কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আত্মার পরিবর্তন: আল্লাহর সাহায্য ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন লাভের মাধ্যম

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ وَمَا لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَالٍ

সরল ‍অনুবাদ: ‘নিশ্চয় আল্লাহ কোনো ক্বওমের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আর যখন আল্লাহ কোনো জাতির মন্দ চান, তখন তা প্রতিহত করা যায় না এবং তাদের জন্য তিনি ছাড়া কোনো অভিভাবক নেই’ (আর-রা‘দ, ১৩/১১)

ভূমিকা:

আল্লাহ তাআলা সমগ্র সৃষ্টিজগতের একমাত্র স্রষ্টা, পরিচালক ও বিধানদাতা (আয-যুমার, ৩৯/৬২)। তাঁর জ্ঞান, ইচ্ছা ও প্রজ্ঞার বাইরে এই বিশ্বজগতে কিছুই সংঘটিত হয় না। মানুষকে তিনি এমন এক অনন্য মর্যাদা ও সামর্থ্য দিয়েছেন, যা অন্য কোনো সৃষ্টিকে প্রদান করা হয়নি। মানুষের অন্তরে তিনি জ্ঞান, বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি, বিবেক ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি স্থাপন করেছেন— যাতে মানুষ হক্ব-বাতিল, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা ও সরল-বক্র পথের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারে এবং সঠিক পথটি বেছে নিতে সক্ষম হয়।

কুরআনুল কারীম মানবজাতিকে আত্ম-সংশোধন, নৈতিক উন্নতি ও সামাজিক পরিবর্তনের জন্য গভীর দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে, এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আয়াত হলো,إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ততক্ষণ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের ভেতরের অবস্থা পরিবর্তন করে’ (আল-রা‘দ, ১৩/১১)

এই আয়াত আল্লাহর চিরন্তন বিধান বা সুন্নাতুল্লাহ (سُنَّةُ الله) প্রকাশ করে— যা নির্দেশ করে, ব্যক্তি বা সমাজের পরিবর্তন তাদের নিজস্ব নৈতিক, আত্মিক ও মানসিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ আল্লাহ কোনো জাতিকে হঠাৎ ধ্বংস বা উন্নতি করান না; বরং তারা যখন নিজেদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থা পরিবর্তন করে, তখনই আল্লাহ তাদের বাহ্যিক অবস্থায় পরিবর্তন আনেন।

আল্লাহ তাআলা মানুষকে সঠিক পথ ও ভ্রান্ত পথের স্পষ্ট পার্থক্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন,إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا ‘আমি তাকে সৎপথ দেখিয়েছি; এখন সে কৃতজ্ঞ হবে নাকি অকৃতজ্ঞ হবে, তা তার নিজের ব্যাপার’ (আল-ইনসান, ৭৬/৩)

অতএব, এই আয়াত মানবজীবনের এক মৌলিক নীতি নির্দেশ করে, তা হলো পরিবর্তনের সূচনা বাহ্যিক শক্তি বা পরিস্থিতি থেকে নয়; বরং আত্মিক ও নৈতিক পরিশুদ্ধতা থেকে হয়। এটি মানব-দায়িত্ব, জবাবদিহিতা ও আত্ম-উন্নয়নের দর্শনকে স্পষ্ট করে এবং সমাজের কল্যাণে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রেরণা প্রদান করে। মানবজাতির স্থায়ী উন্নতি ও সাফল্য অর্জনের একমাত্র পথ হলো অন্তর থেকে নৈতিক ও আত্মিক সংস্কার, যা প্রকৃত মুক্তি ও চিরস্থায়ী সাফল্যের দিকে পরিচালিত করে।

আয়াতের ভাষাগত বিশ্লেষণ:

يُغَيِّرُ (পরিবর্তন করা): এটি এসেছে মূল শব্দ غَيَّرَ থেকে, যার অর্থ হলো রূপান্তর করা, স্থানান্তর করা বা অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো। আয়াতে এটি নির্দেশ করছে যে, আল্লাহ কোনো জাতির সামাজিক বা আধ্যাত্মিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটান।

