একজন যুবকের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে একদল যুবক। একজন যুবকের দ্বীনে ফেরার গল্পই একদল যুবকের দ্বীনে ফেরার গল্প।*একজন যুবক যখন জন্মগত মুসলিম হয়ে মুসলিম সমাজে বাস করে, তখন সে বুঝতে পারে না, ফিতনা কী? কিন্তু ঐ যুবকই যখন আল্লাহর রহমতে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়, তখন সে যুবক বুঝতে পারে ফিতনা কী! সে যখন জন্মগতভাবে মুসলিম ছিল কিন্তু ইসলাম থেকে দূরে ছিল, তখন সে অন্ধকারকেই আলো ভাবত। আর সে অন্ধকারের উপাদান ছিল— গান-বাজনা, প্রেমের নামে যেনা, মদ-সিগারেট, জুয়া, গেমস, অশ্লীলতা ইত্যাদি। সেই যুবক এগুলোকেই জীবনের আলো ভাবত। একসময় সেই যখন আল্লাহর হেদায়াত পায়, তখন সে বুঝতে পারে, সে ফিতনায় পড়ে আছে। তারপর আল্লাহর রহমতে সে এসব হারাম কাজ ছাড়তে থাকে। সে ছালাত আদায় করতে শুরু করে, দাড়ি রাখে, টাখনুর উপর প্যান্ট পরে, নিজের চোখকে হেফাযতে রাখার চেষ্টা করে। এককথায় সে সব হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু সে যুবকের মনে হতে থাকে তার জীবনে সমস্যা তৈরি হতে শুরু করেছে। আর এটার বড় কারণ হলো— সে একসময় যেগুলোকে নিজের জীবনের আলো ভাবত, সেগুলোকে সে এখন ফিতনা বা হারাম বলে চিনে। সে দেখতে পায় তার আশেপাশের মানুষ হারামগুলোকে ফিতনা ভাবছে না। এমনকি তার পরিবারও হয়তো অন্ধকার জীবনকে ফিতনা মনে করে না। কিন্তু ঐ যুবক নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করতে চায়। সেই সময় দাড়ি রাখার কারণে হয়তো শুনতে হয় জঙ্গি। ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে অনেকেই বলে, হয়তো হুজুর হয়ে গেছে। অনেকেই বলে, হয়তো নতুন ভাব ধরেছে। হয়তো তার পরিবারও বিরুদ্ধে যেতে পারে। এভাবে ইসলামের প্রতিটা ধাপ পার করার সময় তাকে অনেক নতুন সমস্যায় পড়তে হয়। এই বার যুবক ভাবতে থাকে, আমার রাষ্ট্র যদি পুরোপুরি ইসলামের রাষ্ট্র হতো তাহলে আমার পথ চলা অনেক সহজ হতো। আমার আশেপাশের মানুষগুলো যদি আমার মতো হতো তাহলেই ভালো হতো। এবার দ্বীনে ফেরার পরে একদল যুবকের দুইটা পথ তৈরি হয়। একদল যুবকের কিছু যুবক ঠিক করে, দ্বীনে চলার পথে যতই বাধা আসুক, যতই ফিতনা আসুক— আমার জীবন থাকা পর্যন্ত দ্বীনের উপর টিকে থাকব ইনশা-আল্লাহ। কিন্তু বাকী যুবকরা চারিদিকের ফিতনা দেখে ভাবতে শুরু করে— কখন কিয়ামত হবে, কখন তার মৃত্যু হবে। এখন সে মৃত্যুকে ভয় পায় না, কারণ তার ঈমান তাকে ভয় পেতে দেয় না। তাই চারিদিকের ফিতনা দেখে সে ভাবতে শুরু করে, কিয়ামত যদি খুব তাড়াতাড়ি হয় তাহলে আমি ঈমান নিয়ে মরতে পারব। কিন্তু কিয়ামতের খবর একমাত্র আল্লাহর কাছেই (আল-আ‘রাফ, ৭/১৮৭)। তাই যুবকেরও জানার পথ নাই কিয়ামত কবে হবে! তখন সে ভাবতে থাকে ফিতনা থেকে বাঁচার নতুন পথ। তখনই সে একদল আলেম ও মিডিয়ার সন্ধান পায়, যারা জিহাদের কথা বলে। আর সেই যুবকও ভাবতে থাকে, ঠিক! জিহাদ দিয়ে সব ফিতনা দূর করে দেওয়া যাবে। এমনকি জিহাদ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলেও অনেক বড় লাভ। তাই সে