কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মধুময় মাস রামাযান

১.

বাবা লাবিব! এইদিকে আসো বাবা! দেখো তোমার আম্মু কত ইফতারী রান্না করেছেন। রামাযান মাস মানে অন্যরকম শান্তি শান্তি ভাব। বাতাসে যেন খুশি ভেসে বেড়ায়। ছোট ছোট বাচ্চাদের মাঝে চলে কে কয়টা ছিয়াম রেখেছে তার পাল্লা। ইট-পাথরের যান্ত্রিক নগরীর নাগরিকরা ছোটে যেন সব ব্যস্ততা শেষে পরিবারের সাথে ইফতার করতে পারে সে আশায়। উমার সাহেবের বেলায়ও তাই। তিনি পরিবারের সঙ্গে ইফতার করার জন্য দ্রুত বাসায় ফিরেছেন। এসে দেখেন লাবিব মন খারাপ করে বসে আছে। —লাবিব! আসো আমরা সবাই একসাথে ইফতার করব। লাবিব অভিমান করেছে বাবা-মার ওপর কেন তাকে সাহরীতে ডাকা হয়নি। মন খারাপ নিয়ে ঘরে একা একা বসে আছে। বাইরে লাবিবের বাবা উমার এবং এক ভাই ইফতার সাজাচ্ছে। লাবিবের আম্মু রান্নাঘরে আর বেশ কয়েক আইটেম বানানো নিয়ে ছোটখাটো যুদ্ধ চালাচ্ছেন। উমার সাহেব ইফতার প্রস্তুত করে লাবিবের নিকটে গেলেন। তার আর্দ্র হস্ত লাবিবের মাথার উপর রেখে বললেন, বাবা তুমি রাগ করছ কেন? আজ ছিয়াম রাখতে পারোনি তো কি হয়েছে? ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাখবে। ছিয়াম তো আর একদিনই ফুরিয়ে যায়নি। কেবল তো মাত্র শুরু হয়েছে রামাযান মাস। ক্ষণকাল পর লাবিবের নিষ্পাপ ঠোঁট দিয়ে অঙ্কুরিত হলো সুমিষ্ট কথামালা। লাবিব তার বাবাকে বলল, বাবা আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করি, উত্তর দিবে? উমার সাহেব বললেন, আমার কলিজার টুকরো একটা কেন, হাজারটা প্রশ্ন করলেও আমি সবগুলোর উত্তর দিব ইনশাল্লাহ। লাবিব বলল, বাবা তোমাকে যদি তোমার অফিসের বস বলে যে, উমার সাহেব তুমি যদি এই কাজটি কর, তাহলে আমি নিজেই এর প্রতিদান তোমাকে দেব! কারো হাত দিয়ে নয়; আমার হাত দিয়ে দেব! তাহলে কি তুমি সেই কাজ করা থেকে বিরত থাকবে? আর যদি সে কাজটি তুমি না করতে পার, তাহলে কি তোমার মন খারাপ হবে না? উমার সাহেব কোনো সংশয় ছাড়াই মৃদু কণ্ঠে উত্তর দিলেন— হ্যাঁ, অবশ্যই করব ইনশাআল্লাহ। আর হ্যাঁ, ওই কাজটা না করতে পারলেও তো আমার মন খারাপ হবে। লাবিব তন্ময় কণ্ঠে বলতে লাগল, বাবা আমরা ছিয়াম কেন রাখি? উমার সাহেব বললেন, আল্লাহ রাখতে বলেছেন তাই। লাবিব বলল, আর এর প্রতিদান কে দেবে? উমার বললেন, বললেন, আল্লাহ নিজ হাতে দেবেন এর প্রতিদান। লাবিব বলল, বাবা তাহলে কি আমি চাইব আল্লাহর কথা না মানি এবং আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার না পাই? —কখনোই আমি তা চাইব না। উমার সাহেব ছেলের কথার কাছে পরাস্ত হলেন। কিন্তু তিনি কোনো রকম গোসসা হলেন না ছেলের উপর। বরং মনে মনে তিনি অনেক খুশি হলেন। কোন্‌ পিতা-মাতাই-বা না চান, ছেলে-মেয়ের কাছে বুদ্ধিতে পরাস্ত হতে! উমার সাহেব বুঝতে পারলেন তার ছেলে তাকে কী বোঝাতে চাচ্ছে। উমার সাহেব বললেন, ঠিক আছে এরকম ভুল আমাদের আর যেন না হয়, আল্লাহ সহজ করুন। এবার চলো, আমরা একটি হাদীছের প্রতি আমল করি। লাবিব বলল, কোন্‌ হাদীছের প্রতি বাবা? উমার সাহেব বললেন, কেন তুমি এই হাদীছ শোনোনি যে, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো ছওম পালনকারী ব্যক্তিকে ইফতার করায়, তাহলে তার জন্য সেই পরিমাণ নেকী রয়েছে, যেই পরিমাণ নেকী ওই ব্যক্তির ছিয়াম রেখে হয়েছে? কিন্তু এতে ওই ছওম পালনকারী ব্যক্তির নেকীর কোনো কমতি হবে না। লাবিবের মনটা আনন্দে নেচে উঠল। হ্যাঁ, বাবা তো ঠিক বলেছেন। লাবিব বলল, হ্যাঁ, মনে পড়েছে বাবা চলো দ্রুত যাই। তারা দ্রুতপদে অগ্রসর হলো ইফতারীর দিকে। এদিকে শারমিন বেগম সবেমাত্র ইফতারীর সব আইটেম রান্না শেষ করেছেন। লাবিব, তার বাবা ও ভাই মিলে ইফতারীগুলো প্যাকিং করে ঝুলিতে উঠালো। খাবারের ঝুলি মানুষের নিকটে বিলি করে তারা পুণ্যের ঝুলি ভারী করতে চায়।

