কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইশ! যদি করতাম!

post title will place here

‘বাবা, ও বাবা’ বলে ডাকতে ডাকতে পাশের রুম থেকে আসলো যাকিয়া। সারাদিন ব্যস্ততার অবসরে তখন বিছানায় শুয়ে স্ত্রীর সাথে গল্প করছিল আরিফ। ‘জানো বাবা, রাঈসারা আজ বিমানে করে কক্সবাজার যাচ্ছে। ওরা সমুদ্রসৈকতে গোসল করবে, সাঁতার কাটবে আরও কত্ত মজা করবে। আমারও বিমানে চড়তে ইচ্ছে করছে। আমাকেও নিয়ে চলো না, বাবা’। আবদারের সুরে বললো যাকিয়া। মেয়ের কথার প্রত্যুত্তরে আরিফ বললো, ‘আচ্ছা মা, পরের সপ্তাহে না হয় আমরাও কক্সবাজারে ঘুরতে যাবো। রাতে সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে প্রাণভরে ঢেউয়ের শোঁ শোঁ শব্দ শুনবো। সমুদ্রের নিরন্তন বয়ে চলা, ঊর্মির উথালপাতাল গর্জন, দিগন্তবিস্তৃত তার জলরাশি আমাদের মুগ্ধ করে তুলবে’। বাবার কথাগুলো শোনামাত্রই আহ্লাদে নেচে উঠলো যাকিয়া।

রাজশাহী কাটাখালীর এক সরকারি অফিসে কাজ করেন আরিফ। অফিসের অদূরেই দু’কামরার এক ছোট্ট বাড়িতে থাকেন তিনি। সাথে তার স্ত্রী এবং ১০ বছরের তনয়া যাকিয়াও থাকে। যাকিয়া পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। আরিফ খুবই এক্টিভ। নিয়মিত অফিসে যান তিনি। তার প্রাত্যহিক এ্যাসাইনমেন্ট রোজ কমপ্লিট করেন। তজ্জন্যই অফিসার মিজানুর রহমানের সবচেয়ে প্রিয় মুখাবয়ব আরিফ। তার সাথে মিত্রসুলভ আচরণ করেন মিজান স্যার।

মসজিদের মিনার ভেদ করে আযানের ধ্বনি এসে শ্রবণেন্দ্রিয় স্পর্শ করলো। রাত গড়িয়ে নূতন ভোরের উদয় হলো। ঘুম ভাঙলো আরিফের। ওযূ করে ফজরের ছালাত পড়ে নিত্যদিনের ন্যায় আজও কুরআন হাতে নিলেন। তার চোখে-মুখে এখনো ঘুমের ছাপ পরিস্ফুট। আজ তো রবিবার। শনি আর রবিবারে তাদের অফিসের দুয়ার বন্ধ থাকে। তবে আরিফ আর তার দু’জন কলিগ আছেন, শুধু তাদের কোনো একজনকে সেদিনগুলোতেও ডিউটি করতে হয়। আর আজ আরিফের ডিউটি। আরিফ ভাবলেন, ‘প্রত্যহই তো অফিসে যাই। আজ না হয় নাই-ই গেলাম। আজ তো আবার কেউ আসবেও না’। ফলে তিনি আবারো ঘুমের আয়োজন করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তন্দ্রা এসে তার আঁখিদ্বয় ছুয়ে দিলো।

আজ সোমবার। কাল তারা কক্সবাজারে যাবে। তাই আজ অফিসের চৌকাঠে ছুটির দরখাস্ত নিয়ে পা দিলে তাকে একটি কাগজ এবং কিছু কথার ফুলঝুরি নিক্ষেপ করেন মিজান স্যার। সেই কাগজ খুলে তিনি তার চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। এতে যে তার বহুদিনের মেহনত ভূলুণ্ঠিত করার উপাদান রয়েছে। হৃদয়কোণে পুঞ্জীভূত স্বপ্নগুলো মুছে দেওয়ার এক মারাত্মক উপকরণ। ‘আসলে আরিফ ভাই, গতকাল কাউকে না জানিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল অফিস থেকে স্যার এসেছিলেন। অফিস তালাবদ্ধ দেখে তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। আধ ঘণ্টা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর মিজান স্যারকে ফোন দিয়ে অপ্রসন্ন গলায় দু-চার কথা শুনিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে গিয়েছেন। আর তিনিই আপনাকে অফিস থেকে কর্মচ্যুত করেছেন’। পার্শ্ব থেকে একজন বাক্যগুলো পাঠ করল। কথাগুলো শোনামাত্রই আরিফের শিরে যেন আকাশ হুড়মুড় খেয়ে পড়লো। আজ যে তাকে দৈন্যের দায়ে পথে বসতে হবে। দুনিয়াটা আজ বিস্বাদ লাগছে। মনের উঠোনে দুঃখের ঝটিকা যেন দ্রুতগামী ঘোড়ার ন্যায় ধেয়ে আসছে। পুলকেরা নিবিড় তিমিরে হারিয়ে যাচ্ছে। মনোরথগুলো অতল সিন্ধুর হিল্লোলে উথালপাতাল করছে।

ঘড়ির কাটা তখন ৬টা ছুঁইছুঁই। নীলিমায় মেঘেরা মেলা বসিয়েছে। পাখিরা খেলা করছে। মনের মধ্যে পুঞ্জীভূত স্বপ্নগুলো যেন নদীর স্রোতের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রক্তিম গোধূলিলগ্নে পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে একরাশ দুঃখ নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে নদীর পানে চেয়ে আছেন আরিফ। হয়তো তিনি তার আদরের রাজকন্যা যাকিয়ার বিমানে করে কক্সবাজার যাওয়ার ছোট্ট অভিপ্রায়টুকু পূরণ করতে পারবেন না। তাকে প্রাণভরে সমুদ্রের সেই মনোহর দৃশ্য দেখাতে তিনি ভীষণভাবে অক্ষম।

প্রিয় পাঠক! বিপদ অজ্ঞেয় এক বিস্ফোরণের নাম। যা আমাদের ঠুনকো এ জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে আছে। আমরা মাঝে মাঝে ভেবে বসি, ‘প্রতিদিনই তো পড়া করে যাই। আজ না হয় থাক। শনিবার থেকে ভালোভাবে পড়া শুরু করব’। আবার কখনো ভাবি, ‘আজ বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দেই। কাল ফজর থেকেই না হয় ছালাত শুরু করব’। কিন্তু ফজর উদয় হওয়ার আগেই যদি চলে আসে মৃত্যু-চিঠি। তাহলে কেমন হবে? যখন পড়া না করে যাওয়ার দিনই শিক্ষক পড়া জিজ্ঞেস করেন, তখন মনে হয়, ইশ! যদি পড়তাম! আজ যদি আরিফ ভেবে কাজ করতেন, যদি তিনি অফিসে যেতেন, তাহলে কি তাকে এ দিনটির মুখোমুখি হতে হতো, বলুন? অতএব, সাবধান!

সাব্বির আহমাদ

 অধ্যয়নরত, মাদরাসাতুল হাদীস, নাজির বাজার, বংশাল, ঢাকা।

Magazine