কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মুসলিমদের অবক্ষয়ের কারণ ও উত্তরণের পথ (পর্ব-২)

post title will place here

দ্বিতীয় শর্ত হলো আল-কুরআনের দর্শন:

বিভিন্ন দৃশ্যমান ও অভ্যন্তরীণ নেয়ামতের প্রতি মানুষ যখন আকৃষ্ট হয়, তখন আল-কুরআন তাকে সতর্ক করে দিয়েছে,أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً ‘তোমরা কি দেখো না আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলে যা কিছু আছে, সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন?’ (লোক্বমান, ৩১/২০)। আর এই নেয়ামতসমূহ কারও পক্ষ থেকে অস্বীকার করা সম্ভব নয় এবং এভাবে ভবিষ্যতে পৃথিবীতে যারা নেতৃত্ব দেবে, তাদের ভয় দূর হয়ে যাবে এবং এমন কিছু অর্জন করবে, যা বিশ্বের কোনো সংস্কার বা বিপ্লব অর্জন করতে পারবে না। আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস, আক্বীদার বিশুদ্ধিকরণ এবং নৈতিকতার পরিশুদ্ধকরণ প্রত্যেক ব্যক্তি ও সমাজকে এমন পরিবর্তন এনে দিয়েছিল যে, তখন বিভ্রান্তি এবং বিচ্যুতি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল আর পৃথিবী একত্ব, বিজ্ঞান ও আদর্শিক জ্ঞানের আলোতে আলোকিত হয়েছিল।[1] অতএব, এটা সুস্পষ্ট যে, তত্ত্ব ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কুরআন মানবজাতিকে যে পথ দেখিয়েছে এবং উন্নত ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করেছে, তার চেয়ে আর কোনো মহৎ উপায় নেই। ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল-কুরআনের প্রথম বিচ্ছুরিত আলোয় আলোকিত একজন মানুষ সর্বনিম্ন যা অর্জন করতে পারে, একজন সেক্যুলার তা করতে পারে না।

বিশ্বাস এবং আক্বীদা একজন মুমিনের আসল মূলধন। যদি সে এটি হারায়, তবে সে তার জীবনের একমাত্র মূলধন হারায়। বিজ্ঞানী টলস্টয়[2] বলেছেন, বিশ্বাস হলো সেই জিনিস, যার মাধ্যমে মানুষ বেঁচে থাকে। এর অর্থ হলো বিশ্বাস জীবনের অন্যতম সেরা মূলধন। যদি কোনো ব্যক্তি এটি হারায়, তবে সে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূলধন হারায়। এটি কোনো গোপন বিষয় নয় যে, আশ্বাস, আধ্যাত্মিক, মানসিক সুরক্ষা ইত্যাদি এক একটি জীবনের মূল্যবান মূলধন। এদের যে কোনো একটির ক্ষতি মানুষের সুখ এবং স্থিতিশীল শান্তিপূর্ণ জীবন লাভের ক্ষেত্রে অভাব সৃষ্টি করে।[3]

তাছাড়া যেসব বৈষয়িক মানদণ্ড ও পার্থিব ধারণা কুরআনে কারীমের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সেগুলো মানুষকে বিশৃঙ্খলা, দুঃখ-দুর্দশা ও যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে দূরে রাখতে অক্ষম। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, নৈতিক অঙ্গীকার ও নৈতিক ঈমানী শক্তি না থাকলে শান্তি লাভ অসম্ভব হতো। আল্লাহ তাআলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً ‘হে মুমিনগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে (শান্তিতে) প্রবেশ করো’ (আল-বাক্বারা, ২/২০৮)। আর শান্তি ও প্রশান্তি আভিধানিক অর্থে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। আয়াতটি সকল মুমিনকে শান্তি ও প্রশান্তি এবং মহান আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। এই আয়াতের অর্থ থেকে কেবল এই সমাধানই আসে যে, ইসলামের ছায়াতলে দৃঢ় বিশ্বাস এবং নৈতিক মূল্যবোধের আনুগত্যের মাধ্যমেই শান্তি অর্জন করা সম্ভব।

