কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

সূরা আল-ফাতিহার তাফসীর (পর্ব-৪)

post title will place here

তিনি সেদিন একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক হবেন, যে ক্ষমতার প্রভাবে তাঁর আদেশ, নিষেধ, পুরস্কার ও শাস্তি সবকিছুই বাস্তবায়িত হবে। সকলের উপর তাঁর ক্ষমতা ব্যবহারের অবাধ অধিকার থাকবে। বিচার দিবসের যাবতীয় কার্যকলাপ তাঁর পরিকল্পনায় বাস্তবায়িত হবে। সেদিন দুনিয়ার রাজাদের ওপর তাঁর নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও একক নিয়ন্ত্রণ থাকবে। সেদিনের সবকিছু তাঁর আদেশে ও তাঁর নামে পরিচালিত হবে। বিশ্বজগতের সবকিছুর অধিপতি তিনি, কিন্তু বিচার দিবসকে তাঁর মালিকানার অধীন বলে বিশেষভাবে উল্লেখের কারণ হলো, সেদিন মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির সামনে আসল রূপে উপস্থিত হবেন। তিনি তাদেরকে তাদের কর্মের ভালোমন্দ প্রতিদান দিবেন। সেদিন তাঁর রাজত্ব, ন্যায়বিচার ও প্রজ্ঞা পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত হবে।[1] দুনিয়ায় যে-সব রাষ্ট্রপ্রধান অহংকার ও গর্ব করত এবং রাজত্ব ও কর্তৃত্বের প্রভাব দেখাত, সেদিন তারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে।[2] রাজা, প্রজা, কৃতদাস ও স্বাধীন সকলেই আল্লাহর নিকট সমমর্যাদার অধিকারী হবে। তারা সকলেই তাঁর মাহাত্ম্য ও ইযযতের নিকট অনুগত, তাঁর পুরস্কার ও প্রতিদানের জন্য অপেক্ষমাণ এবং শাস্তির ভয়ে ভীত থাকবে।[3] সেদিন অহংকার, মর্যাদা, ঔজ্জ্বল্য ও কর্তৃত্বের একমাত্র অধিকারী হবেন মহান আল্লাহ। তিনি বলেন, ‘যেদিন তারা বের হয়ে পড়বে, আল্লাহর কাছে তাদের কিছুই গোপন থাকবে না। আজ রাজত্ব কার? এক প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহর’ (গাফের, ৪০/১৬)

পূর্বের আয়াতগুলোর গবেষক এগুলোকে একজন মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তার হৃদয়ে গভীর বিশ্বাসের বীজ বপন করার সর্বোত্তম উপায় হিসাবে দেখেন। কারণ যদি তিনি বিশ্বাস করেন যে, এমন একটি দিন আসবে, যখন উপকারকারীর উপকার এবং অপরাধীর নির্যাতন প্রকাশিত হবে এবং বিচারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ সর্বশক্তিমান আল্লাহর হাতে থাকবে, তখন সৃষ্টিকর্তার প্রতি বান্দার পর্যবেক্ষণ শক্তিশালী হবে এবং তারা সরল পথে চলার চেষ্টা করবে। উপর্যুক্ত আয়াতের পূর্বের আয়াতত্রয়ে আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের হাক্বীক্বত, তাঁর মাহাত্ম্য, তাঁর কর্তৃত্বের ব্যাপকতা, তাঁর রহমতের প্রশস্ততা এবং দুনিয়া ও আখেরাতের বিষয়ের সম্মিলিত বর্ণনা এসেছে। তারপর কার উপাসনা করা এবং কার নিকট সাহায্য চাওয়া আমাদের উচিত, তার বর্ণনায় উক্ত আয়াতটি এসেছে। তিনি ঐ মহান সত্তা, যার গুণাবলি বিকশিত, যার মহিমা স্পষ্ট এবং এই বিশ্বজগতের ওপর যার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত।[4]

