রামাযান মাস হচ্ছে ইবাদত করার বসন্তকাল। তাইতো এই মাসটাকে বরণ করার জন্য নারীরা মুখিয়ে থাকে। এই প্রবন্ধে ছিয়াম সংক্রান্ত নারীদের বিভিন্ন সমস্যার শারঈ সমাধানের চেষ্টা করা হবে ইনশা-আল্লাহ।
রামাযানে ছিয়াম থাকা অবস্থায় যাবতীয় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য পাপাচার, অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা: ছিয়াম থাকাবস্থায় প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যাবতীয় পাপাচার, অবাধ্যতা, গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকা ছিয়ামের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সকল প্রকার পাপ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে একজন মানুষকে মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিকভাবে পরিপূর্ণ ভালো মানুষে পরিণত করা ছিয়ামের অন্যতম লক্ষ্য। নিছক পানাহার পরিত্যাগ করার শিক্ষা নিয়ে ছিয়াম আসেনি; বরং প্রভূত কল্যাণ, অসংখ্য শিক্ষা, উন্নতি, সমৃদ্ধির প্যাকেজ নিয়ে বছর ঘুরে ছিয়াম আমাদের কাছে আগমন করে। ছিয়াম থাকা অবস্থায় একজন ছিয়াম পালনকারী মিথ্যা, বেহুদা কথা বা আলাপচারিতা, অশালীন আচরণ, গীবত, চোগলখোরি, ঝগড়া, মারামারি, প্রবৃত্তির অনুসরণ করাসহ সকল ধরনের অনিষ্ট কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ করে। কোনো ছিয়াম পালনকারী যদি এগুলোর কোনো একটি কাজের সাথে জড়িত হয়, তাহলে সে ব্যাপারে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِى أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করে না, তার শুধু খানাপিনা পরিত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই’।[1]
যে সকল বিষয় ছিয়ামকে বাতিল করে দেয়:
(১) ইচ্ছাকৃতভাবে খাওয়া এবং পান করা: যদি কোনো ছিয়াম পালনকারী ব্যক্তি ইচ্ছা করে কোনো কিছু খায় এবং পান করে, তাহলে তার ছিয়াম বাতিল হবে এবং সেই সাথে তার উপর ক্বাযা আদায় করা আবশ্যক হবে। সাথে সাথে সে কাবীরা গুনাহগার হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি অনিচ্ছায় কোনো কিছু ভুলবশত খায় অথবা পান করে, তাহলে তার ছিয়াম নষ্ট হবে না। এ সম্পর্কে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ نَسِىَ وَهُوَ صَائِمٌ فَأَكَلَ أَوْ شَرِبَ فَلْيُتِمَّ صَوْمَهُ فَإِنَّمَا أَطْعَمَهُ اللَّهُ وَسَقَاهُ ‘যে ব্যক্তি ভুলে আহার করল বা পান করল, সে যেন তার ছিয়াম পূর্ণ করে। কারণ আল্লাহই তাকে পানাহার করিয়েছেন’।[2]
(২) ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা: যদি কোনো কারণবশত বমি হয়, তাহলে ছিয়ামের কোনো সমস্যা হবে না। তবে কেউ যদি ইচ্ছা করেই বমি করে, তাহলে তার ছিয়াম বাতিল হবে এবং সেই সাথে ক্বাযা আদায় করতে হবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ইচ্ছা করে বমি করে, সে যেন তার ক্বাযা আদায় করে’।[3]
(৩) হায়েয এবং নিফাস: কোনো ছিয়াম পালনকারী নারীর যদি হায়েয অথবা নিফাস হয়, তাহলে তার ছিয়াম নষ্ট হয়ে যাবে- যদিও তা দিনের একেবারে শেষ ভাগে হয়। পরে সে এই ছিয়ামের ক্বাযা আদায় করবে। সকল আলেম এই মত পেশ করেছেন। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে আমরা হায়েয অবস্থায় থাকতাম, তিনি আমাদেরকে ছিয়ামের ক্বাযা আদায় করার নির্দেশ দিতেন; কিন্তু ছালাতের ক্বাযা আদায় করার নির্দেশ দিতেন না।[4]
