কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ঈদে মীলাদুন নবী: পরিচয়, উৎপত্তি, শারঈ হুকুম ও করণীয়

post title will place here

ভূমিকা:

ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যা কুরআন ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত। মুসলিমদের যাবতীয় ইবাদত, উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতা এই দুটি মূল উৎসের ভিত্তিতে পরিচালিত। আজকাল হিজরী বর্ষের রবীউল আউয়াল মাসে মুসলিমসমাজে ‘ঈদে মীলাদুন নবী’ নামে একটি দিনকে ঈদ হিসেবে পালন করা হয়, যা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিন হিসেবে পরিচিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই দিবসটি পালন করা কি ইসলামী শরীআতে দলীলসম্মত? রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে কিংবা তাঁর ছাহাবীরা কি কখনো এই দিন পালন করেছেন?

ইতিহাস ও হাদীছ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঈদে মীলাদুন নবী পালনের প্রচলন বহু বছর পর চালু হয়েছে, যা ইসলামের মূল আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই প্রবন্ধে ঈদে মীলাদুন নবীর পরিচয়, উৎপত্তি, শারঈ হুকুম ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

‘ঈদে মীলাদুন নবী’-এর পরিচয়:

‘ঈদে মীলাদুন নবী’ একটি বহুল প্রচলিত পরিভাষা। এ নামটি তিনটি আরবী শব্দের সমন্বয়ে গঠিত, শব্দ তিনটি হলো عید (ঈদ), میلاد (মীলাদ) ও النبي (নবী)।

ঈদ (عيد)-এর পরিচিতি:

আভিধানিক অর্থ: عيد শব্দটি আরবী, বহুবচনে أَعْيَاد; যার অর্থ হলো বারংবার ফিরে আসা, সমবেত হওয়া, আনন্দ, উৎসব ইত্যাদি।

পারিভাষিক অর্থ: ঈদ-এর সংজ্ঞায় শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

أَنَّ الْعِيدَ اسْمٌ لِمَا يَعُودُ مِنَ الِاجْتِمَاعِ الْعَامِّ عَلَى وَجْهٍ مُعْتَادٍ، عَائِدٌ: إِمَّا بِعَوْدِ السَّنَةِ، أَوْ بِعَوْدِ الْأُسْبُوعِ، أَوِ الشَّهْرِ، أَوْ نَحْوِ ذَٰلِكَ.

‘ঈদ এমন সমাবেশের নাম- যা বছর, মাস, সপ্তাহ বা এরকম কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিত ফিরে আসে’।[1] এই ঈদ সময়কেন্দ্রিক, আবার স্থানকেন্দ্রিকও হয়ে থাকে।

মীলাদুন নবী (ميلادالنبي) -এর পরিচিতি:

আভিধানিক অর্থ:ميلاد (মীলাদ) শব্দটি আরবী, যার অর্থ জন্ম বা জন্মকাল আর النبي (নবী) শব্দটি আরবী হলেও তা সকল মুসলিমের বোধগম্য। উদ্দেশ্য হলো নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সুতরাং ‘ঈদে মীলাদুন নবী’-এর অর্থ হলো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মে খুশি বা উৎসব। 

পারিভাষিক অর্থ: নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম উপলক্ষ্যে যে আনুষ্ঠানিকতা বা উৎসব পালন করা হয়, তাকে ঈদে মীলাদুন নবী বলা হয়।

সাধারণত, বর্তমানে ১২ রবীউল আউয়ালকে শেষ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিন ধরে কিছু সুবিধাবাদী আলেমের পৃষ্ঠপোষকতায় ওয়ায-নছীহত, যিকির-আযকার ও ক্বিয়াম করে পরিশেষে মিষ্টিমুখ করে যে অনুষ্ঠান ত্যাগ বা সমাপ্ত করা হয়, সেটাই হলো ঈদে মীলাদুন নবী।

‘ঈদে মীলাদুন নবী’-এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ:

