কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

সূরা আল-ফাতিহার তাফসীর (পর্ব-৩)

post title will place here

() সকল প্রশংসাআল্লাহর যিনি সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক

আরবী ভাষায় পবিত্রতা ও নির্মলতায় ভরা এবং শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমে পরিপূর্ণ প্রশংসা প্রকাশের এক অনুপম শব্দ ‘হামদ’। গুণ ভালোও হয় আবার মন্দও হয়, তবে ‘হামদ’ কেবল ভালো গুণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। মহাবিশ্বের যা কিছু সুন্দর, যত কিছু সৌন্দর্যমণ্ডিত, মাহাত্ম্যপূর্ণ; তা যে-কোনো স্থানে, যে-কোনো রূপে ও অবস্থায়ই থাকুক না কেন, তা কেবল আল্লাহ তাআলারই সৃষ্টি। তিনি ছাড়া আর কেউ এসবের স্রষ্টা হতে পারে না। সৌন্দর্যের বিচারে এসব সৃষ্টির কোনো তুলনা হয় না, কারণ এসবের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ। এর চেয়ে অধিক সুন্দরের কল্পনা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্যই উক্ত সূরার প্রথমেই ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বলে মহান আল্লাহর প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত, অকৃত্রিম শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে।

حمد (হামদ) শব্দটির দুটি অর্থ একটি ‘ছানা’ তথা প্রশংসা আর অপরটি ‘শুকর’ বা কৃতজ্ঞতা। একজন মুসলিম সর্বক্ষেত্রে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ ব্যবহার করে। তার কুশল বিনিময়, তার অবস্থা জানার উত্তর ও বিদায় গ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। আবার আনন্দদায়ক মুহূর্তেও এর ব্যবহার হয়। কোনো সুন্দর সৃষ্টি কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে প্রশংসায় আল হামদুলিল্লাহ বলা হয়। মহান আল্লাহর কী অপরূপ সৃষ্টি! বলে আল্লাহর প্রশংসা করা হয়।

কিন্তু কৃতজ্ঞতা ( (شكرসম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কৃতজ্ঞতা তখনই হয়, যখন কেউ অপরের জন্য কিছু করে। যখন এমন কিছু করে, যা অন্যের উপকারে আসে বা যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন, তখন শুকরিয়া আদায় করা হয়। যখন আপনি অপরের জন্য ভালো কিছু করেন, তখন সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

ইবনে জারীর আত্ব-ত্ববারী রাহিমাহুল্লাহ-এর মতে হামদ ও শুকর একই অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।[1] আর ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, হামদ ও শুকরের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। হামদ শুধু জিহ্বা আর শুকর জিহ্বা, হৃদয় ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে আদায় করতে হয়। অবদানের স্মরণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশে হৃদয়, জিহ্বা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করতে হয়। হামদ অবদানের বিনিময় কিংবা বিনিময় ছাড়া হতে পারে, কিন্তু শুকর শুধু অবদানের বিনিময়ে হয়ে থাকে। কারণ, পরবর্তী যুগের কোনো কোনো আলেমের মতে হামদ ব্যক্তির সেসব গুণের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, যেগুলো ব্যক্তির মাঝে থাকে এবং সেসব গুণের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়, যেসব গুণের প্রতিক্রিয়া নিজের থেকে অন্যের মাঝে প্রতিফলিত হয়। আর শুকর কেবল সেসব গুণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যেসব গুণের প্রতিক্রিয়া নিজের থেকে অন্যের মাঝে প্রতিফলিত হয়। এটি হৃদয়, জিহ্বা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেমন একজন কবি বলেছেন, আমার তিনটি অঙ্গ তোমাদের উপকার করেছে— আমার হাত, জিহ্বা ও অদৃশ্য হৃদয়।[2]

