যখন তোমরা কাউকে উশকোখুশকো চুলে উদভ্রান্ত নজরে পথে-প্রান্তরে ঘুরতে দেখো— যে কিনা তার কোট কাঁধের উপর ছড়িয়ে উদ্দেশ্যহীন চলছে, তখন তোমরা তাকে পাগল বলো! হতে পারে সে পাগল! আবার এমনও হতে পারে যে, সে দার্শনিক, কবি, গণিতবিদ কিংবা বিজ্ঞানী...!
তোমরা যখন শোনো, একটা লোক— যে কিনা জামা আর পায়জামার মাঝে পার্থক্য করতে জানে না, শুক্রবার বৃহস্পতিবার বোঝে না— তখন তোমরা তাকে পাগল বানিয়ে দাও! অথচ (আনাতুল ফারানেস) ...তিনি ওয়ালীমার দাওয়াত পান রবিবার, চলে যান শনিবারেই। খাবার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে তিনি আশ্চর্যের সাথে অপেক্ষা করতে থাকেন। হঠাৎ করে এমন চলে আসায় বাড়ির গৃহিণী অবাক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকান। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, আজ শনিবার। কিন্তু তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না! তাহলে কি সেই যুগের শ্রেষ্ঠ ভাষা-সাহিত্যিক, উৎকৃষ্ট ব্যক্তিত্ব ‘আনাতুল’ পাগল ছিলেন?!
যখন তোমরা কাউকে কোনো এক কুঁড়েঘরে অথবা নির্জন কোনো গুহায় একাকী বাস করতে দেখো— যে কিনা দুনিয়ার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না, মানুষের সাথে তেমন কথাবার্তা বলে না— তোমরা তাকে পাগল বলে ফেলো! কিন্তু (গাযালী) ...দুনিয়া ত্যাগ করেছিলেন তিনি, অথচ তা তাঁর কাছে জমা হয়েছিল! নিজের সম্মান ভুলে গিয়েছিলেন তিনি, অথচ তা তাঁর দিকে ধেয়ে আসছিল! নেতৃত্ব ছেড়ে ছিলেন তিনি, অথচ তা বশীভূত হয়ে তার দিকে ছুটছিল! বরং তিনি দামেশকের এক মসজিদের মিনারে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। তাহলে কি ইসলামের দলীল, জ্ঞানের পতাকা ‘গাযালী’ পাগল ছিলেন!?
যখন তোমাদের কাছে এমন মানুষের কথা আসে— যে কিনা নিজের নামটাই ভুলে গেছে, তাকে তোমরা পাগল নাম দিয়ে ফেলো! তোমরা কি জানো, কবি (জাহেয) নিজের কুনিয়াত ভুলে গিয়েছিলেন! এমনকি মানুষদের জিজ্ঞেস করতে থাকলেন! শেষে ইবনে হেলাল তাকে মনে করিয়ে দিলেন, ‘আপনি আবূ উছমান!’ তাহলে কি ‘জাহেয’— প্রতিভাবান সাহিত্যিক, আরবের বাগ্যন্ত্র— পাগল ছিলেন!?
‘নিউটন’-কে নিশ্চয় চেনো! তাঁর বাড়িতে একটা বিড়াল থাকত। যখনই তিনি দরজা বন্ধ করে নিজের বই-পুস্তক ও গবেষণায় মনোযোগ দিতেন, তখনই সেই বিড়াল দরজায় শব্দ করত ও নখ দিয়ে আঁচড়াত। এতে তাঁর মনোযোগে বিঘ্ন ঘটত। তিনি উঠে গিয়ে তার জন্য দরজা খুলে দিতেন। এরকমটা বারবার হতে থাকলে তিনি বিরক্তবোধ করলেন। ভাবতে লাগলেন, কীভাবে এর সমাধা করা যায়? তিনি একটি বুদ্ধি পেলেন... বিড়ালটির চলাচলের জন্য দরজার নিচের দিকে একটা ছিদ্র করে দিলেন। এভাবে তিনি তার জ্বালা থেকে রক্ষা পেলেন... একসময় বিড়ালটির তিনটি বাচ্চা হলো। বাচ্চাগুলোর জন্য তিনি আরও তিনটি ছিদ্র করলেন! ...এত বড় জ্ঞানী, যিনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করে ফেলেছেন, অথচ এই ছোট্ট বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেনি যে, মা বিড়াল ও তার বাচ্চাগুলোর জন্য ঐ একটা ছিদ্রই যথেষ্ট ছিল!
