কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আদ-দাওয়াহ ইলাল্লহ: এসো! আল্লাহর পথে... (পর্ব-৩)

post title will place here

ইবাদতের যোগ্য হওয়ার জন্য প্রতিপালক হওয়ার চ্যালেঞ্জ:

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

أَمَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَأَنْزَلَ لَكُمْ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَنْبَتْنَا بِهِ حَدَائِقَ ذَاتَ بَهْجَةٍ مَا كَانَ لَكُمْ أَنْ تُنْبِتُوا شَجَرَهَا أَإِلَهٌ مَعَ اللَّهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ يَعْدِلُونَ - أَمَّنْ جَعَلَ الْأَرْضَ قَرَارًا وَجَعَلَ خِلَالَهَا أَنْهَارًا وَجَعَلَ لَهَا رَوَاسِيَ وَجَعَلَ بَيْنَ الْبَحْرَيْنِ حَاجِزًا أَإِلَهٌ مَعَ اللَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ: হে মানুষ! তুমি কি চিন্তা কর না, কে এত উঁচু আকাশ আর এত সুবিন্যস্ত বসবাস উপযোগী পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন? কে আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরান? সেই বৃষ্টির মাধ্যমে কে উৎপাদন করেন দৃষ্টিনন্দন বাগান? এই সমস্ত বৃক্ষরাজির একটি দানাও তো তোমাদের পক্ষে অঙ্কুরোদগম করা সম্ভব নয়? তবুও কি তোমরা মনে কর, আল্লাহর সঙ্গে আর কোনো উপাস্য থাকতে পারে? আসলে যারা আল্লাহর সাথে শিরক করে, তারা মূলত আল্লাহর সাথে অন্যায় করে। আল্লাহর হক্ব নষ্ট করে।

হে মানুষ! আরও চিন্তা করো! কে পৃথিবীকে কোনো দড়ি, কংক্রিটের পিলার, লোহার জিঞ্জির কোনোকিছু ছাড়াই এমনভাবে শূন্যে স্থির করে রেখেছেন যে, মহাবিশ্বের ক্ষতিকর কোনো আলো ও বস্তু এখানে এসে পৌঁছাতে পারে না এবং এটিও শূন্যে ঘূর্ণায়মান থাকা অবস্থায় অন্য কোনো গ্রহের সাথে ধাক্কা খায় না। এই পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করার জন্য তার বুক চিরে প্রবাহিত করেছেন সুমিষ্ট পানির নদী-নালা, অথচ মহাবিশ্বের অন্য কোনো গ্রহে বসবাস উপযোগী পানি ও অক্সিজেন নেই। পৃথিবীর ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য পৃথিবীর গভীর থেকে স্থাপন করেছেন মজবুত উঁচু উঁচু পাহাড় আর পাশাপাশি প্রবহমান দুই সমুদ্রের মাঝে এমনভাবে পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন যে, একটির লবণাক্ত পানি আরেকটির সুমিষ্ট পানির সাথে মিশে যায় না।

এখন তুমি চিন্তা করে দেখো! পৃথিবীতে যত মিথ্যা ইলাহের ইবাদত বা পূজা করা হয়, তারা কি কেউ এই কাজগুলো করার যোগ্যতা রাখে? যদি না রাখে, তাহলে তুমিই বলো! আল্লাহ ব্যতীত আর কে একনিষ্ঠ ভক্তি ও আনুগত্য পাওয়ার যোগ্যতা রাখে? আসলে যারা আল্লাহর পাশাপাশি অন্য কোনো ভ্রান্ত ইলাহেরও ইবাদত করে, তাদের অনেকেই সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ (আন-নামল, ২৭/৬০-৬১)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَمَا لَهُمْ فِيهِمَا مِنْ شِرْكٍ وَمَا لَهُ مِنْهُمْ مِنْ ظَهِيرٍ - وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ حَتَّى إِذَا فُزِّعَ عَنْ قُلُوبِهِمْ قَالُوا مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ قَالُوا الْحَقَّ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ

ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ: হে নবী! আপনি তাদেরকে বলে দিন, তোমরা যে ভ্রান্ত ইলাহগুলোকে এত শ্রদ্ধা কর, তাদের সামনে মাথা নত কর, বিপদে-আপদে তাদের কাছে দৌড়ে যাও, তাদের কাছে সাহায্য চাও; একবারও কি চিন্তা করে দেখেছ তাদের একজনও কি এই বিশাল আসমান ও যমীনের একটি কণারও মালিকানা দাবি করতে পারবে? পূর্ণ মালিকানার কথা বাদ দিলাম, আংশিক মালিকানারই দাবি করতে পারবে কি? এই সমগ্র মহাবিশ্বের এক বিন্দু পরিমাণেরও তারা আংশিক মালিক হওয়া তো দূরের কথা এই আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে তাদের কোনো সহযোগিতাও নেই। তারা এমন কেউ নয়, যাদেরকে আল্লাহ এসে বলবেন যে, এসো আমাকে সাহায্য করো। তাহলে তাদের অবস্থান কী? এই সমস্ত ভ্রান্ত ইলাহগুলো নির্বাক, নির্জীব ও অসহায়। তাদের একমাত্র পরিচয় তারা আল্লাহর সৃষ্টিজীব।

এবার যদি তুমি বলো, ঠিক আছে! তারা কোনো কিছুর মালিক না হলেও তারা আল্লাহর এত প্রিয় যে, তারা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে পারবে; তাহলে তোমাদের সদয় অবগতির জন্য বলি, ভালো করে জেনে রাখো! প্রথমত, মহান আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ তাঁর কাছে সুপারিশ করার সাহস বা তাঁর সাথে কথা বলার কোনো ক্ষমতা রাখে না। দ্বিতীয়ত, ফেরেশতাদের মতো নূরের তৈরি মহান আল্লাহর এত কাছে থাকা সৃষ্টিজীবেরাও আল্লাহর সাথে কথা বলতে গিয়ে এতটা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে যে, তারা আল্লাহর কথা শুনে ভয়ে-আতঙ্কে পাখা ছটফট করতে থাকে। তাদের পাখার ছটফটানির আওয়াজে আল্লাহর নিকটস্থ ফেরেশতা ছাড়া অন্যরা কথা শুনতে পায় না। তখন তারা আল্লাহর আদেশ সম্পর্কে জানার জন্য আল্লাহর নিকটস্থ ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করে মহান আল্লাহ কী আদেশ দিলেন? তখন নিকটস্থ ফেরেশতারা বলে, তিনি যা বলেছেন সত্য বলেছেন আর তিনি সবার চেয়ে বড়, মহান ও উঁচু। এই যদি হয় ফেরেশতাদের অবস্থা, তাহলে কল্পনা করো তোমাদের সেই সমস্ত ইলাহের মিথ্যুক দাবিদারদের কী অবস্থা হবে? (সাবা, ৩৪/২২-২৩)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى

ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ: আকাশে কত নামকরা ফেরেশতা আছেন, কিন্তু তাদের কোনো শাফাআত বা মধ্যস্থতা কাজে দেয় না, যদি না আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অনুমতি দেন এবং যাকে তিনি পছন্দ করেন (আন-নাজম, ৫৩/২৬)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ بَنِينَ وَحَفَدَةً وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ أَفَبِالْبَاطِلِ يُؤْمِنُونَ وَبِنِعْمَتِ اللَّهِ هُمْ يَكْفُرُونَ - وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَمْلِكُ لَهُمْ رِزْقًا مِنَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ شَيْئًا وَلَا يَسْتَطِيعُونَ

ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ: এই আয়াতের পূর্বের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাআলা তাঁর নেয়ামতের বর্ণনা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, তিনি কীভাবে মানুষের জন্য পশু-প্রাণি থেকে দুধের ব্যবস্থা করেছেন, কীভাবে একই শরীরে রক্ত, দুধ ও বর্জ্য বা গোবর আলাদা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। গরুর একটি থানে প্রতিদিন ৪০০–৫০০ লিটার রক্ত প্রবাহিত হয় দুধ তৈরির জন্য! কিন্তু সেই রক্ত এক ফোঁটাও দুধে মিশে না। চতুষ্পদ জন্তুর দুধে প্রোটিন, মিনারেল ও ফ্যাটের মতো প্রায় ২০০টি উপাদান থাকে, যা পৃথিবীর কোনো ল্যাব এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি। ঠিক এভাবেই মহান আল্লাহ মানুষের জন্য মৌমাছির মাধ্যমে হাজারো ফুল থেকে মধুর ব্যবস্থা করেছেন, যে মধুতে আছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিসেপটিক গুণ, যা সদা সতেজ থাকে এবং নষ্ট হয় না। প্রাচীন মিসরের ৩০০০ বছর পুরোনো মধু বর্তমানে পাওয়া গেছে খাবার উপযোগী অবস্থায়! এক চামচ মধু সংগ্রহ করতে ১২টি মৌমাছিকে প্রায় ৪০০০ ফুল ভিজিট করতে হয়!

