কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

নয়নতারা

post title will place here

রোকেয়া বেগম অনেক রকমের বুদ্ধিশুদ্ধি করে কন্যা নয়নতারাকে বিবাহের জন্য এক প্রকার রাজি করাতে পেরেছেন। কিন্তু নয়নতারার পিতা এ বিষয়ে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কন্যার বিবাহের প্রসঙ্গ তুলতেই পিতা বলেন, আহা বলো কী? মেয়ে লেখাপড়া করছে করুক। বিদ্যাবুদ্ধির দরকার আছে। উচ্চ মাধ্যমিকটা পাশ করুক দেখা যাবে। আমি হইলাম নাসিরুদ্দিন হাওলাদার, দশ গ্রামে নাম যার। আমার কন্যার বিবাহের জন্য চিন্তা কী?

রোকেয়া বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন, এ কথা শুনলে আমার পিত্তি জ্বলে যায়। ছেলের বিবাহের কথা বললেও একই কথা, নাসিরুদ্দিন হাওলাদার, দশ গ্রামে নাম যার। সুকন্যা পায়ের উপর ফেলে যাবে। এদিকে ছেলে যে বুড়া হচ্ছে তার নাই খবর। নাসিরুদ্দিনের ঠোঁট বেয়ে পানের রস নেমে আসছিলো, সুড়ুৎ করে এক টানে আবার মুখে নিয়ে বললেন, কী মরদ ছেলে তোমার? জায়গা জমি, ক্ষেত খামারি হিসেবটা ভালো করে বুঝুক। নাক চোখ ফুটুক। বয়স আর ২৭-২৮ এযুগে কী এমন? আজ বললে কাল পাত্রীর বাপ লাইন ধরবে। আমি হইলাম নাসিরুদ্দিন হাওলাদার…! রোকেয়া বেগম উঠে চলে গেলেন।

দেখতে দেখতে নয়নতারা উচ্চমাধ্যমিক পাস করে স্নাতকে ভর্তি হলো। রোকেয়া বেগম স্বামীকে সবিস্তারে বুঝাতে চেষ্টা করলেন, মেয়ের গাত্রবর্ণ অনুজ্জ্বল, উচ্চতায় কমতি তার উপর বয়স বাড়তে দিলে নানান রকম সমস্যা। গ্রাম-গঞ্জের হিসাব, পাঁচ জনের পাঁচ কথা। ভালো কিছু প্রস্তাব আছে, দেখে-শুনে একটা নিষ্পত্তি করা ভালো। সব শুনে নাসিরুদ্দিন এক থোক পানের পিক ফেলে বললেন, মেয়েটার কিছু রূপে-গুণে কমতি আছে খারাপ বলো নাই, মায়ের পেল তো…। যাইহোক বিয়ে-শাদি নিয়ে এত অস্থিরতার কিছু নাই, তাছাড়া আমি হইলাম নাসিরুদ্দিন হাওলাদার, দশ গ্রামে নাম যার। রোকেয়া বেগম, আ মরণ! বলে উঠে যেতে যেতে ত্যক্ত বিরক্ত স্বরে বললেন, রূপ-গুণ না হয় মায়ের মতো কিছু কম হলো, বাপের মতো আক্কেল জ্ঞান না পাইলে বাঁচে।

কিছুদিন পর সকালবেলা নাসিরুদ্দিন হাওলাদার আধ শোয়া হয়ে পান খেতে খেতে কীসব কাগজপত্র দেখছিলেন। রোকেয়া বেগম চা দিতে আসায় বললেন, জমিলা কি আবার ভাগছে? নতুন মেয়েটা একেবারে সজ্জিত হয়ে রান্নাঘরে গেল। সাজসজ্জার মেয়ে তো কাজের বেলায় ঠনঠন। রোকেয়া বেগম অন্যদিকে মুখ করে বললেন, কাজের মেয়ে নয়, আপনার ছেলের বউ। নাসিরুদ্দিন লাফ দিয়ে উঠে বললেন, বলো কী পাগলের মতো?