আর ‘আমবীর’-এর কাহিনি শোনো... রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ হঠাৎ তাঁর মাথায় বিভিন্ন মাসআলার উদয় হতো। তখন তিনি কলম-খাতা কিছুই পেতেন না, তাই সাথে করে সবসময় চক নিয়ে বেড়াতেন। মাসআলা আসা মাত্রই কোনো কালো দেয়ালে সেটা লিখে রাখতেন। একবার তিনি একটা বগি বা ট্রাককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেটাতে নানান সূত্র ও সংকেতচিহ্ন খুব মনোযোগ দিয়ে লিখছিলেন। এমনসময় ট্রাকটা চলতে শুরু করল। তিনি লিখতে লিখতে সেটার পিছন পিছন দৌড়াতে লাগলেন! আর তিনি জানেন না যে, কী করছেন!
‘হিনরী বুয়ানকারী’ নামে একজন... কিছু লোককে তিনি তার বাড়িতে ওয়ালীমার দাওয়াত দেন। সময় নির্ধারণ করে দেন সাতটায়। সময় হলে মানুষজন আসতে থাকে। হঠাৎ তিনি কোনো কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ...মেহমানরা তাঁকে ডাকেন, কিন্তু তিনি শুনতে পান না! তাঁকে ঠেলাঠেলি করেন, তবুও তাঁর সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না! মেহমানরা এক কাজ করেন, নিজেরাই খেয়ে দেয়ে চলে যান। ...দু’ঘণ্টা পর তিনি ফ্রি হন এবং রান্নাঘরের দিকে গিয়ে ফাঁকা হাঁড়ি, ব্যবহৃত চামচ ও খাবারের অবশিষ্টাংশ দেখতে পান। তিনি ভাবতে থাকেন, ‘খেয়েছি নাকি খাইনি!’ তাঁর ধারণা হলো, তিনি খেয়ে নিয়েছেন! অতঃপর আবার কাজে ফিরে যান!
‘আমরুল্লাহ আফেনদী’ ...তিনি একজন প্রসিদ্ধ তুর্কি আলেম ও তুর্কি গবেষণাগারের প্রধান। প্রতিদিন তিনি তাঁর বাড়ি ‘ইস্কানদার’ থেকে কর্মস্থল ‘ইস্তাম্বুল’ পর্যন্ত লঞ্চে করে যেতেন। একদিন সফরে তাঁর পাশে ব্রিটেন দূতাবাসের একজন অফিসার পড়লেন। অফিসারটির পকেটে ছিল সুস্বাদু পেস্তাবাদাম। ‘আমরুল্লাহ আফেনদী’ ছিলেন গভীর চিন্তার মানুষ। তিনি নিজের অজান্তেই হাত ঘোরাচ্ছিলেন। আচানক তাঁর হাতটি ঐ অফিসারটির পকেটে থাকা পেস্তাবাদামে গিয়ে পড়ে। তিনি তা থেকে তুলতে থাকেন এবং খেতে থাকেন! লোকটি মনে করেন, তিনি হয়তো মজা করছেন। তাই কিছু না বলে চুপ করে থাকেন। এদিকে তিনি খাচ্ছেন তো খাচ্ছেনই। লঞ্চটা ছিল খুবই জনাকীর্ণ, তাই এমন অসুবিধায় অন্যত্র যাওয়ার কোনো উপায়ও ছিল না অফিসারটির। তাই তিনি ভাবলেন, কিছু একটা বলবেন যাতে তিনি থেমে যান। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘পেস্তা কেমন লাগছে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘সেই!’ এই বলে তিনি তার ভাবনায় ফিরে গেলেন এবং খেতে থাকলেন। এবার বুদ্ধি খাটিয়ে লোকটি বললেন, ‘আমার বাড়ির আশেপাশে এরকম বাদাম পাওয়া যায় না, যা আমি সন্তানদের জন্য কিনব! আমি যদি তাদের কাছে পেস্তা ছাড়াই যাই, তাহলে তারা কেঁদে দিবে। ...আফেনদী বললেন, ‘আজীব ব্যাপার!’ এই বলে তিনি আবারও খাওয়াতে মনোযোগী হলেন। তারপর লোকটি বললেন, আপনি কি তাদের জন্য সামান্য কিছু রাখতে উদার হবেন না? তিনি উত্তর দিলেন, ‘অবশ্যই, অনুগ্রহের সবটাই তো তাদের জন্য’। এরপর একমুষ্টি পেস্তা নিয়ে ইংরেজ লোকটার দিকে বাড়িয়ে দেন এবং বাদবাকি সব সাবাড় করে ফেলেন!
তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন। সাথে দেওয়া হলো সুন্দর একটি গাড়ি। যখনই গাড়িতে করে তিনি বাড়ি পৌঁছাতেন এবং ড্রাইভার দরজা খুলে দিত এবং ব্যাগ নামিয়ে দিত, তিনি বলতেন, ‘কত চাও?’ প্রতিবার ড্রাইভার তাঁকে মনে করিয়ে দিতেন যে, এ তো আপনার সম্মানের খাতিরে! মনে পড়লে তিনি বলতেন, ‘ত্বাইয়েব’ (গুড)!
একদা তিনি তাঁর বাড়ির সামনে হাঁটছিলেন। এক মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর বাসাটা কোথায়, জানেন?’ তিনি মহিলাটিকে বললেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী কে এখন!’
‘আব্দুল মাসীহ’ নামে আমাদের এক ইরাকী ভাষাবিদ বন্ধু... সে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন বড় অফিসার ছিল। একবার সে অফিসে গিয়ে নিজের কক্ষ বাদে ভুল করে অন্য কক্ষে প্রবেশ করে। যখন সেখানে দেখে যে, আসবাবপত্রগুলো আগের মতো নেই! তখন খুব রেগে যায় এবং কর্মচারীকে ডেকে বলে, ‘এই ডেস্কটা এখান থেকে সরাও, টেলিফোনটা ওখানে নিয়ে যাও, এটা করো, ওটা করো’ ...যখন তাঁর মনমতো সবকিছু হয়ে যায় তখন সে ভালোভাবে দেখে বলে, ‘এটা কি আমার ঘর?’ কর্মচারী বলে, ‘না, স্যার! এটা আপনার ঘর নয়’। অতঃপর সে তাঁর নিজের ঘরে যায়!
‘আমি ও আনওয়ার আত্তার’ মাঝেমধ্যে তাঁর সাক্ষাতে যেতাম। একবার সে আমাদের জন্য চা এনে গল্পতে মজে গেল। নিজের চা শেষ করে হাত বাড়ালো আত্তারের কাপের দিকে। সেটা শেষ করে আমারটাও ছাড়ল না! চাকর কাপগুলো নিতে আসলে বলল, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে জিজ্ঞেস করছি, তোমরা কি আর চা নিবে?!’
