তৃতীয় বিষয়, আসমানী কিতাবে নৈতিক আদর্শের শিক্ষা:
প্রথম শর্ত হলো বিভিন্ন ধর্মে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা:
নৈতিকতা মানবজীবনে মৌলিক কল্যাণ বয়ে আনে, তাই যখন মানুষের নৈতিক কাঠামো সঠিক হয় এবং তা বাস্তবায়নের গ্যারান্টি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সে তার দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয় এবং সুখী জীবন লাভ করে। কিন্তু নৈতিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হলে বা বাস্তবায়নের গ্যারান্টি না থাকলে মানুষ দুর্দশার কবলে পতিত হয়। ইসলামী বিধান অনুযায়ী সেই ব্যক্তির কথা যুক্তিনির্ভর, যিনি নির্ভুল নৈতিক কাঠামোর আলোকে মহাবিশ্বকে দেখেন। কারণ ভালো কিংবা মন্দ, আমল যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন তা নিরর্থক হারিয়ে যাওয়া অসম্ভব। যখন বলা হয়, মহাবিশ্বের সিস্টেম একটি নৈতিক সিস্টেম, তখন এর অর্থ হলো প্রথমত মানুষ যে কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে তা ভালো হোক বিংবা মন্দ হোক তার প্রভাবের আলোকে মহাবিশ্বের কার্যক্রম আবর্তিত হয় এবং দ্বিতীয়ত এই ভালো ও মন্দ কাজের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা মানুষের কর্মকাণ্ডকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন, যাতে কাজের ভালো-মন্দের আলোকে তাকে প্রতিদান দেওয়া যায়। যদি কোনো ব্যক্তি উক্ত বিষয়দ্বয়ে বিশ্বাস করে, তবে সে বিদ্যমান জগতের উপর একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম নৈতিক শৃঙ্খলার আধিপত্যের উপর বিশ্বাস করল।
এখানে লক্ষণীয় যে, জমহূর উলামা এবং ইসলামী চিন্তাবিদগণ নৈতিকতার প্রভাব বা জীবনে এর গঠনমূলক ভূমিকাকে অস্বীকার করেন না। বিংশ শতাব্দীর আলেমদেরকে অধিবিদ্যা এবং আত্মিক জগতে বিশ্বাস করতে যে কারণটি আবশ্যিকভাবে আহ্বান করেছে, তা হলো সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা, যা দর্শন ও শিল্পনীতির প্রচার এবং নৈতিক আইন বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা বিদ্যমান না থাকার ফল। নৈতিকতা সমগ্র বিশ্বে ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রসারিত করে, হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে, প্রতিভাকে উন্মুক্ত করে, আত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং সবাইকে এক পরিবারের ভাই ও সদস্য করে তোলে। যেমনভাবে এটা মানুষকে কল্যাণ ও ভালো কাজে উৎসাহিত করে তোলে এবং তাকে আধ্যাত্মিক মর্যাদার আসনে আসীন করে, যাতে সে ফেরেশতাদের দলভুক্ত বা এর চেয়ে উচ্চতর অবস্থানের অধিকারী হয়।
দ্বিতীয় শর্ত হলো ইসলাম ও নৈতিকতার স্থায়িত্ব:
যেকোনো নিরপেক্ষ গবেষকের নিকট এটা পরিষ্কার যে, মানুষের পরিপূর্ণতা, তার জ্ঞান অর্জন এবং মর্যাদা সমুন্নত করা ইসলামী বিধানের অংশ। যদি ইসলামী নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত না হতো, তাহলে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হতো না। মানবজীবন চলার পথে মহৎ ব্যক্তিগণ তাদের কাজের মাধ্যমে নৈতিকতার মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিপরীতে তারা মহৎ কাজ সম্পাদন, সংরক্ষণ এবং এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চেষ্টা চালিয়েছেন। ইসলামী সভ্যতা বিভিন্ন জাতির সাথে লেনদেন করেছে, বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে মিশেছে এবং বহুবিধ রীতিনীতি ও ঐতিহ্য প্রত্যক্ষ করেছে। ইসলামী সভ্যতা মুসলিম জাতির বিশ্বাস এবং ইসলামের আন্তর্জাতিক দর্শনকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। নগরায়ণ, সভ্যতা, ঐতিহ্য এবং মানুষের সামাজিক রীতিনীতিতে ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। পক্ষান্তরে আমরা যদি নৈতিক আদর্শ বিবর্জিত পাশ্চাত্য সভ্যতার দিকে নযর দিই, তবে মানবসভ্যতার ইতিহাস অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং চরম ধ্বংসাত্মক পরিণতি লক্ষ্য করি। অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, একটি পথহারা সমাজের সামনে সমাধানের একমাত্র কল্যাণকর উপায় হলো নৈতিকতা অবলম্বন, যা তার জন্য একটি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হতে পারে।
ইসলাম তার অনুসারীদের এমনভাবে গড়ে তোলে যে, তারা জীবনের সকল পরিস্থিতিতে নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, যাতে নৈতিক শিক্ষাগুলো দরিদ্রতা, দুর্বলতা, অক্ষমতা বা পেশিশক্তির প্রভাবে উপেক্ষিত না হয়। এছাড়াও ছদ্মবেশ ধারণ করা বা লোক দেখানো অথবা হারাম সুযোগের অপেক্ষায় থাকা ইত্যাদি নৈতিক পদস্খলন। ইসলাম তাক্বওয়া ও দৃঢ়তার বহিঃপ্রকাশ। মহান আল্লাহ বলেন,
أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ - الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ - لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ لَا تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
‘শুনে রাখো! নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই আর তারা পেরেশানও হবে না। যারা ঈমান এনেছে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করত, তাদের জন্যই সুসংবাদ দুনিয়াবী জীবনে এবং আখেরাতে। আল্লাহর বাণীসমূহের কোনো পরিবর্তন নেই। এটিই মহাসফলতা’ (ইউনুস, ১০/৬২-৬৪)। ইসলাম মানুষকে বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমানভাবে দেখে। নৈতিক শিক্ষা, ইসলামী নিদর্শন ও সামাজিক আদর্শ বাস্তবায়নে ইসলাম কাউকেও বিশেষ সুবিধার অধিকারী মনে করে না।
যেমন আমরা যখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাক্কী জীবনের বছরগুলো পর্যবেক্ষণ করি, তখন ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা কম এবং মুশরিক আরবদের অত্যাচারের ভয়ে মক্কার উপকণ্ঠে আত্মগোপন থাকা সত্ত্বেও কুরআনের বিধানে কোনো পার্থক্য লক্ষ করা যায়নি। মুমিনগণ যেখানেই থাকুক না কেন কুরআনের আয়াতের প্রতিধ্বনি সকল মানুষের জন্য সমান। আল্লাহ বলেন, إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِلْعَالَمِينَ ‘এটি বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ ছাড়া আর কিছুই নয়’ (আত-তাকভীর, ৮১/২৭)।
উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, ইসলামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সকল সাধারণ প্রশিক্ষণ দেওয়া। কোনো নির্দিষ্ট সময় ও স্থানের সাথে এ প্রশিক্ষণ সীমাবদ্ধ নয়।
তৃতীয় শর্ত ধর্মের নৈতিক ব্যবস্থা:
মহাজগতের পরিচালক আল্লাহর ইচ্ছা হলো ইসলামী নৈতিক ব্যবস্থাপনার আলোকে বিশ্বমণ্ডল পরিচালনা করা। সমস্ত বস্তুগত ও নৈতিক শক্তির মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির মাধ্যমে এটি বাস্তবায়িত হয়। কারণ এই ব্যবস্থাপনায় একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় আর তা হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মানুষের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ মানসিকতাকে সন্তুষ্ট করা, যেখানে তাদের আনুপাতিকতা এবং সামঞ্জস্য সংরক্ষিত থাকে। যদিও দার্শনিক মতবাদের সিস্টেমগুলো এই অনুপাতটি সুরক্ষিত করতে অক্ষম। কারণ তারা মানবাত্মা বা এর সীমানার পারিপার্শ্বিক অবস্থার অনুসন্ধান করেনি। ইসলামী নৈতিক ব্যবস্থা মানুষকে সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়ে সুখী করে, যেহেতু মানুষের সমস্ত সহজাত চাহিদা এতে বিবেচনায় আনা হয়।
ইসলাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِثْلُهَا فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ ‘আর মন্দের প্রতিদান মন্দের অনুরূপ হবে। অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপসে মীমাংসা করে, তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ যালেমদের পছন্দ করেন না’ (আশ-শূরা, ৪২/৪০)। যদি কোনো মুমিন অন্যায়ের শিকার হয়, তবে সে শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করবে না এবং তাকে অবশ্যই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে হবে। রাগান্বিত অবস্থায় ক্ষমা করে দেওয়ার মহান আদর্শের সাথে এটি সাংঘর্ষিক নয়। এমন ইতিবাচক ও গঠনমূলক কর্মসূচি মুমিনদের প্রতি অবিচারের পরিণতি সম্পর্কে অত্যাচারীদেরকে সতর্ক করে। কারণ তারা এক্ষেত্রে নীরব থাকে না, বরং তাদের মুখের সামনে দাঁড়ায়। আর পতিতার অপকর্ম ও পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অন্যায় নয়।
পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে আল-কুরআনের শিক্ষা ব্যতীত কোনো শিক্ষা ফলপ্রসূ হতে পারে না। আল-কুরআন শিক্ষায় আমাদের সন্তান ও আধুনিক প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। মানুষের চারিত্রিক বিকাশ, আধ্যাত্মিক উন্নতি, হাতে-কলমে তার আদর্শের অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে তার মানবতা ও উদারতার উন্নয়ন সাধন করতে হবে। ইহকাল ও পরকালে শান্তিপূর্ণ জীবন লাভের একমাত্র উপায় আদর্শবান মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। এজন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম করা প্রতিটি মুমিন মুসলিমের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদের আল-কুরআনের শিক্ষা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার এবং আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে আদর্শ প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তোলার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মুহাম্মাদ মুস্তফা কামাল
প্রভাষক (আরবী), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বরিশাল।