কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

লড়াকু সৈনিক

post title will place here

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একান্ত প্রিয়ভাজন। জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিক দিয়ে তৎকালীন আরবের কতিপয় ব্যক্তির অন্যতম। দৈহিক গঠন, চালচলন, কথাবার্তা প্রভৃতির মাঝে নেতৃত্বের অভিব্যক্তি। দুঃসাহসের মূর্ত প্রতীক। দানের হাত উদার! প্রশস্ত চিত্তে আল্লাহর রাস্তায় দান করেন। সেই উদার মনের লড়াকু সৈনিক আমর ইবনুল ‘আছ রযিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের প্রাথমিক কালে ইসলামের চরম দুশমন। কুরাইশ নেতৃবৃন্দের সাথে একাত্ম হয়ে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরোধিতায় তার ছিল দারুণ উৎসাহ। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু‘আ করলেন। কুরাইশদের প্রধান তিন পুরুষের ব্যাপারে। সেই তিন জনের একজন হলেন আমর ইবনুল ‘আছ রযিয়াল্লাহু আনহু। খন্দকের যুদ্ধে কুরাইশ পক্ষের নেতা সেজে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসেন। খন্দকের পর তার মধ্যে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাফল্য সম্পর্কে পূর্ণ বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল। মনে উদয় হয়েছিল, বিজয়ী হওয়ার জন্যই ইসলামের আবির্ভাব। এ বিশ্বাস তাকে ইসলাম গ্রহণে উৎসাহিত করে। ৭ম হিজরী খায়বার বিজয়ের বছর খালেদ ইবনে ওয়ালিদসহ আমর ইবনুল ‘আছ রযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন।

ইসলাম গ্রহণের কিছুদিন পর তিনি মদীনায় হিজরত করেন। তিনি বলেন, ‘আমার কাফের অবস্থায় আমি ছিলাম রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বড় দুশমন। তখন মারা গেলে জাহান্নামই হতো আমার ঠিকানা। আর মুসলিম হওয়ার পর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও আমার চোখের আড়াল হতে পারতেন না। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরব উপদ্বীপের আশেপাশের রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করে চিঠি লিখেন। আমর ইবনুল ‘আছ রযিয়াল্লাহু আনহু ওমানের শাসকের নিকট রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চিঠি নিয়ে যান। ওমানের শাসক চিঠি পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলিমবাহিনী চারদিক থেকে সিরিয়ায় অভিযান চালায়। রোমান সম্রাট তাদের মোকাবিলার জন্য ভিন্ন ভিন্ন বাহিনী পাঠায়। আজনাদাইনে তারা সমবেত হয়। আমর ইবনুল ‘আছ রযিয়াল্লাহু আনহু ফিলিস্তীন থেকে আজনাদাইনে অগ্রসর হলে খালেদ ইবনে ওয়ালিদ ও আবূ উবাইদা বাছরা অভিযান শেষ করে আমরের সাহায্যের জন্য আজনাদাইনে পৌঁছেন।

প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হলো। নিহত হলো রোমান সেনাপতি। যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল। রোমানরা পরাজয় বরণ করল। মুসলিমবাহিনীর ধারাবাহিক আক্রমণে রোমানবাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে থাকে।

অবশেষে সম্রাটের নির্দেশে মুসলিমবাহিনীকে চূড়ান্তভাবে প্রতিরোধ করার জন্য ‘ইয়ারমুক’ নামক স্থানে দুই লাখ সৈন্য পাঠান। ইয়ারমুকের এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আমর ইবনুল ‘আছ রযিয়াল্লাহু আনহু অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন। রোমানবাহিনী এবারও পরাজয় বরণ করে। সিরিয়ায় ইসলামের ঝাণ্ডা সমুন্নত হয়। সিরিয়া বিজয় সমাপ্ত হয়। খলীফা উমার রযিয়াল্লাহু আনহু-এর অনুমতি প্রার্থনা করলেন আমর ইবনুল ‘আছ রযিয়াল্লাহু আনহু, যাবেন মিসর বিজয়ে। জাহেলী যুগে ব্যবসার সুবাদে মিসর সম্পর্কে তার অনেকটা অভিজ্ঞতা ছিল। প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন খলীফা। তাকে সাহায্যের জন্য খলীফা উমার রযিয়াল্লাহু আনহু যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে সাথে দিলেন। আমর ইবনুল ‘আছ রযিয়াল্লাহু আনহু একে একে মিসরের বিভিন্ন রাজ্য জয় করলেন। অতঃপর ইসকান্দারিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য খলীফা উমারের অনুমতি চেয়ে পাঠান। অনুমতি পেয়ে ইসকান্দারিয়া অবরোধ করেন।

