কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

সভ্যতার চরম বিকাশের যুগেও নারীর যে অমর্যাদা ও অবমূল্যায়ন দেখা যাচ্ছে, তা আরবের আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগকেও ছাড়িয়ে যায়নি- একথা বলা যাবে না। শুধু এদেশেই নয়; পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই নারী জাতি এক অসহনীয় অমর্যাদাকর পরিস্থিতির শিকার। নির্যাতন, নারীপাচার, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের দাবি, বিভিন্ন ধরনের পারিবাকি নির্যাতন, মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার প্রভৃতি নিত্যদিনের ঘটনা আমাদের আতঙ্কিত করে। অপ্রাপ্তবয়স্কা কিশোরী, হাসপাতালের অসুস্থ রোগী এমনকি মৃত লাশ পর্যন্ত পাশবিকতার হিংস্র থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নারী কর্তৃক নারী নির্যাতনের ঘটনাও এ সমাজে কম ঘটে না।

বিগত যুগেও এমনভাবে বিভিন্ন অজুহাত ও কলাকৌশলে তাদেরকে নির্যাতিত হতে হয়েছে। সে যুগে সমাজিকভাবে এর প্রতিরোধের চেষ্টা একেবারে হয়নি একথা বলা যাবে না, তবে যতটুকু হয়েছিল তা সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। এক্ষেত্রে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে বিগত সভ্যতা কর্তৃক নারীকে প্রদত্ত মর্যাদার সাথে ইসলামের দেওয়া মর্যাদার পার্থক্য তুলে ধরতে চেষ্টা করা হবে।

১. গ্রীক সভ্যতায় নারীর অবস্থান : প্রাচীন নানা সভ্যতার মধ্যে গ্রীক সভ্যতা ছিল নামকরা সভ্যতা। জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও চিকিৎসাশাস্ত্রে তৎকালীন পৃথিবীর নেতৃত্ব তাদের হাতে ছিল। কিন্তু নারীর মর্যাদা সেখানে ছিল খুবই দুর্ভাগ্যজনক। গ্রীকদের ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে ‘নারীকে’ মানুষের দুঃখ-কষ্টের মূল উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই নোংরা আক্বীদা তাদের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ফলে কিছুসংখ্যক ব্যতীত অধিকাংশ গ্রীকদের নিকটে নারীর মর্যাদা ছিল না বললেই চলে। অধিকাংশের নিকট বিয়ে ছিল বোঝাস্বরূপ। নারীদের প্রতি সমাজের দায়িত্ববোধ ছিল না বললেই চলে। তৎকালীন সমাজে নারীর অবস্থা পতিতালয়ের নারীদের চাইতেও করুণ ছিল। অবক্ষয়ের যুগে গ্রীকরা আফ্রোদিত (APHRODITE) নামক প্রেম দেবীর পূজা শুরু করে। ফলে বেশ্যালয়গুলো উপাসনালয়ের ন্যায় উঁচু-নিচু সকল স্তরের নারীর কেন্দ্রে পরিণত হয়। এভাবে নারী সমাজের অবমাননার মধ্য দিয়ে গ্রীক সভ্যতার মৃত্যুঘণ্টা বেজে উঠে।

২. রোমক সভ্যতায় নারী : গ্রীকদের পরেই ইতিহাসে রোমান সভ্যতার স্থান। তাদের উন্নতির যুগে নারীর সতীত্ব ও সম্মানকে খুবই মর্যাদার চোখে দেখা হতো। সে সমাজে বৈবাহিক বন্ধন ও পর্দাপ্রথা চালু ছিল। বেশ্যাবৃত্তি চালু থাকলেও লোকেরা এটাকে খুবই ঘৃণা করত।