مَا بِقَوْمٍ (যা কোনো জাতির মধ্যে আছে): এখানে বুঝানো হয়েছে জাতির সামগ্রিক অবস্থা, সমাজব্যবস্থা, মর্যাদা, ঐক্য ও নিয়তি।

مَا بِأَنفُسِهِمْ (তাদের নিজেদের মধ্যে যা আছে): অর্থাৎ মানুষের আত্মা, নৈতিকতা, চরিত্র, অভ্যন্তরীণ বিশ্বাস ও চিন্তাভাবনা। حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটবে তখনই, যখন মানুষ নিজের অন্তর্নিহিত অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে।

মানব-ইচ্ছা ও আল্লাহর ইচ্ছার সম্পর্ক:

কুরআনে আল্লাহ তাআলা মানুষকে বারবার সঠিক পথ অবলম্বনের দিকে আহ্বান করেছেন। তিনি বলেন,فَمَن شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَن شَاءَ فَلْيَكْفُرْ ‘যে চায়, সে ঈমান আনুক আর যে চায়, সে কুফরী করুক’ (আল-কাহফ, ১৮/২৯)। এই আয়াত মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতার স্বীকৃতি দেয়। আল্লাহ মানুষকে এমন জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়েছেন, যার মাধ্যমে সে সঠিক ও ভুল পথের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। তবে একই সঙ্গে তিনি বলেন, وَمَا تَشَاؤُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ ‘তোমরা কোনো কিছুই ইচ্ছা করতে পার না, যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন’ (আল-ইনসান, ৭৬/৩০)

এই দুই আয়াতের সমন্বয়ে বুঝা যায়, মানুষের ইচ্ছাশক্তি বাস্তব, তবে তা আল্লাহর সর্বময় ইচ্ছার সীমার মধ্যেই কার্যকর। মানুষ তার কাজের জন্য জবাবদিহিমূলকভাবে দায়ী, কিন্তু তার ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত আল্লাহর নির্ধারিত পরিধির বাইরে নয়। এ নীতি শুধু নৈতিক শিক্ষা নয়; বরং এটি আল্লাহর এক চিরন্তন সুন্নাহ ইলাহিয়্যাহ—যা ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির উন্নয়ন কিংবা পতনের ভিত্তি নির্ধারণ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ اللّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরাই নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে’ (আল-রা‘দ, ১৩/১১)

এই আয়াত মানবজীবনের নৈতিক পরিবর্তনের মূলভিত্তি স্থাপন করে। মানুষের বিশ্বাস, নৈতিকতা, চিন্তাধারা ও আচরণ— এই চারটি উপাদানই তার ভাগ্য ও সমাজের অবস্থার নির্ধারক। যখন মানুষের অন্তর পরিশুদ্ধ হয় এবং তাদের জীবনে ঈমান, তাক্বওয়া ও ন্যায়ের আলো জ্বলে ওঠে, তখন আল্লাহ বর্ষণ করেন বরকত, প্রশান্তি ও কল্যাণের ধারা,وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَىٰ آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِم بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ ‘যদি জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমান ও যমীন থেকে বরকতের দরজা উন্মুক্ত করে দিতাম’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৯৬)। কিন্তু তারা যখন অবাধ্যতা ও গাফেলতিতে লিপ্ত হয়, তখন নেয়ামতগুলো প্রত্যাহার করা হয়, وَلَٰكِن كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُم بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ‘কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের কারণে’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৯৬)

মানব-ইতিহাস এই বিধানের জীবন্ত সাক্ষী। আদ ও ছামূদ জাতি, ফেরাউন ও বনী ইসরাঈল যখন অন্যায়ের পথে গিয়েছিল, তখন আল্লাহ তাদের উপর থেকে অনুগ্রহ তুলে নিয়েছিলেন। অতএব, পরিবর্তনের সূচনা অন্তর থেকেই শুরু হয়। যে জাতি আত্মশুদ্ধির পথে ফিরে আসে, আল্লাহ তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন আর যে জাতি অন্তর কলুষিত রেখে বাহ্যিক উন্নতির স্বপ্ন দেখে, তারা কখনোই আল্লাহর চিরন্তন বিধানের ব্যতিক্রম ঘটাতে পারে না। ইমাম কুরতুবী p বলেন, এই আয়াত মানবকর্মের দর্শনের মূলনীতি স্পষ্ট করে। মানুষ তার ইচ্ছার অধিকার রাখে, তবে সেই ইচ্ছা কখনও আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে বাস্তবায়িত হতে পারে না। এটি কদর (Divine Decree)-এর প্রমাণ’।[1]

