কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মুসলিম পরিবার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর (পর্ব-৯)

post title will place here

প্রশ্ন: সম্মানিত শাখ! স্ত্রীর সাথে রাত্রিযাপনের অপরিহার্যতা সম্পর্কে আমরা শুনে থাকি। এর দ্বারা উদ্দেশ্য কী? এক বিছানায় থাকা, না-কি এক ঘরে বা এক বাড়িতে অবস্থান করা?

উত্তর: এটি রীতি অনুযায়ী পার্থক্য হতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করো’ (আন-নিসা, ৪/১৯)। কিন্তু আল্লাহ তাআলার বাণী, ‘যদি তোমরা তাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা করো, তাহলে তাদেরকে সদুপদেশ দাও এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও’ (আন-নিসা, ৪/৩৪)- এটি দ্বারা প্রমাণিত হয়, পরিপূর্ণ ঘনিষ্ঠতা হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী এক বিছানায় ঘুমানো। কিন্তু যদি মাঝেমধ্যে একাকী বিছানায় থাকে, তাহলে সমস্যা নেই। তবে নিয়ম হচ্ছে, স্বামী তার স্ত্রীর সাথে এক বিছানায় থাকবে।

প্রশ্ন: সম্মানিত শায়খ! স্ত্রীর ইদ্দত কীভাবে সাব্যস্ত হবে? নির্জনতা, না-কি সহবাসের মাধ্যমে? যদি তাকে তালাক দেয়, তাহলে কি মোহর ফেরত চাইতে পারবে?

উত্তর: মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যখন কোনো মুমিনা নারীকে বিবাহ করবে, অতঃপর তাকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিবে’ (আল-আহযাব, ৩৩/৪৯)। এটি দ্বারা সহবাস উদ্দেশ্য। তবে খোলাফায়ে রাশেদার মতে, একজন ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীর সাথে নির্জনে একাকী থাকে, অতঃপর তার সাথে সহবাস করার পূর্বেই তালাক দেয়, তাহলে ঐ নারীর জন্য ইদ্দত পালন করা অপরিহার্য হয়ে যাবে। আর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনা অনুযায়ী খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত আমাদের জন্য অনুসরণীয়। এই বিধান জীবিত অবস্থায় তালাক বা অন্য কোনোভাবে স্ত্রীকে পৃথক করলে। আর কোনো ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীকে রেখে মারা যায়, তাহলে তার স্ত্রীর উপর ইদ্দত পালন করা এবং সাজসজ্জা ত্যাগ করা অপরিহার্য হয়ে যাবে, যদিও সেটি সহবাস ও নির্জনতার পূর্বে হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি মৃত্যুবরণ করে আর স্ত্রীকে রেখে যায়, তাহলে তার স্ত্রী ৪ মাস ১০ দিন অপেক্ষা করবে অর্থাৎ ইদ্দত পালন করবে’ (আল-বাক্বারা, ২/২৩৪)

মোহরের বিষয়ে বলব, সে যদি তার স্ত্রীকে সহবাস ও নির্জনতার পূর্বে তালাক দিয়ে থাকে, তাহলে সে অর্ধেক মোহর ফেরত পাবে। আর যদি সহবাস করার পরে তালাক দেয়, তাহলে কিছুই ফেরত পাবে না।

সে যদি মারা যায়, তাহলে তার স্ত্রী পূর্ণ মোহর পাবে, সহবাস বা নির্জনতার পূর্বে মারা যাক অথবা পরে মারা যাক। এ মোহরে উত্তরাধিকারীদের কোনো অংশ নেই।

প্রশ্ন: কোনো কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে কিছু নারীকে উপদেশ সম্বলিত ক্যাসেট ও পুস্তিকা বিতরণ করতে দেখা যায়। তাদের এ কাজ কি শরীআতসম্মত?