কিন্তু বৈষয়িক জীবনে তাদের উন্নয়ন চরম শিখরে উপনীত হলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। স্বাধীনতার নামে ঘরের নিরাপদ আশ্রয়স্থল থেকে নারীদের বের করে বাহিরে নিয়ে আসে। সমঅধিকারের ধুয়া তুলে পুরুষের পাশাপাশি তাদেরকে কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যায়। পারিবারিক জীবনে দাম্পত্যের বন্ধন শিথিল হতে থাকে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অবিশ্বাস আর সন্দেহের দানা বাধতে থাকে। বিবাহ বিচ্ছেদ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকে। একসময় বিবাহ সামাজিক চুক্তির ন্যায় হয়ে যায়, যা যেকোনো সময় ভঙ্গ করা যায়। নারীদের বৈবাহিক বন্ধন বাতিল করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অন্যত্রে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে সচরাচর দেখা যেত। পাদ্রী জুরুম (৩৪০-৪২০ খ্রি.) বিগত যুগের একজন নারীর কথা বলেন, যে ৩২ জন পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল এবং সে তার শেষ স্বামীর ২১তম স্ত্রী ছিল। এসব বিয়েকে সমাজপতিরা ‘ভদ্র যেনা’ বলে পরিচয় দিতেন। রোম সমাজের নৈতিকতা বিষয়ক উপদেষ্টা কাতো (CATO) বিষয়টি স্বীকার করেন এবং সমাজে অবাধে প্রচলিত বহুবিবাহ প্রথাকে ‘মন্দ কাজ নয়’ বলে মন্তব্য করেন। এভাবে অবাধ যৌনাচারের বিষাক্ত প্রভাবে রোমকদের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যায়, যা তাদের সভ্যতার দ্রুত পতনকে ত্বরান্বিত করে।

৩. ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের দৃষ্টিতে নারী : রোমকদের পতনের পর খ্রিষ্ট ধর্ম ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রসার লাভ করে। রোমানদের করুণ পতন তাদের উপর দারুণ প্রভাব ফেলে। সেজন্য তারা নারীসঙ্গ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের ঘোষণানুযায়ী, নারী হলো সকল পাপের উৎস এবং মানবজাতির জন্য অভিশাপ। তারতুলিয়ান, ক্রিসোসতাম প্রমুখ পাদ্রী নেতা নারীর সাথে যে কোন উপায়ে যৌনাচারে লিপ্ত হওয়াকে বিধিবদ্ধ ব্যাভিচার হিসাবে নিন্দনীয় মনে করলেও বিয়েকে হালাল বলে মনে করতেন। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে প্রচলিত বৈষম্যমূলক নারী বিদ্বেষী এই সামাজিক প্রথা সমগ্র খ্রিষ্টান জগতকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং নারীর প্রায় সকল অধিকার হরণ করে নেওয়া হয়। ১৮শ শতাব্দিতে ফরাসী বিপ্লব পর্যন্ত এই অবস্থা কম-বেশি চলমান থাকে। কিন্তু নারী বিদ্বেষমূলক এই চরম পন্থা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯ শতকের সূচনালগ্নে এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন হতে থাকে এবং নারী স্বাধীনতার নামে অশ্লীলতা ও যৌনাচারের পথকে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। যেখানে নারী-পুরুষের মেলামেশার অবারিত সুযোগ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমতা বিধান নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, উভয় নীতিই ছিল চরমপন্থা নির্ভর এবং মানব স্বভাব ও প্রকৃতি বিরোধী। ফলে পূর্বের লুপ্ত সভ্যতার ন্যায় অবাধ যৌনাচারের বিষবাষ্পে খ্রিষ্টীয় সভ্যতার ধ্বংসের পথ প্রশস্ত হতে থাকে। অশ্লীলতার পথে তাদের উৎসাহী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে। তাদের সমাজে গর্ভপাতকে আইনগতভাবে সিদ্ধ করা হয়েছে। কুমারীর মাতা হওয়াকে এখন তাদের সমাজে লজ্জা বা দোষের দৃষ্টিতে দেখা হয় না। নারীদের ‘কলগার্ল’ বা যৌনদাসী হওয়াকে সে দেশের সভ্যতার অংশ মনে করা হয়। তাদের সাহিত্য যৌন সুড়সুড়িমূলক আলোচনায় ভরপুর। নগ্নতা এখন তাদের সাংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বল্গাহীন নারী স্বাধীনতা প্রকারান্তরে নারীত্বের অমর্যাদার শামিল। তাই বলা চলে যে, বর্তমানের খ্রিষ্টীয় বা আধুনিক সভ্যতা রোমক ও গ্রীক সভ্যতার ন্যায় ক্রমশই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে।

