কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মনীষী পরিচিতি-২ : মাওলানা কাযী আতহার মুবারকপূরী রহিমাহুল্লাহ

ভূমিকা : ইসলামের ইতিহাস নিয়ে যারা গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন ও এ বিষয়ে অসাধারণ লেখনী উপহার দিয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে মাওলানা কাযী আতহার মুবারকপূরী রহিমাহুল্লাহ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি নাম। ভারতের এই ক্ষণজন্মা আলেমের জীবনী সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিম্নরূপ-

প্রাথমিক পরিচয় : ইসলামিক ঐতিহাসিক মাওলানা কাযী আতহার মুবারকপূরীর বংশীয় নাম হলো ‘আব্দুল হাফীয ইবনু শায়েখ হাজী মুহাম্মাদ হাসান’। তিনি ১৩৩৪ হিজরীতে রজব মাসের ৪ তারিখ মোতাবেক ১৯১৬ সনে উত্তরপ্রদেশের আযমগড় জেলার মুবারকপূর গ্রামের হায়দারাবাদ নামক মহল্লায় এমন গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন, যেখানে মোঘল বাদশাহ হুমায়ূনের রাজত্বকালে রাজা মুবারকপূর সংলগ্ন জেলা ইলাহাবাদের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ শাহ মুবারক রহিমাহুল্লাহ কাড়ামাঙ্গ হতে বসবাস ছেড়ে দিয়ে এখানে জনবসতি গড়ে তুলেছিলেন।

মাওলানার বংশে দীর্ঘ সময় যাবৎ বিচারকের পদ দখলে ছিল। এজন্য তাকেও কাযী বলা হয় ও লেখা হয়। ইংরেজদের শাসনামলের শেষ সময়ে বিচারকের পদটি বিশেষ সম্মানজনক ছিল। মুবারকপূরের কাছে মুহাম্মাদাবাদের গোহনায় আদালত ছিল। আর কাযী মুহাম্মাদ সালীম (মৃ. ১২৬৬ হি.) রবীউল আখের মাসের ১২৫০ হিজরী হতে টানা ১৬ বছর যাবৎ মুহাম্মাদাবাদ গোহনার প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত ছিলেন। যিনি কাযী আতহার মুবারকপূরীর পরদাদা শায়েখ ইমাম বখশ মুবারকপূরীকে ভারপ্রাপ্ত কাযী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সেখানে ছালাতের জামাআত ক্বায়েম, জুমআ ক্বায়েম ঈদায়েনের ছালাত, সমকালীন মাসআলা-মাসায়েল, বিবাহ-তালাক, জমিবণ্টন, মুসলিমদের মাঝে সংঘটিত ইখতিলাফসহ ইত্যাকার বিষয়াবলির সমাধানমূলক বিচারকার্য সম্পাদনের দায়িত্ব অর্পণ করেন।