কিন্তু হামদ না শুকর কোনটি বেশি সাধারণ— এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। শব্দদ্বয়ের মধ্যে ‘আম-খাছের সম্পর্ক বিদ্যমান। অর্থাৎ উভয়টি এক দিক দিয়ে ‘আম বা সাধারণ আবার উভয়টি আরেক দিক দিয়ে খাছ বা বিশেষ অর্থজ্ঞাপন। ব্যবহারের ক্ষেত্র বিবেচনায় হামদ বেশি সাধারণ। কারণ এটি ব্যক্তির সেসব গুণের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, যেগুলো ব্যক্তির মাঝে থাকে এবং সেসব গুণের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়, যেসব গুণের প্রতিক্রিয়া নিজের থেকে মাঝে প্রতিফলিত হয়। যেমন- কেউ বলল, আমি তার বীরত্ব ও উদারতার প্রশংসা করেছি। আবার এটি উপকরণের বিবেচনায় বিশেষ। কারণ এটি জিহ্বা ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। আর উপকরণ বিবেচনায় শুকর সাধারণ, কেননা এটি হৃদয়, কথা ও কাজের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। আর এটি বিশেষ, কারণ এটি শুধু সেসব গুণের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, যেগুলো ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং অন্যের মাঝে সেসব গুণের প্রতিক্রিয়া অন্যের মাঝে প্রতিফলিত হয়। যেমন- আমি তাকে তার বীরত্বের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছি— এ কথা বলা যাবে না তবে উদারতা এবং দয়ার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি— একথা বলা যাবে।[3]

উপরের ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে, আবূ হেলাল আল-আসকারী হামদ ও শুকরের সংজ্ঞা দিয়েছেন, হামদ হলো সুন্দর কিছুর জন্য মৌখিক প্রশংসা, সেটা অভ্যন্তরীণ গুণাবলিকে শামিল করুক। যেমন- জ্ঞান কিংবা বাহ্যিক গুণাবলিকে শামিল করুক। যেমন- দানশীলতা। শুকর এমন একটি শব্দ, যা উপকারকারীর উপকারের প্রতিদানস্বরূপ শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে মৌখিক বর্ণনা, অন্তরের বিশ্বাস ও ভালোবাসা এবং বাহ্যিক সেবার মাধ্যমে।

ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ মাদারিজুস সালেকীন গ্রন্থে বলেছেন, শুকর প্রকার ও উপকরণের দিক দিয়ে সাধারণ এবং পরিপ্রেক্ষিতের বিচারে বিশেষ আর হামদ পরিপ্রেক্ষিতের দিক দিয়ে সাধারণ আর উপকরণের দিক দিয়ে বিশেষ। এর অর্থ হলো, শুকর হৃদয়ের বিনয় ও বশ্যতা স্বীকার, মৌখিক প্রশংসা ও অবদানের স্বীকৃতি প্রদান এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এর সম্পর্ক শুধু বাহ্যিক অবদানের সাথে; সত্তাগত গুণাবলির সাথে নয়। তাই আল্লাহর জীবন, শ্রবণশক্তি, দর্শনক্ষমতা ও জ্ঞানের জন্য ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি’ বলা যাবে না। এসবের কারণে তিনি প্রশংসিত, যেমনিভাবে দয়া ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য তিনি প্রশংসিত।[4]

শুকর কল্যাণ ও অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে হয়ে থাকে। যার সাথে শুকর সম্পৃক্ত, তার সাথে হামদ সম্পৃক্ত, কিন্তু যার সাথে হামদ সম্পৃক্ত, তার সাথে শুকর সম্পৃক্ত নয় এবং যার মাধ্যমে হামদ সংঘটিত হয়, তার মাধ্যমে শুকর সংঘটিত হয়, তবে এর বিপরীত হয় না। কারণ শুকর হয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আর প্রশংসা হয় জিহ্বার মাধ্যমে।

