আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের নিকট কঠিন বিষয়কে সহজ ও বোধগম্য করার জন্য চমত্কার উপমার ব্যবহার করেছেন। আর সেই উপমার মাধ্যমে আমরা কঠিন বিষয় সহজ ও স্পষ্টভাবে বুঝতে সক্ষম হই। পবিত্র কুরআনে মৌমাছির বর্ণনায় আন-নাহল নামে একটি সূরা নাযিল করা হয়েছে। যেখানে মৌমাছি সম্পর্কে আলোচনা অতি চমত্কারভাবে ফুটে উঠেছে। তেমনিভাবে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ছাহাবীগণকে বিভিন্ন বিষয় উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন, যাতে ঈমানী শক্তি আরও সুদৃঢ় ও মযবূত হয়। হাদীছে এমন অনেক উপমা রয়েছে, যেখান থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি, যা মানুষের বাস্তব জীবনের সাথে অতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ করে মুমিন বান্দার জীবনের সাথে মৌমাছির জীবনচক্রের গভীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আজকের এই লেখায় তেমনই কিছু বিষয়ের উপমা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
আবদুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ঐ সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন! নিশ্চয়ই ঈমানদারগণ হলো মৌমাছির মতো, যারা উত্তম জিনিস খায়, উত্তম জিনিস তার পেট থেকে বের হয়। তারা ফুলের উপর বসে কিন্তু তা নষ্ট করে না কিংবা তা ভেঙে ফেলে না’।
মৌমাছির জীবনচক্র থেকে মানবজাতি অর্থাৎ একজন মুমিন বান্দা যে সকল বিষয় শিক্ষা লাভ করতে পারে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো— (১) প্রতি মুহূর্তে মহান আল্লাহকে মেনে চলা, (২) দলবদ্ধ তথা সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করা, (৩) সরদার অর্থাৎ নেতাকে অনুসরণ করা, (৪) উৎকৃষ্ট জিনিস আহরণ করা, (৫) কোনো কিছুর ক্ষতিসাধন না করা, (৬) সবসময় পরিশ্রম করা অর্থাৎ কর্মোদ্যমী হওয়া ও (৭) আমানতদারিতা রক্ষা করা। এছাড়াও মৌমাছির জীবনচক্র থেকে আমরা আরও অনেক বিষয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করতে পারি।
এই বিষয়টি এত সূক্ষ্ম আর গভীর যে, এ নিয়ে সাধারণত কোনো আলোচনা হয় না বা মানুষকে ভাবতে দেখা যায় না। কিন্তু এর মধ্যে রয়েছে অনেক অজানা সূক্ষ্ম বিষয়। মৌমাছি আল্লাহ তাআলার একটি ক্ষুদ্র সৃষ্টি, তবে এর কার্যক্রম অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং সুগভীর। পবিত্র কুরআনে আন-নাহল বা মৌমাছি সূরা নামে একটি পূর্ণ সূরা নাযিল করে এই ক্ষুদ্র প্রাণীটির বিশেষ জ্ঞান-বুদ্ধির উপর আলাদা গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কেন মৌমাছির উপর (এক ধরনের) অহী নাযিল করলেন? কেন উক্ত সূরায় বর্ণিত কথাগুলো বললেন? এটি মুমিন বান্দাদের জন্য ভাববার বিষয়। এই সূরাটির ৬৮ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন,وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ ‘তোমার পালনকর্তা মৌমাছির প্রতি আদেশ করেছেন যে, পর্বতের গুহায়, বৃক্ষ, উঁচু চালে গৃহ তৈরি করো’ (আন-নাহল, ১৬/৬৮)। এখানে মহান আল্লাহ মৌমাছিকে আদেশ করেছেন। ঠিক একইভাবে ৬৯ নাম্বার আয়াতে বলেছেন,ثُمَّ كُلِي مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلًا ‘অতঃপর সর্বপ্রকার ফল থেকে আহার করো এবং আপন পালনকর্তার উন্মুক্ত পথসমূহে চলমান হও’ (আন-নাহল, ১৬/৬৯)। এই বিষয়গুলো থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আমরা দেখি যে, এক একটি মৌমাছি মধু সংগ্রহের জন্য অনেক দূর-দূরান্তে যায়, তথাপি তারা পথ হারায় না; তারা তাদের রবের দেখানো পথে পুনরায় ফিরে আসে। কারণ, তারা সর্বদা আল্লাহর দেখানো পথে ধাবমান, আল্লাহর দেখানো পথে হাঁটে। বিধায় কখনো পথভ্রষ্ট হয় না, নিজ গন্তব্যে ঠিকই ফিরে