ভূমিকা : রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের যা কিছু দিয়েছেন, তা আমাদের মাঝে এসেছে কলমের মাধ্যমে। পূর্বে অডিও, ভিডিও কিংবা এ জাতীয় কোনো উন্নত মাধ্যম ছিল না। অথচ কেবল লিখন পদ্ধতি দ্বারা ইমামগণ যেভাবে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছগুলো সংরক্ষণ করেছেন তা বর্তমান যুগের যে কোনো আধুনিক উপায় বা মাধ্যমকেও হার মানায়। অডিও, ভিডিও বিকৃত করা যায়। কিন্তু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ হাদীছগুলোর কোনো বিকৃতি সাধন সম্ভব নয়। গ্রন্থ পরিচিতির ধারাবাহিকতায় আজকে আমরা সুনানে তিরমিযী গ্রন্থটি সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশা-আল্লাহ।
নাম : الجامع المختصر من السنن عن رسول الله صلي الله عليه وسلم ومعرفة الصحيح والمعلول وما عليه من العمل ‘আল-জামেউল মুখতাছারু মিনাস সুনানি আন রসূলিল্লাহি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়া মা‘রিফাতুছ ছহীহ ওয়াল মা‘লূল ওয়ামা আলাইহি মিনাল আমাল’।
বিবরণ : কুতুবে সিত্তাহ তথা ৬টি গুরুত্বপূর্ণ হাদীছের গ্রন্থের অন্যতম হলো সুনানে তিরমিযী। এতে মোট ৩৯৫৬টি (মাকতাবা শামেলা অনুসারে) হাদীছ রয়েছে। এটির তাহক্বীক্ব করেছেন এবং টীকা যুক্ত করেছেন শায়খ আহমাদ শাকের রাহিমাহুল্লাহ, মুহাম্মাদ ফুয়াদ আব্দুল বাকী রাহিমাহুল্লাহ ও শায়খ ইবরাহীম উতওয়া। এটি ৫ খণ্ডে মিসরের দারুল ফিকর হতে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও আরও অনেক প্রকাশনী হতে গ্রন্থটি মুদ্রিত হয়েছে। শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ গ্রন্থটিকে ছহীহ ও যঈফ দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। এতে প্রায় সব ধরনের হাদীছই স্থান পেয়েছে।
বৈশিষ্ট্যাবলি : এর অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সংক্ষিপ্ত আলোচনায় লিখা দুষ্কর। তবে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ :
১. ইমাম তিরমিযী হাদীছগুলোকে তিনভাবে বিভক্ত করেছেন। ক. ছহীহ খ. যঈফ গ. হাসান।
২. এটি প্রথম হাদীছ গ্রন্থ, যা হাসান পরিভাষাকে ব্যাপকভাবে প্রসার করেছে।
৩. একটি হাদীছ বর্ণনা করার পর তিনি সেই হাদীছের পক্ষে ও বিপক্ষে থাকা ইমামদের ফতওয়া ও আমলসমূহ বর্ণনা করেছেন।
৪. হাদীছের ছাত্রদের জন্য এটি খুবই উপাদেয় ও সুখপাঠ্য গ্রন্থ। এ জন্য আহলেহাদীছ ক্বওমী মাদরাসাগুলোতে মিশকাতের পর পরই তিরমিযী পড়ানো হয়ে থাকে।
৫. প্রতিটি হাদীছের সনদ-মতনের সাথে সাথে মানও উল্লেখ রয়েছে।
৬. একটি হাদীছের একাধিক সনদ বর্ণিত হয়েছে।
৭. জারহ-তা‘দীলের আলোচনা রয়েছে।
৮. ক্ষেত্রবিশেষে রাবীর পুরো নাম ও উপনাম বর্ণিত হয়েছে।
৯. হাদীছের মধ্যকার ত্রুটি-বিচ্যুতি উল্লেখ রয়েছে ইত্যাদি।
ব্যাখ্যাগ্রন্থ : তিরমিযীর একাধিক ব্যাখ্যাগ্রন্থ রয়েছে। যেমন ১. আব্দুর রহমান মুবারকপূরীর তুহফাতুল আহওয়াযী। ২. ইমাম বাগাবী রচিত শারহু জামে‘ তিরমিযী। ৩. ক্বাযী আবূ বকর ইবনু আরাবী মালেকী রচিত আরিযাতুল আহওয়াযী। ৪. ইবনু সাইয়েদিন নাস রচিত আন-নাফহুশ শাযী। ৫. ইবনু রজব হাম্বলী, শারহু জামে‘ তিরমিযী। ৬. ইবনুল মুলাক্কিন, শারহু জামে‘ তিরমিযী। ৭. ইবনু হাজার আসক্বালানী, শারহু জামে‘ তিরমিযী। ৮. জালালুদ্দীন সুয়ূতী, কূতুল মুগতাযী। ৯. তাহের পাটনী, শারহু জামে‘ তিরমিযী। এছাড়াও আবুত তাইয়েব মুহাম্মাদ ইবনু তাইয়েব আস-সিন্দী, আবুল হাসান ইবনু আব্দুল হাদী আস-সিন্দী আল-মাদানী, সিরাজুদ্দীন আহমাদ সারহিন্দী, শামসুল হক্ব আযীমাবাদী, সানাউল্লাহ ইবনু ঈসা খান, বদীউয যামান ইবনু মাসীহুয যামান হায়দারাবাদী প্রমুখ বিদ্বানগণ তিরমিযীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন। এছাড়াও তিরমিযীর রাবী, সনদ ও মতন নিয়েও আলাদা আলাদা গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে, যার মাধ্যমে গ্রন্থটির গুরুত্ব ফুটে ওঠে।