আমরা আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার নিকটেই সাহায্য প্রার্থনা করি অর্থাৎ আপনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদতও করি না এবং সাহায্যও চাই না। আরবী বাক্যে ক্রিয়ার পূর্বে কর্মের ব্যবহার সীমাবদ্ধতার অর্থ দেয় অর্থাৎ উক্ত ইবাদত আমরা একমাত্র আপনার উদ্দেশ্যেই সম্পাদন করি; অন্য কারো উদ্দেশ্যে নয়। এক কথায় তিনি মানুষকে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার, অন্য কারও ইবাদত না করার এবং একমাত্র তাঁর নিকটেই সাহায্য চাওয়ার, অন্য কারো নিকটে সাহায্য না চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। ইবাদতকে ইসতিআনাহ (সাহায্য চাওয়া) এর পূর্বে উল্লেখ করে বিশেষ ইবাদতকে সাধারণ ইবাদতের উপর এবং স্রষ্টার অধিকারকে মানুষের অধিকারের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন।

ইবাদত হলো এমন বাহ্যিক ও আন্তরিক কথা বা কাজের সমষ্টির নাম, যা আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন এবং যাতে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। ইসতিআনাহ হলো কল্যাণ লাভ এবং অকল্যাণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দৃঢ়তার সাথে মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করাই চিরস্থায়ী সুখ ও যাবতীয় অনিষ্ট থেকে মুক্তি লাভের উপায়। কেননা এছাড়া পরিত্রাণের কোনো বিকল্প নেই।[5] বরং একজন মুসলিম অকৃত্রিম আত্মসমর্পণ, বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর আত্মত্যাগে ভরা আনুগত্যের চূড়ান্ত সীমায় তখন পৌঁছতে সক্ষম হয়, যখন তার ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রদর্শিত পন্থায় সম্পাদিত হয়।[6]

উক্ত পদ্ধতিদ্বয়ের আলোকে আমল সম্পাদিত হলেই কেবল তা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। ইসতিআনাহ ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাকে পৃথকভাবে উল্লেখ করার কারণ হলো বান্দা তার প্রত্যেক ইবাদতে ইসতিআনাহ-এর মুখাপেক্ষী। কারণ আল্লাহ যদি না চান, তবে কেবল তাঁর হুকুম পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থেকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া যাবে না।[7]

আয়াতটির মর্মার্থ: হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা একমাত্র আপনার জন্য বিনীত, অনুগত ও বশীভূত। আপনার রক্ষণাবেক্ষণ ও হেফাযত দ্বারা আপনি আমাদের রক্ষা করেন এবং রহমত দ্বারা ঢেকে রাখেন। আপনার আনুগত্যের উপর সর্বদা টিকে থাকার জন্য আমরা একমাত্র আপনারই সাহায্য চাই। আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি কাজে আমরা একমাত্র আপনারই সহযোগিতা কামনা করি। আপনি ব্যতীত অন্য কারো নিকট আমরা আবেদন পেশ করি না। আপনি ইবাদতের যোগ্য, আপনি প্রত্যেক বস্তুর উপর ক্ষমতাবান এবং প্রত্যেক বস্তুর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত। কোনো বিষয়ই আপনার নিকট অদৃশ্য নয় এবং মনের গোপন খবর আপনার নিকট অজানা নয়।[8]

‘আপনি আমাদের সরল পথ দেখান; তাদের পথ, যাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন’। উক্ত আয়াতে সরল পথের দিকে আহ্বান জানানোর পদ্ধতি বর্ণনার পর তিনি আমাদেরকে সরল পথের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত করেছেন। যাতে অন্যের সাথে সংমিশ্রণে সরল পথ সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়। তিনি বলেছেন, ‘তাদের পথ, যাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন; তাদের পথ নয়, যাদের উপর আপনার রাগ বর্ষিত হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট’। অর্থাৎ এই সরল পথ ঐ সব নবী, সত্যবাদী, শহীদ ও নেককারদের পথ, যারা অনুগ্রহপ্রাপ্ত। তারা সঙ্গী হিসেবে কতই না উত্তম! যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আর যারা আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম মান্য করবে, তারা তাদের সাথে থাকবে, যাদের প্রতি তিনি অনুগ্রহ করেছেন’। জিজ্ঞেস করা হলো, তারা কারা? রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তারা হলেন নবী, সত্যবাদী, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ’।[9] উক্ত ব্যাখ্যা তাঁর বাণী-صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ[10] -এর।[11]

