ভূমিকা : রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় যবান নিঃসৃত পবিত্র হাদীছসমূহ যারা লিপিবদ্ধ করার ন্যায় দুরূহ কাজ সম্পাদন করেছেন তাদের অন্যতম হলেন ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ। তার রচিত কালজয়ী গ্রন্থ ছহীহ মুসলিম উম্মাহর জন্য অমূল্য সম্পদ। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো—
নাম ও বিবরণ : গ্রন্থটির নাম হলো, المسند الصحيح المختصر بنقل العدل عن العدل إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم (আল-মুসনাদুস ছহীহ আল-মুখতাছার বি-নাক্বলিল আদলি আনিল আদলি ইলা রাসূলিল্লাহি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। এটি জামে‘ গ্রন্থ। তবে এ নামটি ইমাম মুসলিম স্বয়ং এভাবে রেখেছেন তা কিন্তু নয়। বরং ইমাম মুসলিমের বিভিন্ন উক্তির প্রেক্ষিতে এ নামটি রাখা হয়েছে। এতে ৭৪৫৩টি হাদীছ রয়েছে। এ গ্রন্থের মুদ্রিত সংস্করণে থাকা বাব, অনুচ্ছেদের শিরোনামগুলোও ইমাম মুসলিম সংযোজন করেননি। বরং পরবর্তী ইমামগণ শিরোনাম যোগ করেছেন। তবে ইমাম নববী প্রদত্ত শিরোনামগুলো সর্বাগ্রে রয়েছে। তিনি এগুলো ব্যাখ্যা রচনার সময়ে যুক্ত করেছেন। ফলে গ্রন্থটির সজ্জায়ন বর্ধিত হয়েছে। বুখারীর পরেই এর অবস্থান। অর্থাৎ কুরআনের পর বুখারী, তারপর মুসলিম। তবে ছহীহ মুসলিমের সাজানো-গোছানো বুখারীর তুলনায় অধিকতর চমৎকার। এতে একই হাদীছের একাধিক সনদ রয়েছে। বিখ্যাত এ হাদীছের গ্রন্থটি প্রতিটি মাদরাসার পাঠ্যবই হিসাবে সমাদৃত। বিশ্বের অসংখ্য ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও এর একাধিক অনুবাদ বাংলায় বিদ্যমান। ‘আহলে হাদীস লাইব্রেরী ঢাকা’ হতে মুদ্রিত অনুবাদ গ্রন্থে এর হাদীছ সংখ্যা ৭৪৫৩টি। অন্যদিকে ‘ইফাবা’ মুদ্রিত ছহীহ মুসলিমে ৭২৮১টি এবং ‘ইসলামিক সেন্টার’ অনূদিত গ্রন্থে ৭৩৩৭টি হাদীছ রয়েছে। এতে মোট ৫৪টি অধ্যায় বা কিতাব রয়েছে, যা ‘কিতাবুল ঈমান’ দিয়ে শুরু হয়েছে এবং ‘কিতাবুত তাফসীর’ দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। এর অসংখ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ প্রণীত শরহে মুসলিম সর্বাধিক জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য। উল্লেখ্য, শায়েখ ফুয়াদ আব্দুল বাক্বী কৃত মুখতাছার মুসলিমে মোট হাদীছ সংখ্যা ৩০৩৩টি।
মানহাজ ও রচনাশৈলী : ইমাম মুসলিম এই গ্রন্থ প্রণয়ে ভিন্নধর্মী মানহাজ ও রচনাশৈলীর প্রবর্তন ঘটিয়েছেন। তিনি প্রথমে একটি ‘ভূমিকা’ সংযোজন করেছেন, যা ইমাম বুখারীর সাথে কিছুটা ভিন্নতা রাখে। শুধু বুখারী নয়, বরং অন্যান্য সবার সাথেই ভিন্নতা রাখে। কেননা হাদীছ গ্রন্থে এইরূপ ভূমিকা সংযোজন ব্যতিক্রম ঘটনা। এটি অত্যন্ত সংক্ষেপে রচিত হওয়ায় বুঝা দুষ্কর। তাই স্রেফ ছহীহ মুসলিমের ভূমিকার উপরই একাধিক ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম এই ভূমিকায় ইলমী আলোচনা করেছেন রিওয়ায়াত ও দিরায়াত উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে। এখানে তিনি নিজস্ব কোনো উক্তি যুক্ত করেননি। পুরো ভূমিকাই তিনি বর্ণনা তথা রেওয়ায়াত দিয়েই রচনা করেছেন, যা বিস্ময়কর। এটি যদিও একটি ভূমিকা, তবুও একে আলাদা গ্রন্থ হিসেবে আখ্যা দিলে মোটেও ভুল হবে না।