অতএব, এটি বলা যেতে পারে যে, আয়াতটি ভাষা, জাতি, সম্পদ, অঞ্চল এবং সামাজিক শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য না করে সকল মুমিনকে পুনর্মিলন, শান্তি, নম্রতা এবং আনুগত্যের মাধ্যমে এই সত্য উপলব্ধি করার আহ্বান জানায় যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে বিশ্ব রাষ্ট্রকাঠামোর গণ্ডিতে শান্তির সমাজে বাস করা সম্ভব।[4]

এছাড়া এমন উপাদান দিয়ে মানুষের শারীরিক কাঠামো গঠিত, যা মানুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। তাই তার হৃদয়ে এমন দৃঢ় যোগসূত্র থাকা প্রয়োজন, যা তাকে মানুষের মধ্যে আত্মিক সংযোগ তৈরিতে সাহায্য করে, সেই যোগসূত্রটি মহান আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস। বিশ্বাস মানুষকে সামাজিক ভেদাভেদ থেকে সুরক্ষা দান করে এবং সমাজে বিদ্যমান গোলকধাঁধা থেকে বাঁচিয়ে রাখে, যার স্রোতে সে ভাসমান। বিশ্বাস মানুষের চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন করে তাকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যে, সে গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তীক্ষ্ণ বিচক্ষণ এবং পরম পরিণামদর্শী হতে পারে। অতএব, বিশ্বাস এমন একটি শক্তি, যা মানুষকে সাফল্যের দিকে পরিচালিত করে।[5] আর সর্বোত্তম কাজ তথা সর্বজনীন ন্যায়বিচার করতে পারে এবং তার মুমিন ভাইয়ের ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হতে পারে।

ঈমান স্বয়ং আত্মার মূলধন, বরং এটি মূলধনের সম্ভাব্য বাহ্যিক কাঠামোর প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মহান আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ - تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ‘হে ঈমানদারগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন বাণিজ্যের পথ দেখাব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? আর তা হলো তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে’ (আছ-ফ, ৬১/১০-১১)। কুরআনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমানকে ব্যবসা, লাভজনক পুঁজি ও বাণিজ্য বলে অভিহিত করেছেন৷ মুনাফার উদ্দেশ্যে পুঁজি ব্যয় করতে আগ্রহীর কথা উক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। এই আয়াতে বিশ্বাসের ব্যবসায় জীবনকে মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করতে বলা হয়েছে। এই ব্যবসার বিষয়কে আল্লাহ তাআলা আরও মহিমান্বিত করে বলেছেন, এটি একটি মহান মর্যাদার ব্যবসা এবং তা থেকে অর্জিত মুনাফা যন্ত্রণাদায়ক আযাব থেকে মুক্তির রক্ষাকবচ।[6]

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মানুষ নৈতিকতা জানা এবং নৈতিক আদর্শ গ্রহণ করার পূর্বে বস্তুবাদ সম্পর্কে জানত। উদাহরণস্বরূপ, যখন আপনি বলেন যে, সম্পদ জীবনের মূলধন; শ্রোতা এই বক্তব্যের বৈধতা উপলব্ধি করে এবং এর মূল্য জানে। কিন্তু একইভাবে, সচ্চরিত্র ও নৈতিক গুণের চর্চা জীবনের আরেকটি মূলধন—যা সুখ এবং পরিপূর্ণতা লাভে অনুপ্রাণিত করে, যার প্রভাব সম্পদের প্রভাবের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু মানুষ যত তাড়াতাড়ি সম্পদের গুরুত্ব বুঝে, তত তাড়াতাড়ি নৈতিক চরিত্রের গুরুত্ব বুঝতে পারে না। এমনিভাবে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা এই মহান অনুগ্রহের অধিকারী হন। তারা ঈমানের ছায়ায় আনন্দঘন ও পরিতৃপ্ত জীবন লাভ করেন। তাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতা এবং দীর্ঘ জীবনের উৎস হলো এই ঈমান, যা তাদের অজান্তেই তাদের হৃদয়ে বপন করা হয়েছে। পক্ষান্তরে অনেকে যন্ত্রণা, দ্বিধা, ভয়, আতঙ্ক ও অনুভূতি শক্তির স্বল্পতার মধ্যে জীবন কাটায়; অথচ তারা এর মূল কারণ জানে না। সেটা হচ্ছে তারা জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূলধন ঈমান হারিয়েছে। জেনে রাখুন! তা হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান।[7]