এরাই হলেন সঠিক পথপ্রাপ্ত এবং দৃঢ়ভাবে সত্যের ধারক। ছিরাতে মুস্তাক্বীমকে তাদের দিকে সম্পৃক্ত করার কারণ হলো, তারাই ছিরাতে মুস্তাক্বীমের প্রকৃত পথিক। ‘আল্লাহর ছিরাত’[12] বলে ছিরাতকে নিজের দিকে সম্পৃক্ত করার কারণ হলো তিনি এর সঠিক কাঠামো দান, একে চলার উপযোগী করা এবং এপথে চলার নির্দেশনা দান করেছেন।[13]

হেদায়াত ও ইসলাম হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। অতএব, যারা এই ধ্রুব সত্যকে চিনেছে এবং এর অনুসরণ করেছে, সত্যিকার অর্থে তারাই হেদায়াত পেয়েছে আর ছিরাতে মুস্তাক্বীমের অনুসারী হয়েছে। অতএব, নবীদের পর ছিরাতে মুস্তাক্বীমের সন্ধান পাওয়ার ক্ষেত্রে যারা অগ্রগামী, তারা হলেন ছাহাবায়ে কেরাম, যারা এই আয়াতের আলোকে শ্রেষ্ঠত্ব, সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী।[14]

অতএব, যারা এই পথের অনুসারী, তারাই মহান ব্যক্তিত্ব। আমরা আল্লাহর নিকট সর্বদা প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে তাদের সাথে যুক্ত করেন এবং তাদের পথ, আদর্শ ও নীতির আলোকে পথচলার তাওফীক্ব দান করেন।[15]

اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ-এর নিগূঢ় রহস্য হলো সত্যকে চেনা ও সে অনুযায়ী আমল করার জন্য সাধনা করা। সত্য চেনার পর সে অনুযায়ী আমল না করলে ছিরাতে মুস্তাক্বীমের অনুসারী হওয়া যায় না। যে ব্যক্তি ছিরাতে মুস্তাক্বীমের সন্ধান পেতে চায়, তাকে দুটি কাজ করতে হবে— ১. ছিরাতে মুস্তাক্বীমের সঠিক জ্ঞান অর্জন করার জন্য সাধনা করতে হবে এবং ২. ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। জ্ঞান আহরণের জন্য দীর্ঘ সময় শিক্ষকের সঙ্গ অবলম্বন করতে হবে। এটা অনেক কষ্টসাধ্য বিষয়। তাছাড়া জ্ঞান আহরণে জ্ঞানীর দারস্থ হওয়া কম মানসিক কষ্টের বিষয় নয়।[16]

অতএব, যিনি জ্ঞান আহরণ ও শিক্ষা অর্জনের আসনে সমাসীন হন, তাকে অনেক বিনয়ী হতে হয়। অনেকের পক্ষে এমনটি করা সম্ভব হয় না, ফলে সে ছিরাতে মুস্তাক্বীমের সন্ধান থেকে ছিটকে পড়ে। তাকে অনেক ব্যস্ততা, প্রবৃত্তির অনুসরণ, পারিবারিক অনেক কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়। এমনকি ঘুম ও আনন্দের মতো সুখ থেকেও বঞ্চিত হতে হয় আর তাকে ক্ষুধার্ত থেকেও দীর্ঘ সময় জ্ঞান আহরণে ধৈর্যধারণ করতে হয়।[17]

