কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মৃত্যু পর্যন্ত ইবাদতের ধারাবাহিকতা: একটি বিশ্লেষণ

post title will place here

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ يَضِيقُ صَدْرُكَ بِمَا يَقُولُونَ ‎-‏ فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُن مِّنَ السَّاجِدِينَ ‎-‏ وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ

সরল ‍অনুবাদ: ‘তারা যা বলে, তাতে আপনার বক্ষ সংকীর্ণ হয়, তা আমি অবশ্যই জানি। কাজেই আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাসবীহ পড়ুন এবং সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হোন। আর আপনার প্রতিপালকের ইবাদত করে যান, যতক্ষণ না আপনার কাছে নিশ্চিত বিষয় (মৃত্যু) আসে’ (আল-হিজর, ১৫/৯৭-৯৯)

ভূমিকা:

কুরআন শুধু আধ্যাত্মিক গ্রন্থ নয়, বরং বাস্তব জীবনের যে কোনো সমস্যার সমাধান কুরআনে আছে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কুরআনে বহুবার মানসিক দৃঢ়তা, ধৈর্য এবং আল্লাহর স্মরণে প্রশান্তি খোঁজার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সান্ত্বনা প্রদানের উদ্দেশ্যে নাযিলকৃত আয়াতসমূহ মুসলিমদের জন্য যুগ যুগ ধরে মানসিক প্রশান্তি ও ধৈর্য শিক্ষার অবলম্বন হয়ে থাকবে।

ইসলাম মানবজীবনের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। এ জীবনবিধান মূলত একটি ইবাদতভিত্তিক জীবনবিধান। সমাজের সর্বস্তরে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা এ জীবনবিধানের মূল উদ্দেশ্য, যা কোনো নির্দিষ্ট সময় বা ঋতুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং আজীবন চলমান এক নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা। ইবাদত শুধু আচার–অনুষ্ঠান নয়, বরং মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা। কুরআনে আল্লাহ বলেন,وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ ‘আপনার প্রতিপালকের ইবাদত করুন, যতক্ষণ না তোমার মৃত্যু এসে যায়’ (আল-হিজর, ১৫/৯৯)

তাহলে বুঝা গেল, ইসলাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকার জীবনব্যাপী দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ইবাদতের চূড়ান্ত সীমানা হলো মৃত্যু, এর আগে ইবাদত থেকে অব্যাহতি লাভের কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ ‘নিশ্চয় যারা বলে, আল্লাহ আমাদের রব, তারপর তার উপর (মৃত্যু পর্যন্ত) অটল থাকে, তাদের উপর ফেরেশতারা নাযিল হন’ (ফুছছিলাত, ৪১/৩০)। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মৃত্যু আসা পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করো’।[1] এটি প্রমাণ করে যে, ধারাবাহিকতা ও অধ্যবসায়-ই প্রকৃত সফলতার চাবিকাঠি।

আয়াতের শানে নুযুল:

মক্কার কাফেররা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি নানা ধরনের কটূক্তি, মিথ্যা অভিযোগ, উপহাস ও বিরূপ মন্তব্য করত। এতে তিনি অন্তরে কষ্ট পেতেন এবং দাওয়াতী কার্যক্রমের মহান দায়িত্ব আরও ভারী মনে হতো। আল্লাহ তাআলা মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সান্ত্বনা দিয়ে অত্র আয়াত অবতীর্ণ করেন, ‘আমি জানি আপনার হৃদয় সংকীর্ণ হয়’। কিন্তু আপনার হৃদয়ের সংকীর্ণতা সম্পর্কে আপনার রব অজ্ঞাত নন, বরং তিনি আপনার অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন।[2]

১. সান্ত্বনা লাভ করা: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার কাফেরদের উপহাস, মিথ্যা অভিযোগ ও কটূক্তিতে মানসিকভাবে কষ্ট পেতেন। তাঁর পরিস্থিতি হয়েছিল যে, তিনি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিলেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাআলা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, আপনার প্রতিপালক আপনার কষ্ট সম্পর্কে অজ্ঞাত নন। একজন আদর্শ দাঈ সবসময় প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। তিনি মনে করেন সত্যের দাওয়াত বহন করা মানেই পরীক্ষা, চ্যালেঞ্জ ও বিপদের মুখোমুখি হওয়া। কঠিনতম সময়েও তিনি সত্যের উপর অটল থাকেন এবং ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর পথে অগ্রসর হন।

