কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

উহুদের বীরত্বগাথা

post title will place here

উহুদের ময়দান! এমন একটা হাল হয়েছিল গিরিপথ ছেড়ে দেওয়ায়, যা বিজয়ের একটু আগে পরাজয় সমীরণ বয়ে দেয়। এজন্য প্রতিটা কাজে নেতার আদেশ হিসেব করে করে পালন করতে হয়। তাতে হতাশা, সুখে-দুখে, জয়-পরাজয়ে অনেক কাজে দেয়। দেখুন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেমন কথা বলছিলেন অধিনায়কদের উদ্দেশ্যে। ‘ঘোড়সাওয়ারদেরকে তির মেরে আমাদের কাছ থেকে দূরে রাখবে। তারা যেন পেছন থেকে কোনোভাবেই আমাদেরকে ঘায়েল করতে না পারে। সাবধান! আমাদের জয়-পরাজয় যাই হোক না কেন, তোমাদের দিক থেকে যেন আঘাত না আসে’।[1] তারপর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় অধিনায়কদেরকে বললেন, ‘আমাদের পেছনের দিক তোমরা হেফাযত করবে। যদি দেখো, আমরা মারা পড়ছি, তবুও আমাদের দিকে এগিয়ে এসো না। যদি দেখো যে, আমরা গনীমতের মাল আহরণ করছি, তবুও আমাদের সাথে তোমরা অংশ নিয়ো না’।[2]

ভুলে গেলেন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী! বিজয়ের খুশিতে গিরিপথ ছেড়ে গনীমতের আকাঙ্ক্ষায় ময়দানে পা রাখলেন তির চালানো সেনানীগণ। ফলে বিজয়ের আগেই উহুদের ময়দানে সমরের মোড় ঘুরে গেল। খালেদ ইবনে ওয়ালীদ গিরিপথ ফাঁকা পেয়ে তরবারির আঘাতে এলোমেলো করে দেন মুসলিম সেনাদের। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও আহত হন। ৭০ জন ছাহাবী শহীদ হন। মুশরিকদের দৃঢ় বিশ্বাস- নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিহত হয়েছেন, ফলে তারা তাদের শিবিরে ফিরে মক্কায় ফিরে যেতে শুরু করে। এদিকে মুশরিকদের কিছু নারী-পুরুষ মুসলিম শহীদদের নাক, কান কাটতে থাকে। হিন্দ বিনতে উতবা হামযা রযিয়াল্লাহু আনহু-এর লাশ থেকে কলিজা বের করে মুখে নিয়ে চিবাতে থাকে এবং ওটাকে গিলে নিতে চায়। গিলতে না পেরে থুথু করে ফেলে দেয়। এছাড়া কাটা নাক ও কান দিয়ে মালা গেঁথে গলা এবং পায়ে মলের মতো পরিধান করে।[3]

নিজের আপন চাচার লাশের সাথে হিন্দ এমন আচরণে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনে মনে খুবই আহত হন। ছাহাবীদের গিরিপথ ছেড়ে দেওয়াতেও এত আহত হননি।

কা‘ব ইবনে মালেক রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি ছিলাম ওই মন-মানসিকতার মুজাহিদদের অন্যতম। আমি খেয়াল করলাম যে, মুশরিকদের হাতে শহীদদের অবমাননা চলছে। আমি খানিকটা থেমে এগিয়ে গেলাম। খেয়াল করলাম যে, বর্ম পরিহিত বিশালদেহী একটি লোক শহীদদের লাশের পাশ দিয়ে চলছে। আর একজন মুসলিম এই লোকটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি উভয়ের প্রতি তাকালাম, মনে মনে উভয়ের জোর পরিমাপ করলাম। আমার মনে হলো যে, কাফের লোকটির সমরসাজের মালামাল মুসলিমের চেয়ে ভালো। আমি অপেক্ষা করছিলাম। এক সময় উভয়ে লড়াই শুরু করল। সেই মুসলিম ওই কাফেরকে তরবারি দিয়ে এমন এক আঘাত করলেন যে, কাফের দুটুকরো হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সেই মুখোশ পরিহিত মুসলিম নিজের মুখোশ খুললেন। এরপর বললেন, ওহে কা‘ব! কেমন হলো কাজটা? আমি হচ্ছি আবূ দুজানা।[4]

লড়াই শেষে কিছু মুসলিম মহিলা জিহাদের ময়দানে পৌঁছেন। আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি আয়েশা বিনতে আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহা-কে ও উম্মে সুলায়েম রাযিয়াল্লাহু আনহা-কে দেখেছি যে, তাঁরা কাপড় গুছিয়ে নিয়ে পিঠের ওপর পানির মশক বহন করে আনছেন এবং পানি বের করে আহতদের মুখে দিচ্ছেন।[5] উমার রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, উহুদের দিন উম্মে সালীত রাযিয়াল্লাহু আনহা আমাদের জন্য মশক ভরে ভরে পানি আনছিলেন।[6] এদের একজন উম্মে আয়মান রাযিয়াল্লাহু আনহাও ছিলেন। তিনি পরাজিত মুসলিমদের মদীনায় ঢুকতে দেখে তাদের মুখে ধূলি ছিটিয়ে বলছিলেন, এই নাও সুতা কাটার মেশিন, আর তোমাদের তরবারি আমাদের হাতে দাও। (এখানে আমাদের দেশি ভাষায় বলা যায়— এই চুড়ি তোমরা পরিধান করো, তরবারি আমাদের হাতে দাও)।

এরপর তিনি সেখানে পৌঁছে আহতদের পানি পান করাতে লাগলেন। তাঁর ওপর হিব্বান ইবনে ওরাকা তির চালিয়ে দেয়। ফলে পড়ে যাওয়ায় গা থেকে কাপড় সরে যায় তার। এ দেখে দুশমনরা হো হো করে হেসে ওঠে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এটা খুব কঠিন লাগে এবং তিনি সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাছ রযিয়াল্লাহু আনহু-কে একটি পালকবিহীন তির দিয়ে বলেন, ‘এটা চালাও’। সা‘দ রযিয়াল্লাহু আনহু ওটা চালিয়ে দিলে ওটা হিব্বানের গলায় লেগে যায় এবং সে চিত হয়ে পড়ে যায়। গা থেকে তার কাপড়ও সরে যায়। এ দেখে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন হাসেন যে, তাঁর দাঁত দেখা যায় এবং তিনি বলেন, ‘সা‘দ উম্মে আয়মানের বদলা গ্রহণ করেছে, আল্লাহ তাঁর দু‘আ কবুল করেছেন’।[7]

মনে রাখবেন, কারো বিপদে আপনি হাসবেন না, তাহলে আপনার বিপদেও কেউ হাসবেন। সবাই হাসতে জানে। এটা মনে রাখবেন।

মহিউদ্দিন বিন জুবায়েদ

মুহিমনগর, চৈতনখিলা, শেরপুর।


[1]. সীরাতে ইবনে হিশাম, ২/৬৫-৬৬।

[2]. ফাতহুল বারী, ৭/৩৫০।

[3]. সীরাতে ইবনে হিশাম, ২/৯০।

[4]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/১৭।

[5]. ছহীহ বুখারী, হা/২৮৮০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮১১।

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/২৮৮১ ও ৪০৭১।

[7]. আস-সীরাতুল হালাবিয়্যাহ, ২/২২।

Magazine