কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মুসলিম পরিবার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর (পর্ব-৮)

post title will place here

প্রশ্ন: তেলাওয়াতের সিজদা দেওয়ার সময় কি নারীরা ছালাতের মতোই পূর্ণ হিজাব পরিধান করবে?

উত্তর: এক্ষেত্রে তেলাওয়াতের সিজদার হুকুম ছালাতের মতোই কিনা সে বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যদি ছালাতের মতোই হয়, তাহলে (عورة) লজ্জাস্থান ঢাকা, কিবলামুখী হওয়া এবং পবিত্রতা শর্ত। পক্ষান্তরে এটাকে শুধু সিজদা হিসেবে গণ্য করলে, ছালাতের শর্তসমূহ তার উপর প্রযোজ্য হবে না। নারীদেরকে ছালাতের মতো পূর্ণ হিজাব পরতে হবে না, এমনকি ওযূ অবস্থায় থাকাও অপরিহার্য নয়। তবে প্রথম মতটিকে গ্রহণ করাই সবচেয়ে ভালো। অতএব নারী-পুরুষ সকলের উচিত, ওযূ অবস্থায় সিজদা করা এবং ছালাতে যতটুকু শরীর ঢাকা অপরিহার্য, ততটুকু ঢাকা।

প্রশ্ন: ছালাতরত অবস্থায় কোনো নারী যদি অন্য নারীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করে, তাহলে কি তার ছালাতের কোনো ক্ষতি হবে?

উত্তর: হ্যাঁ, তার ছালাত বাতিল হয়ে যাবে। কারণ, শারঈ বিধিবিধানের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের কোনো পার্থক্য নেই। তবে পার্থক্যের স্পষ্ট দলীল থাকলে সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু সুতরাহ অথবা জায়নামায অথবা সিজদার স্থানের বাইরে দিয়ে অতিক্রম করলে ছালাতের কোনো ক্ষতি হবে না।

প্রশ্ন: কিন্তু শাখ! এথেকে বেঁচে থাকা যদি কঠিন হয়, যেমন- দুই হারামে, তাহলে তার হুকুম কী?

উত্তর: হাদীছের হুকুম সব জায়গার জন্য প্রযোজ্য। কোনো স্থান এথেকে আলাদা নয়। কেউ সামনে দিয়ে গেলে বাধা দিবে। বাধা দিলে কেউ সামনে দিয়ে যাবে না। তবে সম্ভব না হলে কম ভিড়ের সময় নফল ছালাত আদায় করুন! অথবা যে স্থান ফাঁকা থাকে, সেখানে ছালাত পড়ুন! অথবা বাড়িতে গিয়ে নফল ছালাত পড়ুন! কারণ বাড়িতে নফল ছালাত আদায় করা মসজিদের থেকে উত্তম, চাই সেটি মসজিদে হারাম হোক অথবা মসজিদে নববী হোক অথবা অন্য কোনো মসজিদ হোক। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় থাকা অবস্থায় বলেছিলেন, ‘উত্তম ছালাত হচ্ছে বাড়িতে যে ছালাত আদায় করা হয়, তবে ফরয ব্যতীত’।[1] শুধু তাই নয়, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও বাড়িতে নফল ছালাত আদায় করতেন।

প্রশ্ন: বিয়ের রাতে মেয়েদের সাদা পোশাক পরার হুকুম কী, যদি জানা যায় যে, এতে কাফেরদের সাদৃশ্য হচ্ছে?

উত্তর: পুরুষদের মতো করে বানানো না হয়ে থাকলে মেয়েদের জন্য সাদা পোশাক পড়া জায়েয। আর কাফেরদের সাদৃশ্যের যে বিষয়টি বলা হচ্ছে, তা এখন নেই। কারণ প্রত্যেক মুসলিমদের ক্ষেত্রেই নারীদের বিবাহ হলে তারা সাদা পোশাক পরিধান করে। আর প্রত্যেকটি হুকুম তার কারণ থাকা বা না থাকার উপর আবর্তিত হয়। যেহেতু এখন সাদৃশ্য হচ্ছে না; বরং মুসলিম-কাফের সবাই সমানভাবে পরছে, তাই এটিকে নিষিদ্ধ বলা যাবে না। তবে কোনো জিনিস যদি প্রকৃত অর্থেই হারাম হয়ে থাকে, তাহলে সেটি সর্বাবস্থায় হারাম হবে।

প্রশ্ন: একজন নারীর স্বামী তাকে রামাযানের কিছু রাতে তার অতিথিদের জন্য খাবার তৈরি করতে বলে, কিন্তু যখন সে তা করে, তখন খুব ক্লান্তিবোধ করে এবং ঐ রাতে তারাবীর ছালাত পড়তে পারে না। রামাযানের অধিকাংশ রাতে এ অবস্থা চলতে থাকলে সে কি স্বামীর আনুগত্য করতে বাধ্য?