‘শায়েখ তাহের আজ-জাযায়েরী’ —তিনি শামের একজন আলেম ও মোটিভেশনাল স্পিকার। উস্তায কাসেম আল-কাসেমী আমাকে বলেন, তাঁরা বন্ধুরা মিলে তাঁর জন্য একটা নতুন জুব্বা ক্রয় করলেন এবং তাঁকে সেটা পরিয়ে ‘দুম্মা’ নামক জায়গায় নিয়ে গেলেন। সেখানে তাঁরা ‘আমীর উমারের’ বাগানে বড় একটি পুকুরের পাশে বসলেন। সেই মাজলিসে শায়েখ আব্দুর রাযযাক, শায়েখ জামালুদ্দীন কাসেমীসহ আরো বড় বড় আলেমগণ ছিলেন। বসে থাকতে থাকতে শায়েখ তাহের হঠাৎ দাঁড়িয়ে জুব্বা খুলে পুকুরের পানিতে চুবাতে লাগলেন। মাটি দিয়ে সেটাকে ঘষে ধুয়ে নিয়ে লটকিয়ে দিলেন গাছের ডালের সাথে। সেটা শুকে কুঁচকে গেলে পুনরায় পরে নিলেন এবং বললেন, ‘আহ! এতক্ষণে শান্তি পেলাম। নতুন খসখসে কাপড় মস্তিষ্ককে অস্থির করে তোলে। আর পুরাতন কাপড়ে তেমন কিছু মনে হয় না’। এরপর তিনি তাঁর চিন্তাভাবনায় ফিরে গেলেন।
‘সামী বিক আযম’ নামে আমাদের এক ইন্সপেক্টর বন্ধু ছিল। একদিন কথার ফাঁকে সে বলছিল, একবার সে মন্ত্রী মহোদয়কে তাঁর বাড়িতে দুপুরের দাওয়াত দেয়। তাঁর বাড়িটা ছিল শহরের একেবারে শেষপ্রান্তে। প্রতিশ্রুতির দিনে মন্ত্রী সাহেব গাড়িতে করে বাড়ির সামনে আসেন। গাড়ি থেকে নেমে অপেক্ষা দীর্ঘয়িত হবে ভেবে ড্রাইভারকে চলে যেতে বলেন। বাড়ির সামনের প্রশস্ত বাগান পারিয়ে লম্বা সিঁড়ি বেয়ে দরজায় গিয়ে কড়া নাড়েন। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পান না। উপায়ান্তর না থাকায় হোটেলে খেয়ে তাঁকে আগস্টের উত্তপ্ত রোদে পায়ে হেঁটে ফিরে আসতে হয়। আর এদিকে সামী বিক দাওয়াতের কথা ভুলেই গেছে। পরিবারের সাথে কায়রোতে গিয়ে বসে আছে!!!
আমাদের আরেকজন ঔপন্যাসিক বন্ধু ছিলেন। তাঁর নাম হলো— ইযযুদ্দীন আত-তানুখী। একবার তিনি মুতানাব্বীর কয়েক বছরের সাহিত্যকর্ম প্রস্তুত করার জন্য ইলমী সমাবেশের আয়োজন করে দেশের কিছু সাহিত্যিককে আহ্বান করেন। যখন তারা আসলেন, সমাবেশের দরজা বন্ধ পেলেন। অতঃপর তাদের কয়েকজন ‘শায়েখ অসুস্থ হয়ে গেছেন’ ভেবে তাঁর বাড়িতে দেখতে যান। গিয়ে দেখেন, তিনি ‘আবুত তাইয়িব আল-লুগাবী’-এর বই তাহক্বীক্ব করতে ব্যস্ত। তিনি তাদের আগমন দেখে ঐ বই থেকেই আলোচনা করতে লাগলেন! আর সমাবেশের কথা, তিনি সেটা একেবারেই ভুলে গেছেন!!!
এখন কথা হচ্ছে— তারা প্রতিভাবান আলেম, বিজ্ঞানী আর অনন্য ইমাম হওয়া সত্ত্বেও... তাঁরা কি সবাই পাগল!?
জনসাধারণের মতে হয়তো তাঁরা পাগল!!!
কেননা, একটা কাফেলা চলছে। যে কাফেলার সাথে সাথে চলে, সবাই তাঁকেই জ্ঞানী বলে। আর যে আগে চলে যায় এবং নতুন পথে চলে, সেটা আরও নিকটবর্তী ও নিরাপদ হলেও লোকেরা তাঁকে পাগল বলে।
কিন্তু এটা হচ্ছে প্রতিভার পাগলামি। আর ওটা পাগলাদের পাগলামি!!!
প্রতিভাবান তো সেই, যার চিন্তাভাবনা সবসময় জানা-অজানা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দুনিয়াকে দেওয়ার জন্য তাঁর কাছে সময় থাকে না। আর একারণেই সে তাঁর সাথিদের কাছে পাগল বলে আখ্যায়িত হয়!
মূল : ড. আলী তানতাবী
অনুবাদ : মাজহারুল ইসলাম আবির
** শিক্ষার্থী, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
* صور و خواطر গ্রন্থ থেকে অনূদিত, পৃ. ৫১-৫৫।