ঈদে মীলাদুন নবীর ভিত্তি কুরআন ও ছহীহ হাদীছে খুঁজে পাওয়া যায় না। ইতিহাসের পাতায় তাকালে দেখা যায় প্রাক ইসলামী যুগেও এ জাতীয় আচার-অনুষ্ঠান ছিল, যেমন— গ্রীক, ইউনান, ফারা‘এনা ইত্যাদি সভ্যতায় তারা স্বীয় দেবতার অনুষ্ঠান উদযাপন করত। তাদের থেকে গ্রহণ করেছে তাদের পরবর্তী খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। যাদের কাছে বড় ঈদ হলো তাদের নবীর জন্ম উৎসব পালন করা। খ্রিষ্টানদের জন্মোৎসব বা বড় দিবসের অনুষ্ঠান শুধু প্রাক ইসলামী যুগেই পালন করা হতো না; বরং আজও তারা পালন করে চলেছে, সেখান থেকেই অনুসৃত হয়ে মুসলিম সমাজে এসেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, কখন থেকে মুসলিম সমাজে এ অনৈসলামিক রীতির অনুপ্রবেশ ঘটল এবং কার মাধ্যমে ঘটল?

সর্বপ্রথম ঈদে মীলাদুন নবী উদযাপন: ঈদে মীলাদুন নবী এর পক্ষে ও বিপক্ষে সকল আলেম একমত যে, এ মীলাদুন নবীর উৎসব নবী, ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈদের মাধ্যমে কখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। অবশ্যই এসব উত্তম যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর এ বিদআতের উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু কোন সময় এবং কার মাধ্যমে এ বিদআতের উদ্ভব ঘটল, এ নিয়ে ইসলামী মনীষীগণ দুটি মত ব্যক্ত করেছেন—

(ক) হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে সর্বপ্রথম মিসরে ফাতেমীয় সাম্রাজ্যে এ বিদআতের উদ্ভব ঘটে। তারা সর্বপ্রথম ছয়জন ব্যক্তির জন্মোৎসব পালন করে। তারা হলেন— ১. নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ২. আলী, ৩. হাসান, ৪. হুসাইন, ৫. ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহুম ও ৬. তৎকালীন ফাতেমীয় সম্রাজ্যের খলীফা। তখন হতে ফাতেমীয় বা শীআ সম্প্রদায়ের খলীফাগণ নিজ উদ্যোগে জাতীয়ভাবে ছয়জনের জন্মদিবস পালন করতেন।[2]

(খ) হিজরী সপ্তম শতাব্দীর প্রথমদিকে ইরাকের মাওছেল বা মোছেল শহরে তৎকালীন বাদশাহ আল-মুযাফফার-এর পৃষ্ঠপোষকতায় দরবারী আলেম উমার ইবনে মুহাম্মাদ মোল্লা-এর পরিচালনায় সর্বপ্রথম নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হয়।[3]

ইমাম আবূ শামাহ রাহিমাহুল্লাহ উক্ত দুটি মতের সমন্বয় সাধন করতে গিয়ে বলেন, বস্তুত সর্বপ্রথম যারা এ বিদআতের উদ্ভব ঘটায়, তারা হলো ফাতেমী বা শীআ সম্প্রদায়। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে তারা মিসরের রাজধানী কায়রোতে এ বিদআতের আবির্ভাব ঘটায়, অতঃপর সেখান থেকে ফাতেমী সম্প্রদায়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লে ইরাকের মাওছেল শহরে সর্বপ্রথম বাদশাহ মুযাফফার-এর পৃষ্ঠপোষকতায় এ বিদআত চালু হয়। যদিও অন্য অঞ্চলে তা আগেই উদ্ভব হয়েছিল, কিন্তু ইরাকে মাওছেল শহরে তার মাধ্যমেই প্রথম চালু হয়।[4]

আরেক বর্ণনা মতে, ক্রুসেড বিজেতা মিসরের সুলতান ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী (৫৩২-৫৮৯ হি.) কর্তৃক নিযুক্ত ইরাকের ‘এরবেল’ এলাকার গভর্নর আবূ সাঈদ মুযাফফরুদ্দীন কুকবুরী (৫৮৬-৬৩০ হি.) সর্বপ্রথম ৬০৪ হিজরীতে, মতান্তরে ৬২৫ হিজরীতে মীলাদের প্রচলন ঘটান, যা ছিল রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর ৫৯৩ বা ৬১৪ বছর পরে। এই দিন তারা ঈদে মীলাদুন নবী উদযাপনের নামে নাচ-গানসহ চরম স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হতো। গভর্নর নিজে নাচে অংশ নিতেন। আর এই অনুষ্ঠানের সমর্থনে তৎকালীন আলেম সমাজের মধ্যে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন আবুল খাত্ত্বাব উমার ইবনে দেহইয়াহ (৫৪৪-৬৩৩ হি.)। তিনি মীলাদের সমর্থনে বহু জাল ও বানোয়াট হাদীছ জমা করে বই লেখেন এবং ১ হাজার স্বর্ণমুদ্রা বখশিশ পান।[5]