 উত্তর: স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে সদ্ভাবে বসবাস করা অপরিহার্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে সদ্ভাবে জীবনযাপন করো’ (আন-নিসা, ৪/১৯)। রামাযান মাসে এমন পরিস্থিতিতে একজন পুরুষের জন্য তার স্ত্রীকে ক্লান্তিদায়ক কাজে বাধ্য করা ন্যায়সঙ্গত নয়। তবে স্বামী যদি দৃঢ়ভাবে আদেশ করে, তবে নারীর জন্য স্বামীর আনুগত্য করা সঙ্গত বলে মনে করি। অতিরিক্ত ক্লান্তির কারণে যদি তারাবীর ছালাত আদায় করা তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যায়, তবে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তার নিয়্যত অনুযায়ী তার জন্য ছওয়াব লিপিবদ্ধ করে দিবেন। কারণ, সে ওযরবশত তারাবীর ছালাত পড়তে পারেনি। আর তা হচ্ছে, যথাযথ বিষয়ে স্বামীর আনুগত্য করা।

প্রশ্ন: সম্মানিত শাখ! আল্লাহ আপনাকে হেফাযত করুন! আপনি জানেন, বিবাহ হলো একজন পুরুষ এবং একজন নারীর মধ্যে সহজাত বাসনা পূরণের একটি নিরাপদ প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে চারিত্রিক নিষ্কলুষতা বজায় থাকে। যদি এটি না থাকে, তবে বিশ্বাসঘাতকতার দরুন জাতির ধ্বংস নেমে আসে। সম্মানিত শাখ! যারা বিয়ে করতে চান, তাদের প্রতি আপনার নছীহকী? বিয়ের রাতে স্বামী-স্ত্রীর করণীয় কী?

উত্তর: যারা বিয়ে করতে চান, তাদের প্রতি আমার নছীহত হলো, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে নারীদেরকে বিয়ে করার আদেশ করেছেন তাদের মধ্য থেকে একজনকে বিয়ে করা। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা এমন নারীকে বিয়ে করো, যে প্রেমময়ী এবং অধিক সন্তান প্রসবকারী’।[2] তিনি আরও বলেন, ‘চারটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে (সাধারণত) মেয়েদের বিয়ে করা হয়— তার সম্পদ, তার বংশীয় আভিজাত্য, তার সৌন্দর্য এবং তার দ্বীনদারিতার কারণে। সুতরাং তুমি দ্বীনদার নারীকে পেয়ে ভাগ্যবান হও’।[3] নারীরাও সচ্চরিত্রবান এবং দ্বীনদার ছেলেকে পছন্দ করবে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যদি এমন কেউ তোমাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে, যার দ্বীন ও চরিত্রে তুমি সন্তুষ্ট, তাহলে তার সাথে তোমাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দাও’।[4] তবে প্রস্তাব কবুলের পূর্বে তাড়াহুড়ো না করে অবশ্যই তার সম্পর্কে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে, যাতে পরবর্তীতে অনুশোচনা করতে না হয়।

বিয়ের রাতে যে বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখা উচিত, তা হলো, স্বামী তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়ার সময় উৎফুল্ল থাকবে, যাতে দ্রুত তার সাথে ঘনিষ্ট হতে পারে। কারণ, সেই মুহূর্তে তার মধ্যে প্রচণ্ড ভয়ভীতি কাজ করে। স্বামী তার কপালে হাত দিয়ে প্রসিদ্ধ দু‘আটি পাঠ করবে—

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَهَا وَخَيْرَ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَمِنْ شَرِّ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ.

‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এর মধ্যকার কল্যাণ এবং এর মাধ্যমে কল্যাণ চাই এবং তার মধ্যে নিহিত অকল্যাণ ও তার মাধ্যমে অকল্যাণ থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাই’। বরকতের দু‘আ করবে।[5]

স্বামী উচ্চৈঃস্বরে এটি পাঠ করবেন। তবে যদি স্ত্রী ভয় পায় বা বিরক্ত হয়, তবে তার কপালে হাত রেখে নীরবে এই দু‘আ করাই যথেষ্ট।

স্ত্রীর সাথে সহবাসের সময় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত দু‘আ পাঠ করবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কোনো লোক যখন তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে আর তখন (মিলনের পূর্বে) বলে,

بِسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِّبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا.