(৪) ইচ্ছাকৃতভাবে হস্তমৈথুন করা: অধিকাংশ বিদ্বানের মতে, স্ত্রী মিলন ছাড়াই প্রবৃত্তির চাহিদায় যেকোনো মাধ্যমে বীর্যপাত করলে তার ছিয়াম বাতিল হবে এবং সেই সাথে ছিয়ামের ক্বাযা আদায় করতে হবে।
(৫) ছিয়াম ভঙ্গের নিয়্যত করা: যদি কোনো ছিয়াম পালনকারী সজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় ছিয়াম ভঙ্গ করার নিয়্যত করে, তাহলে তার ছিয়াম বাতিল বলে গণ্য হবে। যদিও সে পানাহার না করে। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى ‘প্রত্যেক কাজ নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল’।[5]
সমাজে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণার অপনোদন:
(১) নাপাক অবস্থায় সকাল করলে ছিয়ামের কোনো সমস্যা হয় না: রামাযান মাসে রাতে স্ত্রী সহবাস, স্বপ্নদোষ কিংবা যেকোনোভাবে নাপাক অবস্থায় সকাল করলে ছিয়ামের কোনো সমস্যা হবে না। তার ছিয়াম বাতিলও হবে না কিংবা ক্বাযা আদায় করার কোনো প্রমাণও কুরআন-সুন্নাহতে পাওয়া যায় না। বরং নিঃসন্দেহে নাপাক অবস্থায় সকাল করলে তার ছিয়াম শুদ্ধ বলে গণ্য হবে। হাদীছে এসেছে, আয়েশা ও উম্মু সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাপাক অবস্থায় ফজর করেন, এমতাবস্থায় তিনি তাঁর পরিবারের (স্ত্রী) নিকটে ছিলেন। অতঃপর তিনি গোসল করেন এবং ছিয়াম রাখেন।[6]
(২) প্রয়োজনের তাগিদে তরকারির স্বাদ গ্ৰহণ করা, যদি সেই স্বাদ পেটে না যায়: রামাযানে ছিয়াম অবস্থায় মহিলাদের রান্নার আয়োজন করতে হয়। ফলে বিভিন্ন ধরনের তরকারি রান্না করতে তরকারির স্বাদ আস্বাদন করতে মারাত্মক বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। এক্ষেত্রে তরকারির স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে কিনা? এটা না জানার দরুন অনেক ছিয়াম পালনকারী নারী সমস্যার মুখোমুখি হয়। অনেক মহিলা মনে করে, ছিয়াম অবস্থায় তরকারির স্বাদ আস্বাদন করা যাবে না। যদি কেউ করে, তাহলে তার ছিয়াম হবে না বলেও সমাজে অনেকের কাছে শোনা যায়। প্রকৃতপক্ষে এর মাসআলা হলো, যদি প্রয়োজন হয় তরকারির স্বাদ আস্বাদন করার, তাহলে স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে শর্ত হলো কোনোভাবেই যেন তরকারির স্বাদ পেটে প্রবেশ না করে। যদি পেটে প্রবেশ করে, তাহলে ছিয়াম নষ্ট হবে। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, ছিয়াম অবস্থায় সিরকা কিংবা কোনো কিছুর স্বাদ আস্বাদন করাতে কোনো সমস্যা নেই, যদি সেটা কণ্ঠনালি অতিক্রম না করে।[7] শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, প্রয়োজন ছাড়া খাদ্যের স্বাদ আস্বাদন করা মাকরূহ। কিন্তু এতে ছিয়ামের কোনো সমস্যা হবে না। আর যদি সেটা প্রয়োজনের কারণে হয়, তাহলে সেটা হবে কুলি করার মতো।[8]
এখানে লক্ষণীয় যে, স্বাদ আস্বাদন করার অর্থ হলো, প্রয়োজনে খাদ্যে চিবুনি দেওয়া। বিখ্যাত তাবেঈ ইউনুস রাহিমাহুল্লাহ হাসান রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে বলেন, আমি তাকে শিশুর জন্য খাদ্য চিবুনি দিতে দেখেছি, অথচ তখন তিনি ছিয়াম পালনকারী ছিলেন। তিনি খাদ্য চিবুনি দেন, অতঃপর তার মুখ থেকে বের করেন। অতঃপর খাদ্য শিশুটির মুখে দেন।[9]