৪. কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বেনারীর মর্যাদা : বর্তমান যুগে কমিউনিস্ট বিশ্বে যে সামাজিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তা মূলত ইরানের প্রাচীন ‘মাযদাকী’ মতবাদেরই প্রতিচ্ছবি মাত্র। বাদশা নওশেরওয়া এর পিতা কোবাদ এর আমলে ‘মাযদাক’ নামক জনৈক চিন্তাবিদ মত প্রকাশ করেন যে, মানব সমাজে সকল অশান্তির মূল কারণ হলো, নারী ও অর্থ-সম্পদ। অতএব, এই দুটিকে ব্যক্তিমালিকানা থেকে বের করে জাতীয় মালিকানায় থাকতে হবে। আগুন, পানি ও মাটিতে যেমন সকলের অধিকার আছে, নারী ও সম্পদেও তেমনি সকলের সমান অধিকার থাকবে। বর্তমান সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে সম্পদ জাতীয়করণ করা হয়েছে। নারীর অবস্থা সেখানে মাযদাকী আমলের চেয়ে খুব একটা পৃথক নয়। সেখানে বিবাহ প্রথা চালু থাকলেও, ঘুনে ধরা কাঠের মতোই তা ভঙ্গুর। ফলে নারী সমাজের মর্যাদা ক্রমশই ভোগ্যপণ্যের মতো অবস্থার দিকে যাচ্ছে।

৫. ইয়াহূদী, ব্যবিলনীয়, পারস্য ও হিন্দু সভ্যতায় নারী : ইয়াহূদীদের ধারণা মতে, মা ‘হাওয়া’ ছিলেন ‘মানবজাতির সকল দুঃখ-কষ্টের মূল’। এই ভুল ধারণাই ইয়াহূদী সমাজ জীবনের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। ফলে তাদের সমাজে নারীর মর্যাদা বলতে তেমন কিছুই ছিল না।

গ্রীক সভ্যতার চরম অবক্ষয়ের যুগে ব্যবিলনীয় ও পারসিক সভ্যতায় ব্যাপক অধঃপতন নেমে আসে। ব্যবিলনীয়দের মাঝে ব্যভিচার সাধারণ কর্মকাণ্ডের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পারসিকদের মধ্যে ‘মাযদাকি’ মতবাদের প্রসার ঘটে। একই সময়ে হিন্দুদের মধ্যে ‘বামমার্গী’ নামক চরম নোংরা ধর্মীয় মতবাদ চালু হয়। যেখানে নারীরা পরকালীন মুক্তির মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে বামমার্গী সাধুদের বাড়িতে ও মন্দিরে স্বেচ্ছায় এসে সাধুদের যৌনতৃপ্তি দিত। গ্রীকদের ন্যায় নারীরা হিন্দুদের নিকট ‘পাপাত্মা’ বলে কথিত ছিল। সেকারণে তাদেরকে সম্পত্তির অধিকার, বিধবা বিবাহের অধিকার ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত করা হয়। এমনকি বিধবা নারীকে মৃত স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করা হয়, যা ‘সতীদাহ’ প্রথা নামে পরিচিত। নারীদের জন্য শিক্ষা গ্রহণ ও ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করা নিষিদ্ধ করা হয়। গান্ধর্ব বিবাহ, রাক্ষস বিবাহ, শিবলিঙ্গ পূজা প্রভৃতির মাধ্যমে তারা নারীকে স্রেফ ভোগের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে, যা কম-বেশি আজও চালু আছে।

৬. প্রাক ইসলামী যুগে আরবদের নিকটে নারী : ইসলাম আসার প্রাককালে আরবীয় মহিলা সমাজে দুটি স্তর ছিল-

(ক) উচ্চ শ্রেণির নারী : কবিতা, বীরত্ব, চিকিৎসা, বক্তৃতা, প্রজ্ঞা ইত্যাদির দিক দিয়ে এরা ছিলেন সকলের নিকটে শ্রদ্ধার পাত্রী। মা খাদীজা এই স্তরেরই একজন স্বনামধন্যা বিদুষী নারী ছিলেন। (খ) সাধারণ স্তরের নারী : এই স্তরের নারীরা সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। বিলুপ্ত প্রাচীন সভ্যতায় নারীর যে অবস্থান ছিল, তার চেয়ে খারাপ কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও অধঃপতিত অবস্থায় ছিলেন এই শ্রেণির নারীরা। তাই কন্যা সন্তানের জন্ম বাবা-মা’য়ের নিকট খুবই কষ্টের কারণ ছিল। জন্মের সাথে সাথে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে বা কুয়ায় ফেলে মেরে ফেলত (আন-নাহল, ১৬/৫৮;আত-তাকভীর, ৮১/৮-৯)। সমাজে তাদের কোনো অধিকার স্বীকৃত ছিল না। বিবাহ, তালাক, সম্পত্তির অধিকার সর্বত্রই পুরুষদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। ঠিকাবিবাহ, বহুবিবাহ, বদলিবিবাহ, মা ব্যতীত অন্যান্য সকল মহিলাকে বিবাহ প্রভৃতি বিবাহপ্রথা চালু ছিল। অধিকাংশ নারীকেই অধিকারবঞ্চিত ক্রীতদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া সামাজিকভাবে উন্মুক্ত ছিল। ফলে নারী সাধারণ ভোগের সামগ্রী হিসেবেই ব্যবহৃত হতো।

