প্রাক-ইসলামী যুগে আরবরা মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিল এবং এটা তাদের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এমনকি এটা তাদের নিত্যদিনের সহজাত প্রয়োজনীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। তাদের কবিতা, ইতিহাস ও সাহিত্যের একটি বড় অংশ মদের আলোচনায় ভরপুর ছিল। এর নাম ও গুণাবলির ব্যাপক বিবরণ তাদের ভাষায় ছিল। মদে আসক্ত জাতির জীবনে মদের ব্যবহার এত বেশি ব্যাপকতা লাভ করেছিল যে, মদের ক্রয়-বিক্রয় তাদের নিকট ব্যবসার পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এর প্রমাণ কুরআন মাজীদে অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তিরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (আল-মায়েদা, ৫/৯০)।
আল-কুরআনে মদ বর্জনের আদেশ আসামাত্রই মুসলিমরা মদের পাত্রগুলো চাকু ও ছুরি দিয়ে ভাঙতে শুরু করেন এবং সেগুলোর মধ্যে থাকা মদগুলো মাটিতে ফেলে দেন। এছাড়াও অবশিষ্ট মদের সন্ধানে তারা বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশি চালান, যাতে সেগুলোকেও ফেলে দিতে পারেন। তারা মুহূর্তের মধ্যে কুরআনের আদর্শে উজ্জীবিত এমন একটি জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন যে, তারা মদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে দিলেন এবং এর ব্যবহার থেকে নিজেদের জীবনকে সম্পূর্ণ মুক্ত করলেন। এসবই এ কারণে ঘটেছে যে, সে জাতি ছিল তার ইচ্ছায় স্বাধীন, তার আকাঙ্ক্ষার সামনে বাধাহীন, পাশবিক প্রবণতার সামনে দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসরমাণ। যখন তাকে এটা বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়, তখন সে তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে একে বন্ধ করতে সচেষ্ট হয়। এককথায় সে স্বাধীনতার সুউচ্চ সুখ উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছে, যা তাকে আচরণ নিয়ন্ত্রণের আদেশ দেওয়ামাত্রই সে তা বাস্তবায়নে প্রস্তুত।
আল-কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী মদপান নিষিদ্ধের চর্চায় সফল অভিজ্ঞতার বিপরীতে আমরা দেখতে পাই যে, জাতি, নাগরিকতা ও সংস্কৃতির বিচারে সমৃদ্ধ পশ্চিমা বিশ্ব একই অভিজ্ঞতায় ব্যর্থ হয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিংশ শতাব্দীতে তার জনগণকে মদের ক্ষতি থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা ১৯২০ সালে মদের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার জন্য একটি আইন প্রণয়ন করে। এই আইনটি বাস্তবায়নে তারা সিনেমায় প্রচার, নাটকে মঞ্চায়ন, রেডিও, টেলিভিশন এবং বইপত্রে প্রকাশনা ইত্যাদি মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। সূক্ষ্ম পরিসংখ্যান আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকে তারা মদের (অ্যালকোহল) ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে। এই প্রচারণায় তারা ৬৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। মদের ক্ষতিকর দিকের বিবরণ এবং এর ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে তারা ৯ হাজার মিলিয়ন পৃষ্ঠার কৃষ্ণপত্র তৈরি করে।
এটি কার্যকর হওয়ার তারিখ থেকে অক্টোবর ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ের পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, এই আইন বাস্তবায়নে করতে গিয়ে ২০০ মিলিয়ন লোককে হত্যা এবং অর্ধ-মিলিয়ন লোককে কারারুদ্ধ করা হয়। এই আইন লঙ্ঘনকারীদের দেড় মিলিয়ন পাউন্ড জরিমানা এবং অমান্যকারীদের ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড অর্থদণ্ড প্রদানের আইন করা হয়। এই আইন বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে মার্কিন সরকার ১৯৩৩ সালের শেষের দিকে মাদক নিষিদ্ধকরণ আইন বাতিল করতে বাধ্য হয়। এটা ছিল একটি ব্যর্থ পরীক্ষা।[1]