‘বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শায়তানা ওয়া জান্নিবিশ শায়তানা মা রাযাক্বতানা’। অর্থাৎ, ‘আল্লাহর নামে, হে আল্লাহ! আমাদেরকে শয়তান থেকে রক্ষা করুন এবং আপনি আমাদেরকে যা দিয়েছেন, তা থেকে শয়তানকে রক্ষা করুন’।

তাদেরকে যদি আল্লাহ তাআলা তাদের এই সহবাসে সন্তান দান করেন, তবে এ সন্তানের কোনোরকম ক্ষতিই শয়তান করতে পারে না।[6]

এটি সন্তান সৎ হওয়ার একটি মাধ্যম এবং দু‘আটি সহজও বটে। সেই সাথে আরো বুঝা এবং জেনে রাখা উচিত যে, যৌনমিলন হলে উভয়ের উপর গোসল করা ফরয হয়ে যায়, যদিও বীর্যপাত না ঘটে। অনেকে মনে করেন, বীর্যপাত না হলে গোসল ফরয হয় না। এটি একটি ভুল ধারণা; বরং সহবাস করলে গোসল ফরয হয়ে যায়, বীর্যপাত না হলেও। কেননা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কেউ যখন স্ত্রীর চার হাত-পায়ের মাঝে বসে তার সাথে সহবাসের চেষ্টা করে, তখন গোসল ফরয হয়ে যায়’।[7]

তার মানে, গোসল ফরয হয় দুটির যে-কোনো একটি ঘটলে। বীর্যপাত অথবা সহবাসের মাধ্যমে। চুম্বন, আলিঙ্গন, যৌন কামনার সাথে তাকানো, কথোপকথন বা অন্য যে-কোনো কারণেই বীর্যপাত ঘটলে গোসল ফরয হবে। আর যদি মিলন হয়, তাহলে বীর্যপাত না হলেও গোসল ফরয হবে। উল্লেখ্য, কিছু দম্পতি বিয়ের রাতে ফজরের ছালাতের প্রতি গুরুত্ব দেয় না। কেউ কেউ জামাআতে ছালাত পরিত্যাগ করে শেষ সময়ে একাকী ছালাত পড়ে। আবার কেউ কেউ সূর্যোদয়ের পর ছালাত পড়ে। এটি খুবই খারাপ ও বাজে অভ্যাস, যা আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা। কারণ, আল্লাহর আনুগত্যই তাঁর প্রতি প্রকৃত কৃতজ্ঞতা।

প্রশ্ন: মানুষের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে, স্বামী যদি ফজরের ছালাত জামাআতে আদায় করার জন্য মসজিদে যায়, তাহলে বুঝতে হবে, স্ত্রীর প্রতি তার তেমন আগ্রহ নেই। যদি স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ থাকত, তাহলে ঐদিন তার কাছ থেকে বের হতো না। সম্মানিত শাখ! আল্লাহ আপনাকে হেফাযত করুন! এ বিষয়ে আপনার অভিমত জানাবেন!

উত্তর: এটি ভ্রান্ত কথা; বরং সে যদি ফজরের ছালাত আদায় করে তাহলে বুঝতে হবে, তার স্ত্রীর প্রতি তার আগ্রহ আছে। আল্লাহ তাআলা তার জন্য বিবাহকে সহজ করে দিয়েছেন, এ নেয়ামতের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সে এটি করেছে। অতএব, স্বামীর উপর কর্তব্য হলো, জামাআতের সাথে ফজরের ছালাত আদায় করা। কোনো ওযর ছাড়া জামাআতে ছালাত ছাড়বে না।

প্রশ্ন: সম্মানিত শাখ! আল্লাহ আপনাকে হেফাযত করুন! কোনো কোনো আলেমের মতে, নববিবাহিতা স্ত্রীকে গ্রহণ করার জন্য অপেক্ষাকারী ব্যক্তির জামাআত ত্যাগ করা গ্রহণযোগ্য। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানাবেন!