যারা ইসলামের আলোকে জীবন যাপন করে এবং আল্লাহর বিধান মেনে চলে, তাদের জীবনে পরীক্ষা আসবে এটাই স্বাভাবিক। তাদের জীবন আয়েশময় হবে আর তারা ঝঞ্ঝাটমুক্ত থাকবে এমনটা নয়। কারণ বিরোধিতা ও অপবাদ হলো হক্বের পথে দাওয়াতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে এ পথের কষ্ট ও মানসিক চাপে দিশেহারা না হয়ে আল্লাহর প্রশংসা, তাসবীহ ও যিকিরের মাধ্যমে অন্তরের অশান্তি ও দুঃখ দূর করতে হবে। আল্লাহ তাঁর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কষ্টের সময় তিনটি উপায় শিক্ষা দিয়েছেন— তাসবীহ পাঠ, সিজদা করা এবং ইবাদতে মগ্ন থাকা।[3] এটাই হলো দুঃখ-কষ্ট থেকে উত্তরণের শ্রেষ্ঠ উপায়। কেননা আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়, মনোবল দৃঢ় হয় এবং বিশ্বাস শক্তিশালী হয়।

আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- যিনি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, তিনিও দুঃখ-কষ্টের ভার অনুভব করেছেন; কিন্তু আল্লাহ তাঁকে ধৈর্য, যিকির ও ইবাদতের মাধ্যমে সান্ত্বনা দান করেছেন। অতএব, অন্তরের অশান্তি ও দুঃখ-কষ্ট দূর করার সর্বোত্তম পথ হলো আল্লাহর প্রশংসা করা, ছালাতে সিজদায় অবনত হওয়া এবং নিরলসভাবে ইবাদত চালিয়ে যাওয়া।

২. মানসিক কষ্ট সহ্য ও ধৈর্যের নির্দেশনা: নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হৃদয়ের কষ্ট ও মানসিক চাপ কুরআনে স্বীকৃত বাস্তবতা। দাওয়াতের পথে তাঁকে শত্রুতামূলক কথাবার্তা ও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ সহ্য করতে হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ يَضِيقُ صَدْرُكَ بِمَا يَقُولُونَ‘আমি জানি, তারা যা বলে তাতে আপনার অন্তর সংকুচিত হয়’ (আল-হিজর, ১৫/৯৭)। তবে মনে রাখতে হবে, প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা মানুষের হাতে নয়, বরং তা আল্লাহর দান। তাই আল্লাহ তাআলা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, তাদের কথায় আপনি দুঃখিত হবেন না। নিশ্চয়ই সমস্ত সম্মান আল্লাহর জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য এবং মুমিনদের জন্য’ (আল-মুনাফিকূন, ৬৩/৪)

এ কষ্ট নতুন কিছু নয়, পূর্ববর্তী নবীরাও বিরোধিতা, মিথ্যাচার ও নানা যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তারা ধৈর্যধারণ করেছিলেন, ফলে তাদের উপর আল্লাহর সাহায্য অবতীর্ণ হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, ‘অতএব, ধৈর্যধারণ করুন, যেমন দৃঢ়চিত্ত রাসূলগণ ধৈর্যধারণ করেছিলেন’ (আল-আহক্বাফ, ৪৬/৩৫) আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَى مَا كُذِّبُوا وَأُوذُوا حَتَّى أَتَاهُمْ نَصْرُنَاআপনার পূর্ববর্তী নবীদেরও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছিলতারা ধৈর্যধারণ করেছিলেন এবং কষ্ট সহ্য করেছিলেন, অবশেষে তাদের কাছে আমাদের সাহায্য পৌঁছেছিল’ (আল-আনআম, ৬/৩৪) সর্বশেষে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মানুষের কষ্টদায়ক কথাবার্তা উপেক্ষা করার এবং একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَالْمُنَافِقِينَ وَدَعْ أَذَاهُمْ وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ কাফের ও মুনাফেক্বদের আনুগত্য করো না, তাদের কষ্টদায়ক কথায় ভ্রূক্ষেপ করো না এবং আল্লাহর উপর নির্ভর করো(আল-আহযাব, ৩৩/৪৮)