এর কারণ এই যে, পাশ্চাত্য সভ্যতাগুলো স্বাধীনতার কথা বললেও তারা তাদের জনগণকে ঐ স্বাধীনতা দিতে পারেনি, যে স্বাধীনতা আল-কুরআন একজন মুসলিমকে দিয়েছে। তা হচ্ছে তার পাশবিক আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে সংগ্রামের স্বাধীনতা এবং তার কামনা নিয়ন্ত্রণের অধিকার। পাশ্চাত্য সভ্যতা মনে করে, স্বাধীনতা হলো তুমি যা ইচ্ছা তাই করো এবং যেভাবে ইচ্ছা ক্ষমতার ব্যবহার করো। এই কারণে তারা আবেগ এবং পাশবিক প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বর্জন করেছে। ফলে পশ্চিমা জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে প্রবৃত্তির শিকারে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও সভ্যতায় তারা যতই অগ্রগামী হোক না কেন এক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
আল-কুরআন দ্বারা অনুপ্রাণিত নৈতিক মূল্যবোধ ব্যতীত অন্য কোনো কিছুই মানবাত্মাকে প্রভাবিত করতে, দুনিয়ার প্রলোভন পরিত্যাগ করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করতে এবং বিভিন্ন প্রকার বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ ‘আর ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয় এটি অসাধ্য কাজ, তবে বিনয়ীদের জন্য কঠিন কিছু নয়’ (আল-বাক্বারা, ২/৪৫)। এই সাহায্য প্রার্থনার কাজ অত্যন্ত কঠিন। কেবল নম্র ও বিনয়ীগণই একে যথাযথভাবে সম্পাদন করতে পারে। এই আয়াতে ধৈর্য ও প্রার্থনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ সমস্যার মুখে ধৈর্য ও সততা দৃঢ়তাপূর্ণ অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে আর ছালাত হচ্ছে মহান আল্লাহর সাথে গভীর ও নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যম। এই ইবাদতের মাধ্যমে মানুষ দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, দৃঢ় বিশ্বাস, প্রবণতা ও কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্জন করে।
উল্লেখ্য, আল-কুরআনের আয়াতগুলো কিছু মানুষের ক্ষেত্রে বজ্রের মতো আঘাত করে। সেগুলো তাদের প্রবৃত্তির শিকড় এবং মানুষের মন থেকে পার্থিব আশা-আকাঙ্ক্ষার মূলোৎপাটন ঘটায়। আর এই দুনিয়ায় মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
‘আপনি বলুন! তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী ও গোত্র, সম্পদ যেগুলো তোমরা উপার্জন করেছ, তোমাদের ব্যবসা যার মন্দার আশঙ্কা তোমরা কর, আত্মতৃপ্তিদায়ক বাসস্থান যদি তোমাদের নিকট আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার চেয়ে উত্তম হয়; তবে তোমরা আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। আর আল্লাহ ফাসেক্ব সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না’ (আত-তওবা, ৯/২৪)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ
‘নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের নিকট থেকে তাদের জীবন, তাদের সম্পদ কিনে নিয়েছেন এই মর্মে যে, তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে। তারা এমন যে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে, ফলে তারা হত্যা করে এবং নিহত হয়। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য অঙ্গীকার, যার বিবরণ তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনে বর্ণিত হয়েছে’ (আত-তওবা, ৯/১১১)। আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে ক্রয়ের কথা বলে প্রতিদানের প্রতি আশ্বস্ত করেছেন। কেননা ক্রেতা তাই ক্রয় করে, যার সে মালিক নয়; অথচ আল্লাহ তাআলা সবকিছুর মালিক। এরূপ আয়াত আল-কুরআনে অনেক জায়গায় এসেছে।
আল-কুরআন মানুষকে উচ্চ আধ্যাত্মিক আত্মা উপহার দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ ‘যারা বলে আল্লাহ আমাদের রব, অতঃপর তার উপর অটল থাকে; তখন তাদের উপর আল্লাহর রহমতের ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়ে বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তিত হয়ো না আর জান্নাতের শুভ সংবাদ গ্রহণ করো, যার অঙ্গীকার তোমাদের সাথে করা হয়েছে’ (ফুছছিলাত, ৪১/৩০)। এই আয়াতে মানুষের মূল্যায়ন ঈমান এবং সৎ আমল দিয়ে চিত্রায়িত করা হয়েছে। নিশ্চয় মানুষ ঈমানের ছায়াতলে দৃঢ়তার এমন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে যে, তার উপর আল্লাহর ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়, তাকে শেখায় এবং শুভ সংবাদ দেয়।