ছহীহ মুসলিমের শর্তাবলি : ছহীহ মুসলিম সংকলনে ইমাম মুসলিমের শর্তাবলী নিম্নরূপ।
১. মুত্তাছিলুস সানাদ। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনাকারীদের পরম্পরা ধারাবাহিক হতে হবে। ২. বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য হতে হবে। কোনো বর্ণনাকারীর মাঝে ন্যায়পরায়ণতার অভাব থাকলে বর্ণনাকারী বর্ণিত হাদীছের বিপরিত আমল করলে তার কোনো হাদীছ গ্রহণ করেননি। ৩. হাদীছ বর্ণনাকারী তার ঊর্ধ্বতন বর্ণননাকারীর সমকালীন হওয়া। অর্থাৎ বর্ণনাকারী যার থেকে হাদীছ বর্ণনা করছেন উভয়েই সমকালীন হওয়া। ৪. বর্ণনাকারীর স্মরণশক্তি প্রখর হওয়া। কারণ বর্ণনাকারীর স্মরণশক্তি প্রখর না হলে তারপক্ষে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীকে নির্ভুলভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। ৫. বর্ণিত হাদীছের মতন বা মূল বক্তব্য সবধরনের দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত হতে হবে।[1]
ব্যাখ্যাগ্রন্থ : ছহীহ মুসলিমের অসংখ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচিত হয়েছে। যেমন— ১. ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল ইসপাহানী (মৃ. ৫২০ হি.) রচিত শরহে ছহীহ মুসলিম। ২. আল-মুফহিম লি-শারহি গরীবি মুসলিম। ৩. আল-মুআল্লিম বি-ফাওয়ায়িদি মুসলিম। ৪. ইকমাল আল-মুআল্লিম বি-ফাওয়ায়িদি মুসলিম। ৫. সিয়ানাতু ছহীহ মুসলিম। ৬. আল-মুফহিম ফী শারহি মুখতাছার মুসলিম। ৭. আল-মিনহাজ ফী শারহি ছহীহ মুসলিম। আরও অগণিত গ্রন্থ হয়েছে, যা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।
ছহীহ মুসলিমের ভূমিকার ব্যাখ্যাগ্রন্থ : ছহীহ মুসলিমের ভূমিকা নিয়েও একাধিক ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচিত হয়েছে, যা ইলমে হাদীছের ছাত্রদের জন্য দারুণ উপকারী। যেমন— ১. আল-ঈজায ওয়াল বায়ান লি-শারহি খুত্ববাতি মুসনাদি মুসলিম। ২. শারহু খুত্ববাতি মুসলিম। ৩. শারহু মুক্বাদ্দিমা ছহীহ মুসলিম। ৪. আল-বাহরুল মাওয়াজ। উল্লেখ্য, এ ব্যাখ্যাগুলোরও আবার বিস্তারিত ব্যাখ্যাগ্রন্থ রয়েছে।
মুখতাছার গ্রন্থাবলি : মুখতাছার মানে সংক্ষিপ্তসার গ্রন্থ। ছহীহ মুসলিমের অনেকগুলো মুখতাছার গ্রন্থ রয়েছে। যেমন— ১. ইমাম মুনযিরীর মুখতাছার ছহীহ মুসলিম। ২. অসীলাতুল মুসলিম ফী তাহযীবি ছহীহ মুসলিম। ৩. ইখতিছার ছহীহ মুসলিম। ৪. মুখতারুল ইমাম মুসলিম। উল্লেখ্য, এসব মুখতাছার গ্রন্থগুলোরও একাধিক ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রণীত হয়েছে।