‘ঈদে মীলাদুন নবী’ পালন করার শার হুকুম:

ঈদে মীলাদুন নবী উদযাপন করা একটি সুস্পষ্ট বিদআত। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ঈদে মীলাদুন নবী পালন করেননি এবং করতেও বলেননি। চার খলীফাসহ জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন ছাহাবীর কেউ এ অনুষ্ঠান পালন করেননি। লক্ষাধিক ছাহাবীর কোনো একজনও এ উৎসব পালন করেননি। পরবর্তী যুগের তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈনও এটা পালন করেননি। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম রাহিমাহুমাল্লাহ-সহ হাদীছগ্রন্থ সংকলনকারী মুহাদ্দিছগণও পালন করেননি। এমনকি চার মাযহাবের ইমামগণের কোনো একজনও এ ঈদ পালন করেননি।[6] তারা কেউ পালন করেছেন মর্মে কোনো প্রমাণ অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। সুতরাং বলা যায়, ঈদে মীলাদুন নবী নতুন আবিষ্কার।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ দ্বীন। এ দ্বীন পরিপূর্ণ, বিধায় আমাদেরকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং বিদআত থেকে বিরত থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আর বিদআতকারীর ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরীআতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[7] তিনি আরও বলেন,وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَة ‘তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি করা হতে বিরত থাকো। নিশ্চয়ই প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদআত ও প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী’।[8] অন্য বর্ণনায় এসেছে,وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ ‘আর প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম জাহান্নাম’।[9]

সুতরাং ঈদে মীলাদুন নবী পালন করা বিদআত। কেননা এটি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর প্রায় ৫৯৪ বছর পর ৬০৪ হিজরীতে আবিষ্কৃত হয়। 

‘ঈদে মীলাদুন নবী’ সম্পর্কে কতিপয় বিদ্বানের অভিমত:

(১) শায়খ আব্দুল আযীয ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

لَا يَجُوزُ الِاحْتِفَالُ بِمَوْلِدِ الرَّسُولِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَا غَيْرِهِ؛ لِأَنَّ ذَٰلِكَ مِنَ الْبِدَعِ الْمُحْدَثَةِ فِي الدِّينِ؛ لِأَنَّ الرَّسُولَ لَمْ يَفْعَلْهُ، وَلَا خُلَفَاؤُهُ الرَّاشِدُونَ، وَلَا غَيْرُهُمْ مِنَ الصَّحَابَةِ رِضْوَانُ اللهِ عَلَيْهِمْ، وَلَا التَّابِعُونَ لَهُمْ بِإِحْسَانٍ فِي الْقُرُونِ الْمُفَضَّلَةِ، وَهُمْ أَعْلَمُ النَّاسِ بِالسُّنَّةِ، وَأَكْمَلُ حُبًّا لِرَسُولِ اللهِ، وَمُتَابَعَةً لِشَرْعِهِ مِمَّنْ بَعْدَهُمْ.

‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মীলাদ বা অন্য কারও মীলাদ উদযাপন করা জায়েয নেই। কারণ এটি দ্বীনের মধ্যে সৃষ্ট নতুন বিদআত। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটি করেননি, তাঁর খুলাফায়ে রাশেদীনও করেননি, অন্য কোনো ছাহাবীও করেননি এবং মর্যাদাপূর্ণ যুগে তাদের ন্যায়সঙ্গত অনুসরণকারীগণও (তাবেঈ) করেননি। অথচ তারা ছিলেন সুন্নাহ সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সর্বাধিক ভালোবাসায় পরিপূর্ণ এবং তাঁর শরীআতের অনুসরণে পরবর্তীদের চেয়ে অধিক অগ্রগামী’।[10]