সৎপথে অটল থাকার চ্যালেঞ্জ:

সৎপথে অবিচল থাকা সহজ কোনো কাজ নয়; বরং এটি ধৈর্য, অধ্যবসায় ও আত্মসংযমের এক অবিরাম সাধনা। সত্যের পথে যাত্রা কখনো মসৃণ হয় না; এটি কণ্টকাকীর্ণ ও পরীক্ষায় পরিপূর্ণ হয়। তথাপি এই পথেই নিহিত রয়েছে মানবজীবনের সত্যিকারের সফলতা ও চূড়ান্ত মুক্তি। আল্লাহ তাআলা বলেন, لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ - ثُمَّ رَدَدْنَاهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সর্বোত্তম গঠনে সৃষ্টি করেছি, তারপর তাকে নিকৃষ্ট অবস্থায় নামিয়ে দিয়েছি’ (আত-তীন, ৯৫/৪–৫)। এই আয়াত মানুষকে তার দ্বৈত সম্ভাবনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়— একদিকে উন্নত স্বভাব, জ্ঞান ও নৈতিক শক্তি, অন্যদিকে নৈতিক অধঃপতন ও প্রবৃত্তির দুর্বলতা। এই দুই বিপরীতমুখী শক্তির আকর্ষণে মানবসত্তা গঠিত। মানুষকে সদা নিজের মন্দ প্রবৃত্তি, অহংকার ও কামনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। এই সংগ্রাম সহজ নয়; এটি মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে কঠিন। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৬৯)

এই আয়াতে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, যারা আন্তরিকভাবে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য চেষ্টা করে, তিনি তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করবেন। এটি নির্দেশ করে যে, মানুষের প্রচেষ্টা অপরিহার্য আর সফলতা আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে সম্ভব। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বাস্তবতাকে এক গভীর উপমার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন,حُفَّتِ الجَنَّةُ بِالمَكارِهِ، وحُفَّتِ النَّارُ بالشَّهَواتِ ‘জান্নাতকে ঘিরে রাখা হয়েছে কষ্ট ও দুর্ভোগে আর জাহান্নামকে ঘিরে রাখা হয়েছে কামনা-বাসনায়’।[2]

এই হাদীছ স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, কল্যাণ ও মুক্তির পথ কখনো ভোগ-বিলাসের নয়; এটি আত্মসংযম, ত্যাগ ও ধৈর্যের পথ। সৎপথে অটল থাকতে মানুষকে বারবার নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয় এবং সেই প্রক্রিয়াতেই নিহিত থাকে তার প্রকৃত নৈতিক বিকাশ। অতএব, সৎপথে দৃঢ় থাকার চ্যালেঞ্জ হলো আত্মার পরিশুদ্ধি ও অন্তরের জিহাদ। যে ব্যক্তি এই পথে অবিচল থাকে, আল্লাহ তাআলা তার সঙ্গে থাকেন।

মানুষের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা:

তবে মানুষের এই স্বাধীনতা সীমাহীন নয়; বরং এটি একটি দায়িত্বপূর্ণ স্বাধীনতা, যা তাকে তার কর্ম ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার পথে পরিচালিত করে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে এমন এক সীমিত স্বাধীনতা দান করেছেন, যার মাধ্যমে সে নিজের চেষ্টার দ্বারা সৎপথ অবলম্বন করতে পারে। কিন্তু যদি মানুষ নিজেই নিজের অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা না করে, তবে আল্লাহও তার অবস্থা পরিবর্তন করেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ اللّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরাই নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে’ (আল-রা‘দ, ১৩/১১)। তিনি আরও বলেন,لِمَن شَاءَ مِنكُمْ أَن يَسْتَقِيمَ. وَمَا تَشَاؤُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ ‘তোমাদের মধ্যে যে সোজা পথে চলতে চায়, সে সোজা পথে চলতে পারে; তবে তোমরা কিছুই ইচ্ছা করতে পার না, যতক্ষণ না আল্লাহ জগৎসমূহের প্রতিপালক তা ইচ্ছা করেন’ (আত-তাকভীর, ৮১/২৮–২৯)