(৩) ছিয়াম পালনকারী প্রচণ্ড পিপাসা কিংবা গরমের কারণে ঠাণ্ডা পানি মাথায় ঢালতে পারে: অনেক সময় দেখা যায় প্রচণ্ড গরমের কারণে কিংবা পিপাসার কারণে ছিয়াম পালনকারী ঠাণ্ডা পানি মাথায় ঢালে। অনেকেই মনে করে যে, ছিয়াম পালনকারী পিপাসার কারণে অথবা গরমের কারণে ছিয়াম অবস্থায় ঠাণ্ডা পানি মাথায় ঢালতে পারবে না। এতে ছিয়াম নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা আছে। আবার কেউ কেউ বলে, শরীরের লোম দিয়ে নাকি পানি প্রবেশ করে। প্রশ্ন হলো, পিপাসার কারণে হোক কিংবা গরমের কারণে হোক ঠাণ্ডা পানি মাথায় ঢালতে পারবে কিনা? এ ব্যাপারে যদি আমরা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছাহাবীদের দিকে তাকাই, তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ছাহাবীগণ বলেছেন যে, আমরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দেখেছি, তিনি ছিয়াম অবস্থায় প্রচণ্ড পিপাসা অথবা গরমের কারণে মাথায় পানি ঢালতেন।[10]
(৪) ছিয়াম অবস্থায় স্বামী স্ত্রীকে অথবা স্ত্রী স্বামীকে চুম্বন করতে পারে: যদি কোনো দম্পতি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং কোনো প্রকার বীর্যপাত ছাড়াই শুধু পরস্পরকে চুম্বন করে, তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। যদিও তারা ছিয়াম অবস্থায় থাকে। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিয়াম অবস্থায় তাঁর স্ত্রীকে চুম্বন করেন। আর তিনি ছিলেন নিজেকে সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণকারী।[11] আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা আরো পরিষ্কার করে বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে চুম্বন করেন এমতাবস্থায় তিনি ও আমি উভয়ে ছিয়াম পালনকারী ছিলাম।[12]
তবে যাদের ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা রয়েছে যে, তারা চুম্বন করতে গেলে স্ত্রী সহবাস করে ফেলতে পারেন, তাহলে তার জন্য স্ত্রীকে চুম্বন করা জায়েয হবে না।
(৫) ছিয়াম অবস্থায় ব্রাশ করা যায়: ছিয়াম অবস্থায় ব্রাশ করা যাবে কিনা এ বিষয়ে অনেক ছিয়াম পালনকারী বিড়ম্বনায় পড়েন। কেউ বলে, করা যাবে। আবার কেউ বলে, করা যাবে না। আসলে সঠিক কথা হলো— যদি খাদ্যনালিতে প্রবেশ না করে, তাহলে ব্রাশ করা যাবে আর যদি প্রবেশ করে, তাহলে ব্রাশ করা যাবে না। এক্ষেত্রে দিনের বেলা ব্রাশ করা থেকে বিরত থাকাই সর্বোত্তম। তবে ব্রাশ করা যাবে, এটা জায়েয, এতে সমস্যা নেই। শুধু সচেতন থাকতে হবে যেন খাদ্য খাদ্যনালিতে না যায়।[13]
নারীদের ছিয়াম বিষয়ে জরুরী কিছু মাসআলা:
(১) বৃদ্ধা মহিলা অথবা এমন অসুস্থ যার সুস্থতার কোনো আশা করা যায় না, এমন ব্যক্তির জন্য ছিয়ামের বিধান কী?
এমন বৃদ্ধা মহিলা অথবা এমন অসুস্থ যার সুস্থতার কোনো আশা করা যায় না, তাকে ছিয়াম রাখতে হবে না এবং তার ক্বাযাও আদায় করতে হবে না বলে বিদ্বানগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন। বরং এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রতিটি ছিয়ামের বদলে একজন করে মিসকীনকে খাবার খাওয়াবে।[14]
(২) গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মহিলারছিয়ামের বিধান কী?
