বাংলাদেশের এক শান্ত গ্রাম মেহেরপুর, যেখানে জীবনের স্পন্দন প্রকৃতির মতোই সহজ আর সরল। এই গ্রামের নীরব কোণে মজিবরের ছোট্ট সংসার— স্ত্রী রহীমা আর ১০ বছরের একমাত্র পুত্র ফাহিমকে নিয়ে। মজিবর একজন সাধারণ কৃষক, নিজের জমিতে ধান চাষ করেন আর স্থানীয় হাটে একটি ছোট কাঁচাবাজারের দোকান চালান। তাদের জীবন মধ্যবিত্তের চিরায়ত হাসিমুখে বেঁচে থাকার এক সংগ্রামগাথা।
দারিদ্র্য কখনোই তাদের মনোবল ভাঙতে পারেনি। বরং সততা, ধার্মিকতা আর আত্মসম্মানের দৃঢ় স্তম্ভে তাদের সংসার সর্বদা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ফাহিম, ছোটবেলা থেকেই নীতিবান ও ধর্মভীরু। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করে সে। তার এই গুণ গ্রামের সকলের মন জয় করে নিয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী হায়দার উদ্দীন, যার দিন ফাহিমের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলা ছাড়া যেন অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
হায়দার উদ্দীন গ্রামের বড় হাটে একটি দোকান চালান এবং মোটামুটি সচ্ছল জীবনযাপন করেন। তার দুই সন্তান— ফাহিমের সমবয়সী ছেলে সাদ্দাম ও পাঁচ বছর বয়সের মেয়ে সাদিয়া। তবে হায়দারের প্রধান দুশ্চিন্তার কারণ তার ছেলে সাদ্দাম। সে অত্যন্ত চঞ্চল, অবাধ্য ও উচ্ছৃঙ্খল। ছালাতের ধার ধারে না, কোনো ভালো কাজের প্রতিও তার আগ্রহ নেই।
প্রতিদিন ফাহিমের ভদ্রতা ও নম্রতা দেখে হায়দার উদ্দীন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ‘যদি আমার ছেলেও এমন হতো!’— এই আক্ষেপ প্রায়শই তার হৃদয়ে অনুরণিত হয়।
মসজিদে যাওয়া-আসার পথে প্রায়ই মজিবর ও ফাহিমের সাথে হায়দার উদ্দীনের দেখা হয়। একদিন মসজিদে যাওয়ার পথে ফাহিমের সালাম শুনে হায়দার উদ্দীন বললেন,
—‘আস-সালামু আলাইকুম, চাচা!’।
—‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম, বাবা ফাহিম! কেমন আছো?’
—‘আল-হামদুলিল্লাহ ভালো। আর আপনি?’
—‘আমি ভালো আছি। কুরবানীর ঈদ তো প্রায় এসেই গেল, তোমাদের এবার কী কিনবে?’
