‘এই নে খা, খা-না লালী! দেখ তোর জন্য কত ঘাস আনছি’। এই অনুরোধটুকু সাকিবের, উদ্দেশ্য তার প্রিয় ছাগল লালী। সাকিব সিরাজ উদ্দীনের নিম্নবিত্ত পরিবারের ছোট ছেলে। সে ক্লাস ফোরে পড়ে।
সিরাজ স্থানীয় এক দানশীল ব্যক্তি থেকে ক্বর্যে হাসানার মাধ্যমে কিছু ঋণ নিয়ে এই কুরবানী ঈদে বিক্রি করার জন্য বেশ কয়েকটি ছাগল কিনেছে। লালী সেই ছাগলগুলোর একটি। যাকে সাকিব প্রথম দিন থেকেই খুবই পছন্দ করেছে।
লালীকে পাওয়ার পর থেকে ও নাওয়াখাওয়াই ভুলে গেছে। সাকিবের এমন ছাগলপ্রীতি দেখে ওর বন্ধুরা সবাই হাসিঠাট্টা করে। বিশেষ করে সাব্বির। সাব্বিরকে এমনিতেই সাকিব পছন্দ করে না। কেননা ও একটু গুন্ডা টাইপের ছেলে।
সাব্বিরের সাথে ঝগড়া নেই এমন ছেলে-মেয়ে স্কুলে পাওয়া দুষ্কর। ও কাউকে মেনে চলে না, এমনকি স্কুলের শিক্ষকদেরও নয়। তার কারণ সে খুবই বড় লোকের ছেলে। তার বাবা স্কুলের সভাপতি, আর স্কুলটাও সাব্বিরের দাদার নামে। আর তাই হেন খারাপ কাজ নেই যা সে করে না। সাব্বিরের হাত থেকে বাঁচার জন্য সবাই ওকে এড়িয়ে চলে। তবুও সে গায়ে পড়েই ঝগড়া করতে এগিয়ে যায় সবসময়।
আজও যখন দেখল সাকিব তার প্রিয় ছাগল লালীর সাথে খেলছে, তখনই সাব্বিরের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপল। সে শুধু শুধুই লালীকে দৌড়াতে লাগালো। হঠাৎ এমন আক্রমণ দেখে লালীও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দৌড়াতে শুরু করল। সাকিব কিছুতেই লালীকে আটকে রাখতে পারল না।
সাকিবের এমন অসহায় অবস্থা দেখে সাব্বির হেসে কুটিকুটি। সেই সাথে তার সাঙ্গোপাঙ্গরাও সাকিবকে বিশ্রীভাবে উপহাস করে বলতে লাগল— ‘হি হি ছাগল পালে পাগলে, সাকিবের ছাগল গেল চলে’। এভাবে সবাই চিৎকার করে উল্লাস করতে লাগল। সাকিবের চেহারা প্রায় কাঁদো কাঁদো। সে সবার অপমান সহ্য করে চুপ মেরে রইল। সে ভালো করেই জানে এদের সাথে ঝগড়া করে লাভ নেই। তার চেয়ে তার লালীর কাছে যাওয়াই উত্তম। সাকিবের এমন লেজ গুটিয়ে পালানোর দৃশ্য সাব্বিরদের খুবই উৎসাহ যোগাল। তারা নিজেদের কৃতকর্মে বেশ গর্ববোধ করতে লাগল।
ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু সাব্বির এই ঘটনার রেশ স্কুল পর্যন্ত নিয়ে গেল। পরদিন সাব্বির স্কুলে গিয়ে রটিয়ে দিল ‘ছাগল পালে পাগলে, সাকিব তুমি কোথায় গেলে’। এমন চূড়ান্ত অপমানও সাকিব বেশ ধৈর্যের সাথে হজম করল।
এভাবে অপমান সহ্য করার পরও সাকিব তার লালীর নাগাল ছাড়ল না। কুরবানীর বাজারে সাকিবদের বেশ কয়েকটি ছাগল বিক্রি হয়ে গেল। সাকিবের বাবা বেশ কয়েকবার লালীকে হাটে নিতে চাইলেও সাকিবের বাধার মুখে নিয়ে যেতে পারেনি।
এক শুক্রবার জুমআর খুৎবায় খত্বীব সাহেব কুরবানীর কাহিনী ওয়াজ করলেন। সেই ওয়াজে সাকিব যখন শুনল আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রিয় জিনিসকেই কুরবানী হিসেবে কবুল করেন। যে যার যত প্রিয় পশু কুরবানী করবে সে তত বেশি ছওয়াবের ভাগিদার হবে। সেদিন ঘরে ফিরেই সাকিব তার বাবাকে তার মনের কথা জানাল।