এভাবেই কুরআন আমাদের শিক্ষা দেয় যে, নবীদের পথ হলো ধৈর্য, আল্লাহর প্রতি আস্থা এবং মানুষের কথায় বিচলিত না হওয়ার আদর্শ আর এটাই একজন আদর্শ দাঈ বা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রকৃত বৈশিষ্ট্য।

৩. মৃত্যু পর্যন্ত ইবাদত অব্যাহত রাখা: মুসলিমের জীবন শুধু মাসিক বা বার্ষিক কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদতের নাম নয়; বরং মৃত্যু পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতের ধারাবাহিক যাত্রা। নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহকে যথাযথ ভয় করুন এবং মুসলিম হওয়া ব্যতীত মৃত্যুবরণ করবেন না’ (আল-আনআম, ৩/১০২) আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ ‘যে ব্যক্তি বলে, আমার রব আল্লাহ, তারপর সে তার উপর অটল থাকে, ফেরেশতারা তার নিকট (রহমত নিয়ে) অবতীর্ণ হন’ (ফুছছিলাত, ৪১/৩০)। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করো। যদি তা না পার, তবে বসে পড়ো আর যদি তাও না পার, তবে কাত হয়ে (শুয়ে) ছালাত আদায় করো’।[4] অর্থাৎ মৃত্যু আসা পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করো। নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের ইবাদত করুন, যতক্ষণ না আপনার ইয়াক্বীন আসে’ (আল-হিজর, ১৫/৯৯)। এখানে ‘ইয়াক্বীন’ দ্বারা মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে অর্থাৎ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইবাদত অব্যাহত রাখুন। ইসলামে এমন কোনো সময় নেই, যখন ইবাদত থেকে বিরতি গ্রহণ করা যায়। শৈশব, যৌবন কিংবা বার্ধক্য—জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই বান্দার কর্তব্য হলো আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকা। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতে ধারাবাহিকতা রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, ‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো সেই আমল, যা নিয়মিতভাবে করা হয়, যদিও তা (পরিমাণে) সামান্য হয়’।[5]

এটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা বান্দার নিকট থেকে নিরবচ্ছিন্ন ইবাদত প্রত্যাশা করেন। মৃত্যু যেহেতু জীবনের শেষ সীমা, তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বান্দার দায়িত্ব হলো আল্লাহর প্রতি আনুগত্য অব্যাহত রাখা। কুরআনে অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন তারা মারা যাবে, সেদিন পর্যন্ত তারা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং আল্লাহর হুকুম থেকে বিমুখ হবে না’ (মারইয়াম, ১৯/৫৯)

অতএব, মুমিনের জীবন ইবাদতের ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠতে হবে। ইবাদত কেবল বিশেষ মুহূর্তের কাজ নয়, বরং আজীবন চলমান একমাত্র প্রধান দায়িত্ব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত অবিরামভাবে চলতে থাকবে।

আয়াতগুলোর জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা ও বাস্তব প্রয়োগ:

১. মানসিক চাপ সামলাতে কুরআনের দিকনির্দেশনা: মনোবিজ্ঞানে আল-কুরআনে ব্যবহৃত ‘ضيق الصدر’ শব্দবন্ধের অর্থ হলো ‘Anxiety’ বা ‘Depression’। এর দ্বারা হৃদয়ের অস্বস্তি, মানসিক অস্থিরতা ও উদ্বেগকে বুঝানো হয়। যখন মানুষ উপহাস, বিদ্রূপ বা অন্যায় সমালোচনার সম্মুখীন হয়, তখন তার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে যায়, মনে অস্বস্তি ও সংকীর্ণতা জন্ম নেয়। এ অবস্থায় ব্যক্তি গভীর উদ্বিগ্নতায় নিমজ্জিত হয় এবং মানসিকভাবে চাপে পড়ে, যা বর্তমান মনোবিজ্ঞানে উদ্বেগ ও বিষণ্নতারূপে চিহ্নিত।