উত্তর: আমি মনে করি, উলামায়ে কেরামের বক্তব্য সঠিক-ভুল উভয়টি হতে পারে। এজন্য আমাদের কর্তব্য হলো, কুরআন-সুন্নাহর দিকে ফিরে যাওয়া।

দ্বিতীয়ত, উলামায়ে কেরামের মধ্যে যারা এটি বলেছেন, তারা আসলে পূর্বের প্রচলিত নিয়মের উপর ভিত্তি করে এটি বলেছেন। সেটি হচ্ছে যে, স্বামী তার বাড়িতে নববিবাহিতা স্ত্রীকে গ্রহণ করার জন্য অপেক্ষা করে। স্বামী বাড়িতেই থাকে এবং স্ত্রীকে তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই ব্যক্তির জামাআত ত্যাগ করা গ্রহণযোগ্য। কারণ, সে যদি জামাআতে ছালাত আদায়ের জন্য যায়, তাহলে তার অন্তর এটির সাথে সম্পৃক্ত থাকবে, ছালাতে মনোযোগী হতে পারবে না। আর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘খাবারের উপস্থিতিতে ছালাত আদায় করা যায় না’।[8] ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা রাতের খাবার খাওয়া অবস্থায় ইমামের ক্বেরাআত শুনতে পেতেন, কিন্তু খাওয়া শেষ না করে তিনি ছালাতের জন্য যেতেন না। সুতরাং কোনো ব্যক্তির যদি এই অবস্থায় জামাআতে ছালাত ত্যাগ করা বৈধ হয়, তাহলে নববিবাহিতা স্ত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ ব্যক্তির জন্য জামাআত ত্যাগ করা অধিক যুক্তিযুক্ত। তবে বর্তমান যুগে নিয়ম পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে বর কনের নিকটে আসে। সুতরাং বিষয়টি যেহেতু তারই নিয়ন্ত্রণে, তাই এ অবস্থায় জামাআতে ছালাত ত্যাগ করা ঠিক হবে না।

প্রশ্ন: সম্মানিত শাখ! বাসররাতে অনেকেই নববিবাহিতা স্ত্রীর কাছে যাওয়ার পর তার সামনে দুই রাকআত ছালাত আদায় করে। স্ত্রীও স্বামীর সাথে ছালাত আদায় করে। এমনকি কেউ কেউ কোনো কথা না বলেই ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে ছালাত শুরু করে দেয়। প্রশ্ন হলো, এমন করা কি সুন্নাহ?

উত্তর: এ বিষয়ে কোনো কোনো ছাহাবী থেকে সাব্যস্ত হয়েছে, তারা স্ত্রীর কাছে প্রবেশ করেই ছালাত আদায় করেছেন। তবে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ বিষয়ে ছহীহ সূত্রে কোনো কিছু সাব্যস্ত হয়নি। অতএব, এটি করা বা না করায় কোনো সমস্যা নেই বলে আশা করা যায়।

প্রশ্ন: সম্মানিত শাখ! আপনি জানেন, নারীরা বুদ্ধি ও দ্বীনের ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ। এখানে একটি মাসআলাকোনো মেয়ে যদি একটি ছেলেকে পছন্দ করে, কিন্তু সে অসৎ হয়, আর ওই মেয়ের পিতা একজন সৎ ব্যক্তিকে তার মেয়ের জন্য পছন্দ করে, তাহলে এক্ষেত্রে ওই মেয়ের মতামত গ্রহণ করতে হবে, না-কি তার পিতা যে ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চায়, তাকে তার সাথে বিয়ে দিতে বাধ্য করা হবে?

উত্তর: মেয়ের পিতা যে ছেলেকে পছন্দ করেছে, তার সাথে বিয়ে দিতে বাধ্য করা জায়েয হবে না, যদিও সে ছেলেটি সৎ হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কুমারী মেয়েকে তার অনুমতি ছাড়া বিয়ে দেওয়া যাবে না এবং বিধবা নারীকে তার সম্মতি ছাড়া বিয়ে দেওয়া যাবে না’।[9] ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, ‘পিতা কুমারী কন্যার নিজের বিষয়ে তার সম্মতি নিবে’।[10] আবার যার দ্বীন ও চরিত্র সন্তোষজনক নয়, তার সাথেও বিয়ে দেওয়া জায়েয হবে না; বরং তার অভিভাবক (পিতা) তাকে বাধা দিবে এবং বলবে, যে ছেলেকে তুমি বিয়ে করতে চাচ্ছ, সে অসৎ হলে আমি তার সাথে তোমার বিয়ে দিব না।

প্রশ্ন হলো, ওই মেয়ে যদি এই ব্যক্তিকে বিয়ে করতে জেদ করে, তাহলে কী করা যাবে?

