মূসা আলাইহিস সালাম-এর জন্য হিজরত অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়াল। চলতে চলতে মূসা আলাইহিস সালাম মাদইয়ান নগরের দিকে চলে আসলেন।*
[এক]
এই ঘটনাটুকু পাওয়া যায় কুরআনের সূরা আল-ক্বছাছের ২০ নাম্বার আয়াতের পর থেকে। ঘটনার পরম্পরা সাজালে এমন দাঁড়ায়— হাঁটতে হাঁটতে মূসা আলাইহিস সালাম একটা কূপের কাছে এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন, কিছু লোক সেই কূপ থেকে তাদের বকরিগুলোকে পানি পান করাচ্ছে। তিনি আরও দেখলেন, অল্প দূরে দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সাথেও বকরি। সেই বকরিগুলোও তৃষ্ণার্ত। কিন্তু বকরিগুলোকে পানি পান করানোর জন্য তারা কূপের দিকে এগিয়ে আসছে না। কুরআনে ব্যাপারটা বর্ণিত হয়েছে এভাবে,وَلَمَّا وَرَدَ مَاءَ مَدْيَنَ وَجَدَ عَلَيْهِ أُمَّةً مِنَ النَّاسِ يَسْقُونَ وَوَجَدَ مِنْ دُونِهِمُ امْرَأَتَيْنِ تَذُودَانِ قَالَ مَا خَطْبُكُمَا قَالَتَا لَا نَسْقِي حَتَّى يُصْدِرَ الرِّعَاءُ وَأَبُونَا شَيْخٌ كَبِيرٌ ‘যখন সে মাদইয়ানের কূপের কাছে পৌঁছল, তখন সে একদল লোককে দেখল, যারা তাদের জন্তুগুলোকে কূপ থেকে পানি পান করাচ্ছিল। একটু দূরে সে দুজন রমনীকে দেখল, যারা নিজেদের পশু সমেত দাঁড়িয়ে আছে। তখন সে মেয়ে দুটোর কাছে গিয়ে বলল, কী ব্যাপার তোমাদের? তখন তারা বলল, আমরা আমাদের জন্তুগুলোকে পানি পান করাতে পারি না যতক্ষণ না রাখালেরা তাদের জন্তুদের পানি পান করিয়ে বিদায় হয়। আর আমাদের পিতা খুবই বয়োবৃদ্ধ’ (আল-ক্বছাছ, ২৮/২৩)।
মেয়েগুলো বলছে, ‘আমরা আমাদের জন্তুগুলোকে পানি পান করাতে পারি না, যতক্ষণ না রাখালেরা তাদের জন্তুদের পানি পান করিয়ে বিদায় হয়’। অর্থাৎ, মেয়েগুলো চাচ্ছে না যেখানে পরপুরুষরা উপস্থিত, সেখানে তাদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বকরিগুলোকে পানি পান করাতে। মজার ব্যাপার হলো, সেই অনেক অনেক যুগ আগ থেকেই যে মহিলা-পুরুষের ফ্রি মিক্সিং অপরাধ ছিল, ব্যাপারটা এই আয়াত থেকে প্রমাণিত৷ রাখালরা আছে বলে মেয়ে দুটো সেই কূপের কাছে যাচ্ছে না। দূরে অপেক্ষা করে আছে কখন রাখালদের কাজ শেষ হবে। এই আয়াত থেকে আমরা যা শিখব তা হলো— মিক্স গেদারিং একটা ফিতনা। তাই, নারীদের উচিত নয় পুরুষদের সাথে অবাধে মেলামেশা করা, আর পুরুষদের উচিত নয় নারীদের সাথে অবাধ মেলামেশা করা।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে, ‘তাহলে মেয়ে দুটো একা একা বাইরে এলো কেন?’ উত্তরটা আয়াতেই আছে। মেয়েরা উত্তর দিয়েছিল, ‘আমাদের পিতা খুবই বয়োবৃদ্ধ’। অর্থাৎ, তাদের পিতার বাইরে আসার মতো সক্ষমতা নেই। তাই তারা বাধ্য হয়ে বকরিগুলো নিয়ে বাইরে এসেছিল সেগুলোকে পানি পান করাতে।
[দুই]
তাদের কথা শুনে এবং ঘরে বয়োবৃদ্ধ পিতা কন্যাদের জন্য অপেক্ষারত আছেন শুনে মূসা আলাইহিস সালাম-এর মনে দয়ার সঞ্চার হলো। তিনি তাদের বকরিগুলোকে নিয়ে কূপের কাছে গেলেন এবং কূপ থেকে পানি পান করিয়ে তাদের কাছে ফিরিয়ে দিলেন। এরপর, মূসা আলাইহিস সালাম একটা গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করতে লাগলেন। খানিকক্ষণ পর উক্ত দুই মেয়ের একজন এসে মূসা আলাইহিস সালাম-কে বললেন, ‘আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন। আপনি আমাদের উপকার করেছেন। আমার পিতা চান তার প্রতিদান দিতে’। কুরআনে ব্যাপারটা এভাবে এসেছে, قَالَتْ إِحْدَاهُمَا يَا أَبَتِ اسْتَأْجِرْهُ إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْأَمِينُ ‘তখন নারীদ্বয়ের একজন তার কাছে সলজ্জ পদে আসলো এবং বলল, আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন। আপনি আমাদের বকরিগুলোকে পানি পান করিয়েছেন। এজন্য তিনি চান আপনাকে প্রতিদান দিতে’ (আল-ক্বছাছ, ২৮/২৫)।