মানুষ যখনই আন্তরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে আল-কুরআনের ছায়াতলে জীবনযাপন করে, তখন আল-কুরআনের আয়াতগুলোর মর্মার্থ তার সামনে চিত্রায়িত হয় এবং সে প্রাত্যহিক জীবনে দ্রুত পরিবর্তনের পথে অগ্রসর হয়। যেমন আল-কুরআন মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের চেতনা সৃষ্টি করে এবং তার কাজকে সঠিক ও উপযুক্ত পথে পরিচালিত করে। যখন কোনো মানুষ এইভাবে জীবনযাপন করে, তখন সে দেখতে পায় যে, তার স্বাধীনতাকে কোনো কিছুই পরাজিত করতে পারে না। কারণ আল-কুরআন প্রতিদিন আমাদেরকে উজ্জ্বল সীমারেখা অঙ্কিত গুরুত্বপূর্ণ পথের সন্ধান দেয়।[2]
আর দুই কল্যাণ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা বলেন,قُلْ هَلْ تَرَبَّصُونَ بِنَا إِلَّا إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ وَنَحْنُ نَتَرَبَّصُ بِكُمْ أَنْ يُصِيبَكُمُ اللَّهُ بِعَذَابٍ مِنْ عِنْدِهِ أَوْ بِأَيْدِينَا فَتَرَبَّصُوا إِنَّا مَعَكُمْ مُتَرَبِّصُونَ ‘আপনি বলুন! তোমরা তো তোমাদের জন্য দুটি কল্যাণের একটি প্রত্যাশা কর আর আমরা তোমাদের জন্য প্রত্যাশায় আছি যে, আল্লাহ যেন নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের আযাব দান করেন অথবা আমাদের হাতে শাস্তির ব্যবস্থা করেন। সুতরাং তোমরা অপেক্ষা করো, আমরাও তোমাদের সাথে অপেক্ষায় রইলাম’ (আত-তওবা, ৯/৫২)। নিশ্চয় উল্লিখিত বিষয় দুটি মহান নেয়ামতের একটি, যা একজন মুমিন মুনাফেক্বদের জন্য প্রত্যাশা করে এবং এর জন্য অপেক্ষমাণ থাকে আর তা হলো হয় ইহকালে বিজয় এবং গনীমতের সম্পদ লাভ আর না হয় পরকালে স্থায়ী তওবার সাথে চিরন্তন শহীদী জীবন লাভ, যেখানে মুমিনরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মুনাফেক্বদের জন্য তাদের হাতে শাস্তি ও ধ্বংস কামনা করে।
উল্লেখ্য, দৃঢ়তা এবং স্থিতিশীলতা ব্যতীত বিপদাপদ ও পরীক্ষায় বিজয় অর্জিত হয়নি। এজন্য আল-কুরআন আমাদেরকে আধ্যাত্মিক শক্তি দান করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ ‘নিশ্চয় আমরা তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা, সম্পদের স্বল্পতা, জীবন ও ফসলের ক্ষতি দিয়ে পরীক্ষা করে থাকি। আর আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদেরকে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৫)।
তৃতীয় উদ্দেশ্য ব্যক্তিত্ব গঠন:
ব্যক্তিত্ব গঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা মানুষের ব্যক্তিত্বকে স্থায়ী অবকাঠামো প্রদান করে। যাতে তার ব্যক্তিত্ব পরিপূর্ণ মানবিক রঙে রঞ্জিত হয়। যদি এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান না থাকে, তবে সে জীবনে ব্যর্থতার মুখোমুখি হবে। এজন্য মানুষকে তার সত্তা ও ব্যক্তিত্ব গঠনে মনোযোগ দেওয়া উচিত। যদি এমনটি না হয়, তবে সে তার সে অবস্থার উপর অটল থেকে যাবে। সুতরাং ব্যক্তিত্ব গঠনে ধারাবাহিক সাধনা করা প্রত্যেকের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া অধিকাংশ বিশৃঙ্খলা এবং অপরাধের ক্ষেত্রে আমিত্বকে মানব চরিত্রের সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক আচরণ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর এর উৎস হলো নিজেকে বড় মনে করা। সুতরাং আমিত্ব হলো মহান চরিত্রের শত্রু। এই আমিত্বের অহংকার মূলোৎপাটন না করে কোনো মানুষের পক্ষে মহান চরিত্রের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়।
আমিত্বের মূলোৎপাটন বলতে সকল চারিত্রিক ত্রুটি দূর করা এবং মহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জনে সাধনা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا - وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا ‘ঐ ব্যক্তি সফল, যে নিজেকে পবিত্র করেছে। আর ঐ ব্যক্তি ব্যর্থ, যে নিজেকে কলুষিত করেছে’ (আশ-শামস, ৯১/৯-১০)। অতএব, পবিত্রতা হলো বেড়ে ওঠা এবং মনকে কলুষতা থেকে পবিত্র করা। আর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অর্থটি ‘খায়বাতুন’ থেকে এসেছে, এর অর্থ হচ্ছে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া। এটা পরিষ্কার যে, মানবিক পরিপূর্ণতা আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টিগত স্বভাব অনুযায়ী প্রদত্ত বৈশিষ্ট্যের আলোকে মানুষের পাপিষ্ঠ হওয়া কিংবা আল্লাহভীরু হওয়ার পার্থক্য করা যায়। অর্থাৎ ইসলাম হলো একটি প্রকৃত জীবনবিধান। অতএব, তাক্বওয়া দিয়ে আত্মার গঠনকে আত্মার পবিত্রতা বলে। পবিত্রভাবে তার বৃদ্ধি এবং তাকে সমৃদ্ধ করা, যা তার স্থায়িত্বকে প্রসারিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى وَاتَّقُونِ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ ‘তোমরা (তাক্বওয়ার) পাথেয় সংগ্রহ করো। কেননা সর্বোত্তম পাথেয় হলো তাক্বওয়া। হে জ্ঞানীগণ! তোমরা আমাকে ভয় করো’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৭)।
নিশ্চয় দ্বীন ইসলাম এই আত্মম্ভরিতার চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে অবগত। যারা আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর ইবাদত অস্বীকার করে, ইসলাম তাদেরকে অহংকারী বলে আখ্যায়িত করেছে। আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে বলেন,ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ ‘তোমরা আমার নিকট প্রার্থনা করো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে’ (গাফির, ৪০/৬০)। এই আয়াতে দু‘আ ইবাদত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল-কুরআনের বহু স্থানে এরূপ ব্যবহার দেখা যায়। এর প্রমাণ হলো আল্লাহ তাআলার বাণী, إِنْ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا إِنَاثًا ‘আল্লাহ ব্যতীত তারা যাদের আহ্বান (ইবাদত) করে, তারা নারী ব্যতীত অন্য কেউ নয়’ (আন-নিসা, ৪/১১৭)। অতএব, দু‘আ হলো ইবাদত ও দাসত্বকে স্বীকার করা। আর যে দু‘আ বর্জন করে, সে এই কারণে করে যে, যাতে সে ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে অহংকার প্রকাশ করতে পারে।[3]
অহংকারের আচরণ নিয়ন্ত্রণে ইসলাম নীতিমালা প্রণয়ন করেছে—
(১) নিশ্চয় মানুষের জন্য একজন মাত্র সৃষ্টিকর্তা রয়েছে, যিনি ইবাদতের যোগ্য। মানুষের উচিত তাঁর উপর বিশ্বাস রাখা এবং তাঁর ইবাদত করা, যাতে সে সৌভাগ্য লাভ করতে পারে।
(২) পৃথিবীতে ন্যায়পরায়ণতার প্রচার-প্রসার এবং তাঁর আনুগত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ তাআলা মানুষকে প্রতিনিধি হিসেবে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى ‘তোমরা ন্যায়পরায়ণতার পথ অবলম্বন করো। কারণ সেটা তাক্বওয়ার অধিক নিকটবর্তী’ (আল-মায়েদা, ৫/৮)। তিনি ঐ মহান সত্তা, যিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং এই পৃথিবীতে তোমাদেরকে আবাদ করেছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কি এমন কোনো উপাদান আছে, যার ফলাফল মানব কল্যাণে অবদান রাখতে পারে? বরং পৃথিবীকে আবাদ করার জন্য আল্লাহ তাআলা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে এক শ্রেণির মানুষের পেশা নির্ধারণ করেছেন।
আধ্যাত্মিক মূলনীতি এবং ইসলামী চরিত্রের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যদ্বয়ে বিশ্বাসে সৃষ্ট প্রভাবের দুইটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায়ের প্রভাব হলো নিজ আভিজাত্য এবং অহংকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা আর দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রভাব হলো উত্তম চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের অনুশীলন করা। একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত নিজ সত্তার প্রশংসা থেকে বিরত থাকা এরূপ পর্যায়ভুক্ত। উক্ত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী জীবনযাপন করলে উত্তম চরিত্র অবলম্বন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব।