জিহাদের বাসনা নিজের মধ্যে লালন করে আর ভাবতে থাকে, জিহাদ হচ্ছে না কেন? সেই সময় সে দেখতে পায়, চারিদিকে মুসলিম মার খাচ্ছে অথচ কেউ জিহাদের ডাক দেয় না। এমনকি সে যেসব আলেমকে দেখতে পায়, যারা স্টেজে উঠে, মিডিয়ায় জিহাদের বয়ান করে ঈমানের তীব্রতা প্রকাশ করছে কিন্তু তারাও কোনো জিহাদ করছে না বা জিহাদের ডাক দিচ্ছে না। অন্যদিকে সে দেখতে পায়, একদল আলেম ইসলামের সব ধরনের আলোচনা করলেও জিহাদের ডাক দেয় না। এমনকি তারা সেই যুবকদের সাবধান করছে, তারা যেন জিহাদের নামে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা না করে। এই সময় সে যুবক তার জীবনে কয়েকটা নতুন শব্দ খুঁজে পাই। যেমন— দরবারী আলেম, ত্বাগূতের দালাল, পেট্রোডলার, শাসকের টাকা খায় ইত্যাদি। আর এসব শব্দ তাদের শিখিয়েছে সেই সব আলেম, যারা জিহাদের বক্তব্য করে, কিন্তু নিজেরাও কোনোদিন জিহাদ করেনি। আর দ্বীনে ফেরা সেই যুবকগুলো এসব আলেমের বক্তব্য ঠিক মনে করে, এক শ্রেণির আলেমকে দরবারী আলেম, ত্বাগূতের দালাল ইত্যাদি বলতে থাকে কিন্তু সেই যুবক দ্বীনে ফেরার পর থেকে আজ পর্যন্ত জিহাদের কোনো ডাক পেলো না। তখনই সে আবার ফিতনায় পড়ে যায়। কারণ সে ভেবেছিল, জিহাদ দিয়েই হয়তো এসব ফিতনা দূর করা যাবে। কিন্তু জিহাদের কোনো ডাক তার জীবনে না আসায় শয়তান তার জীবনে অতীতের মতো ফিতনার বীজগুলো রোপণ করতে থাকে। ‘নিশ্চয় শয়তান মানুষের স্পষ্ট শত্রু’ (বানী ইসরাঈল, ১৭/৫৩)। সেই যুবক দ্বীনকে নিজের জীবনে সাময়িক ভেবে নিয়েছিল। সেই যুবক দ্বীনে ফেরার পরে তার যে ঈমানের তীব্রতা ছিল, হারাম-হালালের বিবেচনার যে ক্ষমতা ছিল, তা শয়তান আবার কেঁড়ে নিচ্ছে। দ্বীনে ফেরার পরে সে অনলাইন-অফলাইন দুই জীবনেই যেনার ফিতনা, গান-বাজনার ফিতনা, সব ধরনের হারাম থেকে বেঁচে থাকত। দ্বীনে ফেরার পূর্বে সে তার অনলাইন টাইমলাইনে হালাল-হারাম বিবেচনা না করে, বিভিন্ন ধরনের নারীর ছবি, গান-বাজনা শেয়ার করত। কিন্তু দ্বীনে ফেরার পর সে সমস্ত কিছু মুছে দেয়। আর সেই যুবক ফিতনাগুলো দ্রুত নিজের জীবন থেকে দূর করতে চেয়েছিল জিহাদ দিয়ে। জিহাদের ডাক না আসায়, দেখা যায়— সে আবার ভুলতে শুরু করেছে হারাম-হালালের বিবেচনা। সে এখন অনলাইন টাইমলাইনে নারীর ছবি, গান-বাজনা শেয়ার করে দিলেও আগের মতো ভাবে না। সে এক শ্রেণির আলেমকে দরবারী আলেম বলাকে জিহাদ বানিয়ে নিয়েছে। তবে এই দল যুবকের সবাই এখনো হারাম-হালালের বিবেচনা ছেড়ে দেয়নি, কিন্তু তার মাথায় রয়েছে জিহাদের ডাক আসে না কেন? সে তার ঈমানকে জিহাদের সময়কাল পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে নিয়েছে। কিন্তু তাকে ভাবতে হতো যদি ৫০ বছর পরও জিহাদ হয়, আর আমি যদি তার একদিন আগেও মারা যায় তবুও ঈমান নিয়েই টিকে থাকব ইনশা-আল্লাহ। যদি কিয়ামত চলে আসে, সব কিছু ধ্বংস হতে শুরু করে তবুও ঈমান নিয়ে টিকে থাকব, হালাল-হারাম বিবেচনা করেই চলব ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কিয়ামত ক্বায়েম হয়ে গেলেও তোমাদের কারও হাতে যদি কোনো গাছের চারা থাকে এবং সে তা এর আগেই রোপণ করতে সক্ষম হয়, তবে যেন তা রোপন করে ফেলে’।