২. আধুনিক মনোবিজ্ঞানের সামঞ্জস্য: দুঃখ-কষ্টে নিমজ্জিত মানুষের অবস্থা পরিবর্তন, অশান্ত হৃদয়ের প্রশান্তি এবং হতাশা ও সংকীর্ণতার অন্ধকার থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে আধুনিক বিশ্বে নানা কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— (ক) নিয়মিত ধ্যান (Meditation), যা গভীর চিন্তার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমায়; (খ) ইতিবাচক বাক্যাবলির উচ্চারণ (Positive Affirmations), যা মস্তিষ্কে সাময়িক প্রশান্তি আনে; (গ) শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ (Breathing Exercises), যা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা কমাতে সহায়তা করে। নিঃসন্দেহে এসব পদ্ধতির সুফল ও ইতিবাচক প্রভাব আজকাল ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও আল্লাহর যিকির, ছালাত আদায় ও কুরআন তেলাওয়াতের মহিমা ও গভীরতার তুলনায় এগুলো অত্যন্ত সীমিত ও ক্ষুদ্র। কেননা এসব কৌশল কেবল মনঃসংযোগ সৃষ্টি করে, অথচ ইবাদতের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত হয়। এর ফলশ্রুতিতে সে শুধু সাময়িক নয়; বরং স্থায়ী প্রশান্তি, শক্তি ও আধ্যাত্মিক পরিতৃপ্তি লাভ করে।

এই মানসিক বিষণ্নতার প্রকৃত প্রতিষেধক বস্তুগত কোনো উপাদান নয়, বরং এর মূল চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে আধ্যাত্মিক জগতে। হতাশায় ব্যর্থ না হয়ে মহান আল্লাহর ধ্যানে ফিরে আসাই হলো সেই আধ্যাত্মিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। যিকির, তাসবীহ, কুরআন তেলাওয়াত ও ছালাত মানুষের অন্তরের অশান্তিকে প্রশমিত করে, সিজদার নিবেদন ও আল্লাহর স্মরণ ভগ্ন হৃদয়ে দৃঢ়তা এনে দেয় এবং শক্তিতে বলীয়ান করে।

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনাদর্শ মুসলিমদের জন্য আধ্যাত্মিক পথে চলার একমাত্র অবলম্বন। কঠিন সময়েও কীভাবে ঈমানকে অটল রাখা যায় এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে অন্তরের শান্তি অর্জন করা যায় সে শিক্ষা তারা তাঁর জীবন থেকেই লাভ করেন। ইসলামের আধ্যাত্মিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচলিত যেকোনো চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায় অনেক গভীর, সর্বাঙ্গীন ও অদ্বিতীয়। কেননা এটি কেবল মানসিক অনুশীলন বা মনঃসংযোগ নয়, বরং মানুষের অন্তরকে সরাসরি মহান স্রষ্টার সঙ্গে যুক্ত করার জীবন্ত মাধ্যম।

ঈমানের সেই দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে মানুষ খুঁজে পায় প্রকৃত শান্তি, নিরাপত্তা ও প্রশান্তির আশ্রয়। আল্লাহর স্মরণেই দুঃখী হৃদয় প্রশান্ত হয়, উদ্বিগ্ন প্রাণ নিশ্চিন্ত হয় আর ভগ্ন আত্মা খুঁজে পায় পুনর্গঠনের অমূল্য শক্তি। অতএব, প্রকৃত শান্তি খুঁজতে হলে ফিরে আসতে হবে আল্লাহর স্মরণে, ছালাতে, তেলাওয়াতে ও সিজদাতে। আল্লাহর নৈকট্যই হলো মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয়।