উত্তর: নির্দিষ্টভাবে শরীআতে এমন কিছু বর্ণিত হয়নি। তবে তাদের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কারণ, এমন উপলক্ষ্য ছাড়া নারীরা সাধারণত একত্রিত হয় না। সুতরাং এমন প্রোগ্রামে তাদের মধ্যে ক্যাসেট ও পুস্তিকা বিতরণ করা ভালো এবং এটি দাওয়াতের অন্যতম মাধ্যমও বটে।

তবে এসমস্ত ক্যাসেট ও পুস্তিকা নির্ভরযোগ্য, দ্বীনদার ও ছহীহ মানহাজের আলেমদের হওয়া অপরিহার্য।

প্রশ্ন: সম্মানিত শায়খ! বিয়ের অনুষ্ঠানে ওয়া-নছীহত করার ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

উত্তর: এমন প্রোগ্রামে নছীহত করার বিষয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো কিছু বর্ণিত হয়নি। কিন্তু যদি কোনো আলেমকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়, বিশেষ করে যার বক্তব্য মানুষ মনোযোগ দিয়ে শুনে এবং এমন প্রোগ্রামে তারা বিরক্তিবোধ না করে, তবে তাদের প্রয়োজনীয় হুকুম-আহকাম সম্পর্কে আলোচনা করতে বাধা নেই। কিন্তু খুব বেশি লম্বা করা যাবে না।

তবে ইসলামবিরোধী কোনো কিছু দেখলে উনি নিজে থেকেই তাদেরকে সতর্ক ও নছীহত করবেন। পাশাপাশি কেউ যদি তাকে কোনো মাসআলা নিয়ে প্রশ্ন করেন, তাহলে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে বাধা নেই ইনশাআল্লাহ।

প্রশ্ন: সম্মানিত শায়খ! কোনো কোনো নারীকে বিয়ের সংগীত গাইতে দেখা যায়। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী? এটি কি নিষিদ্ধের মধ্যে পড়বে?

উত্তর: শুধু আওয়াজ নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু যদি এমন অনুষ্ঠানে তাদের সুন্দর ও মিষ্টি কণ্ঠস্বর উঁচু হয় আর মানুষ বিয়ের উল্লাসে মত্ত থাকে, তবে সেক্ষেত্রে বড় ফেতনার আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং তাদের কাছ থেকে আওয়াজ না আসাই উত্তম হবে। বর্তমানে কিছু মানুষ তাদের বাসার বেলকুনি বা বারান্দায় মাইক সেট করে অন্যদেরকে কষ্ট দেয় এবং অস্থির করে তুলে। এটি অবশ্যই হারাম হবে।

মোদ্দাকথা হলো, এমন অনুষ্ঠানে মেয়েদের সংগীত পরিবেশনে বাধা নেই। তবে শর্ত হলো, বাদ্যযন্ত্র থেকে দূরে থাকতে হবে।

প্রশ্ন: সম্মানিত শায়খ! বিয়ের অনুষ্ঠানে নারীরা কি অন্য নারীদের সামনে নাচতে পারবে?

উত্তর: এটি মাকরূহ। প্রথমদিকে আমি এ বিষয়ে শিথিলতা করতাম। কিন্তু নাচের সময় কিছু অঘটন ঘটার সংবাদ শুনে আমি সম্পূর্ণভাবে এটিকে নিষেধ করে দিয়েছি। কোনো কোনো নারী খুবই হালকা, সুন্দর গড়নবিশিষ্ট ও কমনীয় হয়ে থাকে। তাদের নাচ দেখে অন্য নারীরা ফেতনায় পড়ে যায়। আমি শুনেছি, এমন সুন্দরী নারীর নাচ দেখে অন্য নারী তাকে বুকে জড়িয়ে চুমু দিয়েছে। আর এভাবেই স্পষ্ট ফেতনা সৃষ্টি হয়।

প্রশ্ন: সম্মানিত শায়খ! বাগদান উপলক্ষ্যে রিং পরানোর বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