গ্রন্থকার পরিচিতি : আবূ ঈসা মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা ইবনু সাওরা ইবনু মূসা ইবনু যাহহাক আস-সুলামী আল-বূগী আত-তিরমিযী। কেউ কেউ তাকে আবুস সাকান নামেও ডাকতেন।[1] তিনি ২০৯ কিংবা ২১০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাদীছের সন্ধানে অনেকগুলো দেশ ও শহর ভ্রমণ করেছেন। খুরাসান, ইরাক, হিজাযে তিনি একাধিকবার গিয়েছেন। তার দাদা ছিলেন মারওয়াযী। জায়হূন নদীর তীরে অবস্থিত তিরমিয শহরে ইমাম তিরমিযী রাহিমাহুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। এখানে জন্ম ও বসবাসের কারণে তাকে ‘তিরমিযী’ নামে ডাকা হয় এবং তিনি এ উপাধীতেই প্রসিদ্ধ। অতিরিক্ত পড়াশোনা ও লেখালেখির কারণে তার দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। এক পর্যায়ে তিনি অন্ধ হয়ে যান।[2] তিরমিযীর ব্যাখ্যাকার আব্দুর রহমান মুবারকপূরীও এর ব্যাখ্যা শেষ করার পূর্বেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
উস্তাযগণ : ইমাম বুখারী, ইসহাক্ব ইবনু রাহাওয়াইহ, আবূ দাঊদ, মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার, আলী ইবনু সাঈদ আল-কিন্দী প্রমুখ।[3] হাফেয মিযযী, হাফেয যাহাবী আরও অনেকের নাম উল্লেখ করেছেন।
ছাত্রগণ : আবূ বকর আস-সামারকান্দী, আবূ হামেদ মারওয়াযী, হায়ছাম ইবনু কুলাইব প্রমুখ (প্রাগুক্ত)।
প্রশংসাবাণী : ইমামগণ ইমাম তিরমিযীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। হাফেয মিযযী তাকে হাদীছের হাফেয ও ইমামদের অন্যতম বলে উল্লেখ করেছেন (তাহযীবুল কামাল, রাবী নং ৪৪৩১)। ইমাম ইজলীও তাকে হাদীছের হাফেয বলেছেন (আল-ইকমাল, ৪/৩৯৬)। ইবনু নুকতা তাকে ইমাম বলে উল্লেখ করেছেন (আত-তাকঈদ, রাবী নং ১০৪)। ইমাম যাহাবী তাকে হাফেয, বিশিষ্ট ইলমী ব্যক্তিত্ব, ইমাম, শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি ভূষণে ভূষিত করেছেন (সিয়ারু আলামিন নুবালা, রাবী নং ১৩২)। ইবনু হাজার তাকে অন্যতম ইমাম বলেছেন (তাহযীবুত তাহযীব রাবী নং ৬৩৮)। এছাড়াও আরও অনেক প্রশংসাবাণী ইমামদের থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, যা আসমাউর রিজালের গ্রন্থাবলিতে বিদ্যমান।
মৃত্যু : তিনি তিরমিয শহরে সোমবার রাতে রজব মাসের ১০ তারিখে ২৭৯ হিজরীতে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে জগতবাসীকে চিরতরে বিদায় জানান। আল্লাহ তার কবরকে আলোকিত করুন। তাকে জান্নাতবাসী করুন। তার ইলম দ্বারা কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হলো, ইমাম তিরমিযী রাহিমাহুল্লাহ রচিত এ হাদীছের মূল্যবান গ্রন্থটি শুধু আলেমদের জন্যই উপকারী তা নয়। বরং ছাত্রদের জন্যও এটি অত্যধিক উপকারী। গ্রন্থটির তুলনা গ্রন্থটি নিজেই। এটির একাধিক অনুবাদ একাধিক ভাষায় হয়েছে। বাংলা ভাষাতেও এর একাধিক অনুবাদ রয়েছে। আল্লাহ আমাদের সকলকে এ সকল হাদীছের গ্রন্থ সংগ্রহ ও অধ্যয়ন করে তদনুযায়ী আমল করার তওফীক্ব দান করুন- আমীন!
[1]. তাহযীবুত তাহযীব, রাবী নং ৬৩৮।
[2]. তাহযীবুল কামাল, রাবী নং ৫৫৩১।
[3]. প্রাগুক্ত।