الحَمد এর মধ্যে যে ال রয়েছে, তা استغراق তথা ‘সমুদয়’ অর্থে ব্যবহার হয়েছে। প্রশংসার প্রত্যেকটি প্রকার আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। আর কেউ কেউ বলেন ال জিনসের জন্য। জাতিগতভাবে সমস্ত প্রশংসা তাঁরই। ‘হামদ’ এর সম্পর্ক শুধু নেয়ামত প্রাপ্তির সাথে নয়। আল্লাহর নেয়ামত পাওয়া যাক বা না পাওয়া যাক কিংবা নিজে বা অন্য কেউ পাক, সর্বক্ষেত্রে প্রশংসা আল্লাহর প্রাপ্য সেটিই হচ্ছে ‘হামদ’। এ প্রেক্ষিতে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বলে বান্দা যেন ঘোষণা করে, হে আল্লাহ! সব নেয়ামতের উৎস আপনি, আমি তা পাই বা না পাই, সকল সৃষ্টিজগতই তা পাচ্ছে; আর সেজন্য সকল প্রশংসা একান্তভাবে আপনার জন্য আর কারও নয়। কেউ আপনার প্রশংসা করলে আপনি প্রশংসিত হবেন আর কেউ প্রশংসা না করলে প্রশংসিত হবেন না, ব্যাপারটি এমন নয়। আপনি সর্বদা প্রশংসিত। প্রশংসা আপনার স্থায়ী গুণ। প্রশংসা আপনি ভালোবাসেন। আপনার প্রশংসা কোনো দানের বিনিময়ে হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।[5] ‘হামদ’ হলো অন্য সকল উপাস্য ব্যতীত একমাত্র একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এখানে أحْمَدُ الله ‘আমি আল্লাহর প্রশংসা করছি’ ব্যবহৃত না করে الْحَمْدُ لِلَّهِ ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর’ ব্যবহার করা হয়েছে। এর কারণ এই যে, আহমাদুল্লাহ বা ‘আমি আল্লাহর প্রশংসা করছি’ অর্থটি বর্তমান সময়ের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ আমি বর্তমানে আল্লাহর প্রশংসা করছি। অন্যদিকে আল-হামদুলিল্লাহ ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর’ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সকল কালকে শামিল করে।[6] এজন্যই হাদীছে الحَمْدُ لِلَّهِ -কে সর্বোত্তম দু‘আ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।[7] কারণ, উক্ত বাক্য সর্বকালকে ব্যাপৃত করে। অন্য হাদীছে এসেছে, وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلَأُ الْمِيزَانَ ‘আর ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ দাঁড়িপাল্লা পূর্ণ করবে’।[8] একটি হাদীছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-কে উত্তম যিকির বলা হয়েছে কিন্তু অপর হাদীছে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’-কে উত্তম দু‘আ বলা হয়েছে।[9] এজন্য রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিন ও রাতের যিকির এবং ছালাতের পর যিকির সর্বক্ষেত্রে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বলতে বলেছেন। ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ পূর্ণমাত্রার প্রশংসা হওয়ার কারণেই আল্লাহ এতে বেশি খুশী হন। বিশেষ করে নেয়ামত ভোগের পর ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বলে আল্লাহর প্রশংসা করতে হবে তাও আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছেন।[10] এভাবে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ সীমাহীন প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক অতুলনীয় রূপ।