উত্তর: এটি একটি আংটি। আর আংটি পরতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু যদি এর সাথে ভ্রান্ত বিশ্বাস যুক্ত হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। যেমন কিছু মানুষ আংটিতে তার নাম লিখে হবু স্ত্রীকে দেয়। সেও তার নাম আংটিতে লিখে তার হবু স্বামীকে দেয়। তাদের ধারণা, এটি তাদের বন্ধন দৃঢ় করবে। এমন বিশ্বাসে আংটি পরলে হারাম হবে। কারণ, এমন বিশ্বাসের ভিত্তি না শরীআতে আছে, না আছে বাস্তবে। তাছাড়া এ অবস্থায় ঐ নারীকে আংটি পরানো তার জন্য জায়েয নেই। কারণ, সে এখনও তার স্ত্রী হয়নি। আক্বদ ছাড়া স্ত্রী হওয়ার সুযোগও নেই।

প্রশ্ন: সম্মানিত শায়খ! আমরা জানি, নারীরা পরপুরুষের সামনে মুখমণ্ডল খোলা রাখতে পারবে না। কিন্তু হীহ মুসলিমে বর্ণিত নববধূ সম্পর্কিত হাদীছের বিষয়ে আপনার অভিমত কী? যেখানে একজন নারী রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এ উপস্থিতিতে তার হবু স্বামীর সামনে মুখ খোলা রেখে পানীয় এগিয়ে দিয়েছেন।

উত্তর: উক্ত হাদীছ অথবা অনুরূপ যেসব হাদীছে মহিলা ছাহাবীদের মুখ খোলার কথা বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো পর্দার আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বের ঘটনা। কারণ, পর্দার আয়াত কিছুটা দেরিতে ৬ষ্ঠ হিজরিতে নাযিল হয়েছে। এর আগে তাদের জন্য মুখমণ্ডল ও হাত ঢেকে রাখা অপরিহার্য ছিল না। সুতরাং পরপুরুষের সামনে মুখমণ্ডল খোলা রাখার ব্যাপারটি পর্দার আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বের। তবে কোনো কোনো হাদীছ দ্বারা বুঝা যায় যে, এটি পর্দার বিধান আসার পরও ঘটেছে। সেটি স্পষ্ট করা প্রয়োজন।

যেমন খাছ‘আমী নারীর ঘটনা, যিনি বিদায় হজ্জের সময় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসেছিলেন। ঐ সময় ফযল ইবনু আব্বাস বাহনে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে বসেছিলেন। তখন ফযল রাযিয়াল্লাহু আনহু সেই নারীর দিকে তাকাতে থাকেন এবং ঐ নারীও তার দিকে তাকাতে থাকেন। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফযলের চেহারা অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন।[1] যারা নারীদের মুখ খোলা রাখা জায়েয মনে করেন, তারা এই হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করেন। নিঃসন্দেহে এই হাদীছে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। এর দ্বারা জায়েয-নাজায়েয দুটোই প্রমাণিত হওয়া সম্ভব।

জায়েয হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। আর নাজায়েয হওয়ার কারণ হতে পারে, এই নারী ইহরাম অবস্থায় ছিলেন। আর ইহরাম অবস্থায় মুখ খোলা রাখার বিধান রয়েছে। তাছাড়া আমরা জানি না যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ফযল ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু ছাড়া অন্য কেউ তার দিকে তাকিয়েছেন। হাফেয ইবনে হাজার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নারীদের দিকে তাকানো ও তাদের সাথে নির্জনতার ক্ষেত্রে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য যে বিধান, অন্যদের জন্য তা কখনোই প্রযোজ্য হবে না। যেমনটি কোনো নারীকে মোহর বা ওলী ছাড়াই বিবাহ, চারের অধিক বিবাহ করা তার জন্য জায়েয করা হয়েছে। এসমস্ত বিষয়ে মহান আল্লাহ তাঁকে বিশেষভাবে প্রশস্ততা দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী। অন্য মানুষদের ক্ষেত্রে যেটি ঘটার সম্ভাবনা আছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতো পুণ্যবান ব্যক্তির ক্ষেত্রে সেটি ঘটা সম্ভব নয়।