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, কুরআন এই আয়াতে একটা ব্যাপারে জোর দিয়েছে। সেটা হলো— মেয়ে দুইটার একজন মূসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে এসেছেন সলজ্জভাবে। লজ্জার সাথে। কেন? কারণ— মূসা আলাইহিস সালাম তার কাছে পরপুরুষ। তাই, একজন পরপুরুষের সাথে কথা বলতে হলে একটা মেয়েকে যতোটা পর্দা-আবরু, যতটা বিনীত-সলজ্জ হতে হয়, ঠিক ততটুকুই এই মেয়েটার মধ্যে তখন ছিল।
আমরা যখন কোনো নন-মাহরামের সামনে যাই, আমরা যেন খোশগল্পে মেতে না উঠি। আমরা যেন এটা ভুলে না যাই যে, আমি যার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সে আমার জন্য মাহরাম নয়। তাই, তার সামনে যদি আসতেও হয়, যদি কথা বলতেও হয়, যথাযথ পর্দা-আবরু, সলজ্জ হয়েই যেন আসি। আর দরকারের অতিরিক্ত কথা যেন না বলি।
[তিন]
এরপরের কাহিনী সূরাটা আগাগোড়া পড়ে গেলে জানা যায়। মূসা আলাইহিস সালাম উক্ত ব্যক্তির ঘরে এলেন। অনেকের মতে উক্ত ব্যক্তি ছিলেন ইসলামের আরেক নবী শুআইব আলাইহিস সালাম। এরপর, শুআইব আলাইহিস সালাম কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার একটা কন্যাকে মূসা আলাইহিস সালাম-এর সাথে বিয়ে দিতে চাইলেন। তবে, মূসা আলাইহিস সালাম তো তখন মুসাফির। বিয়ের মোহরানা তিনি কোথায় পাবেন? শুআইব আলাইহিস সালাম বললেন, তুমি আমার এখানে আট বছর কিংবা দশ বছর কাজ করো। মেয়াদ পূর্ণ হলেই চলে যেয়ো। মোদ্দাকথা, শুআইব আলাইহিস সালাম-এর ঘরে মূসা আলাইহিস সালাম আট কিংবা দশ বছর কাজ করবেন। এটাই মূসা আলাইহিস সালাম-এর বিয়ের মোহরানা। মূসা আলাইহিস সালাম সেটা মেনে নেন এবং দীর্ঘ দশ বছর শুআইব আলাইহিস সালাম-এর ঘরে কাজ করেন। দশ বছর পূর্ণ হলে তিনি তার স্ত্রী (যার সাথে শুআইব আলাইহিস সালাম মূসা আলাইহিস সালাম-এর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন) সহ অন্যত্র যাত্রা করেন।
এখান থেকে দুটো শিক্ষা :
প্রথমত, যেসব ভাই বিয়ে করেন কিন্তু মোহরানা প্রদান করেন না, কিংবা প্রদান করার ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপও করেন না, তাদের জন্য এই ঘটনায় ভালো রকমের শিক্ষা রয়েছে। মোহরানা প্রদান করার জন্য মূসা আলাইহিস সালাম দশ বছর মজুরির কাজ করতেও দ্বিধা করেননি। তাই, আমাদের উচিত স্ত্রীদের মোহরানার ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন হওয়া।
দ্বিতীয়ত, বিয়ে করার জন্য মূসা আলাইহিস সালাম শুআইব আলাইহিস সালাম-এর ঘরে দশ বছর শ্রমের কাজ করেছেন। একজন নবী তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দশটা বছর ব্যয় করেছেন এই কাজে। তাহলে ভাবুন, বিয়ে জিনিসটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ? বিয়ে যদি খুব হালকা কিংবা যেমন-তেমন কোনো ব্যাপার হতো, মূসা আলাইহিস সালাম কখনোই নিজের জীবনের দশটা বছর এই কাজের জন্য ব্যয় করতেন না।
আমাদের যেসকল ভাই ‘ইলম অর্জনের জন্য’ চিরকুমার থাকার বাসনা হৃদয়ে লালন করেন, তাদের জন্য এখানে বিশাল শিক্ষা রয়েছে। ভাইয়েরা, বিয়ে কখনো ইলম অর্জনের পথে অন্তরায় নয়। যদি তা-ই হতো, মূসা আলাইহিস সালাম সেদিন শুআইব আলাইহিস সালাম-এর প্রস্তাবে রাজিই হতেন না। তাই, বিয়ে করুন৷ বিয়ের জন্য ফিকির করুন। আল্লাহর কাছে নেককার স্ত্রীর জন্য দু‘আ করুন। আল্লাহ সবকিছু সহজ করে দিবেন ইনশাআল্লাহ।
-ওমর ফারুক বিন মুসলিমুদ্দীন*
ত্রিশাল, ময়মনসিংহ৷