আসে। অনুরূপভাবে মানুষও যদি তার রবের দেখানো পথে চলে, সে কখনো পথহারা হবে না। মানুষ তথা মুমিন ব্যক্তির মূল আবাসস্থান হলো জান্নাত। আদম-হাওয়াকে সৃষ্টি করে রাখা হয়েছিল জান্নাতে। সেই জান্নাত থেকে আমরা চলে এসেছি। কিন্তু মহান আল্লাহ আমাদের জন্য জান্নাতে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে রেখেছেন। আমরা যদি তার দেখানো পথে চলি, তাহলে আমরা আমাদের বাসভবন অর্থাৎ জান্নাতে যেতে পারব এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব। মৌমাছি থেকে আমরা এই শিক্ষা লাভ করতে পারি।
তারপর যে বিষয়টি মৌমাছির কাছ থেকে একজন মুমিন বান্দার শেখার আছে, তা হলো— একটি রাষ্ট্রে পরস্পর সুশৃঙ্খল ও দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করা। আমরা একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, মৌমাছি যেখানে চাক বাঁধে, সেটা তাদের একটি রাষ্ট্র। অর্থাৎ এক একটি চাককে এক একটি রাষ্ট্রের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এই রকম এক একটা চাকে প্রায় ১২/১৫ হাজার মৌমাছি থাকে এবং পরস্পর কত সুন্দর মিলেমিশে বসবাস করে, যা সত্যিই ভাববার। আর সেই রাষ্ট্রের থাকে একজন নেতা, যার নেতৃত্বে রাষ্ট্রটি পরিচালিত হয়ে থাকে। আর এই রাষ্ট্রের নেতা হলো রাণী মৌমাছিটি। এই রাণী সমস্ত মৌমাছির চেয়ে একটু আলাদা অর্থাৎ অন্যদের চেয়ে একটু বড় ও সুঠাম হয়ে থাকে। এই রাণী সবাইকে পরিচালিত করে থাকে। সকলের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে তদারকি করে থাকে। প্রথমত, যে দায়িত্বটা বণ্টন করে থাকে সেটি হলো গার্ড বা নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব অর্থাৎ কিছু মৌমাছি আছে যারা তাদের চাক নামক রাষ্ট্রের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা প্রদানে ব্যস্ত থাকে। অনাকাঙ্ক্ষিত কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না, ঢুকতে চাইলে সবাই মিলে তার উপর আক্রমণ করে— এটি রাণীর আদেশ। তারা রাণীর কথার বাইরে এক চুলও নড়ে না। আমরা যদি আমাদের সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাও ঠিক একইভাবে পরিচালিত হয়ে থাকে। যেমন- আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এই দায়িত্বটি অতি যত্নে্র সাথে পরিচালনা করে থাকে আমাদের রাণী অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশ অনুসারে। অনুরূপ কেউ অবৈধভাবে প্রবেশ করতে চাইলে সবাই মিলে তাকে প্রতিহত করে। এটি কিন্তু মৌমাছির কাছ থেকে পাওয়া একটি শিক্ষা।
কিছু মৌমাছি আছে যারা বাচ্চা লালনপালন করে, আমাদের মায়েদের মতো বলা চলে অনেকটা। আর কিছু মৌমাছি আছে যারা মোম সংগ্রহ করে, আবার কিছু মৌমাছি আছে যারা প্রকৌশলী অর্থাৎ বাসা নির্মাণ করে। এগুলো সবই পরিচালিত হয় রাণীর আদেশে। আমরা যদি একটু লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাই যে, মৌমাছির বাসাগুলো এত নিপুণ আর আর্কষণীয় হয় যে, এক একটা কুঠুরির ছয়টি কোণা থাকে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, ছয়টি কোণা কেন? এই ছয়টি কোণারও একটি বিশেষত্ব রয়েছে। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো প্রতিটি কোণা সমানভাবে তৈরি। জ্যামিতিকভাবে হিসাব করে দেখা গেছে যে, যদি ছয়টি কোণা না থাকত তাহলে তার কিছু অংশ বাদ পড়ত এবং কোনো না কোনোভাবে তা পূর্ণ হতো না। ছয়কোণা হওয়ায় এর পরিপূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে। ঠিক একইভাবে যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাব যে, আমাদের দেশের প্রকৌশলীরাও এখন এই নিয়মে বাড়ি তৈরি করছে, যাতে কোনো কোণা অব্যবহৃত অবস্থায় না থাকে। এটি কিন্তু মৌমাছি থেকে প্রাপ্ত একটি শিক্ষা।
