কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

শুকরিয়া জানাই মহান রবের

post title will place here

শুকরিয়া জানাই মহান রবের

[১]

জীবনের তিক্ত এক সময়। যেই সময়ে হারিয়ে ফেলেছিলাম জীবনের সবটুকু আনন্দ। ভুলে গেছিলাম সুখ কী জিনিস! প্রতিটা সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা যাচ্ছিল গুনে গুনে। আমাকে বলে যাচ্ছিল, আমি যাচ্ছি। হতাশা আর মনোব্যথার তীব্র ঝড় আমাকে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছিল বারবার। কষ্টের কাঁটার কাছে বর্শার তীক্ষ্ণ ফলকও লজ্জা পাচ্ছিল। আমার চোখ হয়েছিল ঝরনা আর মুখাবয়ব ঝরনা বেয়ে নামা পাহাড়ের মতো। দিলের কান্নার সুর আকাশের সান্নিধ্য লাভ করেছিল। ভালো লাগার ছিটেফোঁটাও তখন ছিল না আমার মনে। কেবল রবের কাছেই নিঃশব্দে কাঁদতাম। সকাল, দুপুর, রাতে। সময়, অসময়ে। প্রত্যেক ছালাতে মুনাজাতে অশ্রুর বন্যা বইয়ে দিতাম। প্রতিক্ষণে বুকে এসে বিঁধছিল ব্যথার সুচ। হৃদয়ে ক্ষতের কোনো মলম খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। পৃথিবীটা আমার কাছে অসহ্য ঠেকছিল। মরে যেতে ইচ্ছে করছিল বারবার। সেই সময়ের দুঃখ প্রকাশের ভাষা নেই।

একদিন একটুখানি ভাল্লাগার সন্ধানে ভাইয়ের সাথে বাইরে গেলাম। কিন্তু…। পুরো জগতটা যেন আমার চারপাশে ঘুরছিল। মাথাটাও টলমল করছিল। মনে হচ্ছিল, চলন্ত গাড়িগুলো সব আমার দিকেই ধেয়ে আসছে। শহরে কোথায়, কখন চোখের পানি পড়েছে, জানি না। তখন আমি যেন একটা প্রাণহীন দেহ। অটোতে ফেরার পথে মনের তীব্র ব্যথা আর হতাশা নিয়ে ভাইয়ার কাঁধে মাথা রাখলাম। আমার অশ্রু ভিজিয়ে দিচ্ছিল তার পাঞ্জাবী। টপটপ করে তার কাঁধে ঝরছিল বৃষ্টি। এ বৃষ্টি আকাশের মেঘমালার নয়। এ বৃষ্টি মনের অবর্ণনীয় কষ্টের।

হঠাৎ কোনো কারণে আমাদের অটোটা রাস্তার একপাশে দাঁড়াল। আর আমার দৃষ্টি নিবিষ্ট হলো রাস্তার পাশের এক হুইল চেয়ারে। সেই চেয়ারে বসা ছিল আমার চেয়ে দু’এক বছরের বড় দু’জন ছেলে। তাদের আসলে দু’জন বলা যায় কিনা, জানি না! কারণ, তারা একই দেহের দুটো প্রাণ মাত্র। তাদের দেখামাত্র আমার বেদনাবেষ্টিত চিত্ত থেকে কৃতজ্ঞতা স্বরে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বেরিয়ে এলো, আলহামদুলিল্লাহ।

আমার মতো এত দুঃখী নয়তো কারো জীবন— এই ভাবনাটা তাদের দেখামাত্রই উবে গেল। এই যে, একই দেহের দুটো মানুষ! কত কষ্টই না তাদের জীবনে! কতইনা তারা অবহেলিত, অপমানিত এই ধরার বুকে। কতইনা তারা বোঝা আত্মীয়স্বজনের কাছে। কত মানুষ তাদের দেখে নাক শিটকায়। আমাদের তুলনায় তাদের জীবন কতইনা নিষ্ঠুর। কতইনা বেদনাবিধুর! যার প্রমাণ, তাদের গণ্ডবেয়ে নামা দু’ফোটা অশ্রু!

এক্ষণে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীছ আমার বড্ড মনে পড়ছে। তাঁর অমীয় বাণী, ‘তোমরা তোমাদের চেয়ে নিচু স্তরের দিকে দৃষ্টি রাখবে, উঁচু স্তরের প্রতি দৃষ্টি রাখবে না। তাহলে তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের অবজ্ঞা করার অপরাধ হতে রক্ষা পাবে’।[1]

কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারাটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। যখন আমরা আমাদের উপরের শ্রেণির মানুষদের প্রতি তাকাব, তখন অকৃতজ্ঞতায় আমাদের মন ছেয়ে যাবে। বারবার মনে হবে, ওর আছে আমার কেন নেই? আল্লাহ কেন আমাকে তাদের মতো দেননি?! কিন্তু আমরা যখনই পিছন ফিরে নিচের স্তরে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকাব, তখনই মন কৃতজ্ঞতার বর্ষণে কানায় কানায় ভরে উঠবে।

যদি ভাবি ওই মানুষটার কথা, যার নেই একটি হাত, অথবা দুটো, একটি পা, অথবা দুটো। যেই মানুষটা অর্ধশরীরী। তাদের থেকে কি আমাকে ভালো রাখেননি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা?

ওই যে ওই পাগলটা! যার দিকে আমরা কতইনা হেয়, তুচ্ছ আর অবজ্ঞার তির ছুড়ি। তার থেকে কি আমরা ভালো নেই?