উল্লিখিত আয়াতসমূহ ব্যক্তি ও সমাজ পরিবর্তনের এক চিরন্তন ও মৌলিক নীতি প্রকাশ করে। এটি কেবল নৈতিক শিক্ষা নয়; বরং আল্লাহর নির্ধারিত এক চিরন্তন বিধান যা ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির উন্নয়ন কিংবা পতনের প্রকৃত কারণ নির্দেশ করে। এখানে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও আল্লাহর সর্বময় ইচ্ছার মধ্যে এক গভীর ও সূক্ষ্ম সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়েছে। মানুষের ইচ্ছা স্বাধীন, কিন্তু তা কখনোই আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে নয়। এই ভারসাম্যই মানব-অস্তিত্বের সৌন্দর্য, যেখানে মানুষের প্রচেষ্টা পরিবর্তনের সূচনা করে আর আল্লাহর ইচ্ছাই সেই পদক্ষেপকে সাফল্যের পথে পরিচালিত করে।

অতএব, এই আয়াতসমূহ মানুষকে শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত পরিবর্তন শুরু হয় অন্তর থেকে আর আল্লাহ তাআলা সেই আন্তরিক প্রচেষ্টাকেই তাঁর প্রজ্ঞা ও করুণায় ফলপ্রসূ করেন।

আত্মার পরিবর্তনশীলতা ও মানবিক পরীক্ষা:

মানুষের আত্মা (نَفْس) স্বভাবতই পরিবর্তনশীল ও গতিশীল। কখনো এটি ঈমান, তাক্বওয়া ও নৈতিকতার আলোয় উদ্ভাসিত হয়, আবার কখনো প্রবৃত্তি ও খেয়াল-খুশির অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। এই দ্বৈততা মানব-অস্তিত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা মানুষকে এমন স্বাধীনতা দিয়েছেন, যাতে সে সৎপথে অগ্রসরও হতে পারে, আবার পথভ্রষ্টও হতে পারে। তাই আত্মাকে সৎ ও স্থিতিশীল রাখার সংগ্রাম এক অবিরাম সাধনা, যা সম্ভব হয় আত্মসংযম, আত্মপর্যালোচনা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا - وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا ‘যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে, সে সফল হয়েছে আর যে তা কলুষিত করেছে, সে ব্যর্থ হয়েছে’ (আশ-শামস, ৯১/৭–১০)[3]

আর নবী দাঊদ আলাইহিস সালাম-কে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘হে দাঊদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি। সুতরাং মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার করো এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, তা না হলে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে’ (ছোয়াদ, ৩৮/২৬)

এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, প্রবৃত্তির অনুগামী হলে মানুষ সত্যের পথ থেকে সরে যায় আর ন্যায়পরায়ণতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আল্লাহভীতি তাকে নৈতিক স্থিরতা দান করে। আত্মার পরিবর্তনশীলতার মূল শিক্ষা এখানেই নিহিত। যে আত্মা নিজের প্রবৃত্তিকে সংযত করে, আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে দৃঢ় থাকে, সাফল্য তারই জন্য নির্ধারিত। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ আত্মার এই পরিবর্তনশীল প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, আত্মা কখনো مُطْمَئِنَّةٌ (প্রশান্ত ও আল্লাহমুখী), কখনো لَوَّامَةٌ (অনুশোচনাকারী ও আত্মসমালোচনামূলক), আবার কখনো أَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ (অসৎ প্রবৃত্তির দিকে আহ্বানকারী)। মানব-আত্মা এই তিন অবস্থার মধ্যেই ঘূর্ণায়মান থাকে।[4]