আরেকটি বিষয় হলো— যদি কোনো মৌমাছি কোনো ময়লা-আবর্জনা বা স্তূপের উপর বসার পর তার চাকে ফিরে যেতে চায়, তাহলে চাকের নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে চাকে প্রবেশ করতে দেয় না। শুধু নোংরা হওয়ার কারণে তার জন্য এত বাধ্যবাধকতা। কখনো কখনো রাণীর আদেশে তাকে মেরে ফেলা হয়। আমরা জানি ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ’। অনুরূপভাবে আমাদের নিজেদের, আমাদের পরিবার ও সমাজ এমনকি রাষ্ট্রকে পরিশুদ্ধ রাখতে হবে। তাহলে গোটা দেশ পরিবর্তন হয়ে যাবে। যারা এরকম নোংরা কাজে লিপ্ত হবে, তাদের জন্য কার্যকরী আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কেননা আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সাত শ্রেণির মানুষ আল্লাহর আরশের নিচে আশ্রয় পাবে। তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে ন্যায় বিচারক’। আমরা মুমিন বান্দারা সমাজে কত সহজে মৌমাছির কাছ থেকে এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
পরবর্তী বিষয়টি হলো— একজন মুমিনের কেমন হওয়া উচিত আমরা এই শিক্ষাটাও কিন্তু মৌমাছির কাছ থেকে পেয়ে থাকি। মৌমাছি এমন একটি পতঙ্গ, যা মানুষের ক্ষতিসাধন করে না; কিন্তু উপকার করে। মৌমাছি ফুল থেকে নির্যাস নেয়, কিন্তু তা বিন্দুমাত্র নষ্ট করে না। একজন মুমিন ব্যক্তিকে ঠিক অনুরূপ হতে হবে। একজন মুমিন ব্যক্তি কারো ক্ষতি করবে না, বরং সর্বদা উপকারে লিপ্ত থাকবে। একজন মুমিন ব্যক্তি হবেন সর্বদা উদ্যমী ও পরিশ্রমী, যেমনটি মৌমাছি হয়ে থাকে। আমরা একটি বিষয় লক্ষ্য করলে তা বুঝতে পারি যে, মৌমাছি কত কষ্ট করে হাজারো মাইল পরিভ্রমণ করে মানুষের জন্য মধু সংগ্রহ করছে এবং তা বিলিয়ে দিচ্ছে আমাদের মাঝে। কৃষি গবেষণায় এটি প্রমাণিত যে, মৌমাছিরা যদি এক ফুল থেকে অন্য ফুলে গিয়ে মধু সংগ্রহ না করত তাহলে ফুলের পরাগায়ন হতো না। এটাও আল্লাহর একটি বিশেষ নিদর্শন। এখান থেকে সহজে বোঝা যায় যে, মৌমাছিরা কতটা পরিশ্রমী আর উপকারী পতঙ্গ। একজন মুমিন ব্যক্তিকেও তেমনই নিজে কষ্ট করে অন্যের খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে। যেমনটি মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তি কখনো অলস হয় না। মুমিন ব্যক্তি কপালে ঘাম নিয়ে মৃত্যুবরণ করে’। অর্থাৎ একজন মুমিন ব্যক্তি সর্বদাই পরিশ্রমী। আল্লাহর সৃষ্টি মৌমাছির কাছ থেকে আমরা এই শিক্ষা গ্রহণ করে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— মৌমাছি সর্বদা উৎকৃষ্ট ও পরিচ্ছন্ন জিনিস খায়। এরা কিন্তু যে কোনো জায়গা থেকে মধু সংগ্রহ করে না। তারা সবসময় পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকে। তাদের মুখ থেকে নিঃসৃত মধু অত্যন্ত পবিত্র ও স্বচ্ছ। বিষয়টি আমাদের চিন্তা করে দেখা দরকার যে, আল্লাহ আমাদের উপর কত বড় অনুগ্রহ করেছেন। তেমনি আল্লাহ তাআলা পশুদের ব্যাপারে বলেছেন,وَإِنَّ لَكُمْ فِي الْأَنْعَامِ لَعِبْرَةً نُسْقِيكُمْ مِمَّا فِي بُطُونِهِ مِنْ بَيْنِ فَرْثٍ وَدَمٍ لَبَنًا خَالِصًا سَائِغًا لِلشَّارِبِينَ ‘অবশ্যই (গৃহপালিত) চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে তোমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে; ওগুলোর উদরস্থিত গোবর ও রক্তের মধ্য হতে তোমাদের আমি পান করাই বিশুদ্ধ দুগ্ধ, যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু’ (আন-নাহল, ১৬/৬৬)। ঠিক একইভাবে আল্লাহ মৌমাছির মতো পতঙ্গের পেটের মধ্যে থেকে কৌশলে বের করে নিয়ে আসেন মধু। এরপরও কি মানুষ আল্লাহর উপর থেকে ঈমান হারাবে? মৌমাছির মধু যেমনটি পবিত্র ও স্বচ্ছ, তেমনি একজন মুমিন ব্যক্তির অন্তরও পবিত্র ও কলুষমুক্ত হওয়া উচিত। সেই মুমিনের পবিত্র অন্তরে সবসময় ঈমানের আলোয় পরিস্ফুটিত