[1] তাই জিহাদ হোক আর না হোক আমাকে আল্লাহর কাছেই যেতে হবে। সুতরাং আমার জীবনের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত ঈমান নিয়েই টিকে থাকব ইনশা-আল্লাহ। এর মানে এই না যে, আমি জিহাদের বাসনা অন্তরে রাখব না; অবশ্যই আমার অন্তরে থাকবে জিহাদের বাসনা। কারণ নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মারা গেল যে, সে জিহাদ করেনি এবং মনে জিহাদের আকাঙ্ক্ষাও রাখেনি, তবে সে মুনাফিক্বী অবস্থায় মারা গেল’।[2] এই একদল যুবক বা একজন যুবকের সাময়িক ঈমান নয়; পুরো জীবনের ঈমান টিকিয়ে রাখার জন্যই আমাদের একটা হাদীছ মনে রাখতে হবে। ফাযালা ইবনু উবাইদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে লোক নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে, সে-ই আসল মুজাহিদ।[3] আমি আপনি যদি এই হাদীছের বাস্তব উদাহরণ দেখতে চাই, তাহলে আপনার-আমার আশেপাশের একজন ভাই, যে নিয়মিত ছালাত আদায় করে না, দাড়ি রাখে না, টাখনুর উপর প্যান্ট পরে না, হারাম থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে না— তাকে বলুন, এখন যদি কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ হয়, আপনি কি জিহাদে যেতে চান? তার উত্তর হবে—অবশ্যই যাব! যদি এমন উত্তর না হয়, তাহলে বুঝে নিতে হবে সে ব্যতিক্রম। কিন্তু সে জিহাদের যাওয়ার কথা বললে, আপনি তাকে বলেন— ভাই, আপনি ছালাত কেন আদায় করেন না, দাড়ি কেন রাখেন না, টাখনুর উপর প্যান্ট পরেন না কেন? তারপর আপনি বুঝতে পারবেন— কেন সেই আসল মুজাহিদ, যে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে! ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ স্যারের একটি লিখিত অংশ নিম্নে পেশ করা হলো, যা একদল যুবকের অধিকাংশের সাথে মিলে যাবে ইনশা-আল্লাহ।
“বেকারত্ব, বঞ্চনা ও হতাশার পাশাপাশি জ্ঞানহীন আবেগ চরমপন্থা ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্ম দেয়। আমাদের সমাজে যারা সর্বহারার রাজত্বের জন্য বা ইসলামী রাজত্বের জন্য সহিংসতায় লিপ্ত তাদের প্রায় সকলের জীবনেই আপনি এ বিষয়টি দেখতে পাবেন। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা শিক্ষিত বেকার যুবককে কেউ বুঝিয়েছে, এরূপ সহিংসতার মাধ্যমে অতি তাড়াতাড়িই তোমার ও অন্যদের কষ্ট ও বঞ্চনার সমাপ্তি ঘটবে এবং সর্বহারার রাজত্ব বা ইসলামী রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। তুমি ক্ষমতা ও কর্ম অথবা জান্নাত লাভ করবে। বঞ্চিত, বেকার ও হতাশ এ যুবক সহজেই এ কথা বিশ্বাস করে এ সকল কর্মে লিপ্ত হয়। কারণ তার অন্য কোনো কর্ম নেই এবং তার পাওয়ার আশার বিপরীতে হারানোর তেমন কিছই নেই।”[4]
মো. হামিদুর রহমান (তামিম)
শিক্ষার্থী, রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, রাজশাহী।
[1]. আহমাদ, হা/১২৯৮১।
[2]. আবূ দাঊদ, হা/২৫০২।
[3]. তিরমিযী, হা/১৬২১।
[4]. ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ।