কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

সম্পত্তিতে নারীর অধিকার

মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত অনেক বিধানের রহস্য আমরা বুঝে উঠতে পারি না। সৃষ্টি হিসেবে এটাই স্বাভাবিক। সৃষ্টি হয়ে যদি সবকিছু বুঝে ফেলা যায়, তাহলে সৃষ্টি আর সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য থাকলো কোথায়? অনেক সময় আল্লাহর বিধানের রহস্য না বুঝে আমরা সেটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলি; এমন কাজ করে ফেলি, যা রীতিমতো ঈমানকে ধ্বংস করে দেয়। অথচ আল্লাহর বিধান নিয়ে ইতিবাচকভাবে চিন্তা করলে দেখবেন এমন অনেক কিছু বুঝতে পারা যায়, যা ঈমান বৃদ্ধিতে খুবই সহায়ক। তেমনি একটি বিধান হচ্ছে ‘মীরাছ’-সংক্রান্ত বিধান। আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক ছেলের জন্য দুই মেয়ের অংশের সমপরিমাণ (আন-নিসা, ৪/১১)

আপাতদৃষ্টিতে, এই আয়াতটিতে মেয়েদেরকে ছেলেদের তুলনায় কম সম্পত্তি দেওয়া হয়েছে মনে হলেও আসলে কম দেওয়া হয়নি। যদি আপনি আয়াতটি তথা আল্লাহর এই বিধান নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেন, তবে আপনি অশ্রুসিক্ত হতে বাধ্য। কারণ তখন আপনি আল্লাহর অসীম দয়া ও ভালোবাসা টের পাবেন। আল্লাহর ইনছাফ নিয়ে আপনার মনে একটুও সন্দেহ থাকবে না। তখন আল্লাহকে ডেকে বলবেন, হে আমার মালিক! আমি বড় যালেম, তুমি বড় দয়ালু, তুমি বড় ইনছাফকারী।

আচ্ছা! মনে করুন, আপনার ছোট ভাইকে নিয়ে আপনার নানাবাড়িতে ঘুরে আসার জন্য আপনার বাবা আপনাকে ২০০ টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেন। এখন ২০০ টাকা দিয়ে আপনাকে বললেন এখান থেকে তুমি রিকশায় যাওয়া-আসার খরচ বহন করো, তোমার ভাইকে কিছু কিনে দিয়ো ইত্যাদি।

অপরদিকে, আপনার বাবা তার ছোট ছেলেকে ১০০ টাকা গুজিয়ে দিয়ে বললেন, এই নাও, এটা তুমি রেখে দাও।

এখন আপনি যাওয়ার পথে আপনার বাবার কথামতো রিকশা ভাড়া দিলেন, ভাইকে আইসক্রিম কিনে দিলেন। তারপর আসার সময় রিকশা ভাড়া দিলেন। সবকিছু খরচ করার পর দেখা গেল যে, উভয়ের কাছে সমপরিমাণ টাকা অবশিষ্ট রয়ে গেছে।

আপাতদৃষ্টিতে আপনার ভাগটা বড় মনে হলেও আসলে আপনার ভাইয়ের ভাগটা কম ছিল না। যেহেতু তার সকল খরচ আপনার কাঁধে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই তার প্রতি বেইনছাফ হয়েছে—এমনটি বলার আদৌ কোনো সুযোগ নেই।

একজন পুরুষকে একভাগ সম্পদ দিয়ে আল্লাহ তাকে বলেছেন তুমি নারীকে বিয়ের সময় মোহরানা দিয়ো, বিয়ের খরচ তুমি বহন করো, তাকে কাপড়চোপড়, খাবারদাবার, চিকিৎসা, ওষুধপত্র, প্রসাধনীসহ সকল প্রয়োজনীয় কিছু অর্থাৎ তার সকল ভরণপোষণ তুমি চালিয়ে নিয়ো। আর এখানেই শেষ নয়। তার সন্তান গর্ভধারণ থেকে শুরু করে, তার কাপড়চোপড়, খাবারদাবার, চিকিৎসা, পড়াশোনার খরচ তথা ভরণপোষণ তুমি পুরুষ চালিয়ে নিয়ো।

দেখেছেন, কত দায়িত্ব? সে বেচারা দায়িত্ব পালন করতে করতে দেখা যায় তার বড় ভাগটা নারীর ঐ ছোট ভাগ থেকেও আরও ছোট হয়ে যায়। এখন আপনিই বলুন, তাকে যদি বেশি দেওয়া না হয়, তাহলে সে এত খরচ বহন করবে কীভাবে? এই ব্যাপারটি কি কখনো আপনি ভেবে দেখেছেন? এর বিপরীতে নারীকে কি কোনো খরচ করতে বলা হয়েছে? একটি পয়সাও না। তাকে যা দেওয়া হয়েছে, সে তা স্বাধীনমতো খরচ করতে পারবে। এখানে কোনো পুরুষ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। পুরুষের হস্তক্ষেপ করা মানে সে বাড়াবাড়ি ও যুলম করল।

ঐ বাবা যেমন তার এক ছেলেকে আরেক ছেলের তুলনায় অর্ধেক দিয়ে তাকে ঠকাননি। ঠিক একইভাবে, রহমানুর রহীম নারীকে পুরুষের অর্ধেক দিয়েও তাকে মোটেও ঠকাননি। বরং আপনি চিন্তা করলে দেখবেন এটাই তার জন্য যথাযথ পাওনা। কারণ নারীর সকল খরচের দায়িত্ব পুরুষের কাঁধে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এখানে সমান দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। সুতরাং যারা বলে, ‘নারীকে সমান না দিয়ে ঠকানো হয়েছে’ নিশ্চয়ই তারা অবিবেচক ছাড়া আর কিছুই নয়!