২.

তাদের ইফতারের আয়োজন অল্প পরিমাণ হতে পারে। কিন্তু আল্লাহর নেকী তো আর অল্প নয়। উমার সাহেব তাদের সন্তানদের বললেন, আমরা এ কাজ কেন করছি? কেউ কি বলতে পারবে? লাবিবের ছোট ভাই মুছ‘আব বলল, বাবা এগুলো আমরা শুধু আমাদের রবের সন্তুষ্টির জন্য করছি। কেননা আমি জানি আমরা যদি আমাদের রবকে সন্তুষ্টির জন্য কিছু করি, তাহলে তিনি এর প্রতিদান আমাদের দেবেন। ইহকালে হতে পারে, আবার পরকালে হতে পারে।

পাশ থেকে শারমিন বেগম বলে উঠলেন, আজকে তো প্রথম ‘রোজা’ আমরা চেষ্টা করব প্রতিদিন রোজাদারদের ইফতারী করানোর। শারমিন বেগমের কথা শেষ হতে না হতে লাবিব বলল, আম্মু আমরা ‘রোজা’ শব্দটা ব্যবহার না করে ‘ছিয়াম’ বা ‘ছওম’ শব্দটা ব্যবহার করব, তাহলে খুব ভালো হবে। কেননা ছিয়াম শব্দটি আল্লাহ সুবাহানাহু তাআলা তাঁর মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ব্যবহার করেছেন; রাসূলুল্লাহ a হাদীছেও ব্যবহার করেছেন। ছেলের কথা শুনে শারমিন বেগম ভীষণ খুশি হলেন। শারমিন বেগম কিছু বলে ওঠার আগেই লাবিব বলল, আম্মু একটু লক্ষ করুন, ছিয়াম এবং রোজা শব্দের অর্থের দিকে। ছিয়াম শব্দের অর্থ হলো বিরত থাকা। আর রোজা শব্দের অর্থ হলো উপবাস থাকা। দুইটার অর্থ কিন্তু দুই রকম। তাই আমাদের ছিয়াম শব্দটা ব্যবহার করা সমীচীন হবে। কেননা ছিয়াম শব্দটা একজন মুসলিমের সাথে সবচেয়ে বেশি মানানসই। তাই আমাদের উচিত হবে রোজা শব্দটা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা। মানুষ যেন রোজা শব্দটা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে সেজন্য আমাদের প্রয়াস চালাতে হবে। শারমিন বেগম খুশি হয়ে মনে মনে বললেন, তুমি ঠিক বলেছ বাবা!

উমার সাহেব বললেন, চলো! আমরা এবার ইফতারী নিয়ে বেরিয়ে পড়ি হক্বদারের হক্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। শেষ বিকেলের গোধূলিলগ্নে তামাটে বর্ণের ডিমের ন্যায় সূর্যটা যখন তরুবৃক্ষের ডগায় থেকে যখন জানিয়ে দিচ্ছে তার অস্তিত্ব বিলিনের কথা যে, আর বেশি সময় নেই, ক্ষণকাল পরেই আমি আজকের মতো তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেব। ঠিক সে সময় উমার সাহেব তাদের বাচ্চাদের নিয়ে নেমে পড়লেন ব্যস্ত এই শহরে কোনো রাস্তায়। ক্ষণকালের জন্য কারো মুখে হাসি ফুটিয়ে পরকালে অনন্তকালের জন্য নিজেদের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখার চেষ্টাই। পথিমধ্যে তারা পথশিশু থেকে শুরু করে রিকশাচালক, বৃদ্ধ, অসহায়সহ যাদেরকে ছিয়ামরত অবস্থায় পেলেন তাদের প্রত্যেকের একটি করে প্যাকেট এবং একটি করে পানির বোতল ধরিয়ে দিলেন।

৩.

