রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন’।[1] ইসলাম সৌন্দর্য চর্চার অনুমোদন দেয়। তবে এর নির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা আছে, যেন তা পাপে পরিণত না হয়। নারী মাত্রই সৌন্দর্যের প্রতি দুর্বল। নিজেকে কীভাবে সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায় এ নিয়ে অনেকের মাঝে বেশ চঞ্চলতা দেখা যায়। ইসলাম নারীকে বৈধ সাজসজ্জা করতে বাধা দেয় না। বরং বিবাহিত নারীকে তার স্বামীর নিকট সুসজ্জিত ও পরিপাটি থাকার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করে। একজন মুসলিম নারীর যাবতীয় সাজসজ্জা ও শোভা-সৌন্দর্য হবে স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য। তাই শুরুতেই ভাবতে হবে সাজসজ্জা আপনি কার জন্য কিংবা কাকে দেখানোর জন্য করছেন। কারণ পবিত্র কুরআনুল কারীমে নারীদের সৌন্দর্য বাহিরে প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে আপন স্বামীর সামনে সাজসজ্জা কেবল বৈধই নয়, বরং করণীয়ও বটে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকাল মুসলিম নারী মহলে কৃত্রিম রূপচর্চা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পার্লার ব্যবসার নামে এই মহামারি শহরের অলিগলি পেরিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ধর্মীয় বিধিবিধানের প্রতি উদাসীন নারীরা পার্লার সংস্কৃতিকে হাল ফ্যাশনের প্রতীকরূপে জানে। অথচ এসব পার্লারগুলো রূপচর্চার আড়ালে শরীআত লঙ্ঘন করছে এবং অশ্লীলতার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। তাই এহেন পরিস্থিতিতে জানতে হবে নারীর জন্য কী ধরনের সাজসজ্জা বৈধ! এ ব্যাপারে ইসলামী শরীআতের মূলনীতি হলো—
প্রথমত, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সাজসজ্জা হারাম হওয়ার দলীল না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ তা বৈধ। আর হারাম হওয়ার দলীল পাওয়া গেলে অবৈধ। কারণ বস্তুর মূল হচ্ছে, ‘বৈধতা’। আল্লাহ তাআলা বলেন,قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ ‘আপনি বলুন, আল্লাহ নিজের বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তাকে হারাম করেছে? (আল-আ‘রাফ, ৭/৩২)।
দ্বিতীয়ত, কোনো নারী সাজসজ্জা করতে গিয়ে পুরুষের বেশ ধারণ করতে পারবে না। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত,لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الْمُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষদের এবং পুরুষের বেশ ধারণকারী মহিলাদেরকে অভিশাপ করেছেন’।[2]
তৃতীয়ত, সাজসজ্জা ও রূপচর্চায় কোনো অমুসলিম বা প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত কারো অনুকরণ করা যাবে না। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে’।[3]
চতুর্থত, সাজসজ্জার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর বস্তু বা প্রসাধনী ব্যবহার করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিজের ক্ষতি করা যাবে না এবং অন্যেরও ক্ষতিসাধন করা যাবে না’।[4]
রূপচর্চায় ইসলামের নির্দেশনা :
(১) ভ্রু প্লাক করা : সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন উপায়ে ভ্রু চিকন করার যে প্রথা বর্তমানে প্রচলিত আছে, তা বৈধ নয়; বরং হারাম। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, لَعَنَ الله الْوَاشِمَات وَالْمُسْتَوْشِمَات وَالنَّامِصَات وَالْمُتَنَمِّصَات وَالْمُتَفَلِّجَات لِلْحُسْنِ الْمُغَيِّرَات خَلْق الله ‘আল্লাহ অভিশাপ করেছেন সেসব নারীদের, যারা দেহাঙ্গে উল্কি উৎকীর্ণ করে এবং যারা করায়, যারা ভ্রু উঠিয়ে সরু (প্লাক) করে, যারা সৌন্দর্য বাড়াতে দাঁতের মাঝে ফাঁকা সৃষ্টি করে। এরা আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির মধ্যে বিকৃতি সাধনকারী’।[5]
