সকাল থেকেই আকাশটা মেঘের আবরণে ছেয়ে আছে। বেলা একটু গড়াতেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বৃষ্টি দেখে সুমা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তার মা বাড়িতে নেই। সালমা দাদীর বাড়িতে কাজে গিয়েছে। সকালে কাজে যাওয়ার আগে মা তাকে ডেকে বলেছিল, ‘সুমা বেটী! আমার আজ কাজে যেতে মন চাইছে না রে। গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা আর জ্বর জ্বর করছে। তোর সালমা দাদীর বাড়িতে মেহমান এসেছে, তাই যেতে হচ্ছে। নচেৎ বারান্দায় খেজুরপাতার পাটি বিছিয়ে তোর হাতের চালভাজা খেয়ে শুয়ে থাকতাম’। সময় যত গড়াচ্ছে বৃষ্টি ততই ঝমঝমিয়ে পড়ছে। সুমার মনও ততই আতঙ্ক আর ভীতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদিকে সুমার ছোট বোন রুমাও বাড়িতে নেই। চিৎকার করে ডেকেও তার কোনো সাড়া মিলছে না। বারান্দা, ঘর সব ভিজে যাচ্ছে। ছেঁড়া তালপাতার ছাউনি বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা টপটপ করে মেঝেতে পড়ছে। বাড়িতে দু-একটা থালা বাটি যা ছিল, সুমা তা মেঝেতে রেখে দিল, যাতে রাতে ঘুমানোর জন্য একটু শুকনো জায়গা বেঁচে থাকে। একাই মন খারাপ আর চুপচাপ বসে থেকে পুরনো দিনের কিছু কথা সুমার মনে ভেসে আসতে লাগল। তার আব্বু মৃত্যুর সময় বলেছিল, আমার মৃত্যুতে তোমরা ব্যথিত আর বিচলিত হয়ো না। ধৈর্য ধরে থেকো। তোমাদের মা তোমাদেরকে ছাতার মতো আগলে রাখবে। যতদিন তোমাদের মায়ের শরীরে রক্ত প্রবাহ হবে, ততদিন তোমাদের তিন বেলা না হলেও দুই বেলা খেটে না হলেও দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে খাবার ব্যবস্থা করবে। এই কথা ভাবতে ভাবতেই সুমার মন নরম হয়ে গেল। চোখ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করল বৃষ্টির ফোঁটার মতো। আচমকা কাঁপতে কাঁপতে মা বাড়িতে এসে হাযির হলো। সুমা তড়িঘড়ি তার মায়ের হাত দুটো ধরে বারান্দায় তুলে নিল। তারপর আধ ময়লা ছেঁড়া গামছা দিয়ে মাথাটা মুছে দিল। ভেজা কাপড়টা খুলে মা নিজেই একটা শুকনো কাপড় পরিধান করল। এখন গায়ের কাঁপুনি একটু কমলেও জ্বরে কিন্তু শরীর উত্তপ্ত। ভাতের হাড়ির তলদেশে যে কয়টা ভাতের দানা পড়েছিল, সুমা সেগুলো থালায় নিয়ে খেতে দিল। এদিকে ততক্ষণে রুমা খোশ মেজাজে বাড়িতে এসে হাযির। সুমা ও তার মা রুমার উপর প্রচণ্ড রেগে ছিল। কারণ সকাল থেকে সে বাড়িতে নেই। খাওয়া-দাওয়ার কোনো খবর নেই। সারাদিন টোটো করে ঘুরে বেড়িয়েছে। সুমা তাকে বকা দিলে সে কান্না শুরু করে দেয়। কান্নার স্বর একটু কমিয়ে সে বলে, ‘আমার খিদে নেই। আমি রাস্তার ধারের বাগানের আম কুড়িয়ে খেয়েছি। বৃষ্টি একটু জোরে শুরু হলে রফিক কাকুর বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিলাম’। ভেজা গলায় সে মাকে বলে, ‘মা জানো, রফিক কাকুর বাড়ি কত্ত বড়! মেঝেতে কাচ বসিয়েছে। চিকচিক করছে। মুখ দেখা যায়’। মা তার কথা শুনে হাজার কষ্টের পরেও মুচকি হেসে বলল, ‘নারে বেটী! ওগুলো কাচ নয়, দামি টাইলস’। রুমা শুধুই শুনল, কিন্তু আসলে জানে না সে, টাইলস কী জিনিস! রুমা, সুমার একটু কাছ ঘেঁষে বলে, ‘জানিস বোন, তোর জামাতে যেমন গাছের পাতা ফুল ছাপা আছে, কাকুর বাড়ির দেওয়ালেও তাই আছে। মনে হয় কাকু বাড়ির দেওয়ালে জামা পরিয়ে রেখেছে’। সুমা তার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলে, ‘আরে পাগলি বোন, ওটাতো দেওয়ালের প্রিন্টিং। আজকের সময়ে দেওয়ালেও ছাপা রং করা হয়’। একটু লজ্জাবোধ হলো রুমার। মা’র বুকের পাশে গিয়ে সে জানতে চায়, ‘মা, ওমা! কাকুদের এত সুন্দর বাড়ি, আমাদের কেনো ছেঁড়া তালপাতার ছাউনি’। কথাগুলো শুনে মা’র বুকে দুঃখ হলো এবং বলল, ‘দুনিয়ায় আল্লাহ সবাইকে একই রকমভাবে পাঠান না। কাউকে আল্লাহ ধনসম্পত্তি দিয়ে পরীক্ষা করেন আর কাউকে না দিয়ে পরীক্ষা