যখন মানুষ সুখের পিছনে ছুটে, তখন সুখ তার থেকে বিদায় নেয়; কিন্তু যার জীবন কষ্ট দিয়ে শুরু হয়, তার শেষের জীবন আনন্দের হয়। যে কষ্ট সহ্য করে, ধৈর্যধারণ করে, পরিশ্রম করে এবং সাধনায় আত্মনিয়োগ করে; তার পরিণাম সুখময় হয় এবং সে ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের পর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করে। ফলে সে আল্লাহর নিকট এক বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়।[18]

صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ বলে ছিরাতে মুস্তাক্বীম সম্পর্কে যে অস্পষ্টতা ছিল, তা দূর করা হয়েছে। কোনো বিষয়ের সংক্ষিপ্ত বর্ণনার পর বিস্তারিত আলোচনা উক্ত বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। ছিরাতে মুস্তাক্বীমের মূল উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করে। ফলে পূর্বে সংঘটিত বিষয়ের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ এবং সেটা পূর্ণাঙ্গরূপে পালনের জন্য এ পদ্ধতি আরও সহায়ক হয়।[19]

এখানে সরল পথকে অনুগ্রহপ্রাপ্তদের পথ বলে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এই পুনরাবৃত্তি ছিরাতে মুস্তাক্বীমের গভীর পরিচয় এবং এর প্রতিকূলতাগুলো সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য প্রচণ্ড ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। আর যে ব্যক্তি এই পথ অবলম্বন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, সে ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পতিত হবে। ছিরাতে মুস্তাক্বীমকে স্পষ্ট করা এবং এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা এই জন্য প্রয়োজন যে, যাতে এ সম্পর্কে সামান্যতম বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয় এবং মুসলিমদের চলার ক্ষেত্রে এটি সত্য ও স্পষ্ট হয়ে যায়। এটি ঐ রাস্তার প্রমাণ, যে পথে তারা চলেছেন। কারণ দৃঢ়তার গুণে এর গুণান্বিত হওয়া অত্যন্ত স্পষ্ট এবং তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।[20]

মূল বিষয় হলো এই বাক্যগুলো একে অপরকে এমনভাবে স্পষ্ট করে, যা সত্য সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তি অবশিষ্ট রাখে না। এগুলো সবই ছিরাতে অমূল্য হওয়ার প্রমাণ বহন করে। কারণ এটি সম্পর্কে জানা বা না জানার উপর সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা নির্ভর করে। কেননা একে জানা ও আঁকড়ে ধরার মাধ্যমেই সাফল্য অর্জিত হয় এবং অজ্ঞ থাকা বা এর আলোকে চলা থেকে এড়ানোর মাধ্যমে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।[21]

পূর্ববর্তী সৎ মানুষদের এই পথের পথিক বলে হেদায়াতের পথের যাত্রীদের এই সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে যে, তারা এই পথের একমাত্র পথিক নন, বরং পূর্বের অনেক মানুষ এ পথের পথিক ছিলেন। তাছাড়া সংখ্যার স্বল্পতার কারণে এই পথের পথিকদের একাকিত্ব অনুভব করার কোনো কারণ নেই। কেননা এ পথের পথিকের সংখ্যা যে কম হবে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পূর্বেই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অবহিত করে বলেছেন, ‘আপনার ঐকান্তিক আগ্রহ সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষ ঈমান আনবে না’ (ইউসুফ, ১২/১০৩)। সুতরাং এতে আপনার মন খারাপ করার কিছুই নেই। কারণ এটি সেই পথ, যে পথের পথিক ছিলেন অন্য নবী-রাসূলগণ। আর এ পথের পথিক তারাও যারা তাদের অনুসারী ছিলেন। এমন পরিচিত পথে চলতে পথিকের অস্বস্তিবোধ হয় না।[22]