যদি গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মহিলা ছিয়াম থাকার কারণে তার নিজের অথবা বাচ্চার জীবনের শঙ্কা তৈরি হয় অথবা ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাহলে শরীআতে তাদের ছিয়াম না রাখার ব্যাপারে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَضَعَ عَنِ الْمُسَافِرِ شَطْرَ الصَّلَاةِ، وَعَنِ الْمُسَافِرِ وَالْحَامِلِ وَالْمُرْضِعِ الصَّوْمَ أَوِ الصِّيَامَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মুসাফির থেকে ছালাতের অর্ধেক সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি মুসাফির, গর্ভবতী এবং দুগ্ধদানকারী মহিলা থেকে ছিয়ামকে ভারমুক্ত করেছেন’।[15]
যদিও এই মতের ব্যাপারে বিদ্বানগণের মতানৈক্য রয়েছে, তথাপিও গ্ৰহণযোগ্য মত হলো, গর্ভবতী এবং দুগ্ধদানকারী মহিলা প্রত্যেক দিনের ছিয়ামের বদলে পরবর্তীতে ক্বাযা আদায় করবে।[16]
(৩) হায়েয ও নিফাসের সময় ছিয়াম রাখার বিধান কী?
ইসলামী শরীআতে ইবাদতের ক্ষেত্রে বিশেষ করে নারীদের অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে এবং সহজীকরণ করা হয়েছে। প্রত্যেক নারীর জন্য প্রতি মাসেই স্বভাবগত কারণেই ছাড় দেওয়া হয়েছে বিশেষ সমস্যার কারণে, যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য বিশেষ নেয়ামত। তন্মধ্যে হায়েয এবং নিফাস অন্যতম। বিদ্বানদের ঐকমত্যে হায়েয এবং নিফাস অবস্থায় নারীদের ছিয়াম রাখা শুদ্ধ নয়। এমতাবস্থায় তাদের উপর ছিয়াম ফরয নয়; বরং ছিয়াম রাখাই হারাম। তবে যেহেতু এই অবস্থায় ছিয়াম রাখতে পারেনি, তাই পরের রামাযান মাস আসার আগেই তাকে এর ক্বাযা আদায় করে নিতে হবে। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে হায়েয অবস্থায় ছিলাম। আমাদের ছিয়াম ক্বাযা করার নির্দেশ দেওয়া হতো, তবে ছালাত ক্বাযা করার নির্দেশ দেওয়া হতো না’।[17]
(৪) যদি কোনো নারী ওষুধ সেবন করে রামাযান মাসে হায়েয বন্ধ করে, তাহলে কি ছিয়াম পালনে কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে?
হায়েয হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নারীদের জন্য নির্ধারিত বিষয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে এমন কোনো নারী খুঁজে পাওয়া যায়নি, যে নারী পরিপূর্ণ এক মাস ছিয়াম পালনের জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কেননা এটার দায়িত্ব মহান আল্লাহ তাদেরকে দেননি, বরং এটি হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নারীদের জন্য লিপিবদ্ধ বিষয়। তবে হ্যাঁ! যদি কেউ কোনো ওষুধ সেবন করে আর সেটার দ্বারা কোনো ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকে এবং সেই ওষুধ সেবন করার মাধ্যমে রক্তও বন্ধ হয়, তাহলে সেই অবস্থায় ছিয়াম রাখলে তা শুদ্ধ হয়ে যাবে। রক্ত বন্ধ হয়ে গেলেই সে পবিত্র বলে গণ্য হবে।[18]
তবে এ কাজ না করাই ভালো।
(৫) কোনো নারীর ইফতারেরকয়েক মিনিট পূর্বে হায়েয শুরু হলে সে কি ছিয়াম নষ্ট করবে না-কি ছিয়াম পূর্ণ করবে?
এই মাসআলার ক্ষেত্রে করণীয় হলো, যদি কোনো ছিয়াম পালনকারী নারীর ইফতারের কিছু সময় পূর্বে হায়েয শুরু হয়, তাহলে সেই নারীর ক্ষেত্রে ছিয়াম পূর্ণ না করে ছিয়াম নষ্ট করা শরীআতের নির্দেশ। যদি সেই নারী ছিয়ামকে চলমান তথা পূর্ণ করে, তাহলে তার ছিয়াম বিশুদ্ধ হবে না। বরং তার উপর ওয়াজিব হলো ছিয়াম নষ্ট (ছেড়ে দেওয়া) করা।[19]
(৬) যদিএমন কোনো নারী, যার স্বাভাবিকভাবে নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক মাসেই ১০ দিন হায়েয হয়ে থাকে কিন্তু রামাযান মাসে তার স্বভাবগতভাবে ১৪ দিন হায়েয হয়। ফলে সে পবিত্রতা অর্জন করেনি এবং তার লজ্জাস্থান থেকে কালো অথবা হলুদ রঙের রক্ত বের হয়, এমতাবস্থায় সে ১৮ দিন পর্যন্ত অবস্থান করে। ফলে ১৮তম দিন থেকে ছিয়াম, ছালাত আদায় করলে তা শুদ্ধ হবে কি?
