কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

গ্রন্থ পরিচিতি-১৩ : সুনানে ইবনু মাজাহ

ভূমিকা : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রেখে যাওয়া আমানত হাদীছ। সেই হাদীছের সংকলন, রক্ষণাবেক্ষণে মুহাদ্দিছ ইমামগণের ভূমিকা আদৌ ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। তদুপরি আজকে আমরা সেই সকল ক্ষণজন্মা মুহাদ্দিছ ইমামগণের মধ্য হতে ইমাম ইবনু মাজাহ রহিমাহুল্লাহ রচিত একটি মহামূল্যবান গ্রন্থ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ।

নাম ও বিবরণ : এর নাম ‘আস-সুনান’ (اَلسُّنَنُ)। ইমাম ইবনে মাজাহর দিকে সম্বন্ধিত করে একে ‘সুনান ইবনে মাজাহ’ (سُنَنُ ابْنِ مَاجَهْ) বলা হয়। সুনান বলতে ওই সকল গ্রন্থকে বুঝায়, যেখানে পবিত্রতা অধ্যায় হতে শুরু করে অছীয়ত পর্যন্ত যাবতীয় বিষয় ফিক্বহী ক্রমধারা অনুসারে লিপিবদ্ধ হয়। ইমাম ইবনু মাজাহ রহিমাহুল্লাহ গ্রন্থটিকে ২৩০ হিজরীর পর (২৬০ হিজরীর পূর্বে) রচনা করেছিলেন। গ্রন্থটিকে কুতুবে ছিত্তাহ তথা ৬টি অতীব প্রসিদ্ধ হাদীছগ্রন্থের অন্যতম বিবেচনা করা হয়। গ্রন্থটিতে মোট ৪৩৪১টি হাদীছ রয়েছে।[1]

বৈশিষ্ট্যাবলি : গ্রন্থটি খুবই চমৎকার রচনাশৈলীতে প্রণীত ও সুখপাঠ্য। এর কয়েকটি গুণ নিম্নরূপ—

(১) এ গ্রন্থটির হাদীছের সাথে অধ্যায়-অনুচ্ছেদের শিরোনামের মিল স্পষ্ট। অর্থাৎ শিরোনাম অনুসারে হাদীছের উপস্থাপন হয়েছে।

(২) বাব বা অনুচ্ছেদসমূহের মধ্যে থাকা শিরোনামগুলো মূলত হাদীছের মতনে থাকা ফিক্বহী মাসআলাকে নির্দেশ করার জন্য রচিত হয়েছে। আর এটা এমনভাবে পেশ করা হয়েছে যে, যে কোনো পাঠক পাঠ করা মাত্রই অনুধাবনে সক্ষম হবে।

(৩) এই গ্রন্থে হাদীছের পুনরাবৃত্তি নেই। যা অন্যান্য সকল হাদীছের গ্রন্থে বিদ্যমান। অর্থাৎ একই হাদীছের বারংবার উল্লেখ হতে এ গ্রন্থটি মুক্ত।

(৪) এটি শুধু হাদীছের গ্রন্থ নয়। বরং কেউ যদি একে ফিক্বহের গ্রন্থ হিসেবে অধ্যয়ন করে, তাহলেও তার উদ্দেশ্য পূরণ হবে।

(৫) অসংখ্য হাদীছের ‘গরীব’ (غَرِيْبٌ) হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

(৬) যে হাদীছটি যে শহরের বা এলাকার মুহাদ্দিছগণ এককভাবে বর্ণনা করেছেন, ইমাম ইবনু মাজাহ সেই এলাকার সেই হাদীছটি বর্ণনা করার সময় উল্লেখ করে দিয়েছেন যে, এ হাদীছটি অমুক এলাকার রাবী বর্ণনা করেছেন।

(৭) এ গ্রন্থে এমন ৪৮২টি ছহীহ হাদীছ রয়েছে, যা বাকী ৫টি গ্রন্থে নেই।

(৮) এ গ্রন্থে এমন ৩০০২টি হাদীছ রয়েছে, যেগুলো বাকী ৫টি গ্রন্থে বর্ণিত হলেও ইবনু মাজাহ সেগুলো ভিন্ন সনদে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ উক্ত ৩০০২টি হাদীছের এমন কিছু ভিন্ন সনদ এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে, যা বাকী ৫টি গ্রন্থে নেই- যদিও হাদীছগুলো রয়েছে। কিন্তু ইবনু মাজাহর সনদগুলো সেসব গ্রন্থে নেই।

(৯) ছহীহ, যঈফ মিলিয়ে মোট ১৩৩৯টি হাদীছ রয়েছে, যেগুলো অবশিষ্ট পাঁচটি গ্রন্থে নেই। এই অতিরিক্ত ১৩৩৯টি হাদীছ একত্রে ‘যাওয়ায়েদ’ নামে ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থেও সংকলিত হয়েছে।

(১০) শায়েখ আলবানী রহিমাহুল্লাহ-এর তাহক্বীক্ব মোতাবেক ‘ইবনু মাজাহ’ গ্রন্থে ৯৪৮টি যঈফ হাদীছ রয়েছে।

ব্যাখ্যা গ্রন্থসমূহ : অন্যান্য হাদীছের গ্রন্থগুলোর মতো সুনানে ইবনু মাজাহরও অনেকগুলো ব্যাখ্যা গ্রন্থ রয়েছে। যেমন—

১. হাফেয মুগলতাঈ হানাফী রহিমাহুল্লাহ রচিত ‘শারহে সুনানে ইবনু মাজাহ’। এটি পাঁচ খণ্ডে রচিত।