পড়াশোনা : মাওলানা সাহেব বাড়িতে ও মহল্লার একটি ঘরোয়া মক্তবে কুরআনের তৃতীয় পারা অধ্যয়নের সময় মাদরাসা আরাবিয়া ইহইয়াউল উলূম মুবারকপূরে ভর্তি হন। এখানে হাফেয আলী হাসানের কাছে কুরআন খতম করে মুনশী আব্দুল ওয়াহীদ লাহোরপূরীর কাছে উর্দূ, মুনশী আখলাক আহমাদের কাছে গণিত এবং মাওলানা নিয়ামতুল্লাহ মুবারকপূরীর কাছে ফার্সী ও সুন্দর হস্তলিপির শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৩৫০ হিজরীর সফর মাস হতে ১৩৫৯ হিজরীর শা‘বান মাস পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত একই মাদরাসার সুযোগ্য শিক্ষক মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ ইয়াসীনের (মৃ. ২২ই মুহাররম ১৪০৪ হি.) কাছে বেশিরভাগ গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। মাওলানা শুকরুল্লাহ মুবারকপূরীর (মৃ. ৫ই রবীউল আউয়াল ১৩৬১ হি.) কাছে মানত্বেক্ব ও দর্শনের আরও গভীর শিক্ষাগ্রহণ করেন। মাওলানা বাশীর আহমাদ মুবারকপূরীর (মৃ. ৩রা শাওয়াল ১৪০৪ হি.) কাছে ইলমে মানত্বেক্বের কিছু গ্রন্থ, মাওলানা মুহাম্মাদ মাযাহিরী হতে তাফসীর জালালাইন এবং আপন মামা মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া রাসূলপূরীর (মৃ. ১১ই সফর ১৩৮৭ হি.) কাছে ইলমে আরূয, কাওয়াফী এবং হায়আতের কিছু পাঠ গ্রহণ করে উর্দূ, ফার্সী এবং আরবী ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠেন। শেষ বছরে দাওরায়ে হাদীছ সমাপ্ত করার জন্য তিনি জামি‘আহ কাসিমিয়া মাদরাসায়ে শাহী মুরাদাবাদ গমন করেন এবং সেখানে মাওলানা সাইয়েদ ফখরুদ্দীন আহমাদ (মৃ. ১৩৯২ হি.)-এর কাছে ছহীহ বুখারী, সুনানে ইবনু মাজাহ, সুনানে আবূ দাঊদ; মাওলানা সাইয়েদ ইকবাল মিয়াঁ (মৃ. ১৬ই শাউয়াল ১৩৯৫ হি.)-এর কাছে সুনানে তিরমিযী; মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল সাম্ভুলী (মৃ. ১৩৯৫ হি.)-এর কাছে ছহীহ মুসলিম পড়ে ১৩৬০ হিজরীতে সনদ হাছিল করেন।

মাওলানা ছাত্র থাকাকালেই অধিক পড়াশোনা এবং গ্রন্থে নিমগ্ন থাকার কারণে আরবী ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত ও মূলনীতি, যেমন— ভাষা, শব্দের ব্যুৎপত্তি, নাহু, ছরফ, খাছিয়াত ইত্যাদি বিষয়ে যথেষ্ট যোগ্যতা ও দূরদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তার আরবী ভাষায় অত্যাগ্রহ মাকামাতে হারীরী, দিওয়ানে হামাসা, দিওয়ানে মুতানাব্বী, সাবআ মুআল্লাক্বাহ-এর দারস ও লুগাত, সাহিত্যের গ্রন্থাবলি অধ্যয়নের ফল। সূচনাতে কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যয়নের বরকত এটাই ছিল যে, কাযী সাহেব স্বীয় তা‘লীমী যিন্দেগীতে মুশকিল ক্ষেত্রগুলো সমাধান করার ক্ষেত্রে পূর্ণ দক্ষতা হাছিল করেছিলেন। যার কারণে ছাত্রত্বের সময়টুকু অত্যন্ত পরিশ্রমের সাথে অতিবাহিত করতে হয়েছে। এটাই কারণ যে, কাযী সাহেবকে ছাত্র থাকাবস্থাতেই মাদরাসা ইহইয়াউল উলূমের আরবীর ছাত্রদেরকে পাঠ্যপুস্তকসমূহ পড়ানোর ও বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব মাদরাসার পরিচালনা কমিটির পক্ষ হতে সোপর্দ করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক মুবারকপূরীও অত্যন্ত সাবলীল পদ্ধতিতে ইলমী সফলতার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।

শুরু থেকেই গ্রন্থ সংগ্রহ ও ক্রয় করার শখ ছিল মাওলানা সাহেবের। তিনি বই বাঁধাই করে সেই টাকা দিয়ে বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাবলি সংগ্রহ করেছিলেন। গ্রন্থ ও অধ্যয়নের এই অভিরুচির কারণে তার মাঝে প্রবন্ধ রচনা, কবিতা ও কবির প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হয়। অনুরূপভাবে মাওলানার প্রথম প্রবন্ধ ‘মুসাওয়াত’ পত্রিকায় ‘মুমিন’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ বাদাইউনের (ডিসেম্বর ১৯৩৪ খৃ./১৩৫৩ হি.) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সে সময় তিনি ছাত্র ছিলেন। এভাবে তার প্রথম কবিতা বেরেলীর ‘ফুরকান’ পত্রিকায় জুমাদাছ ছানীর সংখ্যায় ১৩৫৭ হিজরীতে ‘মুসলিম কী দু‘আ’ শীর্ষক শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।

কর্মজীবন : মাওলানা মুবারকপূরী পড়াশোনা সমাপ্ত করার পর শাওয়াল মাসের ১৩৫৯ হিজরী হতে মুহাররম ১৩৬৪ হিজরী পর্যন্ত অর্থাৎ সাড়ে চার বছর যাবৎ স্বীয় ইলমী সূতিকাগার ‘ইহইয়াউল উলূম’-এ আরবী শিক্ষক ছিলেন। কিছু বিরতিকাল পর একই মাদরাসায় শাওয়াল ১৩৬৬ হিজরী হতে সফর ১৩৬৭ হিজরী মোতাবেক ১লা অক্টোবর ১৯৪৬ হতে জানুয়ারি ১৯৪৭ পর্যন্ত মোট পাঁচ মাস আরবী ভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন।

মাওলানা পড়াশোনার পাঠ চুকানোর পর যথেষ্ট অর্থকষ্টে পড়েন। তিনি অমৃতসর ও লাহোর চলে যান। সেখানে জানুয়ারি ১৯৪৭ সনে ‘দৈনিক যমযম’-এর পরিচালক মাওলানা উছমানীর সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পান। তার নির্দেশনায় তিনি সাংবাদিকতায় আসেন। কিন্তু তিনি ১০ জুন ১৯৪৭ সনের দেশ বিভাগের কারণে বিশৃঙ্খল অবস্থার কারণে দেশে ফিরে আসেন এবং কখনোই আর যেতে পারেননি। ১৩৬৭ হিজরীর মুহাররম মোতাবেক ১৯৪৭ হতে রজব ১৩৬৭ হিজরী/১৯৪৮ সন পর্যন্ত ‘বাহরায়েচ’-এর একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘আনছার’-এর পরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকেন। যেটি সাত মাস চলার পর উত্তরপ্রদেশ সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। শাওয়াল ১৩৬৮ হিজরী মোতাবেক ১৯৪৮ হতে শা‘বান ১৩৬৭ হিজরী মোতাবেক ১৯৪৯ পর্যন্ত ‘জামি‘আহ ইসলামিয়া ঢাবীল’ মাদরাসায় তিনি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকেন। এখানকার একটি শিক্ষাবছর মাওলানা সাহেবের জীবনের ইলমী, কলমী জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল ছিল। ‘রিজালুস সিন্দ ওয়াল হিন্দ’ গ্রন্থ রচনার সূচনা এখানেই হয়েছিল। যা সিন্ধ ও হিন্দের আলেমদের জীবনী ও অবস্থাসমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ মনে করা হয়।