লেখক পরিচিতি : এই জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থটির প্রণেতা হলেন, مسلم بن الحجاج بن مسلم القشيري أَبُو الحسين النيسابوري ‘মুসলিম ইবনু হাজ্জাজ ইবনু মুসলিম আবুল হুসাইন আল-কুশায়রী নিশাপুরী’।[2] তার নামেই এই হাদীছ গ্রন্থকে ‘ছহীহ মুসলিম’ বলা হয়। তার জন্মসাল নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। তবে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতে, তিনি ২০৬ হিজরীতে খলীফা মামূনের যামানায় জন্মগ্রহণ করেন।[3] বাড়িতেই স্বীয় পিতার কাছে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়।[4] তিনি মাত্র ১২ বছর বয়সে হাদীছ শ্রবণ শুরু করেন।[5] হাদীছের সন্ধানে তিনি একাধিক এলাকা সফর করেন।[6] তিনি কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন।[7] তিনি ব্যবসা করার সময়েও ক্রেতাদেরকে হাদীছ বর্ণনা করতেন।[8] তিনি আক্বীদায় আহলেহাদীছ তথা আছহাবুল হাদীছ ছিলেন। তিনি মুজতাহিদ ছিলেন।[9] কোনো মাযহাবের অনুসারী ছিলেন না।[10] ছিদ্দীক্ব হাসান খানসহ অনেকেই তাকে শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী বলেছেন।[11] যা সঠিক নয়। তবে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী একে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘তিনি কোনো মাযহাবের অনুসারী ছিলেন না। তবে শাফেঈ মাযহাবের সাথে তার ফৎওয়া বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়াতে অনেকে তাকে শাফেঈ মনে করেন’।[12]
উস্তাদমণ্ডলী : তার অনেক উল্লেখযোগ্য উস্তাদ রয়েছেন। যেমন— আব্দুল্লাহ ইবনু মাসলামা ইবনু কানাবী। ইমাম মুসলিম মক্কায় তার থেকে হাদীছ শ্রবণ করেন। আহমাদ ইবনু হাম্বল, ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া নিসাপুরী,[13] আহমাদ ইবনু সাঈদ ইবনু ছখর আদ-দারেমী, আব্দুল্লাহ দারেমী, ইসহাক্ব ইবনু রাহওয়াইহ,[14] কুত্বায়বা ইবনু সাঈদ,[15] এছাড়া আরও অনেক উস্তাদের নাম রিজাল গ্রন্থাবলিতে বিদ্যমান।[16]
ছাত্রবৃন্দ : তার বেশুমার ছাত্র রয়েছেন। যেমন— ইমাম তিরমিযী, ইবরাহীম ইবনু আবূ তালেব, আবূ উমার মুসতামলী, ইবনু খুযায়মা, আবূ মুহাম্মাদ ইবনু আবূ হাতেম আর-রাযী প্রমুখ।[17]
গ্রন্থসমূহ : তার অনেকগুলো গ্রন্থ রয়েছে। যেমন— ১. ছহীহ মুসলিম। ২. কিতাবুত তামঈয। ৩. কিতাবুল ই‘লাল। ৪. কিতাবুল ওয়াহদান। ৫. কিতাবুল আফরাদ। ৬. কিতাবুল আকরান। ৭. কিতাবু সুওয়ালাতিহী লি আহমাদ ইবনু হাম্বল। ৮. কিতাবু আমর ইবনু শুআইব। ৯ . কিতাবু মাশায়েখে মালেক। ১০. কিতাবু মাশায়েখে ছাওরী। ১১. কিতাবু মাশায়েখে শু‘বাহ। ১২. কিতাবু মা লায়সা লাহু ইল্লাহ রাবিন ওয়াহিদ। ১৩. কিতাবুল মুখাযরামীন। ১৪. কিতাবু আওলাদিছ ছাহাবা। ১৫. কিতাবু আওহামিল মুহাদ্দিছীন ইত্যাদি।
