ভূমিকা : ইসলাম ও মুসলিমের খেদমতে যারা নিরলস জীবনযাপন করে গেছেন, যারা নিভৃতে কাজ করে গেছেন, তাদের মধ্যে পাকিস্তানের মুফতী উবায়দুল্লাহ খান আফীফ রহিমাহুল্লাহ-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অত্যন্ত সাদাসিধা পরনের ও গড়নের এই বিশিষ্ট আলেম কখনই নিজেকে প্রচার করতেন না। যার ফলে তার ব্যাপারে আমাদের বাঙালি সমাজ মোটেও ওয়াকিবহাল নন। আজকে তার ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা পেশ করা হলো—
জন্ম : শায়খ উবায়দুল্লাহ খান আফীফ পূর্ব পাঞ্জাবের ফীরোযপুর জেলার কাট্টি বালুচাঁ নামক গ্রামে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদা ছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল রহিমাহুল্লাহ। যিনি হানাফী থেকে আহলেহাদীছ হওয়ার কারণে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।
পড়াশোনা : সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তার পড়াশোনার সূচনা হয়। তিনি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সেসময় প্রথম হতে ষষ্ঠ শ্রেণিকে ‘নিম্ন মাধ্যমিক’ বলা হতো। দরিদ্রতার কারণে তাকে স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। এরপর তিনি মাদরাসায় দ্বীনী ইলম হাছিল শুরু করেন। সেকাল ও একালের মাদরাসাগুলো সর্বদা দরিদ্র জনগণের জন্য শিক্ষার উন্মুক্ত দ্বার হিসেবে অবদান রেখে আসছে। তারপরও এক শ্রেণির মানুষ মাদরাসা শিক্ষাকে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য সর্বদা আন্দোলন করতে থাকেন।
মুফতী উবায়দুল্লাহ খান আফীফ মাদরাসা নাযীরিয়া মিয়াঁ চুন্নু, মাদরাসা খাদেমুল কুরআন ওয়াল হাদীছ এবং ফায়সালাবাদস্থ জামি‘আহ সালাফিয়্যাহতে দ্বীনী ইলম হাছিল করেন। জামি‘আহ সালাফিয়্যাহতে তিনি যে সময় ভর্তি হয়েছিলেন যে সময় কেবল মাদরাসা নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। সে সময় মাদরাসায় মাত্র কয়েকটি ঘর ছিল। যেগুলোর কোনো দরজা-জানালা ছিল না। বিদ্যুৎ তো ছিলই না। সন্ধ্যার পর এমন অন্ধকারে ছেয়ে যেত যে, তিনি না খেয়ে শুয়ে রাত পার করে দিতেন। আহা! কতই না কষ্ট করেছেন তিনি! মাদরাসার পড়াশোনা শেষ করার পাশাপাশি তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবী ভাষায় ফাযেল ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি বেফাকুল মাদারিস সালাফিয়্যাহ তথা সালাফী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রতিটি পরীক্ষাতে তিনি প্রথম হতেন। আল-হামদুলিল্লাহ।
কর্মজীবন : (১) ১৯৬১ সালে ফায়সালাবাদে অবস্থিত দারুল কুরআন ওয়াস সুন্নাহ মাদরাসাতে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। শুরুতেই তিনি মিশকাত, নাসাঈ, আরবী সাহিত্যের বই মুতানাব্বীসহ একাধিক শাস্ত্রের বৃহৎ ও জটিল গ্রন্থসমূহ সফলতার সাথে পড়াতে থাকেন। এ মাদরাসায় তিনি ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পাঠদান করেন। (২) ১৯৬৯ সালে আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর রহিমাহুল্লাহ এবং শায়েখ আব্দুল খালেক কুদ্দূসী রহিমাহুল্লাহ-এর আহ্বানে তিনি লাহোরে অবস্থিত সুপ্রাচীন আহলেহাদীছ মসজিদ ‘চিনাওয়ালী মসজিদ’-এর মাদরাসায় আসেন এবং এখানে তিনি দুই বছর অবস্থান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি এখানে ছহীহ বুখারীর দারসের গোড়াপত্তন করেন। (৩) ১৯৭১ সালে তিনি উকাড়ার মাদরাসা দারুল হাদীছ-এ চলে যান। সেখানে তিনি এক বছর পাঠদান করেন। (৪) ১৯৭২ সালে চিনাওয়ালী মসজিদের সেক্রেটারির দাওয়াতে তিনি আবার উক্ত মসজিদের মাদরাসায় এসে দারস শুরু করেন। (৫) ১৯৭৮ সালে তিনি মুলতানের দারুল হাদীছ মুহাম্মাদিয়া