(২) আল্লামা ইবনু উছায়মীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

إِنَّ الِاحْتِفَالَ بِالْمَوْلِدِ النَّبَوِيِّ لَيْسَ مَعْرُوفًا عَنِ السَّلَفِ الصَّالِحِ، وَلَا فَعَلَهُ الْخُلَفَاءُ الرَّاشِدُونَ، وَلَا فَعَلَهُ الصَّحَابَةُ، وَلَا التَّابِعُونَ لَهُمْ بِإِحْسَانٍ، وَلَا أَئِمَّةُ الْمُسْلِمِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ.

‘নিশ্চয়ই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিন উদযাপন সালাফে ছালেহীনের মধ্যে পরিচিত ছিল না। আর না খুলাফায়ে রাশেদীন তা করেছিলেন, না ছাহাবীগণ তা করেছিলেন, না তাদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে অনুসরণকারী তাবেঈন তা করেছিলেন আর না তাদের পরবর্তী মুসলিম ইমামগণ তা করেছিলেন’।[11]

(৩)‌ শায়খ ছালেহ আল-ফাওযান বলেন,

الِاحْتِفَالُ بِمَوْلِدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِدْعَةٌ فِي الدِّينِ.

‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিন উদযাপন করা দ্বীনের মধ্যে বিদআত।[12]

‘ঈদে মীলাদুন নবী’ উপলক্ষ্যে মুসলিম সমাজে প্রচলিত কর্মকাণ্ড:

(১) মিছিল ও শোভাযাত্রা: বর্তমানে ঈদে মীলাদুন নবী-তে বহু মুসলিম দেশে বড় বড় শোভাযাত্রা ও মিছিল বের করা হয়। রাস্তাজুড়ে ব্যানার, ফেস্টুন, গাড়ি সাজানো হয়। ইসলামী সংগীত বাজানো হয় ব্যান্ড দলের মাধ্যমে। অনেক সময় এসব আয়োজন রাস্তার যান চলাচল বন্ধ করে দেয়, সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং মহিলাদের অংশগ্রহণ, উচ্চ আওয়াজে গান-বাজনা, ঢাকঢোল ইত্যাদির মাধ্যমে অসংযত পরিবেশ তৈরি হয়, যা ইসলামী আদব ও শরীআতের সুন্নাহসম্মত জীবনধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ঈদে মীলাদুন নবী-এর নামে এসব কর্মকাণ্ড কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না।

(২) মীলাদ মাহফিল ও ক্বাছীদা পাঠ: মীলাদ মাহফিল উপলক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় মানুষ নানা ধরনের পাপে লিপ্ত হয়। যেমন— নারী-পুরুষের সংমিশ্রণ, গান-বাজনা ও মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি। সর্বোপরি এসব মাহফিলে শিরকে আকবার তথা বড় ধরনের শিরকও সংঘটিত হয়ে থাকে। আর তা হলো রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য আউলিয়া কেরামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা, তাদের কাছে দু‘আ করা, সাহায্য চাওয়া, বিপদ থেকে মুক্তি কামনা করা এবং এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, তারা গায়েবের খবর জানেন। অথচ এই সমস্ত কাজ করলে মানুষ কাফের হয়ে যায়। এমনকি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম, জীবনী নিয়ে বক্তৃতা, গান (ক্বাছীদা), কবিতা, নাটিকা ইত্যাদি পরিবেশন করা হয়।

(৩) তবারুক বা বিশেষ খাবার বিতরণ: মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিন উপলক্ষ্যে বর্তমানে অনেক জায়গায় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে বিভিন্ন ধরনের মজাদার খাবার তৈরি করে তা বিতরণ করা হয়। সাধারণত এটি তবারুক বা বরকত হিসেবে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে করা হয়। মানুষ মনে করে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে এই খাবার বিতরণ একটি সুনিশ্চিত সৎ কাজ। কিন্তু ইসলামের মূল উৎস কুরআন ও হাদীছের আলোকে বিষয়টি মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, এটি একটি বিদআত (নতুন উদ্ভাবন) অর্থাৎ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা ছাহাবীগণের যুগে চালু বা সুপ্রচলিত ছিল না।