মানুষ যখন সফরে কোনো পথ চলার বা কোনো অপারেশন করার অথবা এজাতীয় কোনো কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তখন তাকে এমন কাজ করতে হয়, যে কাজ ভীতিকর। তখন বলা হয়, এই কাজ, এই অপারেশন, এই পথে ভ্রমণে আপনি একা নন; বরং আপনার পূর্বে অনেক মানুষ এই পথের পথিক ছিলেন। তারা হলেন আপনার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। অমুক, অমুক, অমুক এবং অমুক এ পথে চলেছেন। তখন এটি তার জন্য স্বস্তিদায়ক হয়। তিনি অনুভব করেন যে, তিনি এ পথে অপরিচিত নন। তাই তিনি নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বস্তিবোধ করেন।[23]

হে আমাদের রব! আমাদেরকে আপনার সরল পথের দিকে পরিচালিত করুন, যা আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের সুখের দিকে নিয়ে যায় এবং আমাদেরকে আপনার সৃষ্টির মধ্যে যাদেরকে আপনি নেয়ামত দান করেছেন তাদের দলভুক্ত করুন। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদেরকে তাদের পথ থেকে রক্ষা করুন, যাদের ওপর আপনি তাদের খারাপ কাজের জন্য রাগান্বিত হয়েছেন এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছিল।[24]

এই প্রার্থনায় শিষ্টাচারের সর্বোচ্চ আদর্শ অবলম্বন করা হয়েছে। কারণ মুমিনগণ সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে অবগতির পরে সর্বপ্রথম এই প্রার্থনাটি করেছিলেন। এসবের আগে তিনিই সকল প্রশংসার যোগ্য, তিনিই বিশ্বজগতের প্রতিপালক এবং বিচার দিবসে তিনিই তাদের ওপর একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রয়োগকারী। ইবনু কাছীর রাহিমাহুল্লাহ একে প্রার্থনার সময় প্রার্থনার উপযুক্ত অবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন।

দায়িত্বশীল ব্যক্তির প্রশংসা করা, তারপর তার প্রয়োজন পূরণ করা এবং তার মুমিন ভাইদের প্রয়োজনের জন্য এই বলে প্রার্থনা করা যে, আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করুন। কারণ এটি প্রয়োজন পূরণের জন্য সবচেয়ে সফল উপায় এবং চাওয়া প্রাপ্তির জন্য সবচেয়ে বেশি কার্যকর। এই কারণেই আল্লাহ এই পথ দেখিয়েছেন। কারণ এটা সবচেয়ে নিখুঁত।

সরল পথ বলতে যে পথের সন্ধান করতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে প্রথম দাওয়াত দিয়েছেন অর্থাৎ সরল পথ বলতে যা বুঝায় তা হলো ইসলাম যে বিশ্বাস, নৈতিকতা এবং বিধিবিধান নিয়ে এসেছে, যেগুলোর অনুসরণ মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতে সুখের দিকে নিয়ে যায়। কারণ শান্তির পথ হলো সেই পথ, যে পথকে আল্লাহ তাআলা রিসালাতের মাধ্যমে সীলমোহর করে দিয়েছেন এবং কুরআনকে পূর্ণাঙ্গ সংবিধানে পরিণত করেছেন। এর প্রচার এবং বর্ণনার দায়িত্ব নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর অর্পণ করেছেন।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছে এমন সব প্রমাণ বর্ণিত হয়েছে, যা এই বক্তব্যকে সমর্থন করে। এর মধ্যে নাওয়াস ইবনে সামআন হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ সরল পথের একটি উদাহরণ দিয়েছেন। উক্ত পথের উভয় পাশে দুটি দেয়াল রয়েছে। দেয়ালগুলোতে অনেকগুলো খোলা দরজা রয়েছে। দরজার উপরে পর্দা ঝুলানো রয়েছে। দরজার প্রবেশপথে একজন আহ্বানকারী বলে, হে লোকেরা! সকলে একত্রে সোজা প্রবেশ করো এবং এদিক-সেদিক যেয়ো না। পথের ওপর থেকে আরেকজন আহ্বানকারী ডাকে। যদি কোনো ব্যক্তি ঐ দরজাগুলো খুলতে চায়, সে তাকে বলে, আপনার জন্য আফসোস! এটি খুলবেন না; কারণ আপনি যদি এটি খুলে দেন, তবে আপনি এতে প্রবেশ করে যাবেন। পথটি হলো ইসলাম। দুই পার্শ্বের দেয়ালগুলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধিবিধান এবং খোলা দরজাগুলো আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়। আর পথের ওপর থেকে আহ্বানকারী প্রত্যেক মুসলিমের হৃদয়ে আল্লাহর উপদেশদাতা।

