(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
আমি আয়েশা। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে আমার বসবাস। আমি একজন উইঘুর মুসলিম। মুসলিম ঘরে জন্ম নেওয়া যে কত বড় অপরাধ, তা হাড়ে হাড়ে টের পাই! আমরা এখানে সব সময় নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দুধের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নারী-পুরুষ সবাই চরম যুলুমের শিকার।*
আমার আব্বু সব সময় আতঙ্কিত থাকেন। আম্মুকে সর্বদাই চিন্তিত, কান্নারত দেখতাম। একদিন গভীর রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখি বাসায় সেনাবাহিনীর লোকেরা এসে ঘর-দরজা সব ভেঙে ফেলছে। ঘরে আসবাবপত্র সব চুরমার করে দিয়েছে। তারা খুঁজে খুঁজে কুরআনের একটি কপি পেয়ে তা পদদলিত করে ছিঁড়ে কুঁচি কুঁচি করে ফেলল।
বাবা প্রতিবাদ করলেন। সাথে সাথে কয়েকজন ছুটে এসে বাবাকে প্রচণ্ডভাবে প্রহার করতে লাগল। আমি আর আম্মু ভয়ে কাঁদতেও ভুলে গেলাম। আম্মু আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখলেন। বাবা মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। অজ্ঞান হতে হতেও তিনি আম্মুকে বললেন, ‘আমার আয়েশাকে নিরাপদে নিয়ে যাও’। এরপর বাবাকে তারা আমাদের সামনেই লাথি মেরে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে, শরীরের চামড়া কেটে দিয়ে, হাড় ভেঙে গুড়ো গুড়ো করে, সারা শরীর থেঁতলে দিয়ে মেরেই ফেলল। আমি আর আম্মু বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আম্মুকে দেখে মনে হলো যেন বোবা হয়ে গিয়েছেন। আমি এক পর্যায়ে বাবা বাবা বলে কান্নাকাটি করতে লাগলাম। কিন্তু আমার কান্নাও তাদের সহ্য হলো না।
একজন এসে আমার ছোট্ট শরীরে দড়াম করে এক লাথি মারল। সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তারপর কী হলো জানি না।
এক পর্যায়ে হুঁশ ফিরে এলো। দেখি একটি নতুন স্থানে পুরাতন স্যাঁতসেঁতে ঘরে আমাকে ঠাণ্ডা মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে। আম্মু কোথায় জানি না। জ্ঞান হারানোর পূর্বে আম্মুকে টেনে-
হিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখেছিলাম। দেখেছিলাম আমার বাড়িসহ পুরো এলাকা আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। তারপর কিছু মনে নেই।
আমি আম্মু আম্মু বলে কাঁদতে লাগলাম। সারা শরীর ব্যথা। প্রচণ্ড ক্ষুধা আমাকে এমনভাবে গ্রাস করল যে, নড়ারও শক্তি পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার পাশে আরো দুটি মেয়ে। আমার বয়স ১২ বছর। আমার ডানের জনের বয়স আনুমানিক ৭ বছর হবে। তার পাশের জনের বয়স মাত্র ৩/৪ বছর। তারাও আমার মতোই ক্ষুধার্ত ও আহত। আমরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম। কিন্তু কথা বলার মতো অবস্থা কারোরই নেই। এরই মধ্যে আমি তাদের দুজনের নাম জেনে নিতে চেষ্টা করলাম। তাদের বাসা কোথায়, বাবা-মা কে, কিছুই জানতে পারলাম না। কারণ আমিও কথা বলতে পারছিলাম না। তারাও শারীরিক ও মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত। তাছাড়া ছোট্টটা তো এমনিতেই কিছু জানে না।
হঠাৎ দরজা খুলে গেল। একজন ষণ্ডা-মার্কা লোক ঢুকল। তার মাথা নেড়ে। বুঝলাম সে একজন বৌদ্ধ হান। সে আসা মাত্রই আমাকে লোহার বা এ জাতীয় একটা লাঠি দিয়ে পিটাতে লাগল। আমি বয়সে বড় ছিলাম। তাই আমাকেই প্রথমে লক্ষ্য করে। আমার শরীরের যেখানে মার পড়েছে, সাথে সাথে চামড়া ফেটে গিয়ে রক্ত পড়তে থেকেছে।