জীবিকার সন্ধানে কাযী সাহেব ১৩৬৮ হিজরীর যিলহজ্জ মাস মোতাবেক ১৯৪৯ সনে মুম্বাই চলে যান। আর সেখানে তিনি ‘জমঈয়তুল উলামা মুম্বাই জেলা’-এর অফিসে কর্মরত থাকেন। এভাবে আট মাস অতিবাহিত হওয়ার পর ১৫ই জুন ১৯৫০ ‘দৈনিক গণতন্ত্র মুম্বাই’-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলে মাওলানা এর ‘ভারপ্রাপ্ত পরিচালক’ হিসেবে নিয়োগ পান। তার মেহনত ও লেগে থাকার কারণে কয়েকদিনের মধ্যেই একে মুম্বাইয়ের একটি গ্রহণযোগ্য দৈনিক পত্রিকা মনে করা হতে লাগল। এমনকি দৈনিক ইনকিলাব মুম্বাইয়ের গ্রহণযোগ্যতা ও অফিসিয়াল দাপটকেও প্রভাবিত করতে লাগল। ফেব্রুয়ারি ১৯৫১ মুম্বাইয়ের অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য পত্রিকা ‘ইনকিলাব’-এর সাথে জড়িত হয়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। মাওলানা সাহেবের প্রবন্ধ ও বিরল লিখনের কারণে ইনকিলাবের ব্যাপক উন্নতি হতে লাগল। এ পত্রিকায় মাওলানা সাহেবের দৈনিক তিন/চারটি কলাম প্রকাশিত হতো। কিন্তু সেগুলোতে বর্তমান প্রেক্ষিত ও জ্ঞান হীরকখণ্ডের ন্যায় তথ্যের ভাণ্ডারে ভরপুর থাকত। যা প্রাচীন ও আধুনিক উভয় মহলে সমাদৃত হতো। ২৩ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫১ সন হতে ১৯৯১ সনের এপ্রিল পর্যন্ত ইনকিলাবের মুদ্রিত বর্ণনাসমূহ ও বুদ্ধিবৃত্তিক লিখন যদি গ্রন্থাকারে ভিন্ন শিরোনামে সংকলন করা হতো, তাহলে একাধিক মৌলিক গ্রন্থে সজ্জিত হতে পারত। আর এভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই কলামগুলো সুধী মহলে উৎস ও তথ্যসূত্রের উত্তম উপকরণ হতে পারত। কিন্তু এ কাজ একজন সুযোগ্য ব্যক্তি দ্বারাই সম্পাদিত হতে পারে।

যখন ১৪ মে ১৯৫৪ সনে সাপ্তাহিক ‘আল-বালাগ’ মুম্বাইয়ের পদচারণা শুরু হলো, তখন এর সাথে মাসিক ‘আল-বালাগ’-এর ভিত্তিও স্থাপিত হয়। অন্য দু’জন পরিচালকের সাথে মাওলানাকেও এ অফিসে শরীক করা হয়েছিল। কিছুদিন পর উভয় পরিচালক এই পত্রিকার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিন্তু মাওলানা মুবারকপূরী প্রায় ২৬ বছর যাবৎ ‘আল-বালাগ’ পত্রিকার ‘মুদীরে তাহরী’র হিসেবে কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন।

আমলী জিন্দেগী : মাওলানার আমলী জিন্দেগী, কলমী ব্যস্ততা, মগ্নতা, অকৃত্রিমতা, নিয়মানুবর্তিতা, তাওয়াক্কুল, মুখাপেক্ষীহীনতা, ঈমান ও ইয়াক্বীন, আত্মনির্ভরতা, দৃঢ় মনোবল, সতর্কতা, শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ, অল্পেতুষ্টি, একাগ্রতা, গবেষণা করা, জ্ঞানের গভীরতা, শ্রম ও অক্লান্ত পরিশ্রম, উদ্দীপনা, ভালোবাসা, একনিষ্ঠতা, নিশ্চিন্ততা, ধারাবাহিকতা, ব্যবস্থাপনা, পরিশীলতা, সভ্যতা, দূরদৃষ্টি, সৌম্য চেহারা ও উত্তম আখলাকে পূর্ণ ছিল। মুম্বাইয়ের মতো শহরে থেকে মাওলানা সাহেব দুনিয়াদারী ও ধনসম্পদ কামানোর খুব বড় সুযোগ পেতে পারতেন। কিন্তু মাওলানার মাঝে যে দুনিয়াবিমুখতা, ইলম অনুসন্ধানের অত্যুগ্র বাসনা ও দ্বীনের প্রতি নির্ভেজাল আবেগ ছিল, তা তাকে সম্পদ কামানোর সকল রাস্তা হতে বিরত রেখেছিল। সঊদী আরব এবং আরব দেশগুলোর অন্যান্য সুলতান, নেতা, ব্যবসায়ী এবং সুধীমহলে স্বীয় ইলমী প্রভাব ও বাস্তবায়ন থাকার পরও যাবতীয় হাদিয়া-তোহফাকে তিনি ত্যাগ করেছিলেন। যেগুলো দ্বারা তার দুনিয়াবী সম্পদ বৃদ্ধি হতে পারত। মাওলানা স্বীয় দ্বীনী, ইলমী ও কলমী কাজে এতটাই নিমগ্ন ছিলেন যে, যেটুকু খেলে জীবনধারণ সম্ভব কেবল ততটুকুই খেতেন। অন্যান্য সকল সম্পর্ক এবং মনের চাওয়া ও আরাম-আয়েশকে নিজের জীবনে মোটেও গুরুত্ব দেননি।