—‘আব্বা বলেছেন এবার গরু কিনবেন, ইনশা-আল্লাহ’।
—‘মাশা-আল্লাহ! আমিও আজ সাদ্দামকে নিয়ে গরু কিনতে যাচ্ছি। চলো বাবা, ছালাতের সময় হয়ে গেছে, মসজিদে যাই’।
সেদিনই হায়দার উদ্দীন তার ছেলে সাদ্দামকে সাথে নিয়ে বাজার থেকে মাঝারি আকারের একটি গরু কিনে আনেন। কিন্তু সেই নিরীহ প্রাণীটি যেন সাদ্দামের হাতে পড়ে এক রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। গরুকে নিয়ে সে যা খুশি তাই করতে শুরু করল— ছোটদের ভয় দেখানো, অন্য কারো গরুর সাথে লড়াই লাগানো, এমনকি গরুর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা পর্যন্ত! গরুর প্রতি তার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে এলাকার সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠল।
আসলে সাদ্দাম একটি বড় গরু চেয়েছিল, কিন্তু হায়দার উদ্দীনের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবুও ছেলের জেদের কাছে হার মেনে তিনি ধারদেনা করে গরুটি কিনেছিলেন। অথচ ছেলেটি সেই সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধও দেখাল না।
ফাহিম, বয়সে সাদ্দামের সমকক্ষ হলেও তার ধারেকাছে ঘেঁষতে চায় না। কারণ সাদ্দাম তাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। সাদ্দামের বাবা প্রায়শই ফাহিমের উদাহরণ দিয়ে তাকে শাসন করেন, যা সাদ্দাম কখনোই মেনে নিতে পারে না। তাই সুযোগ পেলেই সে ফাহিমকে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করে। ফাহিম এসব দেখেও নীরব থাকে। সে জানে, হায়দার চাচা তার ছেলেকে ভালো করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করছেন। তাই সাদ্দামের কোনো অপকর্মের কথা সে কখনো হায়দার চাচাকে বলে না। তবে যখনই সাদ্দাম তার গরু নিয়ে ফাহিমকে জ্বালাতন করতে আসে, ফাহিম নীরবে সেখান থেকে সরে যায়।
ফাহিমের মনে চাপা কষ্ট হয়। প্রতি বছর তাদের পরিবার ছাগল কুরবানী করে আর অন্যরা গরু নিয়ে দম্ভ করে বেড়ায়। তাই রোজার ঈদের পর থেকেই ফাহিম তার বাবাকে অনুরোধ করেছিল, যেন এ বছর তারা গরু কুরবানী দেয়। ঈদের সেলামি হিসেবে পাওয়া নিজের জমানো টাকাও সে এর জন্য আলাদা করে রেখেছে।
মজিবর ভালো করেই জানেন যে, তাদের আর্থিক সামর্থ্য গরু কেনার মতো নয়। তবুও তিনি ছেলের ইচ্ছে পূরণের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কয়েকজনের সাথে ভাগে গরু কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তার স্বল্প অর্থের কারণে কেউই রাজি হয়নি। কারণ সকলেরই আগ্রহ বড় গরুর দিকে, যাতে বেশি মাংস পাওয়া যায়।
একদিন সন্ধ্যায় ফাহিম তার বাবার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
—‘বাবা, আমরা কবে গরু কিনতে যাব?’
মজিবর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের গভীরে এক তীব্র কষ্টের ঢেউ অনুভব করলেন। কীভাবে তিনি বলবেন যে, তাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়? মুখে মিথ্যে এক হাসির রেখা টেনে বললেন,
—‘শীঘ্রই যাব, বাবা’।
কিন্তু ফাহিম বাবার কণ্ঠের দুর্বলতা বুঝতে পারল। সে আবার বলল,
—‘বাবা, আমার কাছে কিছু টাকা আছে। তুমি চাইলে আমি সেই টাকাটা গরু কেনার জন্য দিতে পারি’।
