দবির উদ্দিন এক বৃদ্ধ বাদামওয়ালা। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত কখনো বাদ যায় না তার। পরিচিতজনদের কাছে তিনি একজন ঈমানদার দ্বীনদার ব্যক্তি হিসাবেই পরিচিত। ভারী কোনো কাজ তিনি করতে পারেন না। সেই শক্তিও নেই শরীরে। তাই স্কুল-কলেজে বাদাম বিক্রি করে জীবিকার যোগান দিতে হয় তাকে।
একদিন কলেজের এক ছাত্র তার সাথে কথা বলে। সেই ছাত্র তাকে অনেক দিন ধরে কলেজে বাদাম বিক্রি করতে দেখছে। তাই সে জানার কৌতূহল থেকে তাকে প্রশ্ন করে। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে দাদু বলে ডাকত।
—আস-সালামু আলাইকুম। দাদু, কেমন আছো? দাদিমা কেমন আছে? —ওয়ালাইকুম আস-সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতু। আছি, আল-হামদুলিল্লাহ। আল্লাহ ভালো রাখছেন। তোমার দাদিমাও আল-হামদুলিল্লাহ ভালো আছে। আল্লাহ যেমন রেখেছে তাতেই আমরা খুশি। সে প্রশ্ন করে- দাদু, তুমি প্রতিদিন বাদাম বিক্রি করে কত টাকা পাও? সেটা দিয়ে কি তোমার সংসার চলে?
—পাই দাদু যা আসে তাতেই আমার ছোট সংসার চলে যায় আল-হামদুলিল্লাহ। ছাত্রটি বলে, তুমি চাইলে তো ভিক্ষা করতে পারতে? —না রে দাদু! ভিক্ষাবৃত্তি ক্ষেত্রবিশেষে হালাল হলেও অনুত্তম কাজ। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘উপরের হাত (দাতার হাত) নিচের হাত (গ্রহীতার হাত) অপেক্ষা উত্তম’।[1] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র বলেছেন, ‘কষ্ট করে পিঠে বোঝা বহন করে জীবনযাপন করা ভিক্ষাবৃত্তি থেকে অনেক উত্তম’।[2] এটাই আমার নবীর আদর্শ। আর আমি তাঁর আর্দশে বিশ্বাসী। তাই ভিক্ষা করতে আমার বিবেকে বাধে, ভালো লাগে না। এজন্য ভিক্ষা না করে বাদাম বিক্রি করি। হালাল রূযী রোজগার করি। —কিন্তু দাদু অনেকেই তো দেখি আমাদের কলেজে এসে বা রাস্তার ধারে বসে ভিক্ষা করে!
—তাদের মানুষের কাছে ভিক্ষা চাওয়া একটা বদ অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মানুষগুলো চাইলে আমার মতো কম পুঁজির কম পরিশ্রমের এই বাদামের ব্যবসা করতে পারেন। কিন্তু তারা তা না করে ভিক্ষা করে। একদিন অন্য এক বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলি, আপনি ভিক্ষা করেন কেন? আমার মতো বাদাম বিক্রি করতে পারেন না? লোকটি কোনো কথা না বলে চলে যান।
—আচ্ছা দাদু, তোমার কোনো ছেলে-মেয়ে নেই? তারা তোমাদের খোঁজ-খবর কিছু নেয় না। —আছে, থাকবে না কেন? কিন্তু তাদের নিজেদের অবস্থা ভালো না। নিজরাই ভালোভাবে চলতে পারে না। তাই আমি তাদের কোনো চাপ দিই না। তবে মাঝেমধ্যে ছেলেরাও খোঁজ-খবর নেয়, টাকাপয়সা কিছু হাতে দেয়। আবার বাজার-সদাইও করে দেয়। এতেই আমরা খুশি।
—আচ্ছা দাদু, ঠিক আছে, ক্লাস শুরু হবে। আজ তবে যাই পরে কথা হবে ইনশাআল্লাহ। এই বলে ছাত্রটি ক্লাসে চলে যায়। এরপর দবির উদ্দিন কলেজে বাদাম বিক্রি করে স্কুলে চলে আসেন।