৩. সমালোচনার মুখেও ধৈর্য ও স্থিরতার মাধ্যমে সত্যের পর অটল থাকা: রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতের পথে কটূক্তি, উপহাস ও অবমাননার শিকার হতেন। মানুষের অন্যায় সমালোচনা ও দুর্নামে আঘাত পেতেন। কিন্তু তিনি দাওয়াতী কার্যক্রম থেকে কখনো পিছপা হতেন না; বরং আল্লাহর সাহায্য আসবে এই আশায় ধৈর্য ধরে অবিচল থাকতেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়ে বলেন,فَاصْبِرْ عَلَى مَا يَقُولُونَ وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوبِهَا ‘তারা যা বলে, তাতে ধৈর্যধারণ করুন এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করুন’ (ত্ব-হা, ২০/১৩০)। তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে আরও বলেন,وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ يَضِيقُ صَدْرُكَ بِمَا يَقُولُونَ - فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُنْ مِنَ السَّاجِدِينَ ‘আমি তো ভালোভাবেই জানি, তাদের কথায় আপনার বক্ষ সংকীর্ণ হয়ে আসে। সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করুন এবং সিজদাকারীদের দলভুক্ত হোন’ (আল-হিজর, ১৫/৯৭-৯৮)। ধৈর্যের তাৎপর্য বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ ‘আর অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৫)

অতএব, সমালোচনা সহ্য করার একমাত্র পথ হলো ধৈর্য, আল্লাহর ওপর ভরসা এবং তাঁর স্মরণে দৃঢ় থাকা।

ধৈর্যধারণের উপকারিতা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বাণীটি প্রণিধানযোগ্য, তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কেউ ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও প্রশস্ত কোনো দান লাভ করেনি’।[6]

সুতরাং, অন্যের সমালোচনায় আত্মসম্মান হারিয়ে হতাশ হওয়া যাবে না; বরং আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে ধৈর্যের সাথে এগিয়ে চলাই হলো প্রকৃত মুমিনের আদর্শ।

৪. সম্মান বা অপমান মানুষের হাতে নয়, বরং আল্লাহর হাতে: মানুষের কটূক্তি ও অবমূল্যায়ন মুমিনকে বিচলিত করে না। কারণ সে জানে সম্মান, মর্যাদা ও ইযযতের একমাত্র মালিক আল্লাহ তাআলা। আল্লাহ বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعِزَّةَ فَلِلَّهِ الْعِزَّةُ جَمِيعًا ‘যে ব্যক্তি ইযযত ও মর্যাদা কামনা করে, তার জেনে রাখা উচিত সমস্ত ইযযত, মর্যাদা ও সম্মান কেবল আল্লাহ তাআলার’ (ফাতির, ৩৫/১০)। মানুষকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াস যতই করা হোক না কেন, তা কখনোই টেকসই মর্যাদার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। কারণ মানুষ দ্রুত ভুলে যায় এবং অন্যের সমালোচনা করতে দ্বিধা করে না। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করলে বান্দার মর্যাদা পৃথিবী ও আখেরাত উভয় জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনয় প্রদর্শন করে, আল্লাহ তাকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেন’।[7] অতএব, বাস্তব জীবনে আমাদের কর্তব্য হলো মানুষকে খুশি করার চেয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেওয়া। কেননা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই হলো আসল মর্যাদা, প্রকৃত সম্মান এবং চিরস্থায়ী সাফল্যের মূলমন্ত্র।

৫. তাওহীদের গভীর শিক্ষা: আল্লাহকে শুধু উপাস্য হিসেবে স্বীকার করার নাম তাওহীদ নয়, বরং তাঁর পূর্ণতা ঘোষণা করা এবং সকল অপূর্ণতা থেকে তাঁকে পবিত্র ও মুক্ত সাব্যস্ত করাই প্রকৃত তাওহীদ।