মানুষ যখন ভাবে যে, সে স্বতন্ত্র বা স্বাধীন সত্তার অধিকারী; তখন সে মনে করে তার কাঁধে কোনো দায়িত্ব নেই। সে তখন অবাধ্যতা, সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর আইন অমান্য করতে শুরু করে। অবাধ্যতা ও স্বেচ্ছাচারিতা তার প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যাসে পরিণত হয়। কারণ সে মনে করে তার কর্মকাণ্ড কেউ পর্যবেক্ষণ করছে না। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার কল্যাণ সম্পর্কে অবগত থাকার পরও সে এসব থেকে বিরত থাকে না। আর যখন কোনো ব্যক্তি মনে করে যে, তার সকল শক্তি, যাবতীয় সম্ভাবনা ও সার্বিক প্রস্তুতি সবকিছু আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে; তখন সে মনে করে, তার নিজস্ব কোনো শক্তি নেই। ফলে তার স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ থাকে না। এমতাবস্থায় মানুষ মনে করে যে, সে ইলাহী বিধিবিধান বাস্তবায়নে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়েছে।
উল্লেখ্য, মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মহান ব্যক্তিত্ব থেকে আত্মগঠনের কার্যক্রম চলমান আছে। সম্মানিত রাসূলগণের মাধ্যমে এ কার্যক্রমের সূচনা হয় এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সাধারণ সদস্য পর্যন্ত এর কার্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করে। জাতির নবায়ন এবং তার আধ্যাত্মিক গঠনের এই মূলনীতি যখন উপেক্ষিত হয়, তখন জীবন যুদ্ধের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্রিয় ও নিখুঁত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের সংগ্রাম গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, যা একজন মানুষ জীবনের বিভিন্ন স্তরে সম্মুখীন হয়।
এমন বিশ্বাস করা কি সম্ভব যে, কুরআনুল কারীমের চেয়ে উত্তম এমন কিছু আছে, যে তার আদেশ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে পারে? বিষয়টি যদি এমন হয়, তবে মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর রাতে ছালাত আদায় ওয়াজিব কেন? এর কারণ সূরা আল-মুযযাম্মিলে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে,
يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ - قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا - نِصْفَهُ أَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيلًا - أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا - إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا ثَقِيلًا - إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا - إِنَّ لَكَ فِي النَّهَارِ سَبْحًا طَوِيلًا
‘হে বস্ত্রাবৃত! রাতের কিছু অংশ বাদ দিয়ে দাঁড়ান (ছালাত আদায় করুন) কিংবা অর্ধেক রাত কিংবা তা থেকে কিছুটা কম বা বেশি এবং সুবিন্যস্ত ও স্পষ্টভাবে কুরআন তেলাওয়াত করুন। নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি গুরুত্বপূর্ণ বাণী অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয় ইবাদতের জন্য রাতে উঠা প্রবৃত্তি দমনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল। নিশ্চয় দিবাভাগে রয়েছে আপনার দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা’ (আল-মুযযাম্মিল, ৭৩/১-৭)।
লক্ষণীয় যে, আয়াতসমূহের প্রেক্ষাপট বৃহৎ ও ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ এবং দায়িত্ব গ্রহণে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃঢ়তা ও প্রস্তুতির প্রতি ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ আত্মগঠনের উক্ত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আত্মার বিনির্মাণ ছাড়া এটি সম্ভব নয়। এটা এ অর্থে যে, উল্লিখিত আয়াতে সম্বোধিত ব্যক্তি মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তবে তাঁকে ‘হে রাসূল!’ বা ‘হে নবী!’ বলে সম্বোধন করা হয়নি, বরং তাঁকে ‘হে বস্ত্রাবৃত!’ উপাধি দিয়ে সম্বোধন করা হয়েছে। এ আহ্বান এ নির্দেশনা দান করে যে, এটি সৌন্দর্য অবলম্বন কিংবা বিচ্ছেদের সময় নয়; বরং ঘুরে দাঁড়ানো এবং আত্মগঠনের সময়। রিসালাতের মহান দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার এবং এরূপ কাজের জন্য রাতকে বেছে নেওয়ার সময়।
(ইনশা-আল্লাহ চলবে)
প্রভাষক (আরবী), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বরিশাল।
[1]. সৈয়দ আল-হাকীম, উলূমুল কুরআন, পৃ. ৭০।
[2]. ফাযল ইবনে হাসান আত-তিবরাসী, মাজমাউল বায়ান, ১৫/২৮৮-২৮৯।
[3]. ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাযী, তাফসীরুল কাবীর, ১৪/৮১-৮২।