আল্লাহ সরাসরি ‘অনুগ্রহপ্রাপ্তদের পথ’ দেখানোর কথা না বলে ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীমের পথ’ দেখানো বলার কারণ হলো যাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়েছে, তাদের পথই ছিরাতুল মুস্তাক্বীম।

এখানে اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ বলে মানুষ যেন বলছে, হে আল্লাহ! আমি আপনার আদেশ পালন করার জন্য প্রস্তুত। বলুন! আমাকে কী করতে হবে। আপনার উপদেশ আমার প্রয়োজন। যখন আপনি আমাকে যে উপদেশ দিবেন, আমি তাৎক্ষণিকভাবে সেটা পালন করব।

আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা কী করতে হবে বুঝে না। তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, তাদের কী করতে হবে। আপনি কয়েক বছর যাবৎ তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু তারা করে না। আমরাও আল্লাহর কাছে কী করতে হবে, সে উপদেশ চাচ্ছি, কিন্তু সময়মতো করছি না। এখন আমাদের উচিত আল্লাহ যা করতে বলেছেন, সেটাই করা। অন্তত চেষ্টা করা উচিত আর এটাই আমাদের প্রথম বিষয়।

দ্বিতীয়ত, হেদায়াত শব্দটির সমার্থক শব্দ আর-রুশদ। এটার মানে আরশিদনা অর্থাৎ আমাদের পথ নির্দেশনা দিন। আমাদেরকে সত্যের পথে পরিচালিত করুন। তাহলে রুশদ ও হুদার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? হুদা শব্দটি আরবী হাদিয়া থেকে এসেছে। আরবীতে হাদিয়া মানে উপহার। যখন কোনো ব্যক্তি হারিয়ে যায়, তখন তাকে সবচেয়ে বড় যে উপহারটি আপনি দিতে পারেন, তা হলো পথনির্দেশনা। তার জন্য পানি কিংবা খাবার কোনোটিই তেমন ভালো উপহার হিসেবে বিবেচ্য নয়। মরুভূমিতে যে বস্তুটি তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হলো পথনির্দেশনা। এ কারণে আরবরা পথনির্দেশনাকে বেঁচে থাকার সাথে যুক্ত করেছেন। মরুভূমিতে বেঁচে থাকার জন্য চূড়ান্ত পাথেয় হলো সঠিক দিকনির্দেশনা। অতএব, হেদায়াতের উপর অটল থাকার জন্য আমরা আল্লাহর নিকট যে চূড়ান্ত উপহার চাই, তা হলো সঠিক নির্দেশনা।

ইতিপূর্বে যা কিছু ছিল, তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। আল্লাহর প্রশংসা করা, তাঁর প্রভু হওয়া, তাঁর দয়া লাভে ধন্য হওয়া, বিচার দিবসে তাঁর বিচারের সম্মুখীন হওয়া— এর সবই ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। প্রতিটি মানুষই ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর বিচারের সম্মুখীন হবে, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে আমরা বহুবচনের দিকে প্রত্যাবর্তন করলাম। কারণ কেউ একা হেদায়াতের চূড়ান্ত পথ পেলে হবে না। যদি কেউ আল্লাহর সাথে ব্যক্তিগতভাবে একান্ত সম্পর্ক করত চায়, তবে তাকে সম্মিলিতভাবে আল্লাহর নিকট হেদায়াত চাইতে হবে। অন্যান্য মানুষকে বাদ দিয়ে একা একা হেদায়াত চাইলে হেদায়াত পাওয়া যাবে না।

