কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

গ্রন্থ পরিচিতি-১৪ : সুনানে নাসাঈ

post title will place here

ভূমিকা: ইলমে হাদীছে যাদের খেদমত অবিস্মরণীয় হয়ে আছে, যঈফ হাদীছ থেকে ছহীহ হাদীছকে পৃথককরণে যাদের অবদান অসামন্য, যাদের নাম ব্যতীত ইসলামের ইতিহাস কখনোই পূর্ণ হওয়ার নয়, তাদের মধ্য অন্যতম হলেন ইমাম নাসাঈ রহিমাহুল্লাহ। তার রচিত কালজয়ী গ্রন্থ সুনানে নাসাঈ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ।

গ্রন্থের নাম: ‘সুনানুন নাসাঈ’। এর অপর নাম ‘নাসাঈ আল মুজতাবা’। অনেকেই এ মর্মে মতানৈক্য করেছেন যে, মুজতাবা তথা সুনানে নাসাঈ গ্রন্থটি ইমাম নাসাঈ রহিমাহুল্লাহ রচনা করেননি। বরং তার ছাত্র ইবনুস সুন্নী এটি সংকলন করেছেন মাত্র। তবে জমহূর আলেম বলেছেন যে, সুনানে নাসাঈ তথা মুজতাবা গ্রন্থটি ইমাম নাসাঈ স্বীয় বৃহদায়তন গ্রন্থ ‘আস-সুনানুল কুবরা’ হতে সংক্ষেপ করে স্বহস্তে রচনা করেছেন। আর এটাই সঠিক মত।[1]

বৈশিষ্ট্যসমূহ: এই গ্রন্থটির অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ-

(১) এটি কুতুবে সিত্তাহ তথা ছয়টি অধিক বিশুদ্ধতম গ্রন্থের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।[2] (২) এর অধিকাংশ হাদীছ ছহীহাইন তথা বুখারী ও মুসলিমে পাওয়া যায়। (৩) এ গ্রন্থের হাদীছগুলোর অধিকাংশই ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী ছহীহ। (৪) অনেকগুলো হাদীছ উল্লেখিত রয়েছে যেগুলোর মধ্যে থাকা গোপন ত্রুটি-বিচ্যুতি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। (৫) এ গ্রন্থে অনেক স্থানেই হাদীছের মতনের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। (৬) একই অনুচ্ছেদের মধ্যে একই হাদীছকে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। তবে অবশ্যই পুনরাবৃত্তি হওয়া হাদীছগুলোর মধ্যে শাব্দিক তারতম্য থাকে কিংবা রাবীর হাদীছ শ্রবণের উল্লেখ থাকে ইত্যাদি বিভিন্নরকম অতিরিক্ত ফায়েদা থাকে। (৭) একই হাদীছ কখনো তিনি সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করেছেন। সংশ্লিষ্ট মাসআলার সাথে হাদীছের মতন যতটুকু সম্পৃক্ত ততটুকু বর্ণনা করেছেন। আবার অন্যত্র একই হাদীছ দীর্ঘাকারে বর্ণনা করেছেন। (৮) আবার কখনো কখনো তিনি মতনকে বাদ দিয়ে কেবল সনদ বর্ণনা করেছেন। (৯) মাঝে মাঝে তিনি হাদীছের মধ্যে দুর্বোধ্য শব্দের ব্যাখ্যাও করেছেন হাদীছের শেষে। তবে এটা খুব কম হাদীছের মধ্যেই দেখা যায়। (১০) ইমাম নাসাঈ হাদীছ বর্ণনায় ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের হাদীছ বর্ণনার রীতি অনুসরণ করেছেন। (১১) এ গ্রন্থে মোট ৫২টি কিতাব বা অধ্যায়, ২৫৭২টি অনুচ্ছেদ এবং মোট ৫৭৫৪টি হাদীছ রয়েছে।

ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহ: সুনানে নাসাঈর ব্যাখ্যাগ্রন্থ যারা রচনা করেছেন তাদের নামসমূহ হলো—

(১) ইমাম সুয়ূতী রহিমাহুল্লাহ একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন। নাম হলো ‘যাহরুর রুব্বা আলাল মুজতাবা’। (২) আল্লামা শায়েখ আবুল হাসান সিন্দী রহিমাহুল্লাহ সুনানে নাসাঈর টীকা রচনা করেছেন, যা ‘হাশিয়াতুস সিন্দী আলা সুনানে নাসাঈ’ নামে প্রসিদ্ধ। (৩) আল্লামা শায়েখ মুহাম্মাদ আতাউল্লাহ হানীফ ভুজিয়ানী রহিমাহুল্লাহ রচিত ‘আত-তালীকাতুস সালাফিয়্যা’। সুনানে নাসাঈর উপর ৪০ খণ্ডে সমাপ্ত সুবিশাল ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন সদ্য প্রয়াত মুহাম্মাদ ইবনু আলী ইবনে আদম আল ইথিওপী। ২০ সেপ্টেম্বর-২০২০ ইং তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার ব্যাখ্যাগ্রন্থের নাম ‘যাখীরাতুল উক্ববা ফী শারহিল মুজতাবা’। এছাড়াও আরও বেশ কিছু ব্যাখ্যা ও টীকাগ্রন্থ রচিত হয়েছে।