—পোলা দুই মাস আগে গোপনে বিবাহ করেছে। খবর পেয়ে আমি ঘরে তুলে নিলাম। মামলা খালাস।

—কত বড় বজ্জাত! কদিন আগে তমিজদ্দিনকে বলল, ‘এই বছর না হেই বছর, মানুষ বাঁচে কয় বছর? চাচা আপনে আব্বারে বুঝান’। আজ শুনি গোপনে বিবাহ। ছিঃ ছিঃ ছিঃ হাওলাদার বংশের মুখে চুনকালি। দুশ্চরিত্র পোলার জায়গা এ বাড়িতে নয়। সবই তোমার আশকারায়…!

—জাতপাত নিয়ে কথা বলবেন না। ঠিকই করেছে, আপনের আশায় থাকলে আর কবরে ঢুকে যেত।

নাসিরুদ্দিন স্ত্রীকে গঞ্জনা-ব্যাঞ্জনা করলেও ভালো করে জানেন, জমিজমা ক্ষেতখামারি পরিচালনা তিনি আর পেরে উঠেন না। ছেলে সব দেখে। কিছুদিন আগুন গরম দেখালেও, সমাজের জনা শতেক লোক ভোজন প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করলেন।

নতুন আত্মীয় যাওয়া-আসা করে। নয়নতারার ব্যাপারে একেকজন একেক কথা বলে। কেউ কেউ রোকেয়া বেগমের জ্ঞান-বুদ্ধি কম ঠাহর করে বিনামূল্যে জ্ঞান বিতরণে আনন্দ পায়। নতুন বেয়াইন এবং সে পক্ষীয় আত্মীয় কয়েকটা ভালো প্রস্তাব অবশ্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু রোকেয়া বেগম স্বামীর সাথে বিশেষ সুবিধা করতে পারছেন না।

একদিন সুযোগ বুঝে স্বামীকে বললেন, মাথা গরম না করে আমার কথাটা শুনেন। অশ্লীল নাটক-সিনেমার যুগ, চারিদিকে নানান বেহায়াপনা। পোলা-মাইয়ার হাতে হাতে মোবাইল। একটিপে লন্ডন আরেক টিপে ডুবাই। পোলার বিবাহে গুরুত্ব দেন নাই, এখন অঘটনের পর সব দোষ আমার। দয়াকরে এবার মাইয়াটার বিবাহে গুরুত্ব দেন। আর কত বলব আপনারে?

সেবার নাসিরুদ্দিন কোনো প্রকার বাকবিতণ্ডা না করে কন্যার বিবাহে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আগের কিছু পাত্রের খোঁজ নিলেন, নতুন পাত্রের সন্ধান করলেন।

নয়নতারার স্নাতক শেষ হলো। এতদিনের পাত্র চালাচালিতে নাসিরুদ্দিন একটা ইঙ্গিত পেল যে, তার নাম দাম স্ববিশেষ পরিচয় কোথাও যেন ঠেকে যাচ্ছে বারবার। ইতোমধ্যে কম পাত্রের সন্ধান হয়নি। বেশির ভাগ পাত্রপক্ষ নয়নতারার নানা দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করছেন। দু’চার পক্ষ যাদের নয়নতারাকে মনে ধরেছে, তাদেরকে আবার নাসিরুদ্দিনের মনে ধরছে না। তবু তিনি এত সহজে বশে আসার পাত্র নন।

রোকেয়া বেগম শেষ যে পাত্রের সন্ধান করেছেন, তার সবই পছন্দ হয়েছে, পাত্রপক্ষ থেকে ভালো মত পাওয়া গেছে। কিন্তু নাসিরুদ্দিন বেঁকে গিয়ে বললেন, মেয়ে আমার স্নাতক উত্তীর্ণ হয়েছে, উচ্চশিক্ষিত মেয়ে, আর তুমি পাত্র আনালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ। এই পাত্র অপেক্ষা কলাগাছের সাথে বিবাহ দেওয়া উত্তম। রোকেয়া বেগম নানানভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেন, ছেলের না হয় শিক্ষা একটু কম, আমাদের মেয়ের কমতি তো দেখতে হবে। তাছাড়া অতি উচ্চশিক্ষিত মানেই যে সুখী, বাকিরা অসুখী তা তো না। নাসিরুদ্দিন মেজাজি সুরে বলেন, তোমার এত আগুনে পড়ার দরকার নাই। তোমার চাইতে বিবেচনা আমার কম নাই। আমি হইলাম নাসিরুদ্দিন হাওলাদার, দশ গ্রামে নাম যার…!