(২) চেহারায় উল্কি (ট্যাটু) অঙ্কন করা : উপর্যুক্ত হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, শুধু চেহারা নয়; বরং দেহের যে কোনো অঙ্গে উল্কি অঙ্কন করা হারাম।
(৩) ফেক আইল্যাস বা কৃত্রিম পাপড়ি লাগানো : মুহূর্তেই চোখের আবেদন সহস্র গুণ বাড়িয়ে দেয় ফেক আইল্যাস। ইসলামী শরীআতে তা হারাম। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لَعَن اللهُ الْوَاصِلَةَ وَالْمَوْصُولَةَ ‘আল্লাহ তাআলা পরচুলা ব্যবহারকারিণী ও যে করায় উভয়কে লা‘নত করেছেন’।[6] কারণ এটা প্রতারণা। তাই মুসলিম বোনদের এ ধরনের মেকআপ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
(৪) দাঁত স্কেলিং করা : স্কেলিং হলো আঁকাবাঁকা দাঁত সোজা করার উদ্দেশ্যে ব্রেস পরানো। এটি কেবল ফ্যাশন কিংবা এতে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা হলে তা জায়েয নেই। পক্ষান্তরে কারো দাঁত অস্বাভাবিক বাঁকা বা অতিরিক্ত থাকলে তা সোজা করা কিংবা অন্য কোনো চিকিৎসার জন্য হলে বৈধ। হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘যারা অনর্থক দাঁতের মাঝে ফাঁকা তৈরি করে, হাদীছে তাদের ব্যাপারে লা‘নত এসেছে’।[7]
(৬) চোখে রঙিন পর্দা বা কন্ট্যাক্ট লেন্সের ব্যবহার : আজকাল কন্ট্যাক্ট লেন্স ফ্যাশনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। এটি চশমার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি সৌন্দর্যের জন্যও ব্যবহার করা হয়। কন্ট্যাক্ট লেন্সের ব্যবহার শুদ্ধ হতে পারে কয়েকটি শর্তে। যেমন- (১) এটি ব্যবহারে কোনো ক্ষতি প্রমাণিত হওয়া যাবে না। (২) এটি ব্যবহারের কারণে জীবজন্তুর চোখের মতো দেখা যাওয়া চলবে না। (৩) লেন্সটি যেন কারো জন্য ধোঁকার কারণ না হয়। (৪) এটি ব্যবহারে অপচয় হওয়া যাবে না। (৫) এটি যেন কারো ফেতনার কারণ না হয়।[8]
পোশাকের সাজসজ্জার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি :
পোশাক সাজসজ্জার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। নারী ও পুরুষ যেহেতু পৃথক সত্তা, তাই সৃষ্টিগতভাবে তাদের মাঝে বেশ পার্থক্য আছে। সেকারণে সবকিছুতেই তা বজায় রাখা চাই। সুতরাং নারীদের জন্য পুরুষদের মতো আঁটোসাঁটো পোশাক পরিধান করা এবং তাদের সদৃশ্য অবলম্বন করা নিষিদ্ধ।[9] পোশাকের উদ্দেশ্য হলো শরীর আবৃত করা, যা লজ্জাস্থান, সতর ও নারীদের সৌন্দর্যের স্থানগুলো ঢেকে রাখে। তাই কোনো নারীর আঁটোসাঁটো জামা, আঁটোসাঁটো বোরকা বা পাতলা পোশাক পরে বাইরে বের হওয়া জায়েয নেই।[10]
বর্তমান ফ্যাশনের যুগে নিউ মডেল বা আধুনিক জামাকাপড় পরা তখনই বৈধ হবে, যখন তা পর্দার কাজ করবে এবং তাতে কোনো কাফেরের অনুকরণ না হবে। আর নারীদের সালোয়ার বা পায়জামা টাখনুর নিচে থাকতে হবে।[11]
সাজসজ্জার ব্যাপারে লক্ষণীয় বিষয় : সাজসজ্জার ব্যাপারে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে— (ক) বিজাতি কিংবা প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত নারীদের অনুকরণ করার উদ্দেশ্যে হলে এসবের ব্যবহার জায়েয হবে না। (খ) মেকআপে ক্ষতিকর বস্তু বা প্রসাধনী ব্যবহার করা যাবে না। (গ) অতিরিক্ত রূপচর্চা করা যাবে না। কেননা অতিরিক্ত রূপচর্চা হয়তো ত্বকের ক্ষতি করে কিংবা অপচয়ের সীমায় পড়ে। (ঘ) যে সমস্ত প্রসাধনী হালাল বস্তু দ্বারা তৈরি, সেগুলোর ব্যবহার জায়েয।
