কুরআন পড়া শুরু করি, তাহলে কুরআন থেকে এতটুকু প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে, কুরআন মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। পবিত্র কুরআনে যে জায়গাগুলোতে ‘মুহাম্মাদ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সেখান থেকে এটা বুঝার কোনো উপায় নেই যে, ১৪০০ বছর পূর্বে জন্ম নেওয়া মরুভূমির কোনো নবীর কথা বলা হচ্ছে। কেননা ‘মুহাম্মাদ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ প্রশংসিত। আর যেকোনো ব্যক্তি প্রশংসিত হতে পারে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَآمَنُوا بِمَا نُزِّلَ عَلَى مُحَمَّدٍ ‘আর যারা ঈমান আনয়ন করে, সৎকাজ করে এবং মুহাম্মাদ (প্রশংসিত ব্যক্তি) এর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/২) (এই আয়াতের আমরা শাব্দিক অনুবাদ করেছি)।

‘মুহাম্মাদ’-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে প্রশংসিত। আর যদি শাব্দিক অনুবাদ না ধরে মুহাম্মাদকে নাম হিসেবেও ধরি তবুও প্রমাণিত হবে না যে, তিনি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব। কেননা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো পরিচয় পবিত্র কুরআনে তুলে ধরা হয়নি; না তাঁর নাম ও বংশ পরিচয় আর না তাঁর জন্মসাল ও জন্মস্থান, কিছুই বর্ণিত হয়নি। সুতরাং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিচয় জানার কোনো সুযোগ থাকবে না। সেক্ষেত্রে কুরআন কীভাবে কোথায় আসল, কীভাবে আমরা পেলাম তাও জানার কোনো সুযোগ থাকবে না।

(৪) মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ ‘নিশ্চয় আমরা যিকির অবতীর্ণ করেছি আর নিশ্চয়ই আমরা তার সংরক্ষণ করব’ (আল-হিজর, ১৫/৯)

মহান আল্লাহ কুরআনকে সংরক্ষণ করবেন এই দাবির প্রেক্ষিতেই আয়াতটি পেশ করা হয়। অথচ এই আয়াতের শাব্দিক অর্থ করলে ‘যিকির’ দ্বারা কুরআন বুঝানো খুব কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কেননা ‘যিকির’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে স্মরণ করা। আর পবিত্র কুরআনে তাওরাতের জন্যও যিকির শব্দ ব্যবহার হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِنْ بَعْدِ الذِّكْرِ ‘আর আমি যাবূরে লিখেছি যিকিরের পরে’ (আল-আম্বিয়া, ২১/১০৫)

এখানে ‘যিকির’ দ্বারা যদি কোনো বই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তাওরাতই হবে। কেননা তাওরাতের পরে যাবূর অবতীর্ণ হয়েছে।

সুতরাং মহান আল্লাহ তাওরাতের হেফাযতের ওয়াদা করলেন, না-কি অন্য কোনো কিছুর স্মরণকে হেফাযতের ওয়াদা করলেন, তা শুধু কুরআন থেকে নির্ধারিত করা অসম্ভব।

(৫) আদম, শয়তান, ইবলীস ইত্যাদি চরিত্রেরও অনেকে শাব্দিক অর্থ করেছে। ইবলীস অর্থ হতাশ হওয়া, শয়তান অর্থ বিতাড়িত আর আদম অর্থ সামাজিক। এইরকম কুরআনে ব্যবহৃত নামগুলোর শাব্দিক অর্থ করলে এবং বাস্তব চরিত্রের ব্যক্তিগুলো বাদ দিয়ে দিলে কুরআনের আর কিছুই বাকি থাকবে না।

(চলবে)

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক

ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,

সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।


[1]. মাসিক ইশাআতুল ‍কুরআন (মে, ১৯২২ সংখ্যা), পৃ. ১৮।

[2]. বিস্তারিত জানতে পড়ুন : প্রবন্ধটির লেখক কর্তৃক রচিত ‘মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল’ গ্রন্থ।

[3]. বেজদান, ১/৫৫২।

[4]. এক ইসলাম, পৃ. ৪৮।

[5]. উয়ূনে যমযম ফী বিলাদাতে ঈসা ইবনে মারইয়াম।

[6]. মাফহূমুল কুরআন, পৃ. ১২৯।

[7]. লেখকের সাথে যার ডিবেট হয়েছিল।

Magazine