—দবির উদ্দিন, বাদাম দাও। তোমার হাতের বাদাম না খেলে ভালো লাগে না। কেমন আছো? দিনকাল কেমন যাচ্ছে? বাদাম দিতে দিতে জি, স্যার! আল-হামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনাদের সকলের দু‘আয় দিনকাল ভালোই যাচ্ছে।
দবির উদ্দিন সারাদিন স্কুল-কলেজে বাদাম বিক্রি করে আবার মাগরিবের ছালাত পড়ে সন্ধ্যার পর বাজারে বাদাম বিক্রি করতে যায়। এলাকায় তিনি বাদামওয়ালা হিসাবেই পরিচিত। সবার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। রাতে বাজার থেকে ফেরার পথে আবার নতুন বাদাম কিনে এর সাথে খাবারের বাজার নিয়ে তিনি বাড়িতে ফিরেন। এরপর এশার ছালাত পড়ে স্ত্রীসহ আল্লাহর দেওয়া রিযিক্ব খেয়ে দুজনে ঘুমিয়ে পড়েন। এভাবে কাটে দবির উদ্দিনের জীবনের প্রতিটি দিন।
বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল। হঠাৎ করে দবির উদ্দিন স্কুল-কলেজে কোথাও বাদাম বিক্রি করছে না। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা দবির উদ্দিনকে ভালোবাসত। তারা চিন্তা করছিল দবির উদ্দিনের কিছু হয়েছে কি না! এক ছাত্র দবির উদ্দিনের বাড়ি যায় তার খোঁজ-খবর নিতে।
খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারে দবির উদ্দিনের স্ত্রী খুব অসুস্থ। তাকে নিয়ে কয়েক দিন থেকে তিনি হাসপাতালে আছেন। স্ত্রীর অপারেশন করাতে হবে। এজন্য তার অনেক টাকার প্রযোজন। তার ছেলে-মেয়েরাও কিছু কিছু করে টাকা দিয়েছে। কিন্তু তার আরও টাকা প্রয়োজন।
তখন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এবং শিক্ষকরাসহ টাকা তুলে দবির উদ্দিনের হাতে তুলে দিয়ে বলে, স্ত্রীর চিকিৎসা ভালো করে করাও। আমরাও দু‘আ করি আল্লাহ তাকে দ্রুত সুস্থ করে দিন। চিন্তা করো না। আরও টাকা লাগলে আবারও ফান্ড কালেকশন করা হবে ইনশাআল্লাহ।
শিক্ষকদের হাত থেকে টাকা ও দু‘আ পেয়ে খুশিতে দবির উদ্দিন কেঁদে ফেলে। আর আল-হামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া জানান।
তিনি মনে মনে ভাবেন, আমি যদি আজ ভিক্ষা করে সংসার চালাতাম তাহলে হয়তো এই মানুষগুলো আজ আমার মহা বিপদে টাকাপয়সা দিয়ে সহায়তা করত না। ভিক্ষুককে মানুষ সাধারণত করুণা করে; সম্মান ও ভালোবাসে না। আর পরিশ্রমীকে সবাই ভালোবাসে ও সম্মান করে। ন্যায়নিষ্ঠাবান হলে বিপদে এভাবেই পাশে থাকে।
আল্লাহর শুকরিয়া করে তিনি বলেন, ভিক্ষা না করে বাদামের এই ছোট ব্যবসা করার কারণে আজ মানুষের এত ভালোবাসা ও সম্মান পেলাম। তার স্ত্রী সুস্থ হলে তিনি পুনরায় বাদাম নিয়ে স্কুল-কলেজে বিক্রি করতে যান।
সাদিয়া আফরোজ
হাজীর হাট কাঁটাবাড়ি মিলবাজার, রংপুর সদর, রংপুর।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১৪২৭।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/১৪৭১।