নয়নতারা মাতাপিতার বাক্য বিনিময় এখন আর কান পেতে শুনে না। গাত্রবর্ণ আর উচ্চতার সামাজিক পরিমাপে সে যে উত্তীর্ণ হয়নি তা স্কুল বয়স থেকেই জানে। দায়িত্বশীল প্রতিবেশী আর আত্মীয়ের কল্যাণে তার বয়স পাকার খবরও অজানা নয়। বরং প্রতিদিনই সেসব স্মরণ করে দেওয়ার কোনো না কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি পাওয়া যাচ্ছে। নয়নতারা এখন আর শুনেও শুনে না, বুঝেও বুঝে না। মাঝে মাঝে কিছু পাত্রপক্ষের সাথে নিজের দরদামের ব্যাক্যালাপ শুনে স্বহাস্যে জানতে ইচ্ছে করে, অনুজ্জ্বল গাত্রবর্ণের জন্য কত ধার্য করা হয়েছে, কম উচ্চতার জন্য কত ধার্য করা হয়েছে ইত্যাদি। কোনো কিছুই যেন তার গায়ে লাগে না আর। শুধু পাত্রপক্ষ বিদায়ের পর মায়ের নিষ্প্রাণ মুখের দিকে তাকালে তার বুকের ভেতর বিষণ্নতায় ভরে উঠে।

রোকেয়া বেগম আজ অতি আনন্দিত। নয়নতারাকে আরেকটা পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। আল্লাহর রহমতে পাত্রপক্ষ নয়নতারাকে পছন্দ করেছে। পাত্রের শিক্ষা ভালো, ব্যাবসা-বাণিজ্য করে, কথাবার্তা নম্র ভদ্র। মেহমান বিদায় দিয়ে নাসিরুদ্দিন হনহন করে ঘরে এসে বললেন, হারামজাদা মন্টু ঘটকের কান কেটে যদি কুত্তারে না খাওয়াইছি। আমার সাথে দু নম্বরি। ছেলের পরদাদা চৌকিদার ছিল তা আমারে বলে নাই। কতবড় বজ্জাত...। রোকেয়া বেগম আশ্চর্য হয়ে বললেন, কোন সময় কে চৌকিদার ছিল তা নিয়ে এত অস্থিরতার কী আছে? ছেলে তো চৌকিদার না, মাশাআল্লাহ প্রতিষ্ঠিত ছেলে।

—আমার স্নাতক উত্তীর্ণ কন্যা বিবাহ দেব চৌকিদার বংশে? সমাজে মান-ইজ্জত কিছু বাকি থাকে? আমি হইলাম…!

—রোকেয়া বেগম রাগে-দুঃখে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, রাখেন আপনার গরিমা। আপনার মতো বাপের অবহেলা আর অতি অহংকারের কারণে পোলা-মাইয়ার জীবনে দুর্ভোগ।

নাসিরুদ্দিন নানান বাকবিতণ্ডা করে চোখ রাঙিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। রোকেয়া বেগম পুত্রবধূকে বললেন, দেখলে বউ তোমার শ্বশুরের কাণ্ডকারখানা। সর্ব দিকে মন মতো পাইতে গেলে আর বিবাহ হয়? পুত্রবধূ কিছু না বলে নয়নতারার পাশে গিয়ে বসল। রোকেয়া বেগম কন্যার দিকে তাকিয়ে দেখলেন নয়নতারা নয়নজলে ভেসে যায়।

 শিক্ষক ও মিডিয়া হেড, হাবরুল উম্মাহ মডেল মাদরাসা, লক্ষ্মীপুর; লেখক, অ্যা লেটার টু অ্যাথেইস্ট।

Magazine