৭. ইসলামে নারীর মর্যাদা : তৎকালীন বিশ্বের সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ইসলামে নারীকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে, هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ ‘তারা (নারীরা) তোমাদের জন্য ভূষণস্বরূপ, তোমরা (পুরুষরা) তাদের জন্য ভূষণস্বরূপ’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৭)। একটি গাড়ির দু’টি চাকার অবস্থান নির্দিষ্ট আছে; কিন্তু চাকাদ্বয় স্ব স্ব স্থান থেকে সরে গিয়ে একত্রিত হলে যেমন দুর্ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক, তেমনি নারী ও পুরুষ নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান না করে তবে সেখানেও দুর্ঘটনা ঘটবে। কিন্তু যদি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা যায়, তবে সামাজিক পবিত্রতা বজায় থাকবে; মানব সভ্যতা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ‘তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত সেই, যে অধিকতর তাক্বওয়ার অধিকারী’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১৩)। যেনা-ব্যভিচার, ঠিকাবিবাহ, বদলিবিবাহ, সাময়িক বিবাহ, মুতা বিবাহ ইত্যাদিকে হারাম করে ইসলাম নারীর পবিত্রতা ও সতিত্বকে রক্ষা করেছে। পুরুষের ন্যায় নারীকেও স্বামী, সন্তান, পিতা ও ভাইয়ের সম্পত্তিতে অংশীদার করে নারীর সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম। পুরুষের ন্যায় তাদের জন্য শিক্ষাকে অপরিহার্য ঘোষণা করে তাদের শিক্ষার অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ১৪ জন নারীকে বিবাহ করা হারাম ঘোষণা করে তাদের মর্যাদার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ক্রীতদাসীকে বিবাহ করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তাকে সম্মানিত জীবনযাপনের অধিক দেওয়া অত্যধিক ছওয়াবের কাজ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বিবাহের সংক্রান্ত যাবতীয় জাহেলী রেওয়াজ বাতিল করে নারীর সম্মতি গ্রহণ, তাকে মোহরানা প্রদান এবং অলী ও সাক্ষীর মাধ্যমে বিবাহ বাধ্যতামূলক করে তার সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের খোলা তালাক ও বিধবা বিবাহের অনুমতি দিয়ে দুর্বিষহ বন্দি জীবন থেকে তাকে রক্ষা করা হয়েছে। ‘নারী সকল অকল্যাণের মূল’ এই জাহেলী ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ...وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا ‘আমরা মানবজাতিকে সম্মানিত করেছি এবং অন্যান্য সৃষ্টির উপর মর্যাদা দান করেছি’ (বানী ইসরাঈল, ১৭/৭০)। অতপর নারীর উপর পুরুষের যে কর্তৃত্ব ইসলাম ঘোষণা করেছে, তা মূলত সামাজিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে নয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤول عَنْ رَعِيَّتِهِ ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে’।[1]