যদি কোনো নারীর স্বাভাবিকভাবে প্রত্যেক মাসের অভ্যাস অনুযায়ী বেশি দিন হায়েযের রক্ত নির্গত হয় আর সেটা যদি সত্যি হায়েযের রক্ত হয়ে থাকে, তাহলে সে ছিয়াম ও ছালাত থেকে বিরত থাকবে। আর যদি সেই রক্ত হায়েযের না হয় এবং দেখে হায়েযের রক্ত বলেও চিহ্নিত করা না যায়, তাহলে সেটা ঐ নারীর ইস্তেহাযা (এক প্রকার রোগ) বলে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে ঐ নারী ছিয়াম, ছালাত থেকে বিরত থাকবে না; বরং সে ছালাত, ছিয়াম চলমান রাখবে। শুধু অভ্যাসগতভাবে প্রত্যেক মাসের হায়েযের দিনগুলোর পরিমাণ অনুসারে বিরত থাকবে।
এরকম নারীর ক্ষেত্রে সে পবিত্র হয়ে ছিয়াম চলমান রাখবে, অতঃপর যদি সে অচেনা এমন রক্ত দেখে, যা হায়েযের রক্তের মতো না, বরং সেই রক্ত হলুদ অথবা পাতলা রক্ত অথবা কখনো কখনো কালো হয়, সেক্ষেত্রে সেই রক্ত হায়েযের রক্ত বলে গণ্য হবে না; বরং সেক্ষেত্রে তার ছিয়াম এবং ছালাত আদায় বিশুদ্ধ হবে।[20]
পরিশেষে আল্লাহ তাআলার কাছে ফরিয়াদ জানাই, তিনি যেন নারীদের যথাযথভাবে ছিয়াম পালন করার তাওফীক্ব দান করেন- আমীন!
মাযহারুল ইসলাম
দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা দারুস সুন্নাহ, মিরপুর, ঢাকা; শিক্ষক, হোসেনপুর দারুল হুদা সালাফিয়্যাহ মাদরাসা, খানসামা, দিনাজপুর।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৩।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৩৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫৫।
[3]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৮০; তিরমিযী, হা/৭১৬।
[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৩৫; আবূ দাঊদ, হা/২৫৯।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/১।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯২৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১১০৯।
[7]. ইবনে আবী শায়বা, ৩/৪৭।
[8]. মাজমূউল ফাতাওয়া, ২৫/২৬৬।
[9]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হা/৭৫১২।
[10]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৪৮।
[11]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯২৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১১০৬।
[12]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৮৪।
[13]. ছহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/১১৭।
[14]. সূরা আল-বাক্বারা, ২/১৮৪; ছহীহ বুখারী, হা/৪৫০৫; আল-মুগনী, ৪/৩৯৬; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা, ১১/১৬৪।
[15]. মুসনাদে আহমাদ, ৪/৩৪৭।
[16]. আশ-শারহুল মুমতি‘, ৬/২২০; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা, ১০/২২০, ১০/২২৬; মাজমূ‘ ফাতাওয়া শায়খ বিন বায, ১৫/২২৭।
[17]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৪৮; আবূ দাঊদ, হা/২৬৩।
[18]. ছহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/১২৮; ইবনু উছায়মীন রাহিমাহুল্লাহ, হায়েয ও নিফাসের বিধান সংক্রান্ত ৯০টি ফতওয়া।
[19]. ইবনু উছায়মীন রাহিমাহুল্লাহ, হায়েয ও নিফাসের বিধান সংক্রান্ত ৯০টি ফতওয়া।
[20]. ইবনু উছায়মীন রাহিমাহুল্লাহ, হায়েয ও নিফাসের বিধান সংক্রান্ত ৯০টি ফতওয়া।