তাসবীহের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহকে সকল ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা থেকে পবিত্র ঘোষণা করে আর হামদের মাধ্যমে স্বীকার করে যে, আল্লাহ-ই সকল সৌন্দর্য ও পূর্ণতার অধিকারী। এই দুইয়ের সমন্বয়ই তাওহীদের আসল সৌন্দর্য। দুনিয়ার জীবনে মানুষ নানা দুঃখ-কষ্ট, শত্রুতা ও মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়। এসব থেকে মুক্তির প্রকৃত উপায় হলো আল্লাহর যিকির। যেমন- আল্লাহ তাআলা কুরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়; জেনে রেখো! আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়’ (আর-রা‘দ, ১৩/২৮)

অতএব, দাওয়াতী জীবনে বিদ্রূপ বা বিরোধিতার মুখে মুমিনের করণীয় হলো তাওহীদের উপর দৃঢ় থাকা, আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনায় মগ্ন থাকা। কারণ সকল ক্ষমতা, মর্যাদা ও নিয়ন্ত্রণ একমাত্র আল্লাহর হাতে। এজন্যই আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তাহলে তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করো’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৫)। তিনি আরও বলেন, فَاصْبِرْ عَلَى مَا يَقُولُونَ وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوبِهَا ‘তাদের কথায় ধৈর্যধারণ করুন এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে তোমার প্রভুর প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করুন’ (ত্ব-হা, ২০/১৩০)

যিকির ও ছালাতের মাধ্যমে ঈমান দৃঢ় হয়, হৃদয়ে তাওহীদ সুপ্রোথিত হয় এবং আল্লাহর উপর নির্ভরতা আরও শক্তিশালী হয়। ধারাবাহিক যিকিরই মানুষকে ভয়, হতাশা ও অস্থিরতা থেকে মুক্ত করে এবং অন্তরে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। অর্থাৎ মানুষের হৃদয়ের সত্যিকারের শান্তি ও প্রশান্তি কোনো জাগতিক ভরসায় নয়, বরং কেবল আল্লাহর যিকির ও স্মরণেই পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং আল্লাহু আকবার বলে, তার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায় আর যে ব্যক্তি সুবহানাল্লাহ ও আল-হামদুলিল্লাহ বলে, তার মাধ্যমেও আল্লাহর সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায়’।[8]

৬. দাওয়াতের পদ্ধতিগত শিক্ষা বা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দাওয়াতী দায়িত্ব অব্যাহত রাখা: দাওয়াতের পথে সমালোচনা, বিদ্রূপ ও বিরূপ আচরণ স্বাভাবিক বিষয়। একজন দাঈর দায়িত্ব হলো এসবের মুখে ভেঙে না পড়ে ইবাদত ও যিকিরের মাধ্যমে অন্তরের শক্তি অর্জন করা। আল্লাহ কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি জানি, তারা যা বলে তাতে আপনার বক্ষ সংকুচিত হয়। কাজেই আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করুন এবং সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হোন’ (আল-হিজর, ১৫/৯৭-৯৮)। তিনি আরও বলেন, ‘তাহলে তারা যা বলে তাতে ধৈর্যধারণ করুন এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে আপনার প্রভুর প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করুন’ (ত্ব-হা, ২০/১৩০)

পূর্ববর্তী নবীগণও মানুষের বিদ্রূপ, তিরস্কার ও কঠোর আচরণের সম্মুখীন হয়ে ধৈর্যধারণ করতেন এবং মানসিক ভারমুক্তির জন্য আল্লাহর যিকির ও স্মরণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং আপনি ধৈর্য ধরুন, যেমন পূর্ববর্তী দৃঢ় সংকল্পবান রাসূলগণ ধৈর্য ধরেছিলেন’ (আল-আহক্বাফ, ৪৬/৩৫) তিনি আরও বলেন, ‘তাহলে তারা যা বলে তাতে ধৈর্যধারণ করুন এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে আপনার প্রভুর প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করো’ (ত্ব-হা, ২০/১৩০)। হাদীছেও নির্দেশ আছে, ‘দুশ্চিন্তা বা কষ্টে পড়লে বিশেষ দু‘আ পাঠ করলে আল্লাহ প্রশান্তি দান করেন’।[9]