মোটকথা, ইসলামপূর্ব সভ্যতাগুলোর বিপরীতে নারীকে মানব সভ্যতার অগ্রগতির অপরিহার্য অঙ্গ বলে গণ্য করেছে। ইসলামে নারী ভোগের পণ্য কিংবা অকল্যাণের উৎস কোনোটিই নয়; বরং তারা সমাজের অগ্রগতি, উন্নয়ন, সুখ-দুঃখ ইত্যাদির ক্ষেত্রে পুরুষের বিশ্বস্ত ও অপরিহার্য সঙ্গী। এভাবে যে ইসলাম নারীকে জাহেলিয়াতের শৃঙ্খল হতে মুক্ত করে এক অভাবনীয় জীবন ধারার সন্ধান দিয়েছে। তাকে মা, খালা, ফুপু, শাশুড়ি, বোন, কন্যা ইত্যাদি নাম দিয়ে সমাজে সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন করেছে ইসলাম। সেই ইলাহী বিধানকে বর্জন করে প্রগতির নামে নারীর মর্যাদার প্রতীক পর্দাপ্রথাকে দূরে ছুড়ে ফেলে নারী সমাজকে আজ বাইরে বের হতে বাধ্য করা হচ্ছে। নারীর অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যকে স্বাধীনতা ও ফ্যাশনের নামে পুরুষের সামনে মেলে ধরা হচ্ছে। ফলে আগুন আর মোমের পাশাপাশি অবস্থানের ফলে যা ঘটার তাই ঘটছে। রোমান, গ্রীক, হেলেনীয় প্রভৃতি সভ্যতা ধ্বংসের মূল উৎস হিসেবে যেমনভাবে নারীকে প্রধান অনুঘটক করা হয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবে আজকের আধুনিক সভ্যতা ধ্বংসের জন্য নারীর অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তথাকথিত প্রগতিবাদীরাই দায়ী। পর্দাহীন নারী রাস্তায় চলবে, পাশাপাশি চেয়ারে কর্মক্ষেত্রে অবস্থান করবে, আর পুরুষ সহকর্মী তার দিকে লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকাবে না এটা নিতান্তই বাস্তবতা বিরোধী কথা। আর এ কারণেই সমাজে ঘটছে যত অঘটন। আধুনিক যুগে নারী এখন সাধারণ পণ্যের চেয়েও সস্তা। সে এখন বিজ্ঞাপনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির হাতিয়ার, সার্কাস, সিনেমা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ। এই অবস্থার প্রতিকারের জন্য পুরুষ সমাজকে যেমন এগিয়ে আসা প্রয়োজন, তেমনি আত্মমর্যাদাহীন পর্দাহীন নারী সমাজেরও আত্মমর্যাদাবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়া জরুরী। ইসলাম নারীকে যেমন আত্মমর্যাদাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছে, ঠিক তেমনি তাকে সমাজ জীবনে ইসলামের বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। আদর্শ শিক্ষা ও ইসলামী বিধিবিধানের কঠোর অনুসরণ ব্যতীত সমাজে মর্যাদা নিয়ে তার বেঁচে থাকা অসম্ভব।

সুতরাং যতদিন নারী তার নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে বিচরণ করার মানসিকতা অর্জন করতে পারবে না, ততদিন নিজেকে চরিত্রে, ব্যবহারে, আচরণে ও মানসিকতায় মহৎ ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারবে না। যতদিন নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ না হবে, উভয়ের কর্মস্থল পৃথক না হবে, রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা এবং চলচ্চিত্রে চরিত্র বিধ্বংসী প্রচার বন্ধ না হবে, ততদিন সে তার সম্মানজনক আসনে পৌঁছাতে পারবে না।

অতএব, আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিধি-বিধান যথাযথভাবে প্রতিপালন করার চেষ্টা করি এবং এর কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের পরিবার ও সমাজকে উন্নত চরিত্র এবং নৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলি। আসুন! আমরা আমাদের গৌরবময় হারানো অতীতকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করি। আমাদের নারী সমাজকে ইসলামের প্রাথমিক যুগের নারীদের ন্যায় আদর্শবান করে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। হে আল্লাহ! আমাদের নারী সমাজ যেন বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে সেই তাওফীক্ব তুমি তাদেরকে দান কর। তাদেরকে তুমি আদর্শবান, ন্যায়পরায়ণ, দেশপ্রেমিক ও উন্নত মানবিক গুণসম্পন্ন করে গড়ে তোলো। আল্লাহ আমাদের মনের আশা পূরণ করে আমাদের সমাজকে একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও আদর্শ সমাজ হিসেবে কবুল করো- আমীন!

হাফেয আব্দুর রহমান বিন জামিল

 অধ্যক্ষ, জামি‘আহ দারুল ইহসান আল-আরাবিয়্যাহ, কালনী, গোবিন্দপুর, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।


[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৯।


Magazine