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি ঈমানের প্রথম প্রভাব হলো এটি নৈতিকতার ভিত্তি। কারণ নৈতিকতার শৃঙ্খল যেমন— তাক্বওয়া, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, ত্যাগ, আন্তরিকতা ইত্যাদি আল্লাহর উপর বিশ্বাস এবং তাঁর অস্তিত্বকে স্বীকার করার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। কারণ এগুলোর কোনোটিই স্বগোত্রীয় আদর্শের বিপরীত নয়।

দ্বিতীয় বিষয়- আন্তরিকতা ও মানবিক ঐক্য এবং ব্যক্তি ও সামাজিক বিশ্বাসের উপর এর প্রভাব:

মানুষের নিয়্যত ও চারিত্রিক পরিপূর্ণতা ততটুকু হয়, যতটুকু সে তার নিজ সত্তা ও কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নিয়্যতের একনিষ্ঠতা উক্ত পরিমাণের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। আলী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘ঐ ব্যক্তি ধন্য যার আমল, জ্ঞান, ভালোবাসা ও বিদ্বেষ আল্লাহ পরিশুদ্ধ করেছেন এবং তার গ্রহণ, বর্জন, বক্তব্য, নীরবতা, কাজ ও কথাকে একনিষ্ঠ করেছেন’।[8] তিনি আরও বলেছেন, ‘আমল পরিশুদ্ধ করা আমল করার চেয়ে অনেক কঠিন আর ধ্বংসের হাত থেকে ঈমান রক্ষা করা দীর্ঘকাল ইবাদতে ব্যস্ত থাকার চেয়ে অনেক কষ্টসাধ্য বিষয়’।[9] এটা লক্ষণীয় যে, সাধারণভাবে যুবসমাজ তাদের কর্মের ক্ষেত্রে আন্তরিক হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে না। সত্যকে মান্য করার ইচ্ছা থাকলেও জৈবিক চাহিদার প্রবল প্রভাবের কারণে তারা কখনো কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তবে এটি কোনো উদ্বেগের বিষয় নয়। কারণ একজন যুবক যখন সমাজে পথ চলা শুরু করে, তখন সে ভালো কাজের চর্চার মাধ্যমে তার নিয়্যতকে অপবিত্রতার কলুষতা থেকে পরিষ্কার করে। মানুষ যখন আত্মশুদ্ধির উচ্চ স্তরে পৌঁছে যায়, তখন তার আত্মা কাঙ্ক্ষিত পূর্ণতা লাভ করে। এটি কোনো গোপন বিষয় নয় যে, কাঙ্ক্ষিত পরিপূর্ণতার দিকে মানুষকে অগ্রসর করতে উত্সাহ প্রদান কিংবা ভয় দেখানোর ইতিবাচক প্রভাব বিজ্ঞানীরা অবগত হয়েছেন। শিক্ষা এই ইঙ্গিত দেয় যে, উৎসাহ প্রদানের প্রভাব শিক্ষার উপর সবচেয়ে স্পষ্ট এবং সর্বোত্তম।

আল-কুরআনের বহু আয়াতে পাপকর্মের ব্যাপারে সতর্ক এবং ভালো কাজের শুভ সংবাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে সৎকর্ম ও অর্পিত দায়িত্ব পালনের ছওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কর্তব্য পালনে অবহেলাকারী বা ত্রুটিকারীর শাস্তি দ্বিগুণ করা হয়নি। আল্লাহ তাআলার বাণী,مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا وَمَنْ جَاءَ بِالسَّيِّئَةِ فَلَا يُجْزَى إِلَّا مِثْلَهَا وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ ‘যে সৎ কর্ম করবে, সে ১০ গুণ বেশি নেকী পাবে এবং যে মন্দ কাজ করবে, তাকে তার সমপরিমাণ ছাড়া কোনো অতিরিক্ত শাস্তি দেওয়া হবে না আর তাদের প্রতি কোনো যুলম করা হবে না’ (আল-আনআম, ৬/১৬০)। আলী রাহিমাহুল্লাহ মালিক আল-আশতার রাহিমাহুল্লাহ-কে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘তারা আশায় ব্যর্থ; কিন্তু ভালো কাজে তাদের প্রশংসা অব্যাহত ছিল আর তাদের মধ্যে যারা দুঃখ-কষ্ট পেয়েছিল তাদের শাস্তির মাত্রা বৃদ্ধি পায়নি। কারণ তাদের নেক আমলের অধিক স্মরণ সাহসীদেরকে উদ্বুদ্ধ করে এবং শাস্তি ভোগকারীকে অনুপ্রাণিত করে’।[10]

