মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হিজরত তথা ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে যে সূরাগুলো অবতীর্ণ হয়, সেগুলোকে মাক্কী সূরা বলে। মোদ্দাকথা, মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাক্কী জীবনের ১৩টি বছরে যে সূরাগুলো অবতীর্ণ হয়, সেগুলোকে মাক্কী সূরা বলে।
‘তাফসীর’ শব্দটি يفسّر-فسّر থেকে এসেছে, এর অর্থ ব্যাখ্যা করা। আর ‘ফা’-এর জায়গায় ‘সীন’ আনলে তথা فسّر না বলে سفر থেকে নির্গত হলে এর অর্থ হবে আলোকিত হওয়া, উজ্জ্বল হওয়া। ভ্রমণ করলে অনেক অজানা ঘটনা, বিভিন্ন স্থানের প্রকৃতিগত অবস্থা, মানুষের আচার-আচরণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এসব কারণে সফরকে সফর বলা হয়।
সূরা শব্দের অর্থ খণ্ড। যেহেতু সূরা কুরআন মাজীদের অংশ, তাই একে সূরা বলা হয়ে থাকে। আবার সূর শব্দের অর্থ শহরের প্রান্তে স্থাপিত প্রাচীর, যার মাধ্যমে শহরকে রক্ষা করা হয়। যেহেতু একটি সূরা অপর সূরার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষেত্রে প্রাচীর হিসেবে কাজ করে তাই সূরাকে সূরা বলা হয়।
সূরা ফাতিহার ফযীলত:
এটি ছালাতের একটি স্তম্ভ এবং এটি ছাড়া ছালাত শুদ্ধ হয় না। উবাদা ইবনু ছামেত রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না, তার ছালাত হয় না’।[1] ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীছটি সুনির্দিষ্টভাবে সূরা ফাতিহা পাঠের ওয়াজিব হওয়াকে নির্দেশ করে। সূরা ফাতিহা পাঠে অক্ষম ছাড়া কারও জন্য এর পাঠ ব্যতীত ছালাত বিশুদ্ধ হবে না। অন্য বর্ণনায় আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘প্রত্যেক যে ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা হয় না, সেটা অসম্পূর্ণ’।[2]
এটি কুরআনের সবচেয়ে সম্মানিত ও শ্রেষ্ঠ সূরা। এটি এমন একটি সূরা, যার মতো সম্মানিত সূরা কোনো ইলাহী গ্রন্থে অবতীর্ণ হয়নি। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উবাই ইবনু কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বললেন, ‘তুমি কি চাও যে আমি তোমাকে এমন একটি সূরা শিক্ষা দিই, যা তাওরাত, ইনজীল, যাবূর এমনকি ফুরক্বানেও (কুরআনে) অবতীর্ণ হয়নি?’ তিনি বললেন, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ছালাতে কীভাবে পাঠ করো?’ অতঃপর তিনি উম্মুল কিতাব তথা সূরা ফাতিহা পড়ে শোনালেন। তখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ! তাওরাত, ইনজীল, যাবূর এমনকি ফুরক্বানেও অনুরূপ কোনো সূরা নাযিল হয়নি আর সেটি হলো সাবউল মাছানী ও মহান কুরআন’।[3]
সূরা ফাতিহা আল-কুরআনের সবচেয়ে মহান সূরা। কারণ এতে কুরআনের মর্মার্থ বর্ণিত হয়েছে। এ কারণেই আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এটি আল-কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা। এর আয়াতগুলো এত মর্যাদাবান যে, এগুলো বারবার পাঠ করা হয়। আবূ সাঈদ ইবনুল মুআল্লা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি যখন ছালাত আদায় করছিলাম, তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি আমাকে ডাকলেন, কিন্তু আমি ছালাত পড়া শেষ না করে তাঁর কাছে আসিনি। অতঃপর আমি তাঁর নিকট আসলে তিনি বললেন, ‘কীসে তোমাকে আমার কাছে আসতে বাধা দিল?’ আমি বললাম, আমি ছালাত আদায় করছিলাম। তিনি বললেন, ‘আল্লাহ কি বলেননি, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দাও, যদি তিনি তোমাদেরকে ডাকেন, তাঁর ডাকার উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন?’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাকে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা শিক্ষা দিব না?’ অতঃপর তিনি আমার হাত ধরলেন এবং যখন তিনি মসজিদ থেকে বের হতে চাইলেন, তখন আমি বললাম, আপনি কি বলেননি আমি অবশ্যই অবশ্যই তোমাকে আল-কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা শিখাব? তিনি বললেন, ‘আল-হামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামীন— এটাই বারবার পঠিত সাতটি আয়াত এবং মহান কুরআন, যা আমাকে দেওয়া হয়েছে’।[4]