বড় কষ্ট হয়, যখন তথাকথিত নারীবাদীরা এখানে এসে সমান অধিকারের নামে ইনছাফের প্রশ্ন তুলে। আরে! অধিকার যদি সমান হয়, তাহলে দায়িত্বটাও সমান হতে হবে। এই যে আপনি ১০ মাসের অধিক সময় ধরে সন্তান গর্ভধারণ করছেন। এই দায়িত্বের অর্ধেক কি পুরুষকে দেওয়া সম্ভব? এই যে আপনি দুবছর সন্তানকে কষ্ট করে স্তন্যপান করাচ্ছেন, এই দায়িত্বের অর্ধেক কি পুরুষকে দেওয়া সম্ভব? একইভাবে, পুরুষ বিয়ের সময় মোহর দিচ্ছে, আপনি কি তাকে মোহরের মতো কিছু দিবেন? তার ওপর আপনার ভরণপোষণের দায়িত্ব রয়েছে। মাতৃত্ব সামলে আপনি কি তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিবেন? এসব দায়িত্ব সমানভাবে যেমন ভাগাভাগি করা সম্ভব নয়, তেমনি অধিকারও সমানভাবে ভাগ করা সম্ভব নয়। এসব দায়িত্ব যদি সমান সমান করা যায়, কেবল তখন সমান অধিকারের প্রশ্ন আসবে, তার আগে প্রশ্ন তোলাও অযৌক্তিক।

সমান অধিকারের প্রশ্ন তখন আসবে, যখন দায়িত্ব সমান হবে। যেখানে দায়িত্ব সমান নয়, সেখানে সমান অধিকারের প্রশ্ন তোলা একেবারেই অমূলক। দায়িত্ব সমান নয় এমন জায়গায় সমান অধিকার দেওয়া মানে একজনের ওপর যুলম করা। এজন্য কথাটি ‘সমান অধিকারনয়; ‘ন্যায্য অধিকারহওয়া উচিত। যার যতটুকু পাওয়ার কথা সে ততটুকু পাবে, সে তার পাওনার ক্ষেত্রে কম পেয়ে যুলমের শিকার না হলেই হলো।

যদি আপনি সমান অধিকারের কথা বলেন, তাহলে আমি নিশ্চিত আপনি বুঝেশুনে নিজের জ্ঞান খাটিয়ে বলেননি। 

চিন্তা করে বললে আপনি সমান অধিকারের কথা বলতে পারতেন না, বরং ন্যায্য অধিকার বলতেন। আপনি তথাকথিত নারীবাদীদের টোপ গিলেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

যখন আপনি সমান অধিকারের কথা বলছেন, তখন আপনি মূলত কী বলছেন, জানেন? আপনি বলছেন, আপনি যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের সিইও হন, তবে আপনার আর আপনার কর্মচারীর বেতন সমান হতে হবে। কী, পারবেন সেটা মেনে নিতে? তখন তো ঠিকই আপনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবেন। তখন তো ঠিকই গলা ফাটিয়ে বলবেন, তার দায়িত্ব আর আমার দায়িত্ব কি সমান? এই ভিন্নতা যদি আপনি বুঝতে পারেন, তবে নারী-পুরুষের অধিকারের ভিন্নতা কেন বুঝতে পারবেন না?

এদের দায়িত্ব সমান না হওয়ায় তাদের অধিকার সমান না হওয়াটা যদি যৌক্তিক হয়, ইনছাফ হয়, তাহলে ঠিক একইভাবে নারী ও পুরুষের দায়িত্ব সমান না হওয়ায় তাদের অধিকার সমান না হওয়াটা কেন যৌক্তিক হবে না, কেন ইনছাফ হবে না? আপনার যে মস্তিষ্ক ঐ মালিক-কর্মচারীর অধিকারের ভিন্নতা বুঝতে সক্ষম, সেই একই মস্তিষ্ক নারী-পুরুষের অধিকারের ভিন্নতা বুঝতে অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে কেন?

হায় আফসোস! নারীদের প্রতি আল্লাহ কতটা দয়া করেছেন, ইনছাফ করেছেন সেটা যদি তারা প্রকৃত অর্থে বুঝতে পারত, তাহলে তারা রবের শুকরিয়ায় মস্তক অবনত করত।

কারণ আল্লাহ তাদেরকে যে অংশ দিয়েছেন, সেখান থেকে তাদেরকে কোনো খরচের দায়িত্ব দেননি, পুরুষের মতো আলাদা করে কারও কোনো দায়িত্ব বহনেরও কথা বলেননি। তাদের দায়িত্ব পুরুষের কাঁধে দিয়ে তাদেরকে বরং ভারমুক্ত রেখেছেন।

এ সমাজের কিছু পুরুষ নারীদের প্রাপ্য অধিকার ঠিকমতো দেয় না—এটা স্রেফ তাদের দোষ। এজন্য তাদেরকে একদিন কঠিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তাই বলে আপনি আল্লাহর বিধানকে দোষ দিতে পারেন না। আল্লাহর বণ্টনে নাখোশ থাকতে পারেন না। আল্লাহ তো আপনাকে বঞ্চিত করেননি। অপরদিকে, অন্য কোনো ধর্মে বাবার সম্পত্তিতে নারীদেরকে কোনো অধিকারই দেওয়া হয় না। সেই জায়গায় ইসলাম আপনাকে কত সম্মানিত করেছে। এই সম্মান বুঝতে না পারা সত্যিই অনেক বড় দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। আর একজন মুমিনা কখনোই দুর্ভাগা হতে চাইবে না। মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!

রাকিব আলী

আম্বরখানা, সিলেট।

Magazine