হতে থাকে। অনুরূপভাবে একজন মুমিনের খাদ্য ও উপার্জন সবই পবিত্র হওয়া উচিত। আমরা খেয়াল করলে দেখতে পাই যে, যারা মুমিন নয়, তারা যা পায় তাই খায়। তাদের মধ্যে কোনো হালাল-হারাম, রুচি-অরুচি ও উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্টের কোনো ভেদাভেদ নেই। সাময়িক সুবিধার জন্য তারা হারাম পথে পয়সা কামাতে ও হারাম খাদ্য গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। কিন্তু তুলনা করলে দেখা যায় যে, একটি ক্ষুদ্র কীট মৌমাছি এদের চেয়ে উৎকৃষ্ট। উৎকৃষ্ট আহার করে থাকে। একজন মুমিনের মৌমাছির কাছ থেকে এই শিক্ষাটাই গ্রহণ করা উচিত যে, সর্বদা হালাল খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। কেননা হালাল খাদ্য দেহ ও মনকে পবিত্র রাখে।
এখানে মৌমাছির কাছ থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মুমিন বান্দার শেখার রয়েছে। সেটি হলো— কারো ক্ষতি না করা। আমরা জানি, ‘সেই প্রকৃত মুমিন যার হাত, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও জিহ্বা থেকে অন্য মানুষ নিরাপদে থাকে’। আমাদের আচরণও প্রকৃত মুমিনের মতো হওয়া উচিত। যেমনটি মৌমাছি শুধু ফুল ও ফলে উড়তে থাকে এবং দেখতে থাকে এখান থেকে যদি আমি মধু বা নির্যাস নিই তাহলে এটার কোনো ক্ষতি হবে কি? যদি বুঝতে পারে যে ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে, তাহলে সেখান থেকে নির্যাস নেওয়া থেকে বিরত থাকে। আর দেখার পর যখন বুঝতে পারে যে, এখান থেকে মধু বা নির্যাস নিলে কোনো ক্ষতি হবে না, বরং পরাগায়ন হবে ও উপকার হবে তখন শুধু সেখান থেকে নির্যাস নেয়। যেখান থেকে যতটুকু নিলে ক্ষতি হবে না, সেখান থেকে শুধু ততটুকু নেয়। এটি আমাদের জন্য কত বড় শিক্ষণীয় বিষয়, তা আমরা একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারি। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ক্ষতি করা যাবে না, ক্ষতি সহ্য করাও যাবে না’। এজন্য আমাদের সবার উচিত কারও ক্ষতি না করা, ক্ষতি সহ্যও না করা। আমাদের চেষ্টা করতে হবে সমাজ, পরিবার ও নিজেদের জানমালের যেন ক্ষতি না হয়, সেই দিকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।
সর্বশেষ একজন মুমিন বান্দার মৌমাছির কাছে যে বিষয়টি শেখার আছে তা হলো— আমানতদারিতা। যেটি উত্তম চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। যদি আমরা এই বিষয়ে মৌমাছিদের উপর দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাই যে, তারা কী পরিমাণ বিশ্বস্ততা এবং আমানত রক্ষা করে থাকে! মৌমাছি মধু আহরণ করা থেকে চাকে পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো দায়িত্বটাই আমানতদারিতার সাথে পালন করে থাকে। তারা তাদের রাণীর আদেশ এমনভাবে পালন করে যে, এক বিন্দু মধুও তারা নষ্ট করে না বা নিজের পাকস্থলীতে জমা রাখে না। কী এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত!
একইভাবে একজন মুমিন সম্পদকে আল্লাহর আমানত মনে করে সঠিকভাবে ব্যবহার করবে। হারাম বা নিষিদ্ধ পথে ব্যবহার করবে না। বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেবে না। আল্লাহ তাআলা মৌমাছির বর্ণনা দিয়ে কত সুন্দরভাবে তা আমাদের বুঝিয়েছেন। অনেক সময় দেখা যায় আমরা অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করি, সরকারি সম্পদকে নিজের সম্পদ মনে করে থাকি- এগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে।
আমরা আল্লাহর তৈরি এই একটি পতঙ্গ থেকে অনেক মূল্যবান কিছু শিক্ষা লাভ করলাম। তা যদি আমরা আমাদের বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে থাকি, তাহলে আমরা আমাদের আসল গন্তব্যে অর্থাৎ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব ইনশা-আল্লাহ।