বহুমুখী প্রতিভার দৃষ্টান্ত : মাওলানা কেবল একজন সাহিত্যিক ও কবিই ছিলেন না; তিনি ধর্ম ও রাজনীতির সাথে বাস্তব জীবনেও সম্পর্ক রাখতেন। আর অন্যান্য আন্দোলনসমূহের সাথে সুসম্পর্ক রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইলমী ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠান নির্মাণেও প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেন। ১১ জুমাদাছ ছানী ১৩৭১ হিজরী মোতাবেক ১৯৫১ মাদরাসা মিফতাহুল উলূম ভূন্ডীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। যা অদ্যাবধি উন্নতি বজায় রেখে চলেছে। অনুরূপভাবে মুবারকপূরে রচনা, সংকলনের জন্য তিনি ‘দায়েরা মালিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তার কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। মেয়েদের আধুনিক শিক্ষার জন্য আনছার গার্লস স্কুল মুবারকপূর এবং ১৪০০ হিজরীতে মাদরাসা হিজাযিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর প্রতিষ্ঠা করেন।

ইহইয়াউল উলূম মাদরাসায় কাযী সাহেবের উস্তাদদের মধ্যে কেউই সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক, লেখক ও সংকলন ছিলেন না। কিন্তু তিনি স্বীয় যোগ্যতা, আল্লাহ প্রদত্ত দক্ষতার দ্বারা এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করে দেখিয়েছেন। যদি মানুষের মধ্যে অনুসন্ধানী মন ও অন্তরের টান থাকে; এছাড়াও দৃঢ় উৎসাহের কমতি না থাকে, তাহলে সে ক্ষুদ্র স্থানে থেকেও কল্পনা ও ধারণার স্তর পেরিয়ে আলেমদের কাতারে স্বীয় স্থান করে নিতে পারে। আর সমাজকে স্বীয় অস্তিত্ব অনুভব করাতে পারেন। মাওলানার প্রতিটি ছাত্র ইলমী, তা‘লীমী শ্রম, ইতিহাস ও গ্রন্থের প্রতি আগ্রহ, গভীর উৎসাহ, উচ্চ সাহস, আত্মনির্ভরতার নমুনা ও সৃজনশীলতার ছাপ রাখত।

রচনাসমূহ : প্রায় ৩৫টি গ্রন্থ মাওলানা সাহেব রচনা করেছেন। এ ব্যতীত মাওলানা সাহেবের সফরনামা, পত্রাবলি ও অসংখ্য প্রবন্ধ গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হওয়ার অপেক্ষায়। ছাত্র থাকাকালীন রচিত ‘খায়রুয যাদ ফী শারহি বানাতে সুআদ (আরবী)’ গ্রন্থটি অপ্রকাশিত; মিরআতুল ইলম (আরবী) অপ্রকাশিত, আছহাবে ছুফফার নামে কাব্যগ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন। ‘মে তুহূর’ অপ্রকাশিত এবং কবিতার সংকলন বিদ্যমান।