কিন্তু তার বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না লালীকে কুরবানী দিতে। কেননা তাদের সেই সামর্থ্য নেই কুরবানী করার। কিন্তু কে শুনে কার কথা। সাকিব তো নাছোড়বান্দা। বেশ কয়েকজন খরিদ্দার এসে ফেরত গেছে, সাকিব কিছুতেই লালীকে বিক্রি করতে রাজি নয়। কেননা সে লালীকে ভালোবেসে ফেলেছে। আর ভালোবাসার জিনিসই কুরবানী দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত সাকিবের মা’র কথা শুনে তার বাবা রাজি হয়।
এদিকে সাব্বিরের কানে যখন সাকিবের কথা গেল, তখন সে হেসেই লুটোপুটি। কেননা গ্রামে তারাই সবসময় বড় গরু দিয়ে কুরবানী করে। তাই যখন গরীবের ছেলে সাকিব ছাগল দিয়ে কুরবানী করবে শুনল তখন তো তার হাসি পাওয়ারই কথা। সে সাথে সাথেই তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে চলে গেল সাকিবের কাছে। তাকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করল রাগিয়ে দিতে ।
কিন্তু শান্ত ছেলে সাকিব কিছুতেই সে পথে পা বাড়ালো না। শেষ পর্যন্ত সাব্বির নিজে নিজেই বড়াই করে বলতে লাগল— ‘এই একটা পুঁচকে ছাগল দিয়ে কি কুরবানী হয়? কুরবানী করতে হয় গরু দিয়ে। এবার আমাদের সবচেয়ে বড় গরু দিয়ে কুরবানী করব’।
সাব্বিরের এইসব কথা শুনেও না শুনার ভান করে ওকে এড়িয়ে যেতে চাইল সাকিব। কিন্তু সাব্বির নাছোড়বান্দা, সে যে করেই হোক সাকিবের সাথে ঝগড়া করবেই। যখন সাব্বির অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করতে লাগল, তখন সাকিব একটি কথাই বলল— ‘বড় গরু যবেহ করলেই কুরবানী কবুল হয় না, কুরবানী দিতে হয় প্রিয় জিনিস’। এটা বলেই সাকিব লালীকে নিয়ে চলে গেল। কিন্তু সাব্বির চলে গেল না। সে ভাবতে লাগল কথাটা। শেষে ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, এবার হাটে সবচেয়ে বড় এবং দামী গরুটা তারাই কিনবে।
যে ভাবা সেই কাজ। সাব্বির তার বাবাকে নিয়ে সব হাট-বাজার ঘুরে সবচেয়ে বড় এবং দামী দেখে একটা গরু কিনল। সাব্বিরের বাবাও ছেলের এমন উৎসাহ দেখে খুশী হলো। কেননা সচরাচর সাব্বির এইসব নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাত না। তাই ছেলের এমন আগ্রহ তাকেও বেশ আন্দোলিত করল।
সাব্বির তাদের কুরবানীর গরু নিয়ে সারা গ্রাম চষে বেড়াল। সবাইকে গরু দেখিয়ে দেখিয়ে বেশ গর্ববোধও করতে লাগল। সাকিবদের ঘরে গিয়েও সাকিবকে স্পেশালভাবে দেখিয়ে দিল যে, তাদের গরু কত বড়। এমনকি সুযোগ বুঝে গরু দিয়ে লালীকে গুঁতো দিতেও দ্বিধা করল না সাব্বির।
অবশেষে কুরবানীর পালা শেষ হলো। সাব্বির মনের আনন্দে বন্ধুবান্ধব নিয়ে কুরবানীর গরুর গোশত খেতে লাগল। অপরদিকে সাকিব কিছুতেই লালীর রান্না করা গোশত স্পর্শ করতে চাইল না। তার বাবা-মা এত করে বুঝালো তবুও সে খেল না। শুধু লালীর মায়ায় কান্না করতে লাগল। যে লালীকে নিয়ে তার সুন্দর কিছু দিন অতিবাহিত হয়েছিল, সেই আনন্দ-অশ্রুঝরা দিনগুলো শুধুই তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে লাগল।
