কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মনুষ্যত্ব

মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবনকাল হয় তার সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত চঞ্চলতা, স্বাধীনতা ও পবিত্র সরলতা নিয়ে। তার চঞ্চলতা থাকে চির মুক্ত। তার স্বাধীনতা থাকে হার না মানা। তার সরলতা থাকে উন্মুক্ত উদার। কিন্তু ব্যক্তি তার পরিবার ও সমাজের গণ্ডি এবং জাতি ও দেশের ভ্রান্ত গোঁড়ামি প্রভৃতি পথে চলার মাধ্যমে তার অবাধ গতি, নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে। এসব ধীরে ধীরে আমাদের জীবনীশক্তি, রক্ত, গোশত, মজ্জা, মনুষ্যত্ব, বিবেক সমস্ত কিছু জোঁকের মতো শোষণ করে। জীবনবৃক্ষের শাখায় যে ফুল ফোঁটে, তাই মনুষ্যত্ব। জাতি ও রাষ্ট্রকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছানোর জন্য মানুষের অন্তরে মূল্যবোধ তথা সৌন্দর্য, প্রেম, আনন্দ প্রভৃতি চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে।

মনুষ্যত্ব মানে মানুষের অস্তিত্ব। পশু ও মানুষের মাঝে পার্থক্যের প্রধান উপকরণ হলো মনুষ্যত্ব। মনুষত্বের তাগিদে ব্যক্তি স্বকীয় শক্তি, আত্মমর্যাদা ইত্যাদি সুকুমার বৃত্তি গুণাবলি লাভ করে থাকে। পবিত্র কুরআনের ভাষায় মানুষের মাঝে দুটি বিষয় কাজ করে— একটি বিবেক, অপরটি নাফস তথা অন্তর। তারই যোগসূত্রে আমাদের মধ্যে দুটি সত্তা রয়েছে— (১) জীবসত্তা ও (২) মানবসত্তা।

জীবসত্তার কাজ প্রাণরক্ষা করা। এখানে আমরা অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে ছুটাছুটি করি। কী করে জীবনধারণ করা যায়, কীভাবে সন্তানসন্ততির ভালো যত্ন নেওয়া যায়, সে চিন্তায় অস্থির হয়ে দৈন্যতায় দিনাতিপাত করছি। কিন্তু আল্লাহ কর্তৃক বান্দা ও প্রাণীর (পশু) মধ্যে পার্থক্যকরণে যে অস্তিত্ব সৃষ্টি করেছেন, তাই মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, মানবসত্তা আমাদের জীবনে প্রধান সোপান হলেই প্রাণিত্ব বন্ধনকে দূরে ফেলে দিতে পারি না। কেননা প্রাণিত্ব ব্যতীত মনুষ্যত্ব উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতো।

শিক্ষাই পারে একমাত্র মনুষ্যত্বকে ও প্রাণিত্বকে একই মালায় গাঁথতে। এখানে শিক্ষার দুটি আদর্শ আছে— একটি ক্ষুদ্র আর্দশ, অপরটি মহৎকর্ম। প্রথমটির মাধমে ব্যক্তি অর্থ ও সমৃদ্ধির মাধ্যমে সুখস্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে। আর দ্বিতীয়টি মানুষের সুপ্ত বৃত্তিগুলোর উন্মেষ বা উন্মুক্ত করে।

এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে, যেখানে আমরা অন্নচিন্তার বেড়ি থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি না, সেখানে মনুষ্যত্বকে গ্রহণ করা মঙ্গলগ্রহে যাত্রার মতো। উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে আমরা এ কথাই বলব, শিক্ষার মারফতে সর্বাগ্রে অন্ন-বস্ত্রের চিন্তার বেড়ি উন্মোচন এবং তারই যোগসূত্রে মানুষের মাঝে নৈতিকতা, মূল্যবোধ মনোবিকাশ জাগ্রত করা দরকার। তা না হলে ব্যক্তি পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির মতো উড়ার জন্য পাখা ঝাপটাবে, কিন্তু উড়তে পারবে না।

বর্তমানে আমরা মানব কল্যাণকে মনুষ্যত্ব ভেবে গুলিয়ে ফেলি। এক্ষেত্রে মানব কল্যাণের সঠিক মর্মার্থ অবগত হওয়া প্রয়োজন। আমরা এক মুষ্টি ভিক্ষা দেওয়াকে মানব কল্যাণ মনে করে থাকি। এতে মনুষ্যত্বকে হেয়-তুচ্ছ করা হয়। আর মানবমর্যাদা বা মানবসত্তাকে অবমাননাকর কার্যাবলি কখনোই মানব কল্যাণে ফলপ্রসূ হতে পারে না।

রিলিফ, রিহেবিলিটেশন, রেডক্রস ইত্যাদি সেবাধর্মী সংস্থাকে আমরা মানব কল্যাণে প্রধান উৎস হিসেবে গ্রহণ করি। এর ফলে আমরা ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ, পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ হাত গুটিয়ে ফেলেছি। অতএব, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে।

পরিশেষে আমাদের বিশ্বাস মুক্তবুদ্ধির সহায়তায় সুপরিকল্পিত পথে কল্যাণময় পৃথিবী রচনা সম্ভব। তবেই মানব কল্যাণ হয়ে যাবে মানব মর্যাদা, মনুষ্যত্বের সহায়ক।

আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।

Magazine