একারণে আলেমগণের নিকট মূলনীতি হলো, কোনো আয়াত বা হাদীছে পরস্পর বিরোধী দুটি বিষয় বুঝার সম্ভাবনা থাকলে সেটি দ্বারা দলীল পেশ করা যাবে না। যেহেতু প্রশ্নে উল্লিখিত হাদীছটি অস্পষ্ট, সেকারণে সুস্পষ্ট দলীলের দিকে ফিরে যাওয়া অপরিহার্য। আর সুস্পষ্ট দলীল দ্বারা প্রমাণিত যে, স্বামী এবং মাহরাম ছাড়া অন্য পরপুরুষের সামনে একজন নারীর জন্য মুখমণ্ডল খোলা রাখা জায়েয নেই। এটি ফেতনা ও অনিষ্টের পথ খুলে দেয়। আপনারা জানেন, যেসব দেশে নারীদের মুখমণ্ডল খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেখানে কি বিষয়টি শুধু মুখমণ্ডলের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে? না; বরং মুখ, মাথা, ঘাড়, গলা, বাহু, নলা, বুক সবই উন্মুক্ত হয়ে গেছে। তারা এখন নারীদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। যদি মন্দের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়, তবে নিশ্চিত থাকুন! আপনি যদি দরজার একটি পাল্লা খুলেন, তাহলে বহু দরজা খুলে যাবে। কেউ সেটিকে আটকাতে পারবে না। কুরআন-সুন্নাহর বাণী ও বাস্তব যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নারীদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা ওয়াজিব।

আমি তাদের কথায় বিস্মিত হই, যারা বলে, নারীদের পা ঢাকা অপরিহার্য এবং হাতের কব্জি খোলা রাখা জায়েয। প্রশ্ন হলো, কোনটি ঢাকার গুরুত্ব বেশি? দুই হাতের কব্জি নয় কি? কেননা দুই হাতের কোমল কব্জি, সুন্দর সুন্দর আঙুলগুলো পায়ের থেকে বেশি আকর্ষণ সৃষ্টি করে।

আমি আরও বিস্মিত হই, যখন তারা বলে, নারীদের দুই পা ঢাকা ওয়াজিব, তবে মুখমণ্ডল খোলা রাখা জায়েয। প্রশ্ন হলো, কোনটি ঢাকার গুরুত্ব বেশি? এটা বলা কি যুক্তিসম্মত হবে, প্রজ্ঞাময় সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিকট থেকে পরিপূর্ণ নাযিলকৃত ইসলামী শরীআত নারীকে তার পা ঢাকা অপরিহার্য করে মুখমণ্ডল খোলা রাখার অনুমতি দিবে?

জবাব- না, হতেই পারে না। এটি হিকমতের পরিপন্থী। কারণ, নারীর পায়ের থেকে তার মুখমণ্ডলের প্রতি পুরুষের আকর্ষণ বহুগুণ বেশি থাকে। আমার মনে হয় না, কোনো মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তার পা সুন্দর, না-কি অসুন্দর এটি কেউ খোঁজ করবে। চেহারা বাদ দিয়ে পায়ের খোঁজ নেওয়া অসম্ভব; বরং তার মুখ দেখবে, ঠোঁট দুটো কেমন? চোখ দুটো কেমন? চেহারা বাদ দিয়ে পায়ের খোঁজ নেওয়া অসম্ভব। অতএব, নারীর মুখমণ্ডল হলো ফেতনার জায়গা।

তবে মুখমণ্ডলকে আওরাত বা লজ্জাস্থান বলার অর্থ এটা না যে, সেটি যৌনাঙ্গের মতো প্রকাশ করতে লজ্জা লাগবে; বরং উদ্দেশ্য হলো, মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা অপরিহার্য। কারণ, মুখমণ্ডল খোলার কারণে তার প্রতি আকর্ষিত হলে সে ক্ষতির শিকার হবে।