সকল ‘হামদ’ আল্লাহর বলে একটি বড় সত্যের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রশংসার যোগ্য কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন, সেটা কোনো সৃষ্টির নিজস্ব নয়। কেননা, তার স্রষ্টা একমাত্র সেই আল্লাহ তাআলা, যিনি নিজ ক্ষমতায় তাকে সৃষ্টি করেছেন। বস্তুত সমস্ত সৌন্দর্য ও সকল কল্যাণের উৎস তিনি। মানবজাতি, ফেরেশতামণ্ডলী, গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্ররাজি, চন্দ্ৰ-সূৰ্য, রাত-দিন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইত্যাদির কোনোটিই আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়নি, বরং প্রত্যেকটিকে একমাত্র আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। অতএব, এসবের সৃষ্টির ক্ষেত্রে যত প্রশংসা হতে পারে, তা পাওয়ার একমাত্র যোগ্য হক্বদার আল্লাহ তাআলা। উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোয় যেহেতু আল্লাহর সাথে কারও অংশীদারিত্ব নেই, কাজেই এসব অবদানের প্রশংসায় আল্লাহর সাথে কারও অংশীদার হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। সৌন্দর্যদাতা, অনুগ্রহকর্তা, সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা ও ক্রমবিকাশক ইত্যাদির কারণে মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা, ইবাদত-বন্দেগী এবং দাসত্ব-আনুগত্য পেশের একমাত্র সত্তা আল্লাহ তাআলা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো শক্তি এসবের এক বিন্দুরও দাবিদার হতে পারে না। কারণ এক্ষেত্রে তাদের কোনো অবদান নেই। তাছাড়া ভালো বা মন্দ সকল অবস্থায় কেবল এক সত্তারই হামদ বা প্রশংসা করতে হয় আর তিনি হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা।[11] এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা হলো যে, কেউ যদি কোনো খারাপ কিছুর সম্মুখীন হয়, তখনও যেন বলে, الحَمْدُ لِلَّه عَلَى كُل حــــــال অর্থাৎ সর্বাবস্থায় আল্লাহর জন্যই যাবতীয় হামদ।[12]

কুরআন হাদীছ হতে সুস্পষ্টরূপে জানা যায় যে, সাধারণভাবে কোনো ব্যক্তির গুণ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এতটুকু প্রশংসাও করা যায় না, যাতে তার ব্যক্তিত্বকে অসাধারণ করে তোলা হয় এবং একপর্যায়ে সে আল্লাহর সমকক্ষতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মূলত এরূপ প্রশংসাই মানুষকে মানুষ পূজার কঠিন পাপে নিমজ্জিত করে। এজন্যই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমরা অতিরিক্ত প্রশংসাকারীদের দেখবে, তখন তাদের মুখে মাটি নিক্ষেপ করো’।[13] নতুবা তার মনে গৌরব ও অহমিকা ভাবের উদ্রেক হতে পারে। তখন হয়তো মনে করতে পারে যে, সে বহুবিধ গুণের অধিকারী, তার বিরাট যোগ্যতা ও ব্যাপক ক্ষমতা আছে। আর কোনো মানুষ যখন এই ধরনের খেয়াল নিজের মনে স্থান দেয়, তখনই তার পতন শুরু হয় এবং সে পতন হতে সে উদ্ধার হতে পারে না। তাছাড়া মানুষ যখন আল্লাহ ছাড়া অপর কারো গুণ বা সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার প্রশংসা করতে শুরু করে, তখন সে ভক্তি-শ্রদ্ধার জালে বন্দী হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সে মানুষের পূজনীয় বস্তুতে পরিণত হয়। এই অবস্থা মানুষকে শেষ পর্যন্ত চরম শিরকের পথে পরিচালিত করে। সেজন্যই যাবতীয় ‘হামদ’ একমাত্র আল্লাহর জন্যই করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।

‘আলামীন’ ‘আলাম’-এর বহুবচন। কোনো কোনো তাফসীরকার বলেন, ‘আলাম’ বলা হয় সেই জিনিসকে, যা অন্য জিনিস জানার মাধ্যম হয় বা যার দ্বারা অন্য কোনো বস্তু সম্পর্কে জানতে পারা যায়। সৃষ্টিজগতের প্রত্যেকটি বস্তুই এমন এক মহান সত্তার অস্তিত্বের নিদর্শন, যিনি সেই বস্তুর সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা, পৃষ্ঠপোষক ও সুব্যবস্থাপক। এজন্য সৃষ্টিজগতকে আলাম বলা হয়। ‘রব্বুল আলামীন’ বলতে কী বুঝায় এই আয়াতে তার ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়নি, তবে অন্য আয়াতে তা স্পষ্ট করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, قَالَ فِرْعَوْنُ وَمَا رَبُّ الْعَالَمِينَ - قَالَ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا إِنْ كُنْتُمْ مُوقِنِينَ ‘ফেরাউন বলল, রব্বুল আলামীন বলতে কী বোঝায়? মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, আসমান ও যমীন এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী সকল বস্তুর রব হলেন রব্বুল আলামীন, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (আশ-শুআরা, ২৬/২৩-২৪)। এই আয়াতে সৃষ্টিজগতের সব কিছুকে ‘আলামীন’ এর অন্তর্ভুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আসমান ও যমীনে এত ‘আলাম’ বিদ্যমান যে, মানুষ আজ পর্যন্ত এসব জগতের কোনো পরিসংখ্যান নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়নি। যেমন- মানব, জিন, ফেরেশতা, উদ্ভিদ, পশু ও পক্ষিকুল ইত্যাদি এক একটা জগৎ। এগুলো অসীম জগতের কয়েকটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত মাত্র। মানবজ্ঞান সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে একেবারেই সমর্থ নয়।[14]