উত্তরে বলব, আমরা তার সাথে বিয়ে দিব না, আর এ কারণে আমাদের পাপও হবে না। তবে বিয়ে না দিলে যদি উভয়ের মধ্যে পাপ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে অন্য কোনো শারঈ বাধা না থাকলে বড় ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া যায়।

প্রশ্ন: সম্মানিত শাখ! কোনো কোনো পিতা তার মেয়ের বিয়ের মোহর সম্পূর্ণ নিয়ে নেয়। তার মেয়েকে সামান্য পরিমাণ ব্যতীত কিছুই দেয় না। এ বিয়েগুলোতে কখনো কখনো কল্পনাতীত মোহর নির্ধারণ করা হয়। যেমন: দেড় লক্ষ রিয়াল। এরপর বিয়ের বহু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর পিতা যদি বুঝতে পারে যে, এ মোহর তিনি তার মেয়ের কাছ থেকে জোরপূর্বক সম্মতি ছাড়াই নিয়েছেন, তাহলে তার করণীয় কী?

উত্তর: এ প্রশ্নে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে:

প্রথমত, পিতা হোক বা অন্য কেউ হোক কোনো অভিভাবকের জন্য মোহরের কিছু অংশ শর্ত করা জায়েয নেই। কারণ মোহর সম্পূর্ণই নারীর সম্পদ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা নারীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও’ (আন-নিসা, ৪/৪)। আমর ইবনে শুআইব থেকে বর্ণিত হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো নারীকে বিয়ের পূর্বে মোহরানা বা দান হিসেবে কিংবা অন্য কোনো প্রকারের পাত্রের পক্ষ হতে কিছু দেওয়া হলে তা ওই স্ত্রীলোকটির জন্যই। আর বিয়ের পরে যা কিছু দেওয়া হবে, সেটি তার যাকে তা দেওয়া হয়েছে’।[11] সঠিক মত অনুযায়ী, এক্ষেত্রে পিতা এবং অন্য কারো মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবে মেয়ে যখন মোহর গ্রহণ করবে এবং তার মালিকানা সাব্যস্ত হবে, তখন শুধু পিতার জন্য জায়েয আছে সেটি থেকে সামান্য অংশ গ্রহণ করার। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে ওই মেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আর পিতা ছাড়া অন্য অভিভাবকদের জন্য কোনো কিছুই গ্রহণ করা জায়েয নেই। তবে যদি ওই মেয়ে উদার হয়ে সন্তুষ্টচিত্তে কিছু দেয়, তাহলে সেটি হালাল।

দ্বিতীয়ত, কোনো কোনো সময় কল্পনাতীত মোহর নির্ধারণ করা হয়। এটি সুন্নাত পরিপন্থী। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এক ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে বললেন, আমি জনৈকা আনছারী মহিলাকে বিয়ে করেছি। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি কি দেখে নিয়েছিলে? কেননা আনছারদের চোখে ত্রুটি থাকে। লোকটি বললেন, আমি তাকে দেখে নিয়েছি। তিনি বললেন, কী পরিমাণ বিনিময়ে তুমি তাকে বিয়ে করেছ? লোকটি বললেন, চার উকিয়ার বিনিময়ে। তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, চার উকিয়ার বিনিময়ে? মনে হয় তোমরা পাহাড়ের পার্শ্বদেশ থেকে রৌপ্য খুঁড়ে এনে থাকো। আমাদের নিকট এমন কিছু নেই, যা তোমাকে দান করতে পারি। তবে আমি তোমাকে শীঘ্রই একটি যুদ্ধাভিযানে পাঠিয়ে দিচ্ছি, যার লব্ধ গনীমত থেকে তুমি একাংশ লাভ করতে পারবে। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর তিনি বানূ আবস-এর বিরুদ্ধে একটি অভিযান দল প্রেরণ করেন, যার সাথে তিনি ঐ লোকটিকে পাঠিয়ে দেন।[12] চার উকিয়া সমান ১৬০ দিরহাম, যা যাকাতের নিসাবের কিছু কম। অতিরিক্ত মোহর বিয়েতে বরকত কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। সবচেয়ে বরকতময় বিয়ে হচ্ছে, যা সহজে অল্প খরচে সম্পন্ন করা হয়।