কুরআন মাজীদে মানুষের সুখময় জীবন লাভের পথ সম্পর্কে মহান আল্লাহ আলোচনা করেছেন, যাতে তাদেরকে মহৎ নৈতিকতা অর্জন, সৎকর্ম সম্পাদন, প্রতিকূলতায় ধৈর্যধারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা যায়। একবার আল্লাহ বলেছেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ - جَزَاؤُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ‘আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করছে, তারাই শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি, তাদের জন্য তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত আর তারা তাতে চিরস্থায়ী থাকবে’ (আল-বাইয়িনাহ, ৯৮/৭-৮)। আবার কখনো অন্য সূরায় তিনি বলেন,يَا أَيُّهَا الْإِنْسَانُ إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَى رَبِّكَ كَدْحًا فَمُلَاقِيهِ ‘হে মানুষ! তুমি তোমার পালনকর্তার জন্য পরিশ্রম করেছ। অতএব, তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করো’ (আল-ইনশিক্বাক্ব, ৮৪/৬)। আর অন্যটি মানুষকে নেক আমলের দিকে আহ্বান করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ‘আর ভালো কাজ করো, নিশ্চয় আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৫)। অথবা তিনি তাদেরকে কল্যাণের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং সৎকর্ম সম্পাদনে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যেমনটি মহান আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُونَ - أُولَئِكَ يُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَهُمْ لَهَا سَابِقُونَ ‘যারা তাদের প্রিয় বস্তু দান করে আর তাদের অন্তর ভীত-শঙ্কিত থাকে এ জন্য যে, তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে। আর তারাই কল্যাণের কাজে দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং তাতে তারা অগ্রগামী’ (আল-মুমিনূন, ২৩/৬০-৬১)। কেননা কল্যাণের এই প্রতিযোগিতা ঈমানের অন্যতম নিদর্শন এবং কখনো কখনো মহান আল্লাহ মুজাহিদদেরকে তাদের কাজে উৎসাহিত করার জন্য সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ‘আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট’ (আল-বাইয়্যিনাহ, ৯৮/৮)। আর তিনি নিজেকে দাতা ও মুত্তাক্বীদের সহযোগী ও সাহায্যকারী উল্লেখ করে বলেন,إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا وَالَّذِينَ هُمْ مُحْسِنُونَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাক্বী এবং যারা সৎকর্মপরায়ণ তাদের সাথে আছেন’ (আন-নাহল, ১৬/১২৮)। পরিপূর্ণতা ও কল্যাণের পথে পৌঁছার জন্য তিনি ঈমানদারদের উৎসাহিত এবং অনুপ্রাণিত করেন। এর পাশাপাশি তিনি মুশরিক ও নাস্তিকদের সতর্ক করেন এবং কাফের ও পাপাচারীদের অনন্তকাল জাহান্নামে অবস্থান কামনা করে তাদেরকে তাঁর ক্রোধের কথা জানিয়ে দেন। এমন অবস্থা সম্পর্কে বুঝানোর জন্য প্রথমত মহান আল্লাহ তাঁর নবী মূসা আলাইহিস সালাম-এর বাণী পেশ করে অবাধ্যদের সম্মুখে ঘোষণা করেন, إِنْ تَكْفُرُوا أَنْتُمْ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا فَإِنَّ اللَّهَ لَغَنِيٌّ حَمِيدٌ ‘আপনি এবং পৃথিবীর সকল মানুষ যদি কাফের হয়ে যান, তবে নিশ্চয় আল্লাহ বিত্তশালী, প্রশংসিত’ (ইবরাহীম, ১৪/৮)

দ্বিতীয় শর্ত হলো ব্যক্তি ও জাতির ঈমানের ওপর আন্তরিকতার প্রভাব:

ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কুরআনের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বরকতময় পুনর্জাগরণের সূচনায় এর ভূমিকা সুস্পষ্ট। কারণ জাতির দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এরূপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং কুরআনের সকল সূরায় বর্ণিত আন্তরিকতার মর্মার্থের প্রভাবকে ইচ্ছার স্বাধীনতা, মানব ব্যক্তিত্ব গঠন ও তার প্রস্তুতির প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমরা দেখতে পাই যে, বিশ্বের যেকোনো নবজাগরণের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ হচ্ছে এর লোক ও নেতাদের বস্তুবাদ থেকে দূরে রাখা এবং নৈতিকতা ও নৈতিক চেতনার প্রতি তাদের আনুগত্য ধরে রাখা, যাতে তারা একটি দৃঢ় ভিত্তির উপর বীরদর্পে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

ইচ্ছার স্তরে কুরআন মানুষের ইচ্ছাকে প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করেছে। তাই কুরআনের শিক্ষার ফলে একজন মুসলিম তার প্রবৃত্তিকে বাধা দিতে এবং বিভিন্ন কল্পনার প্রলোভন ও প্রবৃত্তির রঙিন চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন,

زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَآبِ - قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَلِكُمْ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ

‘মানুষের কাছে সুশোভিত করা হয়েছে নারী, সন্তান, পুঞ্জীভূত স্বর্ণ ও রৌপ্যভাণ্ডার, চিহ্নযুক্ত অশ্ব, গৃহপালিত পশু এবং শস্যক্ষেত্র; এসব পার্থিব জীবনের সম্পদ আর আল্লাহরই নিকট রয়েছে উত্তম আশ্রয়স্থল। বলুন! আমি কি তোমাদেরকে এসব হতেও অতি উত্তম কোনো কিছুর সংবাদ দেব? যারা মুত্তাক্বী তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট এমন বাগান রয়েছে, যার নিম্নদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত, তারা তাতে চিরকাল থাকবে আর রয়েছে পবিত্র সঙ্গী এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি, বস্তুত আল্লাহ বান্দাগণের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা’ (আলে ইমরান, ৩/১৪-১৫)

এই শিক্ষা ও বশ্যতার অন্যান্য মডেলের মাধ্যমে কুরআন মানুষকে তার অভ্যন্তরীণ কামনা-বাসনার দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে, যা তার হৃদয়ে মিশ্রিত রয়েছে; যাতে মানুষের ইচ্ছা কামনার হাতিয়ারে পরিণত না হয়। এমন কোনো চালিকাশক্তি নেই, যা মানুষের ইচ্ছাকে দৈর্ঘ্য-প্রস্থসহ পূর্ণ মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে তার অভ্যন্তরীণ কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত করার এই প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছেন ‘জিহাদ আল-আকবার’।[11]

(ইনশা-আল্লাহ চলবে)

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                    মুহাম্মাদ মুস্তফা কামাল

প্রভাষক (আরবী), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বরিশাল।


[1]. মুহাম্মাদ ফখরুদ্দীন আর-রাযী, তাফসীরুল কাবীর, ১৩/১৩৫।

[2]. একজন রাশিয়ান গবেষক ও সাহিত্যিক; বিশ্বের নামকরা লেখকদের একজন।

[3]. শহীদ মুর্তজা আল-মাতহারী, ধর্মীয় ও সামাজিক ভাষণ, পৃ. ২৭১।

[4]. আল-ফযল বিন হাসান আত-ত্ববরিসী, মাজমাউল বায়ান, ২/৪৪-৪৫।

[5]. কার্লন ওয়েলসন, রিহলাতুন নাহওয়াল বিদায়া, পৃ. ৪৫০।

[6]. মুহাম্মাদ হুসাইন আত্ববাত্ববাই, আল-মীযান ফী তাফসীরিল কুরআন, ১৯/২৬৮।

[7]. শহীদ মুর্তজা আল-মাতহারী, ধর্মীয় ও সামাজিক ভাষণ, পৃ. ২৭৩।

[8]. শয়খ মুহাম্মাদ আল-হুসাইন ইবনে আলী ইবনে শু‘বা, তাহুফফুল উকূল আন আলির রাসূল, পৃ. ১০০।

[9]. বাহরুল আনওয়ার, ৭৭/২৮৮।

[10]. মুহাম্মাদ আব্দুহু, নাহজুল বালাগা, ৩/৬০৯।

[11]. সৈয়দ মুহাম্মাদ বাক্বির আল-হাকীম, উলুমুল কুরআন, পৃ. ৬৯।


Magazine