অতএব, দাওয়াতের পথে সফলতা অর্জন ও মানসিক দৃঢ়তা লাভের প্রধান উপায় হলো ধৈর্য, যিকির, দু‘আ ও ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। মানুষের বিরূপ আচরণ নয়, বরং আল্লাহর সান্নিধ্যই একজন দাঈকে প্রকৃত শক্তি ও স্থিতিশীলতা প্রদান করে। মানুষের নেতিবাচক আচরণ একজন দাঈকে দুর্বল করতে পারে না। কারণ প্রকৃত শক্তি আসে কেবল আল্লাহর সান্নিধ্য থেকে। আল-কুরআনের আরেক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে,الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللَّهِ ‘যারা ঈমান এনেছে, তাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণেই প্রশান্ত হয়’ (আর-রা‘দ, ১৩/২৮)। কুরআনের আয়াতসমূহে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, পূর্ববর্তী নবীগণও মানুষের বিদ্রূপ, অস্বীকৃতি ও কঠোর আচরণে মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত হতেন। তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দুশ্চিন্তা দূর করার সহজ ও কার্যকর উপায় শিক্ষা দেন। ধৈর্য ও যিকিরের শক্তি অর্জনের মাধ্যমেই তারা নানা বাধা ও বিপদ অতিক্রম করেছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা, দু‘আ, যিকির ও ছালাত হলো মানসিক প্রশান্তি লাভের প্রকৃত উপায়।

৭. আজকের মুসলিমদের জন্য বাস্তব শিক্ষা: ধর্মচর্চার পথে অগ্রসর হলেই আজও সমালোচনার কণ্টক বিঁধে যায়, বিদ্রূপের তীর এসে অন্তরকে বিদ্ধ করে। তবুও হক্বের পথিকের যাত্রা থেমে থাকে না। সে ছালাতের সঞ্জীবনী শক্তিতে, যিকিরের মাধুর্যে এবং তাসবীহের প্রশান্ত স্রোতে নিজের অন্তরকে দৃঢ় করে। কারণ সে জানে যে, প্রকৃত শক্তি মানুষের জিহ্বায় নয়; বরং প্রকৃত শক্তি নিহিত থাকে আল্লাহর স্মরণে অবিচল অন্তরে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যেমন ভয় করা উচিত এবং মুসলিম হওয়া ব্যতীত মৃত্যুবরণ করো না’ (আলে ইমরান, ৩/১০২)। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা যতটুকু সহজ মনে করো, ততটুকু কুরআন পড়ো এবং ছালাত ক্বায়েম করো...’ (আল-মুযযাম্মিল, ৭৩/২০)। প্রধান ইবাদত ছালাত শুধু আধ্যাত্মিক প্রশান্তি নয়, বরং তা নৈতিক সুরক্ষারও উপায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ছালাত অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৪৫)। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি বলে, আল্লাহ আমার রব, তারপর সে তার কথার উপর অটল থাকে, ফেরেশতারা তার নিকট অবতীর্ণ হয়’ (ফুছছিলাত, ৪১/৩০)। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের আমল গণনা হতে থাকে’।[10] মুসলিমের জীবন একটানা ইবাদতের ধারাবাহিক যাত্রা, মৃত্যু হলো তার সমাপ্তি বিন্দু। অতএব, ততক্ষণ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

৮. ছালাত, যিকির ও সিজদার মাধ্যমে মানসিক শান্তি: মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে ছালাত কার্যকরী ওষুধ। সিজদা শুধু শরীরের ক্রিয়া নয়, বরং অন্তরের বিনয় প্রকাশ। এর মাধ্যমে মানসিক চাপ লাঘব হয় এবং আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুঃখ-কষ্টে গভীর আত্মপ্রশান্তি অর্জন করা যায়। সুশৃঙ্খল জীবন লাভের একমাত্র মাধ্যম হলো ছালাত। মন খারাপ, হতাশা বা দুঃখে পড়লে ‘সুবহানাল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ’ বলা এবং ছালাতে দাঁড়ানোই হলো সর্বোত্তম থেরাপি। একারণে আল্লাহ বলেন, ‘আর সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও’ (আল-হিজর, ১৫/৯৭-৯৮)। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই ছালাত কুৎসা ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখে’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৪৫)। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি সিজদা করো এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করো’ (আল-আলাক্ব, ৯৬/১৯)। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বান্দা তার রবের সবচেয়ে নিকটে হয় যখন সে সিজদায় থাকে’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমার চোখের শীতলতা (শান্তি) ছালাতে’।[11] এক ছাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ইসলামে কোন কাজটি শ্রেষ্ঠ? তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সময়ের মধ্যে ছালাত আদায় করা’।[12] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুঃখের সময় বলতেন, ‘হে বেলাল! ছালাত ক্বায়েম করো, এর দ্বারা আমাদের মন প্রশান্ত করো’।[13]