যতই লালীর কথা মনে পড়ছে ততোই সাকিব আবেগতাড়িত হয়ে নীরব অশ্রুজলে সিক্ত হতে লাগল। তার বাবা ছেলের এই অবস্থা দেখে তাকে জানালো যে, যদি সে কুরবানীর গোশত না খায়, তবে তাদের কুরবানী কখনোই আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। বাবার এই কথা খুবই কাজ দিল এবং সাথে সাথে কান্না মুছে সবার সাথে খেতে বসল। কেননা সে আল্লাহকে খুশী করার জন্যই কুরবানী করেছে।
কুরবানীর দিন রাত্রে সাকিব বুকভাঙা লালীর কষ্ট নিয়ে ঘুমোতে গেল। অপরদিকে সাব্বির এত খেয়েছে যে, কখন ঘুমিয়ে পড়ল সে খেয়ালই তার ছিল না। ঐদিন রাত্রে সাকিব খুব সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখতে লাগল। যেখানে অপূর্ব সুন্দর সাদা চাদরে ঢাকা একজন মানুষ তাকে নিয়ে যাচ্ছে সবুজ প্রকৃতিতে ঢাকা পাহাড়ের পানে।
একসময় সেখানে দেখতে পেল তার প্রিয় লালীকে। লালীকে দেখেই সে আনন্দে আত্মহারা! লোকটি তাকে লালীর পিঠে তুলে দিল। আর লালী তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল সুদূর দিগন্ত পানে। সেখানে হাজারো সুন্দর সুন্দর পশু-পাখি খেলা করছে। কত সুন্দর সেইসব দৃশ্য। এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
ওদিকে সাব্বিরও গভীর ঘুমে বিশ্রী বিদঘুটে একটি স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নে কালো কাপড়ের ঢাকা একটি লোক তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের উপরে। যেখানে তাদের কুরবানীর গরুটা ক্রুদ্ধ মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাকে দেখামাত্রই তার দিক তেড়ে গেল। সে নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। তার এই অবস্থা দেখে কালো লোকটি হা হা হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
যখন সাব্বির প্রাণবাজি রেখে কালো গরুটির হাত থেকে বাঁচার লড়াই করছে, তখন একটি দৃশ্য দেখে সে থমকে দাঁড়াল। সে দেখতে পেল সাকিব তার প্রিয় ছাগল লালীর পিঠে বসে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর তাকে দেখামাত্রই মুচকি হাসি দিয়ে তার থেকে দূরে সরে যেতে লাগল। একসময় ক্রুদ্ধ গরুটি সাব্বিরকে প্রচণ্ড একটি গুঁতো দিল। আর সাথে সাথেই তার ঘুম ভেঙে গেল। সে খুবই অস্থিরতা অনুভব করল। যখন সে স্থির হলো, তখন বুঝতে পারল আসলে কুরবানী নিয়ে সে যা করেছে তা খুবই ভুল ছিল।
পরদিন সকালে সাব্বির সাকিবের সাথে দেখা করে তার স্বপ্নের কথা জানাল এবং তার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইল। সেই সাথে এটা স্বীকার করে নিল যে, বড় গরু দিয়ে কুরবানীর করলেই হবে না। যাকে দিয়ে কুরবানী করা হবে তার প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসাও থাকতে হবে। সাকিবও তার স্বপ্নের কথা সাব্বিরকে বলল, সেই সাথে তাকে ক্ষমা করে দিল। এরপর থেকে সাব্বির আর সাকিবের মধ্যে খুবই সুন্দর বন্ধুত্ব তৈরি হলো।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।