আমরা কত রঙের, কত ঢঙের পোশাক পরছি প্রতিনিয়ত। কিন্তু একটিমাত্র ছিঁড়া কাপড়ই যার আবরণ, তার হৃদয়টা কতটা আহত!

ওই যে পথশিশুটা, যে কিনা সামান্য কিছু খাবারের জন্যে সারাটাদিন রাস্তায় রাস্তায়, স্টেশনে স্টেশনে বা ডাস্টবিনে বোতল, প্লাস্টিক, কাগজ কুড়িয়ে বেড়ায়!

ওই যে মানুষটা, আস্তাকুঁড়ের পাশের পচা জায়গাটা যার বাসস্থান। প্রতিক্ষণে যে লজ্জারাঙা হাতদ্বয় পেতে থাকে মানুষের দেওয়া দুটো পয়সার আশায়! তাদের জীবনটা কতইনা কষ্টের!!!

আকাশের চাঁদ-তারা, অপরূপ এই ধরা! আমরা চোখ মেললেই দেখতে পাই! পৃথিবীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে, বাতাসের পরতে পরতে ভাসতে থাকা কত্ত রকম ধ্বনি, যা আমরা অনায়াসেই শুনতে পাই! মনের মাঝে জমা কত্ত দুঃখকথা, সুখগাঁথা, যা আমরা কত সহজেই কথামালায় প্রকাশ করতে পারি।

কিন্তু যাদের চোখ নেই, যার আলোও আঁধার, আঁধারও আঁধার! যার নেই শ্রবণশক্তি, নেই কথা বলার ক্ষমতা! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের কি তাদের তুলনায় ভালো অবস্থানে রাখেননি!?

[২]

মাঠে মাঠে ফসলের বাহার, যেগুলো আমাদের জোগায় আহার। যদি এমন না হতো, জমে যেত ক্ষুধার পাহাড়। হয়ে যেতাম বড়ই আকাল। যদি না থাকত গাছে ভরা ফল; গরু, ছাগল, মুরগির পাল, কোথা থেকে পেতাম আহার? কখনো কি শুকরিয়া জানানো হয়েছে, এসবের মালিকানা যার?

এই যে পানির বাহার— নদী, নালা, সাগর। আকাশের বৃষ্টি ঝুমুর ঝুমুর। যেই পানি ছাড়া মুহূর্তেই ফুরাবে জীবনের প্রহর। শুকিয়ে যাবে গাছপালা, চারিপাশ, মৃত্তিকা, শহর। হয়ে পড়বে সব নিথর। অথচ কত অনুগ্রহে রব দিয়েছেন এই নেয়ামত! আমরা করি কি এসবের শুকরিয়া?

এই যে বায়ু-বাতাস, যা বিহীন চলত না শ্বাস। যা ছাড়া মৃত্যু করবে গ্রাস। এই যে আগুন। তার কতসব গুণ, যার দ্বারা তৈরি করি খাবার, পেয়ে যাই আহার। এর জ্বালানি-কাঠেরও তো রয়েছেন এক স্রষ্টা। কখনো কি করা হয় এসবের বিনিময়ে প্রসংশা?

এসবের কথাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সূরা আল-ওয়াক্বি‘আর ৬৩-৭৪ নং আয়াতে বলেছেন।

যিনি দিয়েছেন কর্মমুখর দিন। দিন শেষে আবার নিস্তব্ধ রাত। সমস্ত ক্লান্তি, ব্যস্ততা দূর করতে দিয়েছেন ঘুম। ঘুম শেষে দুধের শিশুর হাসির মতো মিষ্টি ভোর। আরো দিয়েছেন সূর্যাস্তের নির্মল কোমল আভা। দিয়েছেন আকাশের ওপরে আকাশ। যার মাঝে শুভ্র চন্দ্র। চাঁদের জোছনা। আলোতে ভরা সূর্য।

সূর্যাস্তে নদীর জলে সূর্যের স্নিগ্ধ ছায়া। বসন্তের নানা রঙের নানা ঢঙের পুষ্পকলির সৌন্দর্যের মেলা। শীত শেষে পল্লবরাজির ঝরে পড়া। শরতে তুলোতুল্য মেঘের উড়াউড়ি। হেমন্তে ফসলের গোলা। শীতে লেপ-কাঁথা মুড়ানো ঘুম। গ্রীষ্মে মিষ্টি মিষ্টি ফল। বর্ষায় নানান রূপের বৃষ্টি। এগুলোতে মুগ্ধ হয়ে কখনো কি বলা হয়— ‘সুবহানাল্লাহ?’

আরো দিয়েছেন আম্মু-আব্বুর মতো অতুলনীয় নেয়ামত। দিয়ে থাকেন প্রিয়তমা-অর্ধাঙ্গিনী। দেন সন্তানসন্ততি। বাঁধেন আত্মীয়তার বাঁধন।

শুধু তাই নয়; তিনি আরো আরো অনেক অনেক বেশি বেশি নেয়ামত দিয়ে থাকেন, যদি আমরা শুকরিয়া আদায় করি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তাহলে আমি আরো বেশি বেশি দিব’ (ইবরাহীম, ১৪/৭)

এত এত নেয়ামতে ঘিরে রেখেছেন তিনি। এর বিনিময়ে তিনি কী চান? তিনি চান আমাদের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা।

আসুন! কৃতজ্ঞচিত্তে বলি— আল-হামদুলিল্লাহ।

মাজহারুল ইসলাম আবির

শিক্ষার্থী, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৯০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৬৩; মিশকাত, হা/৫২৪২।

Magazine