আত্মার পরিবর্তনই সমাজ পরিবর্তনের মূল ভিত্তি:

কুরআনের এক চিরন্তন নীতি মানবসমাজের পরিবর্তনের প্রকৃত সূত্রটি স্পষ্ট করে তুলে ধরে,إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ ‘আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের ভেতরের অবস্থা পরিবর্তন করে’ আল-রা‘দ, ১৩/১১)

এই আয়াত মানবের আত্ম-পরিবর্তনের (Self-Reformation) গুরুত্বের প্রতি গভীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কোনো সমাজের উন্নতি বা অবনতি হঠাৎ করে বাহ্যিক শক্তি, রাজনৈতিক পরিবর্তন বা সামাজিক চাপের কারণে ঘটে না; বরং পরিবর্তনের প্রকৃত সূচনা ঘটে মানুষের অন্তরের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জগতে। সমাজের ভিতরে স্থায়ী সংস্কার সম্ভব হয় তখনই, যখন ব্যক্তির হৃদয় ও আত্মা সত্য, ন্যায় ও তাক্বওয়ার পথে সংশোধিত হয়।

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর নেয়ামতের স্থায়িত্ব নির্ভর করে আত্মার পবিত্রতার ওপর, আত্মা বিকৃত হলে নেয়ামতও বিলুপ্ত হয়’।[5] এই বক্তব্যে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, মানুষের চরিত্রের সততা, নৈতিকতা এবং অন্তর্গত পরিশুদ্ধি ছাড়া সমাজে স্থায়ী উন্নতি সম্ভব নয়। আত্মার নৈতিক অবনতিই মানুষের জীবনে ও সমাজে বিপর্যয়, দুর্বলতা ও পতনের মূল কারণ।

এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ইসলামী সমাজবিজ্ঞানীরা আত্ম-পরিবর্তনকে সমাজ পরিবর্তনের ভিত্তি হিসেবে দেখেছেন। ইবনু খালদুন তাঁর ‘মুক্বাদ্দিমা’-তে বলেন,النُّفُوسُ إِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ العُمْرَانُ ‘যখন আত্মাগুলো কলুষিত হয়, তখন সভ্যতাও ধ্বংস হয়ে যায়’।[6] অন্যদিকে, সাইয়িদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ তাঁর ‘ফী যিলালিল কুরআন’-এ বলেন, القُرْآنُ يُقَرِّرُ أَنَّ نُقْطَةَ الْبَدْءِ فِي التَّغْيِيرِ هِيَ النَّفْسُ الْبَشَرِيَّةُ، لَا النِّظَامَ السِّيَاسِيَّ وَلَا الِاقْتِصَادِيَّ ‘কুরআন ঘোষণা করে যে, পরিবর্তনের সূচনাবিন্দু হলো মানুষের অন্তর, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নয়’।[7]

এই বক্তব্যগুলোর সারকথা হলো, আত্মার পরিবর্তনই সমাজ পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি। আইন, প্রশাসন বা সংস্কারমূলক কর্মসূচি যতই উন্নত হোক না কেন, তা তখনই কার্যকর হয়—যখন মানুষের অন্তর নৈতিকভাবে পরিশুদ্ধ হয়। ব্যক্তিগত তাক্বওয়া, ন্যায়পরায়ণতা ও নৈতিক শুদ্ধতাই সমাজে ন্যায়ের কাঠামো নির্মাণের ভিত্তি স্থাপন করে। অতএব, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ পরিবর্তনের প্রকৃত সূচনা হয় আত্মার জগতে। যখন মানুষ নিজেকে সংশোধন করে, তখনই তার পরিবার, সমাজ ও জাতিও পরিবর্তনের পথে অগ্রসর হয়।

মানুষের ইচ্ছা ও আল্লাহর ক্ষমতা দান:

ইমাম ইবনু কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, উক্ত আয়াত আল্লাহর ন্যায়নীতি, সুবিচার ও প্রজ্ঞার চিরন্তন সূত্রের প্রমাণ বহন করে। বান্দা যদি সৎপথে চলার ইচ্ছা করে, তাহলে সে তা করতে সক্ষম; তবে সেই ইচ্ছা ও সৎপথে চলার প্রেরণাও আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। আল্লাহ-ই বান্দার হৃদয়ে সৎপথে চলার আগ্রহ ও শক্তি জাগিয়ে তোলেন। বান্দা কখনোই আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সঠিক পথে অটল থাকতে বা কোনো সৎকর্ম সম্পন্ন করতে পারে না।

তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, আল্লাহ তাআলা মানুষকে সীমিত ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন, যাতে সে ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে সঠিক পথটি বেছে নিতে পারে। তবে এই ইচ্ছাশক্তি কেবল তখনই কার্যকর হয়, যখন তা আল্লাহর ইচ্ছা ও মানুষের প্রদত্ত সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। সুতরাং বান্দার উচিত নিজের সামর্থ্যের উপর নির্ভর না করে সর্বদা আল্লাহর সাহায্য ও দিকনির্দেশনা কামনা করা।[8]

যখন কোনো জাতি গুনাহ ও অবাধ্যতার পথ অবলম্বন করে, তখন তাদের নেয়ামত, জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ও বরকত প্রত্যাহার করা হয়। ফলে তারা ঈমান থেকে কুফরীতে, আনুগত্য থেকে অবাধ্যতায়, কৃতজ্ঞতা থেকে অহংকারে রূপান্তরিত হয়। তবে যদি তারা নিজের ভুল থেকে ফিরে আসে, তওবা করে এবং ন্যায়ের পথে অটল থাকে, আল্লাহ তাআলা তাঁর রহমতে তাদের মর্যাদা ও অবস্থান পুনরায় ফিরিয়ে দেন। তাই যারা সত্যপথে চলার দৃঢ় সংকল্প করে, তারা আল্লাহর তাওফীক্ব ও সহায়তায়ই তাতে সফল হয়।[9]

মোদ্দাকথা, মানুষের ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা যখন আল্লাহর ইচ্ছা ও তাওফীক্বের সঙ্গে একীভূত হয়, তখনই কল্যাণ, পরিবর্তন ও প্রকৃত সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়। আর তখন আল্লাহ তাআলা দুঃখ ও কষ্টময় জীবনকে পরিণত করেন কল্যাণ, প্রশান্তি ও রহমতে পরিপূর্ণ জীবনে।

(ইনশা-আল্লাহ! আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল

প্রভাষক (আরবী), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বরিশাল।


[1]. তাফসীর আল-জামে‘ লি আহকামিল কুরআন।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮২২।

[3]. বায়ানুন নাযম ফিল কুরআনুল কারীম, মুহাম্মাদ ফারূক, ফারেস আযযাইন, (দারুল ফিকর: দামেস্ক, সিরিয়া, প্রথম সংস্করণ: ২০০৪ খ্রি.), ২/৪১৭-৪১৮।

[4]. ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, মাদারেজুস সালেকীন, (দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ: বৈরূত, লেবানন), ১/৩১৪-৩১৫।

[5]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-জাওয়াবুল কাফী, (দারুল মাআরিফ: বৈরূত), পৃ. ৭৯–৮১।

[6]. ইবনু খালদুন, আল-মুক্বাদ্দিমা, (দারুল ফিকর: বৈরূত), পৃ. ৪৫৩।

[7]. সাইয়িদ কুতুব, ফী যিলালিল কুরআন, (দারুশ শুরূক সংস্করণ), ৪/১৮৫৭।

[8]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, (দারুল মুফীদ: বৈরূত, লেবানন), ৪/৪৩৫।

[9]. আত-তাফসীরুল ওয়াছীত্ব, লাজনাতুল বুহূছ আল-ইসলামিয়্যাহ, হাইয়াতুল আম্মাহ লিশউনিল মাত্বাবিআ আল-আমিরিয়্যাহ, (দামেস্ক, সিরিয়া, প্রথম সংস্করণ: ১৯৯৩ খ্রি.), ৫/৪১৭-৪১৮।

Magazine