মাদরাসামুখী হন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি বাইক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে স্বীয় কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা পান। ফলে তার বাম কাঁধ একেবারে অবশ হয়ে যায়। আরও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে এর চার দিন পর। তিনি আবারও সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে ডান হাঁটুতে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছাত্রদেরকে পড়াতেন। অতঃপর আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর রহিমাহুল্লাহ লাহোরে একটি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করে দেন এবং দক্ষ চিকিৎসক নিয়োগ করে নিজ খরচে চিকিৎসা সেবা দিতে থাকেন। ফলে তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন। (৬) হাঁটাচলার মতো অবস্থা ফিরে এলে তিনি তৃতীয়বারের মতো চিনাওয়ালী মসজিদের মাদরাসায় দারস দেওয়া শুরু করেন। এটি ১৯৭৯ সালের কথা। তিনি এখানে একাধারে ১৩ বছর পাঠদান করেন। এরপর সঊদী গ্রান্ড মুফতী শায়খ আব্দুল আযীয ইবনে বায রহিমাহুল্লাহ-এর আদেশে তাকে ‘সঊদী মাবঊস’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমৃত্যু তিনি এই পদে আসীন থাকার পাশাপাশি হাদীছের দারস জারী রাখেন। তিনি ৫০ বছরেরও অধিককাল যাবৎ ছহীহ বুখারীর দারস দিয়েছেন। এই বিশেষ নেয়ামত আল্লাহ সবার ভাগ্যে রাখেন না।
খুৎবা প্রদান : তিনি সারা জীবনে কতগুলো মসজিদে খুৎবা প্রদান করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। শ্রোতা তার বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত। একইসাথে ইলমী আলোচনা ও শ্রোতাকে আকৃষ্ট করতে পারায় তার জুড়ি ছিল না। আসলে তিনি একজন অনেক বড় মাপের বক্তা ছিলেন।
রচনাবলি : তিনি এত ব্যস্ততার মধ্যেও অনেকগুলো মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন— (১) ফাতাওয়া আলমগীরী পার য়েক নাযার। (২) আহকামে জানাযা। (৩) ফাতাওয়া আহলেহাদীছ (তিন খণ্ডে)। (৪) আল-আজবিবাতুছ ছহীহা ফী তারদীদি মাযহাবিশ শীআ। (৫) ফাতাওয়া মুহাম্মাদিয়া ইত্যাদি।
মৃত্যু : অসংখ্য-অগণিত আলেমের উস্তাদ এই মনীষী ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে দুনিয়ার বন্ধন ত্যাগ করে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দরবারে চলে যান। আল্লাহ শায়খের উপর রহম করুন। তার কবরকে জান্নাতের নেয়ামতে পূর্ণ করে দিন। তার ইলম দ্বারা জাতিকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক্ব দিন। আমীন!
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, আল্লামা উবায়দুল্লাহ খান আফীফ রহিমাহুল্লাহ বড় মাপের একজন আলেম ছিলেন। দ্বীনী ইলম হাছিল করতে গিয়ে তিনি অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। এছাড়া দ্বীন প্রচারের স্বার্থেও তাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। আল্লাহ তাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন- আমীন!
তথ্যসূত্র :
১. ফাতাওয়া মুহাম্মাদিয়া, পৃ. ৩১-৫৯, তাফসীর আহসানুল বায়ান-এর লেখক আল্লামা ছালাহুদ্দীন ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ এবং পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম শায়েখ মুফতী মুবাশশির আহমাদ রব্বানী হাফিযাহুল্লাহ-এর লেখনী থেকে গৃহীত।
২. উইকিপিডিয়া,
(লিংক : wikipedia.org/wiki/مفتی_محمد_عبیداللہ_خان_عفیف)।
৩. রোযানাহ পাকিস্তান (লিংক : https://dailypakistan.com.pk/09-Feb-2022/1401122)।
৪. বিখ্যাত ঐতিহাসিক আলেম শায়েখ ইসহাক ভাট্টি রহিমাহুল্লাহ, দাবিস্তানে হাদীছ, পৃ. ৫৩০-৫৩৭।