কেটে গেলো দুটি বছর। খলীফা উমার রযিয়াল্লাহু আনহু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। আমরকে চিঠি লিখলেন, তোমরা দুই বছর ধরে অবরোধ করে বসে আছো। এখনো কোনো ফলাফল প্রকাশ পেল না। মনে হচ্ছে রোমানদের মতো তোমরাও ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে বসেছো। আমার চিঠি যখন তোমার হাতে পৌঁছবে, তখনই লোকজন ডেকে তাদের সামনে জিহাদ সম্পর্কে ভাষণ দিবে এবং আমার এ চিঠি পাঠ করে শুনাবে। তারপর জুমআর দিন শত্রুবাহিনীর উপর আক্রমণ চালাবে। খলীফার নির্দেশে শত্রুবাহিনীর উপর আক্রমণ চালালে অল্প সময়ের ব্যবধানে ইসকান্দারিয়া মুসলিমবাহিনীর অধিকারে আসে। এভাবে আমর ইবনুল ‘আছ রযিয়াল্লাহু আনহু লড়াকু সৈনিক হিসেবে অনেক দেশ দখল করে খ্যাতি অর্জন করেন।

তিনি মৃত্যুর শয্যায় শায়িত। আব্দুর রাহমান ইবনু শাম্মাসা তাকে দেখতে এলেন। আমর ইবনুল ‘আছ রযিয়াল্লাহু আনহু দেয়ালের দিকে মুখ করে কাঁদতে লাগলেন। ছেলে আব্দুল্লাহ জানতে চাইলেন কাঁদার কারণ। বাবা কাঁদছেন কেন? রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি আপনাকে অমুক অমুক সুসংবাদ দেননি? আমর রযিয়াল্লাহু আনহু অশ্রুভেজা চোখে জবাব দিলেন, আমার জীবনের তিনটি পর্ব অতিক্রান্ত হয়েছে। একটি পর্ব এমন গেছে যখন আমি ছিলাম কট্টর দুশমন। আমার চরম বাসনা ছিল, যে কোনোভাবেই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করা। তারপর আমার জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে ইসলাম কবুল করলাম। তখন আমার এমন অবস্থা যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর চেয়ে কোনো ব্যক্তি আমার কাছে অধিকতর প্রিয় বা সম্মানিত বলে মনে হয়নি।

অতিরিক্ত সম্মান এবং ভীতির কারণে তার প্রতি আমি ভালো করে চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। কেউ যদি এখন আমাকে তাঁর চেহারা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে আমি বলতে পারব না। তখন যদি আমার মরণ হতো, জান্নাতের আশা ছিল। এরপর আমার জীবনের তৃতীয় পর্ব। এ সময় নানা কাজে আমি জড়িয়েছি। জানি না এর পরিণাম কী হবে। আমার মৃত্যু হলে বিলাপকারীরা যেন আমার জানাযার সাথে না যায়। দাফনের সময় ধীরে ধীরে যেন মাটি চাপা দেয়। দাফনের পর একটি জন্তু যবেহ করে গোসত ভাগবাঁটোয়ারা করে নেওয়া যায়, এতটুকু সময় পর্যন্ত কবরের কাছে থাকবে। যাতে আমি তোমাদের উপস্থিতিতেই কবরের সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে পারি। আল্লাহর ফেরেশতাদের প্রশ্নের জবাব ঠিক ঠিকভাবে দিতে পারি।

আমর ইবনুল ‘আছ রযিয়াল্লাহু আনহু ! ধন্য জীবন! বেশির ভাগ জীবন কেটেছে মুজাহিদ বেশে। জিহাদের ময়দানই যেন তার বালাখানা। এ কারণে জ্ঞান অর্জন বা চর্চার সময় ও সুযোগ তিনি কম পেয়েছেন। কুরআন পড়ে তিনি বিশেষ পুলক ও স্বাদ অনুভব করতেন।

বৈশিষ্ট্য! সে এক অনন্য মানুষ। বিরল দৃষ্টান্ত। সাহিত্য ও রসিকতায় পারদর্শী। সে যুগের তিনিই শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক। অল্পকথায় অধিক ভাব প্রকাশ, সুন্দর উপমা প্রয়োগ এবং কাব্য ও ভাবের অলংকরণ তার সাহিত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ঈমানের বলিষ্ঠতা সম্পর্কে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন যে, লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছে, আমর ইবনুল ‘আছ রযিয়াল্লাহু আনহু ঈমান এনেছে।

মহিউদ্দিন বিন জুবায়েদ

মুহিমনগর, চৈতনখিলা, শেরপুর।

Magazine