একটানা ৫/৬ মিনিট মার খেয়ে আমি অবশ হয়ে নেতিয়ে পড়ি। অজ্ঞান হবার পূর্বমুহূর্তে দেখতে পেলাম, সেই অমানুষটা ৭ বছরের মেয়েটিকে মারছে। মেয়েটি এই মার সহ্য করতে না পেরে ঘরময় ছুটাছুটি করতে লাগল। এক পর্যায়ে সে মেঝেতে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। এরপরও সেই যালেম মার বন্ধ করল না। একটানা মার খেয়ে সে এতটাই আহত হলো যে, আমার মনে হচ্ছিল সে মারা গেছে।
আমি আধবোজা চোখ দিয়ে দেখতে পেলাম যে, সর্বশেষ সেই ৩/৪ বছরের নিষ্পাপ কোমল, কচি বাবুটিকে ধরল। তাকে কয়েকটি বাড়ি দিতেই সে মা, মা বলে চিৎকার করে পড়ে গেল। পড়ার সময় তার মাথা মেঝেতে জোরে বাড়ি খেল। সে যে পড়ে গেল, আর উঠতে পারল না। নরপশুটির আঘাতে সে ইহকাল ত্যাগ করল।
এক পর্যায়ে লোকটা গালিগালাজ করতে লাগল। আমাদের গালি দেবার সময় ইসলাম, মুসলিম, আল্লাহ, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কেও প্রচণ্ড রোষে গালিগালাজ করছিল। আমি আর থাকতে পারলাম না। চোখের চারপাশে ঘোর অমানিশা নেমে এলো।
তারপর কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম জানি না। এক সময় চোখ দুটি মেলে ধরতে চেষ্টা করলাম। কোনোভাবেই মাথা তুলতে পারছিলাম না। দীর্ঘক্ষণ যাবৎ এক ফোটা পানিও পান করতে পারিনি। ক্ষিদের অনুভূতিটা সেই কবেই শেষ হয়েছে! আমি ব্যাকুল হয়ে ‘আম্মু আম্মু’ বলে কাঁদছিলাম। আমার গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছিল না। ক্ষীণকণ্ঠে কয়েকবার ডাকার পর আর শব্দ বেরুল না। জানি না, আম্মুর এখন কী অবস্থা!
পাশে দুজনেই নিথর হয়ে পড়ে আছে। এর কিছুক্ষণ পর লোকটি আরেক জনকে নিয়ে আসলো। তারা এসে ধরাধরি করে ছোট্ট মেয়েটাকে তুলে নিয়ে বাড়ির পেছনে নিয়ে গেল। একটু পর শব্দ পেলাম। বুঝতে পারলাম বাবুটাকে তারা আবর্জনা বা ঝোপ-জঙ্গলে ফেলে দিয়েছে।
আমার সমস্ত কষ্ট ছাপিয়ে বাবুটার মৃত্যু বারংবার পীড়া দিতে লাগল। আমি চিন্তা করতেও পারছিলাম না। পাশের জনের গায়ে টোকা দিলাম। সে একটু নড়ে উঠল।
আমার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু চোখ দিয়ে কোনো পানি পড়ছে না। কীভাবে পড়বে? শরীরে কি এক ফোটা পানিও আছে? বাবার মুখে শুনেছিলাম, ‘আইলান কুর্দি’র কথা। আমিও যদি তার মতো সাগরে ভেসে মারা যেতাম, তাহলে কতই না ভাল হতো! ঘরের দরজা আবারো খুলে গেল। আমার মনে আর কোনো ভয় কাজ করছে না। ভয় করার মতো অবস্থাও নেই। আমি এখন অনুভূতিহীন একজন মানুষ। আমি কীভাবে বেঁচে আছি সেটাই জানি না। কেন বেঁচে আছি তা কি বলে দিবে তোমরা? লোকটি আবার এলো। এসে আমার মুখে এক টুকরো বাসি রুটি ছুড়ে দিল। মেঝেতে পানি ঢেলে দিয়ে বলল, মেঝে চেটে যেন পিপাসা নিবারণ করি।
আমি জানি না, কীভাবে এখান হতে মুক্তি পাব। কেউ আমাদের বাঁচাতে আসবে কি না, জানি না। এরপরের প্রতিটি মুহূর্ত কীভাবে কাটবে তা ভাবতেও পারছি না। একটি কথাই বারবার মনে আসছিল, আমরা কী দোষ করেছিলাম?
আমি জানি না, ভবিষ্যতে আর কত নির্যাতন সইতে হবে। আমি জানি না, আমি এত আঘাত নিয়ে এখনো কীভাবে বেঁচে আছি। এ দুনিয়াতে আমি কোনো বিচার পাব? নাইবা পেলাম। কিয়ামতে তো আল্লাহকে পাব। সেদিন আমি আল্লাহকে সব বলে দিব...।
* সৈয়দপুর, নীলফামারী।