رَبّ মহান আল্লাহর অন্যতম সুন্দর নাম। এর বাংলা অর্থ প্রতিপালক। এই বিশ্বজগতে অগণিত সৃষ্টি আছে, যাদের চাহিদা একে অপর থেকে অবশ্যই ভিন্নতর। প্রত্যেক জীবকে অবস্থা, পরিস্থিতি এবং প্রকৃতি ও দৈহিক গঠন অনুযায়ী তার চাহিদার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা যিনি করেন, তাকে রব বলে। এই অর্থে কোনো জিনিসের প্রতি সম্বন্ধ (ইযাফত) করা ব্যতীত রব এর ব্যবহার অন্য কারো জন্য বৈধ নয়। ‘রব’ শব্দটি আল-কুরআনে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সৃষ্টি করা, সজ্জিত করা, স্থাপন করা, প্রত্যেকটি জিনিসের পরিমাণ নির্ধারণ করা, পথ প্রদর্শন করা, বিধান প্রদান করা, কোনো জিনিসের মালিক হওয়া, লালনপালন করা, রিযিক্ব দান করা ও উচ্চতর ক্ষমতার অধিকারী হওয়া ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাছাড়া ভাঙা-গড়ার মালিক হওয়া, জীবনদান করা, মৃত্যু দান করা, সন্তান দেওয়া, আরোগ্য প্রদান করা ইত্যাদি অর্থও এর মধ্যে নিহিত আছে। আর যার মধ্যে একসঙ্গে এই সবকিছু করার ক্ষমতা বিদ্যমান, তিনিই রব। যেমন কুরআন মাজীদের সূরা আল-আ‘লায় অনুরূপ ব্যাপক অর্থে রব শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেন,سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى - الَّذِي خَلَقَ فَسَوَّىٰ - وَالَّذِي قَدَّرَ فَهَدَىٰ ‘পবিত্রতা ঘোষণা করো তোমার সুমহান রবের নামের, যিনি সৃষ্টি করেছেন অতঃপর যথাযথভাবে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং যিনি প্রত্যেকটি জিনিসের পরিমাণ সঠিকরূপে নির্ধারণ করেছেন, অতঃপর তাকে পথ দেখিয়েছেন’ (আল-আলা, ৮৭/১-৩)। এই আয়াত হতে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, রব তাকেই বলতে হবে, যার মধ্যে সৃষ্টি করার, সৃষ্টির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিন্যস্ত ও সজ্জিত করার, প্রত্যেকটির পরিমাণ নির্ধারণ করার, হেদায়াত দানের, শারঈ বিধিবিধান প্রদান করার যোগ্যতা রয়েছে। যিনি নিজ ক্ষমতায় সমগ্র সৃষ্টিজগতকে শুধু সৃষ্টিই করেননি, বরং প্রত্যেক সৃষ্টিকে এমন বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা দান করেছেন, যার মাধ্যমে সে যথাযথভাবে অভিযোজিত হতে পারে এবং তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে পরস্পরের সহিত এমনভাবে সংযুক্ত করতে পারে যে, সেগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নিজ নিজ স্থানে সন্নিবেশিত হয়ে যায়। রব তিনিই, যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে কর্মক্ষমতা এবং সেই সঙ্গে তাকে একটি নির্দিষ্ট কাজ ও দায়িত্ব প্রদান করেন। প্রত্যেকের জন্য তার নিজের ক্ষেত্র ও সীমানা নির্ধারণ করে দেন। আল্লাহ বলেন, وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا ‘আর তিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং তার পরিমাণ ঠিক করেছেন’ (আল-ফুরক্বা, ২৫/)