২. ইমাম সুয়ূতী রহিমাহুল্লাহ রচিত ‘মিছবাহুয যুজাজা’। এটি এক খণ্ডে প্রণীত।

৩. ইমাম ইবনুল মুলাক্কিন রহিমাহুল্লাহ প্রণীত ‘মা তামাসসু ইলাইহিল হাজাহ’।

৪. ইমাম কামালুদ্দীন দুমায়রী রহিমাহুল্লাহ প্রণীত ‘আদ-দীবাজাহ আলা সুনান ইবনে মাজাহ’।

৫. ইমাম বুরহানুদ্দীন হালাবী রহিমাহুল্লাহ প্রণীত ‘শারহে সুনান ইবনে মাজাহ’।

৬. আল্লামা আবুল হাসান সিন্ধী রহিমাহুল্লাহ প্রণীত ‘কিফায়াতুল হাজাহ ফী শারহে সুনান ইবনে মাজাহ’।

৭. ওয়াহীদুয যামান রহিমাহুল্লাহ প্রণীত ‘রফঊল আজাজা আন সুনান ইবনে মাজাহ’।

৮. আল্লামা আব্দুল গনী মুজাদ্দেদী দেহলবী রহিমাহুল্লাহ রচিত ‘ইনজাহুল হাজাহ’।

৯. পাকিস্তানের আধুনিক যুগের আলেম আল্লামা মুহাম্মাদ আলী জানবায প্রণীত ‘ইনজাযুল হাজাহ বি শারহি সুনানে ইবনে মাজাহ’। গ্রন্থটি ছয়টি বৃহৎ খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। এর কাজ অদ্যাবধি চলমান। উল্লেখ্য, উপর্যুক্ত সবগুলো ব্যাখ্যাগ্রন্থই আরবী ভাষায় রচিত। এছাড়া উর্দূ ভাষাতেও অনেকগুলো ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রণীত হয়েছে।

ইমাম ইবনু মাজাহ রহিমাহুল্লাহ-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী :

নাম : উপরিউক্ত গ্রন্থটির প্রণেতা হলেন ইমাম ইবনু মাজাহ রহিমাহুল্লাহ। তার পুরো নাম হল ‘আবূ আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযীদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে রিবঈ আল-কাযবীনী। তিনি ইবনু মাজাহ নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি ২০৯ হিজরী মোতাবেক ৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের কাযবীনে জন্মগ্রহণ করেন।

উস্তাযগণ : তিনি অসংখ্য বর্ষীয়ান উস্তাযের কাছে অধ্যয়ন করেছেন। যেমন আবূ বকর ইবনু আবী শায়বাহ, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু নুমায়ের, হিশাম ইবনু আম্মার দামেশকী, মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার প্রমুখ রহিমাহুমুল্লাহ।[2]

ছাত্রগণ : ইবরাহীম ইবনু দীনার, আবূ ইয়া‘লা আল-খলীলী, মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা আস-সাফফার রহিমাহুমুল্লাহসহ অগণিত ছাত্র রয়েছে।[3]

উলামায়ে কেরাম মন্তব্য : এখানে কয়েকজন মনীষীর প্রশংসাবাণী তুলে ধরা হলো—

১. হাফেয মিযযী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন,الحافظ، صاحب كتاب السنن ذو التصانيف النافعة والرحلة الواسعة ‘তিনি হাদীছের হাফেয, সুনানে ইবনু মাজাহ গ্রন্থের প্রণেতা, অসংখ্য উপকারী গ্রন্থের রচয়িতা এবং (ইলমের সন্ধানে) ব্যাপক ভ্রমণকারী ছিলেন’।[4]

২. হাফেয যাহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন,ابن ماجه الحافظ الكبير المفسر صاحب السنن والتفسير والتاريخ ومحدث تلك الديار ‘ইমাম ইবনু মাজাহ হাদীছের উচ্চমাপের হাফেয, মুফাসসির, সুনানে ইবনু মাজাহ, তাফসীর ও ইতিহাসের লেখক। তিনি তৎকালীন সময়ের যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ছিলেন’।[5]

৩. ইবনু হাজার রহিমাহুল্লাহ লিখেছেন,صاحب السنن أحد الأئمة حافظ صنف السنن والتفسير والتاريخ ‘তিনি সুনান গ্রন্থের লেখক, অন্যতম একজন ইমাম, হাদীছের হাফেয। তিনি সুনান, তাফসীর ও তারীখের গ্রন্থ রচনা করেছেন’।[6]

মৃত্যু : ইমাম ইবনু মাজাহ ৬৪ বছর বয়সে ২৭৩ হিজরীতে এই নশ্বর দুনিয়া ত্যাগ করে মহান রবের কাছে চলে যান।[7] আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন- আমীন!

উপসংহার : অন্য হাদীছের গ্রন্থাবলির পাশাপাশি সুনানে ইবনু মাজাহ গ্রন্থেরও অধিক মাত্রায় অধ্যয়ন করা উচিত। কেননা ইলমে হাদীছের জ্ঞানের সাগরে ডুব দিতে হলে এই গ্রন্থের পরশ পেতেই হবে।


[1]. ফুয়াদ আব্দুল বাক্বীর তাহক্বীক্ব অনুসারে।

[2]. সুনানে ইবনু মাজাহ হা/১-৬ দ্র.।

[3]. মিযযী, তাহযীবুল কামাল, রাবী নং ৫৭১০।

[4]. প্রাগুক্ত।

[5]. যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, রাবী নং ১০।

[6]. তাকরীবুত তাহযীব, রাবী নং ৬৪০৯।

[7]. প্রাগুক্ত।

Magazine