সাজসজ্জার আরো কিছু সামগ্রী :
(১) নেইলপলিশ : নেইলপলিশ যদি পবিত্র বস্তু দ্বারা প্রস্তুত হয়, তাহলে ব্যবহার করা জায়েয। তবে নেইলপলিশ যদি চামড়ায় পানি প্রবেশে প্রতিবন্ধক হয়, তাহলে তা নখে থাকাবস্থায় ওযূ ও ফরয গোসল হবে না। নখ থেকে তুলে ওযূ ও ফরয গোসল করতে হবে। তবে পিরিয়ড অবস্থায় নেইলপলিশ ব্যবহার করলে করতে পারবে। বারবার ওযূর সুবিধার্থে পিরিয়ডের বাইরে পবিত্রাবস্থায় নেইলপলিশ ব্যবহার না করাই অধিকতর নিরাপদ।[12]
(২) সেন্ট, পারফিউম বা বডি স্প্রে : সাধারণত সেন্ট, পারফিউম বা বডি স্প্রে ব্যবহার জায়েয, যদি তাতে ইসলাম অসমর্থিত ও ক্ষতিকর কোনো উপাদান না থাকে। তবে নারীদের জন্য তা ব্যবহার করে বাহিরে গমন করা যায়েয নেই। হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,كُلُّ عَيْنٍ زَانِيَةٌ وَالمَرْأَةُ إِذَا اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ بِالمَجْلِسِ فَهِيَ كَذَا وَكَذَا يَعْنِي زَانِيَةً ‘প্রত্যেক চক্ষুই ব্যভিচারী। আর মহিলা যদি (কোনো প্রকার) সুগন্ধি ব্যবহার করে কোনো (পুরুষদের) মজলিসের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, তবে সে ব্যভিচারিণী’।[13] তাই বাড়ির বাইরে সুগন্ধি ব্যবহার হারাম। তবে মুসলিম নারীরা গৃহের অভ্যন্তরে সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারে।[14]
নারীর রূপলাবণ্য, শোভা-সৌন্দর্য ও কমনীয়তা নারীর কাম্য বিষয়। স্বামী ব্যতীত অন্য কোনো গায়রে মাহরামের জন্য অঙ্গসজ্জা করা ও তা প্রদর্শন করা জায়েয নয়। কালের পরিক্রমায় নারীদের মেকআপ ও প্রসাধনী সামগ্রীর বৈচিত্র্য বেড়েছে। তাই আধুনিক কালে নিজেকে যত সংযত রাখা যাবে, আখেরাতের পথ তত সুগম হবে। একজন নারী খুব সহজেই তার চিন্তা, রুচি, মননশীলতা, রুচিশীলতা ও নান্দনিকতা তার পরিবার থেকে ধীরে ধীরে জাতীয় জীবনে ছড়িয়ে দিতে পারে। আজকের নারীসমাজ যদি স্বর্ণযুগের মুসলিম মহিলাদের দিকে দৃষ্টিপাত করে, তবে দেখতে পাবে তারা সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা নয়, বরং তাক্বওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন। আল্লাহর নিকট রং, রূপ, আকৃতি, অর্থ-বিত্ত ইত্যাদির কোনো মূল্য নেই। তাঁর নিকট ওই ব্যক্তি সম্মানিত, যিনি তাক্বওয়ায় সবার চেয়ে অগ্রগামী (আল-হুজুরাত, ৪৯/১৩)। আল্লাহ সবাইকে তাঁর নির্দেশিত পথে চলার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
নাজমুল হাসান সাকিব
দাওরায়ে হাদীছ (মাস্টার্স), ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা; অধ্যয়নরত (ইফতা), আল-মারকাজুল ইসলামী, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/৯১।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৮৮৫।
[3]. আবূ দাঊদ, হা/৪০৩১, হাসান; মিশকাত, হা/৪৩৪৭।
[4]. দারাকুত্বনী, হা/৩০৭৯।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৮৮৬।
[6]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৯৮।
[7]. ফাতহুল বারী, ১০/৩৭২।
[8]. Islছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামm Q & ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, প্রশ্ন নং ৯২৬।
[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৪৬।
[10]. আল-মুফাছছাল ফী আহকামিল মারআ, ৩/৩৩০।
[11]. ফাতহুল বারী, ১০/২৫৯।
[12]. আপকে মাসায়েল, ৭/১৩৭।
[13]. তিরমিযী, হা/২৭৮৬, হাসান।
[14]. তুহফাতুল আহওয়াযী, ৮/৭১।