আমি তাদের কথায় বিস্মিত হই, যারা বলে, মাথার তিনটি বা তার কম চুল বের করে রাখা নারীদের জন্য নাজায়েয। অতঃপর তারা বলে, নারীরা তাদের সুন্দর মসৃণ ভ্রূ এবং ছায়াময়ী চোখের পাতা বের করে রাখতে পারবে। শুধু এটুকু নয়; বরং লিপস্টিকসহ বর্তমানে আরো সাজসজ্জার উপকরণ আছে সবকিছুই প্রকাশ করতে পারবে।

আমার বিশ্বাস, যে ব্যক্তি পুরুষের চাহিদা ও তার আকর্ষণের জায়গা সম্পর্কে জানে, তার পক্ষে সম্পূর্ণ প্রজ্ঞাপূর্ণ শরীআতের দোহাই দিয়ে নারীর দুই পা আবৃত করাকে আবশ্যক করে মুখমণ্ডল খোলার বৈধতা দেওয়া অসম্ভব।

এ বিষয়ে আমি বর্তমান যুগের আলেমদের মতামত দেখেছি। তারা মনে করেন, ভয়াবহ ফেতনা থেকে বাঁচতে নারীদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখার আবশ্যকতার উপর আলেমদের ঐকমত্য রয়েছে। নায়লুল আওতার প্রণেতা ইবনে রাসলান থেকে উল্লেখ করেছেন, আমরা বৈধ বললেও বর্তমানে মানুষের ঈমানের দুর্বলতা এবং অধিকাংশ নারীদের চারিত্রিক নিষ্কলুষতা না থাকাই তাদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা উচিত। তবে বর্তমান মুসলিমদের অবস্থা অনুযায়ী মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা ওয়াজিব বলাই শ্রেয়। কারণ, কোনো বৈধ বিষয় যদি হারামের মাধ্যম হয়, তখন ঐ মাধ্যমও হারাম হয়ে যায়।

আমি বিস্মিত হচ্ছি, একটি গোষ্ঠী যখন নারীদেরকে পর্দাহীনতার দিকে শক্তভাবে আহ্বান করছে, তখন এর ক্ষতিকর পরিণতি জানার পরও এভাবে শিথিল ফতওয়া দেওয়া কীভাবে আমাদের জন্য মানানসই হয়?

যে-কোনো বিষয়ে কথা বলার আগে আল্লাহকে ভয় করা উচিত। অনেক ছাত্র একটি বিষয় খেয়াল করে না। তাদের হয়তো পুঁথিগত জ্ঞান আছে, কিন্তু মানুষের সার্বিক অবস্থা ও পরিণতি বিবেচনা না করে শুধু বইয়ের জ্ঞানের আলোকে ফতওয়া দিয়ে বসে।

উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু কখনো কখনো সার্বিক কল্যাণ বিবেচনায় বৈধ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিতেন। যেমন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে এবং আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর যুগে ও উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফতের প্রথম দুবছর পর্যন্ত তিন তালাক এক তালাক সাব্যস্ত হতো। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি এক শব্দে অথবা একই মজলিসে পর পর তিন তালাক দিলে এক তালাক গণ্য করা হতো। কিন্তু মানুষের এক সাথে তিন তালাক দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেলে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, লোকেরা একটি বিষয়ে তাড়াহুড়ো করেছে, যাতে তাদের অবকাশ ছিল। এখন যদি বিষয়টি তাদের জন্য কার্যকর করে দেই, তবেই তা কল্যাণকর হবে। সুতরাং তিনি তা তাদের জন্য কার্যকর করলেন। অর্থাৎ তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দিলেন। কারণ, তারা তাড়াহুড়ো করেছে। আর তাড়াহুড়ো হারাম।

