কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

প্রশ্ন (৭): কিছু দাঈ আলেম না হলেও ইসলামবিধ্বংসী ষড়যন্ত্র ফাঁস করে উম্মাহকে সতর্ক করছেন। যদিও অনেকে আক্বীদা বা মাসআলার আলোচনায় যান না, তবু কিছু আলেম তাদের বক্তব্য শুনতে নিষেধ করেন— এর কারণ কী? আর বর্তমান সময়ে উম্মাহর সবচেয়ে জরুরী করণীয় কী?

উত্তর: এর পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে- ১. সঠিক জ্ঞানের অভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানোর শঙ্কা। কিছু দাঈ যদিও নেক উদ্দেশ্যে কথা বলেন, কিন্তু আক্বীদা বা মাসআলা-মাসায়েলের ক্ষেত্রে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়। তাই আলেমগণ সতর্ক করেন যেন সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত না হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না; নিশ্চয়ই কান, চোখ, হৃদয় এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে’ (বনী ইসরাঈল, ১৭/৩৬)। ২. আত্মপ্রচার বা অতিরঞ্জিত বর্ণনা। অনেক সময় ষড়যন্ত্র উন্মোচনের নামে অতিরঞ্জিত, ভিত্তিহীন বা নির্ভরযোগ্য উৎস ছাড়া তথ্য প্রচার হয়, যা ভয় বা ঘৃণা উসকে দিতে পারে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তারপর এমন এক ব্যক্তির বিচার করা হবে যে জ্ঞান অর্জন করেছে, বিতরণ করেছে এবং কুরআন মাজীদ অধ্যয়ন করেছে। তখন তাকে হাযির করা হবে। আল্লাহ তাআলা তার প্রদত্ত নেয়ামতের কথা তাকে বলবেন এবং সে তা চিনতে পারবে (এবং যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও করবে), তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, এত বড় নেয়ামত পেয়ে বিনিময়ে তুমি কী করলে? জবাবে সে বলবে, আমি জ্ঞান অর্জন করেছি, তা শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমারই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরআন অধ্যয়ন করেছি। জবাবে আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি তো জ্ঞান অর্জন করেছিলে এজন্য যে, যাতে লোকে তোমাকে জ্ঞানী বলে। কুরআন তিলাওয়াত করেছিলে এজন্য যে, যাতে লোকে বলে, তুমি একজন কারী। তা বলা হয়েছে। তারপর নির্দেশ দেওয়া হবে, সে মতে তাকেও উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে (ছহীহ মুসলিম, হা/৪৮১৭)। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার প্রতি মিথ্যারোপ করে, সে যেন জাহান্নামে তার বাসস্থান নির্ধারণ করে নেয় (ছহীহ বুখারী, হা/১০৭)। ৩. শরীআতের সীমালঙ্ঘন করা। কেউ কেউ এমন ভাষা বা ভঙ্গিতে কথা বলেন যা আদব, হিকমত বা ইসলামী শিষ্টাচারের পরিপন্থী। এতে ইসলাম ও দাঈ উভয়ের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত’ (আলে ইমরান, ৩/১৫৯)। ৪. জ্ঞান ছাড়াই ফতওয়া দেওয়া। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আছ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তর থেকে ইলম উঠিয়ে নেন না, কিন্তু দ্বীনের আলেমদের উঠিয়ে নেওয়ার ভয় করি। যখন কোনো আলেম অবশিষ্ট থাকবে না, তখন লোকেরা মূর্খদেরকেই তাদের নেতা বানিয়ে নিবে। তাদের জিজ্ঞেস করা হলে না জানলেও তারা ফতওয়া প্রদান করবে। ফলে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যকেও পথভ্রষ্ট করবে’ (ছহীহ বুখারী, হা/১০০)। মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (বিখ্যাত তাবেঈ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নিশ্চয়ই এ ইলম হলো দ্বীন। কাজেই কার কাছ থেকে তোমরা দ্বীন গ্রহণ করছে তা যাচাই করে নাও (ছহীহ মুসলিম মুকাদ্দামা, ১/১১)। ৫. বিদআতীদের থেকে জ্ঞান অর্জনে সতর্ক করা। ইবনু সীরীন রাহিমাহুমাল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এমন এক সময় ছিল যখন লোকেরা সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত না। কিন্তু পরে যখন ফেতনা (হাদীছের নামে মিথ্যা কথার আমদানি) দেখা দিল, তখন লোকেরা হাদীছ বর্ণনাকারীদেরকে বলল, তোমরা যাদের নিকট থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছ, আমাদের কাছে তাদের নাম বলো। তারা এ কথা এ কারণে জানতে চাইত, যাতে দেখা যায় যে, তারা আহলে সুন্নাত কি-না? যদি তারা এ সম্প্রদায়ের হয়, তাহলে তাদের হাদীছ গ্রহণযোগ্য হবে আর যদি দেখা যায় তারা বিদআতী, তাহলে তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হবে না (ছহীহ মুসলিম মুকাদ্দামা, ১/১১)। এছাড়াও আরো অনেক কারণ রয়েছে। বর্তমান সময়ে উম্মাহর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু করণীয়গুলো নিম্নরূপ- ১. ইলম ও শুদ্ধ আক্বীদা অর্জন করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ অর্থাৎ ‘জ্ঞান অর্জন করুন যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো উপাস্য নেই’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/১৯)। ২. আল্লাহ তাআলাকে অর্থাৎ তাঁর দেওয়া জীবনব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর কেউ আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করলে, সে অবশ্যই সরল পথের হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে’ (আলে ইমরান, ৩/১০১)। ৩. কলহ ও মতবিরোধ বর্জন করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করবে না, করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্যধারণ করো; নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন (আল-আনফাল, ৮/৪৬)। ৪. মুসলিমদের ভালোবাসা ও পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল আর তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, তাদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল (আল-ফাতহ, ৪৮/২৯)। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সে মহান সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত (পরিপূর্ণ) ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না সে নিজের (মুসলিম) ভাইয়ের জন্য সে জিনিস পছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে’ (ছহীহ বুখারী, হা/১৩; ছহীহ মুসলিম, হা/৭২)। ৬. দু‘আ ও আল্লাহর উপর ভরসা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমাদের রব বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে’ (গাফির, ৪০/৬০)।

প্রশ্নকারী : মুহসিন বিন ইমামুদ্দীন

টোক, কাপাসিয়া, গাজীপুর।

Magazine