কথাটা মিথ্যে নয়। ফাহিম রোজার ঈদে বেশ কিছু টাকা সেলামি পেয়েছে। আগের দুই ঈদের জমানো টাকাও তার কাছে রয়ে গেছে। সেই টাকাগুলো সে তার মায়ের কাছে জমা রেখেছে এবং মাঝে মাঝে মায়ের কাছে গিয়ে নিজের সঞ্চয় দেখে আসে। তার মাও ফাহিমের কষ্টের এই অর্থ খুব যত্নের সাথে আগলে রাখেন। অবশ্য, যখনই কোনো আর্থিক সংকট দেখা দেয়, তখন ছেলের এই জমানো টাকা থেকে তিনি খরচ করেন এবং হাতে টাকা আসার সাথে সাথেই তা পূরণ করে দেন। তাই ফাহিমের তার এই সঞ্চয়ের উপর অগাধ বিশ্বাস রয়েছে।
ছেলের কথা শুনে মজিবরের চোখ চিকচিক করে উঠল। এই টাকা তো তিনি ছেলের ভবিষ্যতের জন্য জমাতে বলেছিলেন, আর আজ সেই টাকাই ছেলে কুরবানীর গরু কেনার জন্য দিতে চাইছে! তার হৃদয় ব্যথায় ভরে উঠল, কিন্তু মুখে কোনো কথা সরল না।
এভাবে দিন পেরোতে লাগল, আর কুরবানীর ঈদের বাকি রইল মাত্র কয়েক দিন। সাদ্দাম তার ছোটখাটো গরুটি নিয়ে বেশ হইচই আর দাপাদাপির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ছোট গরু হলেও সে বড় বড় গরুর সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য প্রায়ই তাদের সাথে লড়াই লাগিয়ে দিচ্ছে। এতে তার গরুর সামান্য ক্ষতি হলেও সে যেন এক অদ্ভুত আনন্দ পাচ্ছে। বিষয়টি ফাহিমের মোটেও ভালো লাগছে না।
সময় বয়ে যায়, কুরবানীর ঈদও প্রায় দরজায় কড়া নাড়ছে। এরই মধ্যে সাদ্দাম তার গরু নিয়ে নানা ধরনের অন্যায় কাজ করেই যাচ্ছিল। একদিন গরুকে এতটাই জোরে দৌড়াতে বাধ্য করল যে, গরুটি গুরুতরভাবে আহত হলো।
পরের দিন সকালে ফাহিম জানতে পারল হায়দার চাচার গরুটি মারা গেছে। এক গভীর বিষণ্ণতা নিয়ে সে তাদের বাড়িতে গেল। সেখানে গিয়ে দেখল হায়দার উদ্দীন মৃত গরুর পাশে পাথরের মতো বসে আছেন, তার চোখে অশ্রুর বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে আর বুকের ভেতর যেন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।
চারিদিকে তিনি অন্ধকার দেখছেন। আগামীকাল ঈদ আর এখন হাতে একটিও টাকা নেই। এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত, যখন তার মনে এই ভাবনাগুলো ভিড় করছে, ঠিক তখনই ফাহিম এসে দাঁড়াল তার সামনে। শান্ত স্বরে বলল,
—‘চাচা, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর আফসোস করে কোনো লাভ নেই। বিপদে ধৈর্য ধরতে হয়। এটা আল্লাহর পরীক্ষা’।
হায়দার উদ্দীন হতবিহ্বল হয়ে ফাহিমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার পর ফাহিম বাড়ি ফিরে এলো। মাকে সবকিছু খুলে বলল। তারপর মিনতি করে বলল,
—‘মা, আমার জমানো টাকাটা দাও। আমি চাচাকে দেব’।
রহীমা প্রথমে অবাক হলেও ছেলের দৃঢ়তা দেখে আর দ্বিরুক্তি করলেন না। তার ছোট্ট ছেলে কী বলছে! মা একটু চিন্তা করলেন। তিনি জানেন হায়দার ভাই ফাহিমকে কতটা স্নেহ করেন। কিন্তু তাই বলে কি তিনি ছেলের কাছে টাকা চাইবেন? না, কখনোই না। তাহলে ফাহিম কি নিজেই টাকা দিতে চাইছে? যাই হোক, ছেলের উপর মায়ের অগাধ বিশ্বাস। তাই কোনো কথা না বাড়িয়ে তিনি ছেলেকে তার জমানো ৪ হাজার টাকা দিলেন। ফাহিম টাকাটা হাতে নিয়েই দ্রুত হায়দার উদ্দীনের বাড়ির দিকে রওনা হলো। ছেলেকে টাকা দেওয়ার কথা ফাহিমের মা তার স্বামীকে জানালেন।