ইসলামের খুবই সুন্দর একটা শিক্ষা হলো তথ্য আর হেদায়াত এক নয়। তথ্য হলো কোনো গন্তব্যে পৌঁছার বিবরণী, যা আপনাকে পার্থিব জীবনে সাময়িক কোনো ঠিকানায় পৌঁছাতে সাহায্য করবে। যেমন আপনি হারিয়ে গেলে কেউ আপনাকে বলল, সামনে এক কিলোমিটার গিয়ে বামে মোড় নিবেন, তারপর সামান্য গিয়ে আবার ডানে মোড় নিবেন, তারপর সোজা যাবেন— এটা হলো তথ্য। তথ্য কখনো কখনো শুধুই পথনির্দেশনা হয়ে থাকে। যেমন ট্র্যাফিক পুলিশ ও জিপিএসের পথনির্দেশনা। কিন্তু আল্লাহ তাআলার পথনির্দেশনা তথ্যের চেয়েও বেশি কিছু। আল্লাহর পথনির্দেশনা ব্যক্তিগত পছন্দ ও অপছন্দের প্রতিটি মুহূর্তের সাথে সম্পৃক্ত। আমরা আল্লাহর নিকট নিছক তথ্য চাই না, বরং আমরা চাই সেই শক্তি, যা দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি। তথ্যগত বিবরণী আর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানো এক জিনিস নয়। কখনো কখনো আমাদের কাছে সব তথ্যই থাকে, তারপরও আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের এমন ইচ্ছাশক্তি নেই, যা দিয়ে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হব। মানুষ যখন ভুল করে, তখন যদি তাকে তার ভুল সম্পর্কে অবহিত করা হয়, তবে সে তার ভুল স্বীকার করে। ভুল করার এমন অবস্থা থেকে বাঁচতেই আল্লাহর নিকট পথনির্দেশনা প্রার্থনা করা দরকার। পথনির্দেশনা যদি শুধু তথ্য হতো, তবে সেটা একবার পেলেই যথেষ্ট হতো। কারণ আপনাকে একবার তথ্য সরবরাহ করা হলে সে একই তথ্যের আর প্রয়োজন হয় না। আমাদের ঈমানের মানদণ্ড অনুযায়ী আমরা আল্লাহর নিকট ‘ইহদিনা’ বলি। যার ঈমান যত শক্তিশালী, সে তত বেশি আল্লাহর নিকট হেদায়াত চায়। বেঁচে থাকতে চাইলে আপনাকে যেমন কয়েক ঘণ্টা পরপর পানি পান করতে হবে, তেমনি বারংবার আল্লাহর কাছে হেদায়াত চাইতে হবে। হেদায়াতের বিষয়টি মানবদেহে পানির চাহিদার অনুরূপ। মানবদেহে যেমন কয়েক ঘণ্টা পরপর পানির প্রয়োজন হয়, তেমনি কয়েক ঘণ্টা পরপর তার অন্তরের পথনির্দেশনার প্রয়োজন হয়। আমাদের বারবার আল্লাহর নিকট ফিরে আসতে হবে এবং اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ বলতে হবে। এটা তথ্য নয় যে, একবার চাইলেই হয়ে যাবে; বরং এটা গাড়ির জ্বালানির মতো। জ্বালানি শেষ হলে যেমন বারবার জ্বালানি দিতে হয়, তেমনি বারবার হেদায়াত চাইতে হবে। কারণ অন্তরে ঈমানের আলোকবর্তিকা একটা সময় পর নিষ্প্রভ হয়ে যাবে। আপনাকে এ আলোকবর্তিকা আবার জ্বালাতে হবে। কেউ একথা বলতে পারে না যে, এটা আমি পেয়ে গেছি, আমার এটার আর প্রয়োজন নেই। পানির তৃষ্ণার মতো এটাকে বারবার চাইতে হবে।