(৪) গান-বাজনা ও আলোকসজ্জা: বিভিন্ন মসজিদ, রাস্তা, গলি এবং বাড়িঘরকে বর্ণিলভাবে সাজানো হয়, বিভিন্ন রঙের বাতি ও লাইটিং করে আনন্দ উদযাপন করা হয়। এতে প্রচুর অর্থ অপচয় করা হয়। অথচ ইসলামী শরীআতে এই ধরনের অপসাংস্কৃতিক আয়োজন বা বাহ্যিক চাকচিক্য ও অপচয় কখনো উৎসাহিত করা হয়নি। এমনকি কিছু এলাকায় গান-বাজনা, আতশবাজি, নাচ, আলোকসজ্জা ইত্যাদি করতে দেখা যায়, যা শরীআতের সাথে সাংঘর্ষিক।

(৫) নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরআত্মাআগমন করে এই বিশ্বাস করা: অনেকের ধারণা, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন। আবার কেউ মনে করে, ঐ রাতে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রূহ আগমন করেন (নাঊযুবিল্লাহ!)। তাই তারা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে দাঁড়িয়ে যায়। এটা বিরাট মূর্খতা ও অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্বিয়ামত দিবসের পূর্বে আপন কবর থেকে বের হবেন না বা কারও সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করবেন না এবং কোনো সমাবেশেও উপস্থিত হবেন না। বরং ক্বিয়ামত পর্যন্ত অন্যান্য নবীর মতোই স্বীয় কবরে অবস্থান করবেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَوَّلُ مَنْ يَنْشَقُّ عَنْهُ الْقَبْرُ وَأَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি আদমের শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমার কবরই সর্বপ্রথম উন্মুক্ত করা হবে। আমিই প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশই সবার আগে গৃহীত হবে’।[13]

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে ১২ রবীউল আউয়ালকে তৃতীয় ঈদ হিসেবে পালন করা হয়। তবে ইসলামী শরীআতে ঈদ মাত্র দুটি— ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিন হিসেবে এই দিনকে পালন করার জন্য ‘জশন-ই-বেলাদাত’ নামে অনুষ্ঠান, মীলাদ, মাহফিল ও জুলুসের আয়োজন করা হয়। এগুলোর কোনোটাই কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত নয়।

উপসংহার:

ইসলামে ইবাদত ও উৎসব নির্ধারিত হয় কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা। তাই নিজের পক্ষ থেকে নতুন কোনো ইবাদতের পদ্ধতি বা দিন নির্ধারণ করা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। বিদআত পরিহার করে সুন্নাহর উপর অবিচল থাকাই প্রকৃত ঈমানদারের পরিচয়। সুতরাং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিবস পালন নয়, বরং পরিপূর্ণভাবে তাঁকে অনুসরণই কাম্য। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ ও সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

আবূ মাহদী মামুন বিন আব্দুল্লাহ

 অধ্যয়নরত, আক্বীদা ও দাওয়াহ বিভাগ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।


[1]. ড. শহীদুল্লাহ খাঁন মাদানী, ঈদে মীলাদুন্নাবী, পৃ. ৪।

[2]. আল-খিতাত লিল মাকরীযী, ১/৪৯০-৪৯৯।

[3]. সুয়ূতী, হুসনুল মাক্বছাদ, পৃ. ৪২; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ১৩/১৪৭।

[4]. আবু শামাহ, আল-বা‘এছ আলা ইনকারিল বিদা‘ ওয়াল হাওয়াদিছ, পৃ. ২৩-২৪; বিস্তারিত: আল-আইয়াদ ওয়া আছারুহা আলাল মুসলিমীন, পৃ. ২৮৬-২৮৯।

[5]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ১৩/১৩৭।

[6]. আব্দুস সাত্তার দেহলভী, মীলাদুন্নাবী, পৃ. ৩৫।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮।

[8]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; মিশকাত, হা/১৬৫।

[9]. নাসাঈ, হা/১৫৭৮।

[10]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে বায, ১/১৭৮।

[11]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে উছায়মীন, ২১/৬২।

[12]. আল-ইজলাল আল-ইলমী ওয়াল আমালী, পৃ. ১৫২।

[13]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২৭৮।

Magazine