প্রশংসাবাণী : ইমামগণ তার সম্পর্কে যা বলেছেন, তা অত্যন্ত দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে। এখানে কয়েকটি প্রশংসাবাণী উল্লেখ করা হলো— ১. মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার বলেছেন, ‘পৃথিবীতে চার জন হাদীছের হাফেয রয়েছেন, তন্মধ্যে ইমাম মুসলিম ইবনু হাজ্জাজ অন্যতম’।[18] ২. খত্বীব বাগদাদী তাকে ‘অন্যতম ইমাম, হাদীছের হাফেয’ বলেছেন।[19] ৩. আবুল বারাকাত শারাফুদ্দীন বলেছেন, ‘ইমাম মুসলিম এতটাই প্রসিদ্ধ যে, তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তা সত্ত্বেও আমরা বলি, তিনি একজন ইমাম, হাদীছের হাফেয, হুজ্জাতুল ইসলাম’।[20] ৪. যাহাবী বলেছেন, ‘তিনি বিখ্যাত হাদীছের হাফেয, অত্যন্ত বড় মাপের হাদীছের হাফেয’।[21] ৫. ইবনু হাজার বলেছেন, ‘তিনি ছিক্বাহ, হাদীছের হাফেয, ইমাম, লেখক, ফিক্বহের আলেম’।[22] এছাড়াও আরও অনেক ইমাম তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
মৃত্যু : ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ ২৬১ হিজরীতে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে এই নশ্বর দুনিয়া হতে বিদায় নেন।[23]
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হলো, ছহীহ বুখারীর পর সর্বাধিক বিশুদ্ধ হাদীছের গ্রন্থ ছহীহ মুসলিম একটি অনবদ্য, কালজয়ী গ্রন্থ হবার সুবাদে সর্বস্তরে ব্যাপক নন্দিত। আল্লাহ লেখককে রহম করুন এবং আমাদের এই গ্রন্থটি ব্যাখ্যাসহ অধ্যয়ন করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
[1]. ছহীহ মুসলিমের ভূমিকা ‘সারসংক্ষেপ’।
[2]. হাফেয মিযযী, তাহযীবুল কামাল, রাবী নং ৫৯২৩।
[3]. ইবনু খাল্লিকান, ওয়াফায়াতুল আ‘য়ান, ৫/১৯৫; ইমাম নববী, শরহে ছহীহ মুসলিম, ১/১১; ইমাম মুসলিম : ওয়া মানহাজুহু ফী ছহীহি, পৃ. ১৬।
[4]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব, ১০/১২০।
[5]. তাযকিরাতুল হুফফায, রাবী নং ৫৮৮।
[6]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১২/৫৫৮।
[7]. তাহযীবুত তাহযীব, ১০/১১৫; আল-ইবার, ২/২৩।
[8]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১২/৫৭০।
[9]. আবূ উবায়দা মাশহূর হাসান, আল-ইমাম মুসলিম ইবনু হাজ্জাজ, পৃ. ৪৩।
[10]. আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবুল হাদীছ, পৃ. ৬৯।
[11]. আল-হিত্তাহ, পৃ. ১৯৮।
[12]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ১/১২২।
[13]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১২/৫৫৮।
[14]. তাহযীবুত তাহযীব।
[15]. আল-মুনতাযাম, ৫/৩২।
[16]. তাহযীবুল কামাল, রাবী নং ৫৯২৩; তাহযীবুত তাহযীব, রাবী নং ২২৬।
[17]. তাহযীবুত তাহযীব, রাবী নং ২২৬, ১০/১২৬।
[18]. তারীখে বাগদাদ, ২/১৬, সংক্ষেপিত।
[19]. তারীখে বাগদাদ, রাবী নং ৭০৪১।
[20]. তারীখে ইরবেল ২/১৩৬।
[21]. আল-মুঈন ফী তাবাকাতিল মুহাদ্দিছীন, রাবী নং ১১৬৯।
[22]. তাকরীবুত তাহযীব, রাবী নং ৬৬২৩।
[23]. আল-ইরশাদ ফী উলামায়ে হাদীছ, ৩/৮২৫।