বাড়ির মানুষদের সাথে ইফতার করার জন্য বাড়ি ফেরার তাড়া, ঠিক তখন উমার সাহেব ও তার ছোট ছোট কচিকাঁচা বাচ্চাদের হাত থেকে ইফতার পেয়ে তাদের অপ্রসন্ন বদনে আনন্দের যে ঢেউ বয়ে গেছে তা হয়তো বিল গেটসের সব টাকা দিয়েও ক্রয় করা যাবে না। অথচ সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে উমার সাহেব মানুষকে কত খুশি করতে পেরেছেন, যা ভোলার নয়। যারা ইফতার পেয়েছেন তারা প্রত্যেকে খুশি হয়ে উমার সাহেব ও তার ছোট ছোট কচিকাঁচা বাচ্চাদের জন্য দু‘আ করেছেন। আল্লাহ তাআলা কি তাদের দু‘আ কবুল করবেন না? ইনশাআল্লাহ আল্লাহ কবুল করবেন। কেননা রাসূল a এক হাদীছে বলেছেন, এক মুসলিম যদি অপর মুসলিমের জন্য তার অনুপস্থিতিতে দু‘আ করে, তবে ওই দু‘আ কবুল করে নেওয়া হয়। আল-হামদুলিল্লাহ। আরেকটি মজার জিনিস হচ্ছে- রাসূল a বলেছেন, রামাযান মাসের আগমনে আসমানের সমস্ত দরজা খুলে দেওয়া হয়। জান্নাতের সমস্ত দরজা খুলে দেওয়া হয়। রহমতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। যেহেতু সমস্ত দরজা খুলে দেওয়া হয়, সেহেতু এ সময় দু‘আ কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

রাস্তায় ইফতারী দেওয়া শেষে উমার সাহেব একটি বস্তিতে গেলেন। সেখানে মানুষদেরকে মাদুরে বসিয়ে তারাও একটি মাদুরে বসল। প্রত্যেকের সামনে ইফতারী। সকলে ইফতারী নিয়ে বসে আছে রব্বে কারীমকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াসে। প্রত্যেকে ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হওয়ার পরও কেউ কিছু মুখে নিচ্ছে না। সবাই মুআযযিনের কোকিলকণ্ঠে সুমিষ্ট ধ্বনি ‘আল্লাহু আকবার’ শোনার অপেক্ষায় আছে। কেননা এরা সবাই যে মুসলিম অর্থাৎ আত্মসমর্পণকারী। আল্লাহর নিকটে প্রত্যেকে আত্মসমর্পণ করেছে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হতেই দূর থেকে ভেসে আসছে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি। সবাই রাসূল a-এর সুন্নাহ অনুযায়ী ‘বিসমিল্লাহ’ বলে একটি করে খেজুর নিজ নিজ মুখে পুরে দিল। সবাই ইফতারী করছে কোনো রকমের বিশৃঙ্খলা নেই। হইহুল্লোড় নেই। কতই না সুন্দর ইসলামী নীতি। সবার খাওয়া যখন শেষ, তখন উমার সাহেব সবাইকে ইফতার শেষের দু‘আ পড়তে বললেন।

সবকিছু শেষে তারা মাগরিবের ছালাতের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন জামাআতে। ছালাত শেষে উমার সাহেব তার সন্তানদের আনন্দচিত্তে বাড়ি নিয়ে চলে আসলেন। বাড়ি এসে লাবিব তার বাবাকে বলল, বাবা একটি কাজ করলে কেমন হয়? উমার সাহেব বললেন, কী কাজ? লাবিব বলল, বাবা রামাযান মাস কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এবং ফযীলতপূর্ণ মাস তুমি কি জানো? উমার সাহেব বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই জানি। কারণ এই মাসে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ করেছেন, যাতে বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াতের দিক-নির্দেশনা রয়েছে। লাবিব বলল, বাবা তুমি ঠিক বলেছ। আর এই মাসে এক হরফ পড়লে ১০ থেকে ৭০০ গুণ নেকী বৃদ্ধি পায়। উমার সাহেব বললেন, তুমি ঠিক বলেছ। তো আমরা এখন কি করতে পারি? লাবিব বলল, বাবা তুমি যদি কিছু কুরআন মাজীদ কিনে যারা গরীব কিন্তু কুরআন মাজীদ পড়তে পারে তাদের হাদিয়া দিতে তাহলে তুমি অনেক নেকীর কাজ করতে। উমার সাহেব তার ছেলের কথায় সহমত পোষণ করলেন এবং বললেন, শুধু অপরকে কুরআন মাজীদ হাদিয়া দিয়ে পড়তে বললেই হবে না; আমাদেরও কুরআন মাজীদ বেশি বেশি পড়তে হবে। এখন চলো, আমরা কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করে আযান হলে মসজিদে এশার ছালাত আদায় করেতে যাব। অতঃপর এশার ছালাত ও তারাবীর ছালাত জামাআতে আদায় করে লাইব্রেরিতে যাব। তারপর কিছু কুরআন মাজীদ ক্রয় করে অসহায় মানুষদের মাঝে বিলি করব ইনশাআল্লাহ। একথা শুনে লাবিব আনন্দের সাথে বাবার সাথে গেল।

ফজলে রাব্বি বিন শফিকুল

অধ্যয়নরত, মাদরাসাতুল হাদীস, নাজির বাজার, বংশাল, ঢাকা।

Magazine