সূরা ফাতিহা ঐ মহান সূরা, যার অবতরণে আল্লাহ তাআলা বিশেষ আয়োজন করেন। আকাশ থেকে দরজা খুলে বিশেষ ফেরেশতা প্রেরণের মাধ্যমে এই সূরা অবতীর্ণ করেন। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণিত রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বসে ছিলেন, তখন তিনি তাঁর উপর থেকে কিছু শুনতে পেলেন, তাই তিনি মাথা তুলে বললেন, ‘এটি আসমানের একটি দরজা, যা আজকে খোলা হয়েছে। আজকের আগে কখনও খোলা হয়নি। সেখান থেকে একজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়ে বললেন, ইনি একজন ফেরেশতা, যিনি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন; আজ ব্যতীত কখনও তিনি অবতরণ করেননি। তাই তিনি তাকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, এমন দুইটি নূরের সুসংবাদ নিন যা আপনাকে দেওয়া হয়েছে; আপনার পূর্বে আর কোনো নবীকে দেওয়া হয়নি। তা হলো সূরা ফাতিহা এবং সূরা আল-বাক্বারার শেষাংশ। আপনি যখনই এর থেকে একটি অক্ষরও পড়বেন, তখনই আপনাকে এর প্রতিদান দেওয়া হবে’।[5]
আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ফাতিহাকে আল-কুরআনের শ্রেষ্ঠ সূরা বলে ঘোষণা করেছেন। ইবনু জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট (এমন সময়) গেলাম, যখন তাঁর প্রস্রাবের বেগ ছিল। আমি বললাম, আস-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি আমার কথার উত্তর দিলেন না। আমি বললাম, আস-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। আমি বললাম, আস-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিন্তু তিনি আমার কথায় সাড়া দিলেন না। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাঁটতে শুরু করলেন এবং আমি তাঁর অনুসরণ করলাম, যতক্ষণ না তিনি তাঁর বাসায় প্রবেশ করলেন। তারপর আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। আমি বিষণ্ন ও দুঃখিত হয়ে বসে পড়লাম। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এলেন এবং পরিশুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘ওয়া আলাইকাস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ, ওয়া আলাইকাস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ, ওয়া আলাইকাস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ’। অতঃপর বললেন, ‘হে আব্দুল্লাহ ইবনে জাবের! আমি কি তোমাকে আল-কুরআনের সর্বোত্তম সূরার সংবাদ দিব না?’ আমি বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! অতঃপর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ফাতিহা শেষ পর্যন্ত পড়ে শুনালেন।[6] আনাস ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি পথে ছিলেন। তিনি নিচে নেমে গেলেন, একজন লোক তাঁর পাশে নেমে এসে বললেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘তোমাকে কি উত্তম কুরআন বলব না?’ তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর তিনি আল-হামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামীন তেলাওয়াত করলেন।[7]
এই সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। কারণ সূরা হিজর মাক্কী সূরাগুলোর একটি। এটি হলো বারবার পঠিত সেই সাতটি আয়াত সংবলিত সূরা, যার সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِنَ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنَ الْعَظِيمَ ‘আর আমি আপনাকে বারবার পঠিত সাতটি আয়াত এবং মহান কুরআন দিয়েছি’ (আল-হিজর, ১৫/৮৭)।
হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, এটিকে মাছানী বলার বিষয়ে মতভেদ আছে। এর একটি কারণ হলো, এটি প্রতি রাকআতে পুনরাবৃত্তি করা হয়। আর কেউ কেউ বলেন, এর দ্বারা মহান আল্লাহর প্রশংসা করা হয়, তাই মাছানী বা প্রশংসামূলক সূরা বলা হয়। কেউ কেউ বলেন, সূরাটি এই উম্মতের জন্য একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবস্থা, যা অন্যান্য জাতির জন্য করা হয়নি।
এখানে মহান আল্লাহর প্রশংসা, গুণ ও মহিমা বর্ণনার সাথে তাঁর দাসত্ব ও একত্বকে সংযুক্ত করে তাঁর নৈকট্য চাওয়া হয়েছে। তারপরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি এবং সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষার বিষয় আনা হয়েছে। আর তা হচ্ছে, তাঁর নিকট সঠিক পথের সন্ধান চাওয়া হয়েছে। সুতরাং কোনো দাঈর ডাক যদি এরূপ বৈশিষ্ট্যের হয়; তবে তার সাড়া না পাওয়ার কোনো কারণ নেই৷[8]
সংক্ষিপ্ত হলেও এখানে তাওহীদের তিন প্রকারের প্রতিটির আলোচনা স্থান পেয়েছে। ‘তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত’-এর বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা ‘আল-হামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামীন’ বলেছেন। তাওহীদুর উলূহিয়্যাত বা ইবাদতের যোগ্য হওয়ার একত্বের বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘ইয়্যাকা না‘বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতাঈন’ এবং নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন ‘আর-রহমানির রহীম ও মালিকি ইয়াওমিদ্দ্বীন’। অতএব বুঝা গেল, উক্ত তিন প্রকারের তাওহীদই এই সূরায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।[9]
সূরাটি হৃদয় ও দেহের নিরাময় উভয় নিরাময়কেই অন্তর্ভুক্ত করে। ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, হৃদয়ের নিরাময় বলতে হৃদয়ের পূর্ণ মাত্রার নিরাময়কে বুঝায়। কারণ এর অসুস্থতা ও রোগাক্রান্ত হওয়া দুটি নীতির উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে, তা হলো একটি জ্ঞানের কলুষতা আর অপরটি উদ্দেশ্যের কলুষতা। এর ফলে দুটি মারাত্মক রোগের সৃষ্টি হয়, তা হলো একটি পথভ্রষ্টতা আর অপরটি ক্রোধ। পথভ্রষ্টতা হলো জ্ঞানের কলুষতার আর ক্রোধ হলো উদ্দেশ্যের পথভ্রষ্টতার ফল। এই দুটি রোগ হৃদয়ের সকল রোগের নিয়ন্ত্রক। সুতরাং ছিরাতে মুস্তাক্বীমের হেদায়াত পাওয়া নির্ভর করে হৃদয়ের পথভ্রষ্টতা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপর। অতএব, এই হেদায়াত চাওয়া প্রত্যেক বান্দার জন্য সবচেয়ে বড় ফরয। প্রতিদিন প্রতিটি ছালাতে আল্লাহর নিকট এই হেদায়াত চাইতে হবে। এর তীব্র প্রয়োজনীয়তা এবং কাঙ্ক্ষিত হেদায়াত লাভের প্রচণ্ডতার কারণে অন্য কোনো কিছু চাওয়ার স্থান এখানে হয়নি। ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই সাহায্য চাই’ আয়াতটি আল্লাহর পরিচয়, তাঁর কার্যক্রম ও অবস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে হৃদয় ও নিয়্যতের কলুষমুক্তি শামিল করে।
শারীরিক নিরাময় ঐ সকল বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে, যার বর্ণনা হাদীছ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের নিয়মে এসেছে আর অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণিত। হাদীছের প্রমাণ হলো আবূ সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েত। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একদল ছাহাবী আরবের একটি গোত্রপ্রধান যে সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছিল, তার নিরাময়ে সূরা ফাতিহা দিয়ে ঝাড়ফুঁক করেন; ফলে সে আরোগ্য লাভ করে। তখন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সূরা ফাতিহা তাকে ওষুধের প্রয়োজনীয়তা থেকে রক্ষা করেছে। অনেক সময় সূরা ফাতিহার ঝাড়ফুঁক এমন পর্যায়ের নিরাময় দান করে, যা ওষুধ করতে পারে না। এমন ফলাফল অসম্ভব পরিস্থিতিতে ঘটেছে। কারণ উক্ত গোত্রের লোকেরা যে শুধু অমুসলিম ছিল তা নয়, বরং তারা কৃপণ ও নিকৃষ্ট ছিল। আর যদি ক্ষেত্রটি সম্ভাব্য হতো, তবে ফলাফল কত ইতিবাচক হতো!’[10]
তারপর তিনি বললেন, ‘আমি যন্ত্রণাদায়ক ব্যথায় ভুগতাম, যা আমার নড়াচড়া করা প্রায় বন্ধ করে দিত। তাওয়াফ এবং অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে এমনটি হতো। তাই আমি দ্রুত সূরা ফাতিহা পাঠ করতাম এবং তা দিয়ে ব্যথার জায়গায় এমনভাবে বুলাতাম যেন একটি নুড়ি পাথর তার উপর পড়ত। এমনটি আমি অনেকবার করেছি। আমি যমযমের এক কাপ পানি নিয়ে তার উপর অনেকবার সূরা ফাতিহা পাঠ করে তা পান করতাম। এতে আমি এমন শক্তি দেখতে পেতাম, যা ওষুধে দেখিনি’।[11]
এই সূরা বিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের সকল ভ্রান্তপন্থিদের মতামত খণ্ডন এবং এ উম্মতের ধর্মভ্রষ্ট ও বিদআতী লোকদের যুক্তি খণ্ডন অন্তর্ভুক্ত করে। এটি দুটি উপায়ে শেখানো হয়, তা হলো সাধারণ এবং বিস্তারিতভাবে।
এর ব্যাখ্যা এই যে, সরল পথের মধ্যে রয়েছে সত্যকে জানা, তাকে প্রাধান্য দেওয়া, একে অন্যের চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া, তাকে ভালোবাসা, তার প্রতি আনুগত্য করা, তার দিকে আহ্বান করা এবং যথাসম্ভব তার শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। বাস্তব সত্য হলো সেই সত্য, যার উপর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর ছাহাবীগণ ছিলেন এবং যার আলোচনা আল্লাহর নাম, তাঁর গুণাবলি, তাঁর মহিমা, তাঁর একত্ব, তাঁর আদেশ, তাঁর নিষেধাজ্ঞা, তাঁর প্রতিশ্রুতি ও তাঁর হুমকির অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে। এর আলোকেই আমল করার আদেশ করা হয়েছে। আর ঈমানের ঐ গভীর স্তরে তার আলোচনা এসেছে, যে স্তরগুলো মহান আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারীদের বিচরণ স্তর। হক্ব সম্পর্কিত উল্লিখিত বর্ণনা আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল; তবে মানুষের মতামত, অবস্থা, মতবাদ ও পরিভাষা পরিহার করা হয়েছে।[12] সকল আসমানী কিতাবের সারমর্ম সূরা ফাতিহায় রয়েছে।[13]
সূরা ফাতিহা সবচেয়ে দরকারি দু‘আ শামিল করে। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, যদি সবচেয়ে উপকারী দু‘আ নিয়ে ভাবা হয়, তবে সেটা অসুস্থতা থেকে মুক্তি চাওয়ার দু‘আ। তিনি বলেন, ‘আমরা আপনারই ইবাদত করি এবং আপনারই সাহায্য চাই’ সূরা ফাতিহার এই আয়াতে উক্ত দু‘আর সন্ধান পেয়েছি।[14] সংক্ষেপে সূরা ফাতিহা উভয় জগতের সমস্ত কল্যাণ ও সুখের চাবিকাঠি।
ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এটি হলো কিতাবের সূচনা, কুরআনের জননী, বারবার পঠিত, সম্পূর্ণ নিরাময়কারী, উপকারী ওষুধ, পূর্ণাঙ্গ ঝাড়ফুঁক, সম্পদ ও সাফল্যের চাবিকাঠি, শক্তির সংরক্ষক, দুশ্চিন্তা ও আশঙ্কার সংহারক, কষ্ট ও ভয়ের বিনাশকারী সেই ব্যক্তির জন্য, যে এর মূল্য জানে, একে মর্যাদা দেয়, অসুস্থতা থেকে মুক্তিতে একে ব্যবহার করে, সুস্থতা লাভ ও চিকিত্সায় একে প্রয়োগ করে এবং এর ঐ গোপন রহস্য জানে, যার জন্য এর এত সম্মান।
একদল ছাহাবী যখন তারা এর রহস্য সম্পর্কে জানলেন, তখন তারা সাপের কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে এর দ্বারা ঝাড়ফুঁক করলেন। সাথে সাথে লোকটি সুস্থ হয়ে গেল। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘তুমি কীভাবে জানলে এর দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা যায়?’ এক কথায় বলা যায়, সকল কল্যাণের চাবিকাঠি এবং উভয় জগতে সাফল্যের মূলমন্ত্র হলো এই সূরা।
ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, যে ব্যক্তি ইলাহী তাওফীক্ব লাভ করে এবং অন্তর্দৃষ্টির আলোয় আলোকিত হয়, সে সূরাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, এর আলোচ্য বিষয় তথা আল্লাহর একত্ব, তাঁর সত্তাগত পরিচয়, তাঁর নাম ও গুণাবলির বর্ণনা, তাঁর কর্মের বিবরণ, তাঁর আইনের প্রয়োগ, তাঁর ভাগ্য নির্ধারণ, বিচারদিবসে তাঁর মালিকানা, তাঁর প্রভুত্ব, একত্বে তাঁর বিমূর্ততা, তাঁর প্রতি পূর্ণাঙ্গ আস্থা, সকল কাজের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে অর্পণ, একমাত্র তাঁরই প্রশংসা, সকল কল্যাণ তাঁর হাতে, তাঁর প্রতি সকল কাজের প্রত্যাবর্তন, তাঁর নিকট সঠিক পথের অন্বেষণ, উভয় জগতের কল্যাণ লাভ ও তাদের ক্ষতি থেকে মুক্তির জন্য এর অর্থ সংযুক্তি, ব্যাপক শুভ পরিণাম এবং এর সাথে সম্পৃক্ত পরিপূর্ণ নিয়ামত লাভ ইত্যাদি উপলব্ধি করতে পারে। এটি তাকে নানাবিধ ওষুধ ও ঝাড়ফুঁক থেকে মুক্তি দেয়, তার কল্যাণের দরজা খুলে দেয় এবং ক্ষতির উপকরণগুলো প্রতিহত করতে তাকে সাহায্য করে।[15]
আমাদেরকে সূরা ফাতিহার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে। পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাত এবং অন্যান্য নফল ছালাতে সূরা ফাতিহার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে তেলাওয়াত করতে হবে। আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে গভীর একাগ্রতা অর্জন করতে হবে। আমাদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয় ছিরাতে মুস্তাক্বীমের সন্ধান লাভের জন্য সাধনা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে ছিরাতুল মুস্তাক্বীম সন্ধান লাভ করার তাওফীক্ব দিন। ছিরাতে মুস্তাক্বীমের যাত্রী আমরা যেন ইহকালে কল্যাণ ও পরকালে মুক্তি লাভ করতে পারি, সে তাওফীক্ব আল্লাহ আমাদের দান করুন- আমীন!
(ইনশা-আল্লাহ চলবে)
মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল
প্রভাষক (আরবী), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বরিশাল।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৫৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৯৪।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৯৫।
[3]. তিরমিযী, হা/২৮৭৫; নাসাঈ, হা/১১২০৫; আহমাদ, হা/৯৩৪৫।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪৭৪।
[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮০৬।
[6]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৫৯৭।
[7]. নাসাঈ, সুনানুল কুবরা, হা/৮০১১; ইবনু হিব্বান, হা/৭৭৪; মুসতাদরাকে হাকেম, হা/২০৫৬।
[8]. মাদারিজ আস-সালিকীন, ১/২৪।
[9]. মাদারিজ আস-সালিকীন, ১/২৪-২৭।
[10]. মাদারিজ আস-সালিকীন, ১/৫২-৫৫।
[11]. মাদারিজ আস-সালিকীন, ১/৫৮।
[12]. মাদারিজ আস-সালিকীন, ১/৫৮।
[13]. মাদারিজ আস-সালিকীন, ১/৭৪।
[14]. মাদারিজ আস-সালিকীন, ১/৭৪।
[15]. জাদুল মাআদ, ৪/৩১৮।