এদিকে হায়দার উদ্দীন তার স্ত্রীকে বললেন সাদ্দামকে ঘরে ডেকে আনতে। বাবার ভয়ে ছেলেটা না জানি কোথায় পালিয়ে গেছে। ফাহিমের কথা শুনে হায়দার উদ্দীন কিছুটা সান্ত্বনা পেলেন এবং ধৈর্য ধরলেন। এখন কুরবানী কীভাবে দেওয়া যায়, তার একটা হিসাব মেলানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। কারণ কুরবানী দিতে হলে আজই কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু গরু কেনা তো দূরের কথা, একটা ছাগল কেনার মতো নগদ টাকাও তার হাতে নেই। কুরবানী উপলক্ষ্যে দোকানের জন্য তিনি বেশ কিছু মালামাল তুলেছেন, তাই হাতে তেমন নগদ অর্থ নেই। তাই ভাবলেন, কারো কাছ থেকে ধার করে হলেও একটা ছাগল কিনতে হবে।
এইসব দুশ্চিন্তার মাঝে ফাহিম এসে উপস্থিত হলো হায়দার উদ্দীনের কাছে। ততক্ষণে সাদ্দামও বাড়িতে ফিরে এসেছে। ফাহিমকে তার বাবার কাছে দেখে সাদ্দামের মনে হলো, ফাহিম নিশ্চয়ই তার নামে বিচার দিয়েছে। কারণ সে জানে, তার খারাপ ব্যবহারের কারণেই গরুটি মারা গেছে, আর সেটা ফাহিমও দেখেছে।
টাকা হাতে নিয়েই ফাহিম হায়দার উদ্দীনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল এবং বলল,
—‘চাচা, এই টাকাটা রাখেন। একটা ছাগল কিনে কুরবানী দেন। এটা আমারই টাকা। ঈদের সেলামির টাকা’।
হায়দার উদ্দীন প্রথমে কোনো কথা বলতে পারলেন না। তার চোখ জলে ভরে গেল। এমন দিনে, এমন কঠিন পরিস্থিতিতে, এত ছোট একটি ছেলের এই মহানুভবতা— তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি।
ফাহিম আরও বলল,
—‘চাচা, এই টাকা আমি মায়ের কাছ থেকে নিয়ে এসেছি। কোনো চিন্তা করবেন না’।
টাকাটা দিয়েই ফাহিম দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। হায়দার উদ্দীন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠিক তখনই তিনি তার ছেলেকে দেখতে পেলেন এবং বললেন,
—‘দেখেছিস, ভালো ছেলে কাকে বলে?’
সাদ্দাম বুঝতে পারল, সত্যিই তো, ভালো ছেলে তো ফাহিম। সে জানে, ফাহিম তার বাবাকে গরু কেনার কথা বলেছিল। কিন্তু তার বাবা গরুটি কিনতে পারেননি। এটা নিয়ে সাদ্দাম ফাহিমকে অনেক টিটকারিও মেরেছে। অথচ আজ তার গরু নেই, ছাগল কেনারও টাকা নেই, আর সেই মুহূর্তে ফাহিম তার জমানো টাকা নিয়ে এগিয়ে এসেছে।
অবশেষে হায়দার উদ্দীন মজিবরকে ডেকে আনলেন এবং সবকিছু খুলে বললেন। তারা দুজনে মিলে বাজারে গিয়ে দুটি ছাগল কিনে আনলেন— একটি ফাহিমের জন্য, অন্যটি সাদ্দামের জন্য।
কুরবানীর ঈদের দিনে দুটি পরিবারই আনন্দের সাথে ঈদ উদযাপন করল।
ঈদের ছালাত শেষে মজিবর ফাহিমকে কাছে ডেকে বললেন,
—‘বাবা, জানো কুরবানীর আসল শিক্ষা কী?’
—‘না বাবা’।
—‘কুরবানী মানে শুধু পশু যবেহ করা নয়; কুরবানী মানে হলো নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটিকে আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগ করা। আজ তুমি তোমার আনন্দ, তোমার স্বপ্ন—সব ত্যাগ করেছো অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। ঠিক যেমন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম করেছিলেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য’।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।