যদি কেউ মুখ খোলা রাখা বৈধও মনে করে, তবুও তার ইলমী আমানতের দাবি হচ্ছে, বর্তমান এ ফেতনার সময়ে এটিকে বৈধ না বলে হারামের মাধ্যম হওয়ার কারণে নাজায়েয আখ্যায়িত করাই শ্রেয়। যদিও কুরআন-সুন্নাহর স্পষ্ট ও তাত্ত্বিক দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুখ খোলা রাখা হারাম। শুধু তাই নয়, পা বা পায়ের নলা প্রকাশ করার চাইতে মুখমণ্ডল প্রকাশ করা অধিকতর হারাম।

প্রশ্ন: সম্মানিত শায়খ! কোনো ব্যক্তি বিয়ে করায় তার পিতা যদি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে বলপ্রয়োগ করে, তাহলে সে কি পিতার অবাধ্য হয়ে স্ত্রীকে রাখবে, না-কি তালাক দিয়ে পিতার অবাধ্য হওয়ার পাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করবে?

উত্তর: কোনো পিতা যদি তার পুত্রবধূকে তালাক দেওয়ার জন্য পুত্রকে আদেশ করে, তবে এক্ষেত্রে দুটি অবস্থা রয়েছে—

প্রথম অবস্থা: পিতা তালাক দেওয়ার যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করে তালাক দিতে বলেন। যেমন তিনি তার ছেলেকে বলবেন, তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দাও! কারণ, তার আচরণ সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। কোনো ছেলের সাথে প্রেম করে অথবা দূষিত অশ্লীল সমাজে যাতায়াত করে ইত্যাদি। এমন অবস্থায় পিতার কথামতো তার স্ত্রীকে তালাক দিবে। কেননা পিতা তার খেয়ালখুশি মতো তালাক দিতে আদেশ করেননি; বরং ছেলের বিছানাকে কলুষমুক্ত করতে চেয়েছেন।

দ্বিতীয় অবস্থা: পিতা ছেলেকে বলেন, তোমার স্ত্রীকে তালাক দাও! কারণ, ছেলে তার বউকে অনেক ভালোবাসে। ফলে পিতা ঈর্ষান্বিত হন। আর মায়ের মধ্যে ঈর্ষাবোধ তো আরও বেশি থাকে। স্ত্রীকে ভালোবাসলে মায়েরা খুবই ঈর্ষান্বিত হন, এমনকি ছেলের বউকে সতিন মনে করেন। এমতাবস্থায় পিতা-মাতার আদেশ মানা ন্যায়সঙ্গত হবে না; বরং স্ত্রীকে রেখে পিতা-মাতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তাদেরকে নম্র ভাষায় বুঝিয়ে পরিতুষ্ট করবে। বিশেষ করে স্ত্রী যদি দ্বীনদার ও সচ্চরিত্রা হয়, তাহলে তো তাকে তালাক দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

ইমাম আহমাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে হুবহু এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়। তাঁর কাছে একজন ব্যক্তি এসে বললেন, আমার পিতা আমার স্ত্রীকে তালাক দিতে বলছেন। ইমাম আহমাদ তাকে বললেন, তুমি তালাক দিয়ো না। লোকটি বললেন, উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন পুত্রবধূকে তালাক দেওয়ার জন্য ছেলেকে আদেশ করেন, তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে উমারকে কি তালাক দিতে বলেননি? জবাবে ইমাম আহমাদ বলেন, তোমার পিতা কি উমারের মতো?

কোনো পিতা যদি তার সপক্ষে উক্ত ঘটনা দ্বারা দলীল পেশ করেন, তবে তাকে ইমাম আহমাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মতো জবাব দিতে হবে। তবে তাকে নম্র ভাষায় বলাই ভালো হবে, উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বিশেষ কল্যাণার্থেই পুত্রকে এমন আদেশ করেছিলেন।

(ইনশা-আল্লাহ চলবে)

মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ছলেহ আল-উছায়মীন

অনুবাদ : ড. আব্দুল্লাহিল কাফী মাদানী

পিএইচডি, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫১৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৩৪।

Magazine