অতএব, এক ব্যক্তি যখন আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করে, তখন সে প্রকারান্তরে এ কথারই ঘোষণা করে যে, আমার বাহ্যিক, অভ্যন্তরীণ, দৈহিক, আধ্যাত্মিক, দ্বীনী ও বৈষয়িক যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করার দায়িত্ব ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই গ্রহণ করেছেন। আমার এই সবকিছু একমাত্র তাঁরই মর্জির উপর নির্ভরশীল। আমার সবকিছুর একচ্ছত্র মালিক তিনিই। আর কেউ তার কোনো কিছু পূরণ করার অধিকারী নয়। বস্তুত সৃষ্টিলোকে আল্লাহর দু’ধরনের রুবূবিয়্যাতের কার্যকারিতা বিদ্যমান। যথা- সাধারণ রুবূবিয়্যাত বা প্রকৃতিগত এবং বিশেষ রুবূবিয়্যাত বা শরীআতগত।

(ক) প্রকৃতিগত বা সৃষ্টিমূলক: মানুষের জন্ম, তার লালনপালন ও ক্রমবিকাশ ঘটানো, তার শরীরকে অসম্পূর্ণতা হতে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর করা এবং তার মানসিক বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন করা।

(খ)শরীতভিত্তিক: মানুষের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রকে পথ প্রদর্শন করা, ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য নির্দেশনার জন্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করা। যাঁরা মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রতিভার পূর্ণতা সাধন করেন। তাঁদেরই মাধ্যমে তারা হালাল, হারাম ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত হন। নিষিদ্ধ কাজ হতে দূরে থাকতে এবং কল্যাণকর কাজের সন্ধান লাভ করতে পারেন।

অতএব, আল্লাহ তাআলার মানুষের রব হওয়ার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ব্যাপক। কেননা আল্লাহ তাআলা মানুষের রব হওয়া কেবল এজন্যই নয় যে, তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তার দেহের গঠন প্রদান করেছেন এবং তার দৈহিক শৃঙ্খলাকে স্থাপন করেছেন। বরং এজন্যও তিনি রব যে, তিনি মানুষকে আল্লাহর বিধান মোতাবেক জীবন যাপনের সুযোগ তৈরি করেছেন, তাদের হেদায়াতের জন্য নবী প্রেরণ করেছেন এবং নবীর মাধ্যমে সেই ইলাহী বিধান দান করেছেন।

(চলবেইনশা-আল্লাহ)


[1]. তাফসীর আত্ব-ত্ববারী, ১/১৩৮।

[2]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ১/১৩২।

[3]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ১/১৩২।

[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন, ২/২৪৬।

[5]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ১/১৩২; তাফসীর আত্ব-ত্বাবারী, ১/১৩৮।

[6]. তাফসীর আত্ব-ত্ববারী, ১/১৩৮।

[7]. তিরমিযী, হা/৩৩৮৩।

[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২৩।

[9]. তিরমিযী, হা/৩৩৮৩; ইবনু মাজাহ, হা/৩৮০০।

[10]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৮০৫।

[11]. তাফসীর আত্ব-ত্ববারী, সূরা ফাতিহার তাফসীর, ১/১৩৮।

[12]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৮০৩।

[13]. আহমাদ, হা/৫৬৮৪; ইবনু হিব্বান, হা/৫৭৭০।

[14]. কুরতুবী, ফাতহুল ক্বাদীর।

Magazine