মাওলানার ইলমী ও কলমী খেদমতকে সম্মানের সাথে দেখা হয়েছিল। ভারত সরকার ১৯৮৪ সনে ‘সদরে জমহূরিয়াত এ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করেছে। ১৯৮৪, ১৯৮৬ সনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যিয়াউল হক্ব ইলমী স্বীকারোক্তি হিসেবে অন্যান্য পুরস্কার ও পাকিস্তানের স্মারক চিহ্ন দিয়েছেন। এর সাথে সাথে পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী মহলের পক্ষ থেকে ‘মুহসিনে সিন্ধ’-এর উপাধিতেও তাকে ভূষিত করা হয়েছিল।

তামীরাতে আদব মাওলানা আনজুম, লাহোরের নির্ভরযোগ্য, ইদারাতু তুরাছ আল-আরাবী কুয়েতের ইলমী পরামর্শদাতা, জমঈয়তুল উলামা মহারাষ্ট্র-এর সভাপতি, দ্বীনী তা‘লীমী বোর্ড মহারাষ্ট্রের সভাপতি, আনজুমান খুদ্দামে নবী মুম্বাইয়ের সদস্য, মুম্বাইয়ের চাঁদ দেখা কমিটির সদস্য, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লাহোরের পারসোনাল ল’ বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, শায়খুল হিন্দ দেওবন্দের কর্ণধার, দারুল মুছান্নিফীন আযমগড়ের সম্মানিত উপদেষ্টা, বুরহানে দিল্লীর উপদেষ্টা পরিচালক, দারুল উলূম তাজুল মাসাজিদ ভূপাল, দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ, জামি‘আহ আশরাফিয়া নতুন ভোজপূর (বিহার)-এর মজলিসে শূরার সদস্যও তাকে বানানো হয়েছিল।

মৃত্যু : আল্লাহ তাআলা মাওলানার ইলম, সন্তান, ধনসম্পদে অত্যন্ত বরকত দিয়েছেন। যা গুটিকতক মানুষই পেয়ে থাকে। এটি মাওলানা সাহেবের দ্বীনী ইখলাছ, ইলমী একাগ্রতা, অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা, আত্মশুদ্ধি এবং দুনিয়াবিমুখতার সুফল। ইলমী দুনিয়ার এই মহান যোদ্ধা ও সম্মানিত ব্যক্তি রবিবার ২৭ সফর ১৪১৭ হিজরী মোতাবেক ১৪ জুলাই ১৯৯৬ সনে রাত ১০টায় দুনিয়ার বন্ধন ছিঁড়ে পরপারে পাড়ি জমান। আল্লাহ তাআলা তাকে রহমত করুন। আমীন!

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, মাওলানা কাযী আতহার মুবারকপূরী রহিমাহুল্লাহ একজন ভালো ছাত্র, দক্ষ শিক্ষক, লেখক, গবেষক, বহু ভাষাবিদসহ একাধিক গুণে গুণান্বিত ছিলেন। আল্লাহ তার লেখনী দ্বারা মুসলিমজাতির উপকার সাধন ক্বিয়ামত অবধি জারী রাখুন- আমীন!


তথ্যসূত্র :

১. মাওলানা নূর আলম খলীলী আমীনী, পাস-ই মারগ যিন্দা, পৃ. ২৯৯-৩২৯।

২. কাযী আতহার মুবারকপূরী, ক্বায়েদায়ে বোগদাদী সে ছহীহ বুখারী তাক, পৃ. ১৮-১৯।

৩. মাওলানা কামারুযযামান মুবারকপূরী, মাজমূআ কালাম কাযী আতহার মুবারকপূরী, পৃ. ১-৫০।

৪. আল-মুওয়াররিখুল ইসলামী আল-হিন্দী আশ-শাহীর কাযী আতহার মুবারকপূরী ফী যিম্মাতিল্লাহ, পৃ. ৪-১৫।

৫. মাসিক আল-ফয়সাল, সংখ্যা-৪ (২৮ ছফর ১৪২১ হি./জুন ২০০০ খ্রি., রিয়াদ, সঊদী আরব), পৃ. ৯৬-১০০।

Magazine