আর যখনই বিবাহে অতিরিক্ত খরচ হয়, তখন স্বামী খুবই দুশ্চিন্তা এবং উৎকণ্ঠায় থাকে। বিশেষ করে সে যদি এ কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে যায়। যখনই তার স্ত্রীকে নিয়ে তার মন খুশি থাকে অতঃপর ওই কথা মনে হয়ে যায়, তখন তার সব খুশি দুশ্চিন্তায় এবং সুখ-শান্তি দুঃখ-কষ্টে রূপান্তরিত হয়।

অতঃপর তার স্ত্রীর সাথে যদি সামঞ্জস্য না হয়, তখন তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা সহজ থাকে না এবং তার সাথে খুবই কষ্ট ও যন্ত্রণায় জীবনযাপন করতে হয়। তার স্ত্রীর বিষয়টি থাকে ঝুলন্ত। না স্ত্রী, না তালাকপ্রাপ্তা। আর স্ত্রী যদি বিবাহ বাতিল করতে চায়, তাহলে সাধারণত মোহর ফেরত না দিলে স্বামী রাজি হবে না। আর মোহর বেশি হলে এটি নারী এবং তার পরিবারের জন্য খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।

এ কারণে আমি আমার মুসলিম ভাইদেরকে অনুরোধ করব, তারা যেন অতিরিক্ত মোহর নির্ধারণ এবং সেটি নিয়ে প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকেন, যাতে যুবকদের জন্য বিয়ে সহজ হয় এবং সমাজে ফেতনা কমে আসে।

প্রশ্ন: সম্মানিত শায়খ! কিছু বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ প্রয়োজন মনে করছি। যেমন- বিয়ের ওলীমায় দাওয়াতের জন্য যে কার্ড ছাপানো হয়, এগুলোর কোনোটির মূল্য ৭ রিয়াল পর্যন্ত হয়। এ বিষয়ে যদি সতর্ক করতেন, বিশেষ করে এর বিকল্প আমাদের কাছে রয়েছে। যেমন- কার্ডে ইলমী কথাবার্তা লিখে তার অপর পৃষ্ঠায় দাওয়াতপত্র লিখা অথবা কোনো ইসলামী ক্যাসেটের মোড়কে দাওয়াতপত্র লিখা অথবা রঙিন কাগজে কম্পিউটারে টাইপ করে দাওয়াতপত্র লিখা, যার জন্য খুব বেশি খরচ হবে না। এ বিষয়ে অপচয় রোধ করতে কোনোছীহত করবেন কি?

উত্তর: আমি আমার ভাইদেরকে এক্ষেত্রে অপচয় ত্যাগ করতে বলব। আমি মনে করি, শুধু দাওয়াত দেওয়ার জন্য এত পয়সা খরচ করা স্পষ্ট অপচয়। অথচ এ দাওয়াতে সে সাড়া দিতে পারে, আবার নাও দিতে পারে। একসময় এ দাওয়াতপত্র মাটিতে ছুঁড়েও ফেলবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কোনোভাবেই অপচয় করবে না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই’ (আল-ইসরা, ১৭/২৬-২৭)

আর কার্ডে দাওয়াতপত্র লিখে তার উল্টো পৃষ্ঠায় ইলমী ও উপকারী কথা লিখা এটি ভালো চিন্তা। তবে যেন সাধারণ কাগজে করা হয়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। আর দ্বিতীয় যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, ইসলামিক ক্যাসেটের মোড়কে দাওয়াতপত্র লিখা, এটিও ভালো। আমরাও এমনটি অনেক দাওয়াতে দেখেছি এবং এ বিষয়ে আমরা যথাসাধ্য সহযোগিতা করব। সুতরাং সবাই যদি এটি করে, তাহলে একই সাথে ওলীমার দাওয়াত ও দ্বীনের দাওয়াতও হবে। দুটো ভালো বিষয় একসাথে যুক্ত হলো। আর তৃতীয় যে প্রস্তাবটি অর্থাৎ রঙিন কাগজে দাওয়াতপত্র লিখা, এটিও ভালো। খরচ কম এবং উপকারীও বটে।

মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ছলেহ আল-উছায়মীন

-অনুবাদ : ড. আব্দুল্লাহিল কাফী মাদানী

(ইনশা-আল্লাহ চলবে)


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩১; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৮১।

[2]. আবূ দাঊদ, হা/২০৫০।

[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৬৬।

[4]. তিরমিযী, হা/১০৫৮।

[5]. আবূ দাঊদ, হা/২১৬০।

[6]. তিরমিযী, হা/১০৯২।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯১।

[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৬০।

[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৫১৩৬।

[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪২১।

[11]. আবূ দাঊদ, হা/২১২৯।

[12]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪২৪।

Magazine