সূরা আল-ফাতিহার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা অত্র সূরাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। এই সূরায় দুটি বিষয় আছে, একটি জ্ঞান এবং অপরটি কাজ। আলহামদু থেকে মালিকি ইয়াওমিদ্দীন পর্যন্ত পুরোটাই আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞানের কথা আর এরপর থেকে অবশিষ্টাংশ কাজ সম্পর্কে। সূরাটি শুরু হয়েছে জ্ঞান দিয়ে আর শেষ হয়েছে কাজ দিয়ে।

(চলবেইনশা-আল্লাহ)

প্রভাষক (আরবী), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বরিশাল।

[1]. আব্দুর রহমান আস-সা‘দী, তাফসীরুস সা‘দী (প্রকাশক: মুআসসাসাতুর রিসালা, প্রথম প্রকাশ: ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ), পৃ. ৩৯।

[2]. ইবনে জারীর আত্ব-ত্ববারী, তাফসীরে ত্ববারী (ছাপা ও প্রকাশনা: দারুল হিজর, কায়রো, মিশর; প্রথম প্রকাশ: ২০০১), ১/১৫০।

[3]. আব্দুর রহমান আস-সা‘দী, তাফসীরুস সা‘দী (প্রকাশক: মুআসসাসাতুর রিসালা, প্রথম প্রকাশ: ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ), পৃ. ৩৯।

[4]. মুহাম্মাদ সাইয়েদ আত-ত্বনত্ববী, তাফসীরে ওয়াসীত্ব (প্রকাশক: দারুন নাহযা, প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দ), পৃ. ২১।

[5]. তাফসীরুস সা‘দী, পৃ. ৩৯।

[6]. তাফসীরে ওয়াসীত্ব, পৃ. ২১।

[7]. তাফসীরুস সা‘দী, পৃ. ৩৯।

[8]. তাফসীরে ওয়াসীত্ব, পৃ. ২১।

[9]. আন-নিসা, ৪/৬৯।

[10]. আল-ফাতিহা, ১/৭।

[11]. উস্তায ড. খালিদ বিন উছমান আল-সাবত হাফিযাহুল্লাহ-এর লেকচার থেকে সংগৃহীত। লিংক:https://khaledalsabt.com/index.php/interpretations/3621/9.

[12]. আশ-শূরা, ৪২/৫৩।

[13]. উস্তায ড. খালিদ বিন উছমান আল-সাবত হাফিযাহুল্লাহ-এর লেকচার থেকে সংগৃহীত। লিংক:https://khaledalsabt.com/index.php/interpretations/3621/9.

[14]. আল-ফাতিহা, ১/৭।

[15]. তাফসীরে ওয়াসীত্ব, পৃ. ২২।

[16]. আল-ফাতিহা, ১/৭।

[17]. তাফসীরুস সা‘দী, পৃ. ৪০।

[18]. প্রাগুক্ত।

[19]. উস্তায ড. খালিদ বিন উছমান আল-সাবত হাফিযাহুল্লাহ-এর লেকচার থেকে সংগৃহীত। লিংক:https://khaledalsabt.com/index.php/interpretations/3621/9.

[20]. তাফসীরুস সা‘দী, পৃ. ৩৯।

[21]. আল-ফাতিহা, ১/৭।

[22]. উস্তায ড. খালিদ বিন উছমান আল-সাবত হাফিযাহুল্লাহ-এর লেকচার থেকে সংগৃহীত। লিংক:https://khaledalsabt.com/index.php/interpretations/3621/9.

[23]. প্রাগুক্ত।

[24]. প্রাগুক্ত।

Magazine