উপসংহার:

সূরা আল-হিজরের আলোচ্য আয়াত, তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আয়াত ও হাদীছসমূহ প্রমাণ করে যে, ইবাদত আজীবনের এক অবিরাম যাত্রা, যা মৃত্যুর মধ্য দিয়েই শেষ হয়। ইবাদত কেবল আচার নয়; বরং নৈতিক দৃঢ়তা, আধ্যাত্মিক প্রশান্তি ও অন্তরের শক্তি প্রদান করে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের গবেষণাও প্রমাণ করে যে, মানসিক চাপ নিরসনের প্রকৃত সমাধান হলো প্রশান্তির উৎসে মনোনিবেশ করা। ইসলামে সেই প্রশান্তির উৎস হলো ছালাত, যিকির ও তাসবীহ পাঠ। অতএব, মুসলিমের উচিত আজীবন ধারাবাহিকভাবে ইবাদত করা, যাতে মৃত্যুর মুহূর্তে সে আল্লাহর কাছে ঈমানদার বান্দা হিসেবে ফিরে যেতে পারে।

দাওয়াতের পথে বিরোধিতা, অপমান, উপহাস একজন দাঈর জীবনের অনিবার্য সঙ্গী। এখান থেকে উত্তরণের প্রথম ও প্রধান উপায় হলো ধৈর্যধারণ করা। পূর্বের যুগের নবীদের জীবন থেকে ধৈর্যের শিক্ষা নিতে হবে। বিরোধী শক্তির আক্রমণ, কটূক্তি বা মিথ্যাচারকে গুরুত্ব না দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। মনে রাখতে হবে সাহায্য, মান-সম্মান, ক্ষমতা সবকিছুর মালিকানা আল্লাহর হাতে। এগুলোর কোনো কিছুই মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই।

উক্ত আয়াতগুলো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তরকে সান্ত্বনা দিয়ে যেমন তাঁর দায়িত্বপালনে শক্তি জুগিয়েছে, তেমনি প্রতিটি যুগের মুসলিমের জন্য জীবনের কঠিন মুহূর্তে আল্লাহর স্মরণে ফিরে যাওয়ার পথনির্দেশনা দিয়েছে। আধুনিক বিশ্বে মানসিক চাপ, ইসলাম বিদ্বেষ ও নৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে আয়াতগুলোর শিক্ষা অত্যন্ত যৌক্তিক ও অধিক প্রাসঙ্গিক।

সূরা আল-হিজরের এই তিনটি আয়াতকে কুরআনের সাইকোস্পিরিচুয়াল থেরাপি (Psychospiritual Therapy) বা মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বলা যায়।

মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল

প্রভাষক (আরবী), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বরিশাল।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৬৩।

[2]. ওয়াহবাতুল যোহাইলী, তাফসীরুল মুনীর, ১৪/৭৪।

[3]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৪/৬৬৫।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/১১১৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৩৫১।

[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৬৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৪২।

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/১৪৬৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৫৩।

[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮৮।

[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৩০।

[9]. মুসনাদ আহমাদ, হা/৩৭১২।

[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৩১।

[11]. নাসাঈ, হা/৩৯৪০।

[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৫।

[13]. আবূ দাঊদ, হা/৪৯৮৫; মুসনাদ আহমাদ, হ/২২৫৮৯।

Magazine