ইমাম নাসাঈ রহিমাহুল্লাহ: এই মহান গ্রন্থটির প্রণেতা হলেন ইমাম হাফেয আহমাদ ইবনু শুআঈব ইবনু আলী ইবনু সিনান ইবনু বাহর ইবনু দীনার আল-খুরাসানী আন-নাসাঈ আবূ আব্দুর রহমান আল-কাযী।[3] খুরাসানের একটি শহর ‘নাসা’। সেই দিকে সম্বন্ধ করে তাকে নাসাঈ বলা হয়। তিনি ২১৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছেন।[4] অল্প বয়সে তিনি হাদীছের জ্ঞান চর্চা শুরু করেন এবং কুরআনের হাফেয হয়েছিলেন। তিনি খোরাসান, হিজায, মিছর, ইরাক, শাম ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ইলমী মারকাযসমূহে সফর করে ইলম হাছিল করেছেন। ইলম অর্জনের লক্ষ্যে তার মতো এত সফর করার নযীর পাওয়া যায় না।[5]

শিক্ষকগণ: তার অনেক উস্তায রয়েছেন। তন্মধ্যে ইমাম বুখারী, যুহলী, আলী ইবনু খাশরাম, আলী ইবনু হুজর, আব্বাস ইবনু আব্দুল আযীম আম্বারী, মুহাম্মাদ ইবনুল মুছান্না, মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার প্রমুখ রহিমাহুমুল্লাহ।[6] তবে তিনি ইমাম বুখারী হতে হাদীছ শ্রবণ করেছেন কি না তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

ছাত্রগণ: তার অসংখ্য ছাত্রের মধ্য হতে ইবরাহীম ইবনু ইসহাক্ব, আবূ ইসহাক্ব ইবরাহীম, আবুল আব্বাস আবইয়ায, আহমাদ ইবনু ইবরাহীম রহিমাহুমুল্লাহ উল্লেখযোগ্য।[7]

তার সম্পর্কে ইমামদের প্রশংসা: ইমামগণ তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। হাফেয যাহাবী তাকে হাদীছের ই‘লালের ক্ষেত্রে সর্বাধিক দক্ষ ইমাম হিসেবে উল্লেখ করেছেন।[8] ইমাম হাফেয ইবনু নুকতা বলেছেন, ‘ইমাম নাসাঈ মুসলিম জাহানের ইমামদের ইমাম ছিলেন’।[9]

গ্রন্থসমূহ: তিনি অনেকগুলো মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন: আস-সুনানুল কুবরা, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ফাযায়েলুল কুরআন, খাছায়েছু আলী রযিয়াল্লাহু আনহু ইত্যাদি। এ যাবৎ তার লিখিত ৩২টি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়।

মৃত্যু: অত্যন্ত নম্র, উত্তম চরিত্রের অধিকারী, মুজতাহিদ ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমাম, হাদীছ বিশারদ এই মহান ব্যক্তি ফিলিস্তীনে ৩০২ হিজরীতে মারা যান।[10]

উপসংহার: সুনানে নাসাঈ ছয়খানা প্রসিদ্ধ গ্রন্থের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। হাদীছ থেকে মাসআলা ইসতিমবাত করা শেখার ক্ষেত্রে ছাত্র, আলেম ও গবেষকদের জন্য এই গ্রন্থটি হতে পারে উত্তম সহায়ক। আল্লাহ আমাদেরকে এ গ্রন্থের মধ্যে থাকা মনি-মুক্তা আহরণ করার তওফীক্ব দান করুন- আমীন!


[1]. সুনানে নাসাঈ, ‘ভূমিকা’ পৃ. ৬১, মুওয়াসসাতুর রিসালাহ।

[2]. হুসনুল মুহাযারাহ, পৃ. ৩৫০; আল-হিত্তা, পৃ. ৩৯৬।

[3]. খলীলী, আল-ইরশাদ, ১/৪৩৫।

[4]. যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফায, ২/৬৯৮।

[5]. যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৪/১২৭।

[6]. তাহযীবুল কামাল, ১/৩২৯; তাহযীবুত তাহযীব, ১/৩৫।

[7]. গ্রাগুক্ত।

[8]. যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৪/৩২।

[9]. ইবনু নুকতা, তাকমিলাতুল ইকমাল, রাবী নং ৬৩২৬।

[10]. মিযযী, তাহযীবুল কামাল ১/৩৪০।

Magazine