করেন। রুমাকে বোঝাতে চাইলে ব্যাপারটা সে বুঝেছে। একটা কথা বলাই ভালো, সুমার বয়স এখন ১৩-১৪। রুমার বয়স ৬-৭। বেলা যত গড়াচ্ছে মায়ের শরীরের অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে। জ্বর এত বেশি যে বেহুঁশ হওয়ার উপক্রম। সুমা বিচলিত হয়ে পড়েছে মাকে নিয়ে সে কী করবে, ভেবে কুল পাচ্ছে না। মায়ের চিকিৎসার জন্য ঘরে এক টাকাও নেই। তাই সে ঠিক করল গ্রামের অর্থশালী বিত্তবান কিছু মানুষের কাছে গিয়ে যাকাতের টাকা চাইবে। সেই টাকা দিয়ে চিকিৎসা করে মাকে সারিয়ে তুলবে। সেই ভেবে সে গ্রামের অর্থশালী হারুন কাকুর বাড়ি গিয়ে উঠল। হারুন কাকুর কাছে গিয়ে সে তার সমস্যার কথা জানিয়ে যাকাতের টাকা চাইল। হারুন কাকু একটু বিস্মিত হয়ে বলে, ‘যাও যাও ওসব হবে না, যাও’। সুমা একটু শোকাহত হয়ে হারুন কাকুকে বলে, ‘আপনার গচ্ছিত সম্পদের ১০০ টাকার যে আড়াই টাকা যাকাত হিসেবে দেওয়া লাগবে যেটা আমার মতো গরীব অসহায়রা পাওয়ার দাবি রাখে। আপনি কি সেটা জানেন না?’ হারুন কাকু চিৎকার করে বলে, ‘আমায় জ্ঞান দিচ্ছ, আমি তোমার থেকে শিখব নাকি? যাও আমার বাড়ি থেকে দূর হও’। সুমা শেষবারের মতো তাকে বলল, ‘যাকাতের হিসাব করে না হয় দেবেন না, কমপক্ষে কিছু টাকা দান তো করেন’। যেই মানুষটা ইসলাম ধর্মে যেটা বাধ্যতামূলক ছিল সেটাতেই কর্ণপাত করল না, ঐচ্ছিক ব্যাপারে কি তার মন বসে! সুমার দানের টাকা চাওয়াতেও কোনো লাভ হলো না। প্রায় প্রত্যেকটা অর্থশালী বাড়ি থেকে তাকে এভাবেই মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরতে হলো। মায়ের জন্য আল্লাহর কাছে আরোগ্য কামনা ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকল না। যেই মায়ের শরীর কিনা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল, এখন দেখে পুরো শরীর শীতল, নিথর। নিঃশ্বাস নেবার সময় পেটটা যে দোলা দিচ্ছিল এখন সেটাও বন্ধ। সুমার বুঝতে আর সমস্যা হলো না মা তাদের দুনিয়ায় অভিভাবকহীন রেখে পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন। চোখের সামনের দুনিয়া সুমার অন্ধকার হলো। অন্তরে তার হাহাকার শুরু হয়ে গেল। চোখের জলে তার চোয়াল ভিজে গেলো। রুমা তো এখনো ঠিকমতো জানে না মরে গেলে মানুষ আর ফিরে আসে না। কথা বলে না। মা মরে গেলেও যে আর কথা বলবে না, হাতের বাহুটাকে বালিশ করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে না, বাড়ি ফিরতে দেরি হলে আদর করে বকা দেবে না, কোলে বসিয়ে ভাত খাইয়ে দেবে না। তাইতো সে মায়ের শরীর নাড়িয়ে বলে, ‘মা, ও মা! মাগো কত ঘুমাচ্ছ, উঠবে কখন, অনেক বেলা হয়েছে, ভাত রাঁধবে না, খেতে দিবে না আমায়’। রুমার একথা সুমার মনে বেদনার চাকু দ্বারা খোঁচা দিচ্ছিল। সুমার কান্নায় পাড়ার সব লোক জড়ো হলো। ক্ষমতাবান বিত্তশালীরাও ছিল। ওদের মধ্যে কেউ বলাবলি করতে লাগল আমার টাকায় কবরের জন্য কয়টা বাঁশ কিনে নিয়ে আয় তো। কেউ বলে, আমার টাকায় কাফনের কাপড়। তাদের এই সাহায্যের কথা সুমা সহ্য করতে পারল না। কান্নাস্বরেই বলল, ‘যেই ধর্মের নিয়মে দাফন করতে কাফন আর বাঁশ সাহায্যের কথা বললেন, সেই ধর্মই তো আপনার অতিরিক্ত সম্পদের ১০০ টাকায় আড়াই টাকা গরীবদের দিতে বলেছে। দান করার কথা বলেছে। এই মেকি ভালোবাসা আর সাহায্যের কী মূল্য, যাতে জীবিতরা উপকৃত হয় না। এই সমপরিমাণ টাকা সাহায্য যদি কালকে দিতেন, তবে হয়তো এ প্রাণটা বেঁচে যেত। জানি এই বিশাল ভিড়ে লোক দেখানো সাহায্যের ঘোষণা মাত্র’। সুমার এই কথাগুলো সবাই নিস্তব্ধ হয়ে শুনেছিল। কেউ কিছু বলেনি।
যদি সবাই নির্দেশমতো যাকাত দিতো, তবে গরীবদের পরিসংখ্যান পাল্টে যেত। ক্ষুধার্তদের তালিকা কমে আসত। খাদ্যাভাবে মৃতের সংখ্যা কমে যেত। কত মাকে চিকিৎসার অভাবে প্রাণ দিতে হতো না!
মিফতাউল ইসলাম
মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।