এই সমস্ত নেয়ামত বর্ণনার ধারাবাহিকতায় মহান আল্লাহ স্ত্রী-পুত্র, সন্তানসন্ততির নেয়ামতের বর্ণনা দিয়েছেন। মানুষের আত্মিক প্রশান্তির সবচেয়ে বড় জায়গা তার পরিবার। পরিবারে শান্তি থাকলে সে দুনিয়াতেই জান্নাতের স্বাদ পেয়ে যায়। পরিবারের শান্তি পৃথিবীর কোনো প্রযুক্তি মানুষকে দিতে অক্ষম। এত কিছুর পরও মানুষ কীভাবে আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করতে পারে আর ত্বাগূতের অনুসরণ করতে পারে? অথচ আল্লাহ ব্যতীত তাদের যারা ইবাদত করে, তারা আসমান ও যমীন থেকে এক ফোঁটা রিযিক্বের ব্যবস্থাও তাদের জন্য করতে পারবে না। জি, এক ফোঁটা দুধ বা এক ফোঁটা মধুও মানুষের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব নয়। তাদের অক্ষমতাই প্রমাণ করে যে, তারা ইবাদতের যোগ্য নয় (আন-নাহল, ১৬/৭২-৭৩)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَنُ وَلَدًا - لَقَدْ جِئْتُمْ شَيْئًا إِدًّا - تَكَادُ السَّمَاوَاتُ يَتَفَطَّرْنَ مِنْهُ وَتَنْشَقُّ الْأَرْضُ وَتَخِرُّ الْجِبَالُ هَدًّا - أَنْ دَعَوْا لِلرَّحْمَنِ وَلَدًا - وَمَا يَنْبَغِي لِلرَّحْمَنِ أَنْ يَتَّخِذَ وَلَدًا - إِنْ كُلُّ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِلَّا آتِي الرَّحْمَنِ عَبْدًا

ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ: যারা পৃথিবীতে বিভিন্ন বাতিল ইলাহ বানিয়েছে এবং সেগুলোকে বিভিন্নভাবে মহান আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম একটি উদাহরণ হচ্ছে, খ্রিষ্টানদের ঈসা আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহর সন্তান দাবি করার বিষয়টি। মহাশক্তিশালী মহাপবিত্র মহান আল্লাহর সম্মান, মর্যাদা ও পবিত্রতার শানে সন্তান দাবি করার বিষয়টি এতটা ভয়ানক ও গর্হিত এবং এই কথার জঘন্যতার ওযন এত ভারী যে, যদি তা আসমান ও যমীনের উপর নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে এই কথার জঘন্যতা সহ্য করতে না পেরে এত বিশাল আসমান চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে আর এত বিশাল পৃথিবী ফেটে বিদীর্ণ হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ সন্তান, পিতা, ঘুম, খাবার ও বিশ্রামসহ মানুষের মতো সকল দুর্বলতা থেকে পবিত্র। আর সন্তানের মুখাপেক্ষী হওয়া তো বহু দূরের কথা; এই আসমান-যমীন ও তার মঝে যত সৃষ্টিজীব আছে, সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন, যত মহৎ ও সম্মানিতই হোক না কেন, অভিশপ্ত ইবলীস থেকে শুরু করে মহা সম্মানিত ফেরেশতা পর্যন্ত, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ‍শুরু করে ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালাম-সহ অন্যান্য সকল নবী, অলী-আউলিয়া, ছিদ্দীক্ব-শুহাদা যেই হোক না কেন, তাদের সবার সাথে মহান আল্লাহর একমাত্র সম্পর্ক হলো তারা মহান আল্লাহর সৃষ্টিজীব ও দাস আর মহান আল্লাহ তাদের সৃষ্টিকর্তা ও প্রভু (মারইয়াম, ১৯/৮৮-৯৩)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ

ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ: ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের সাধু, পণ্ডিত ও মারইয়াম (আ.)-এর ছেলে ঈসা আলাইহিস সালাম-কে তাদের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে। অথচ স্বয়ং ঈসা ও মারইয়াম আলাইহিমাস সালাম সারাজীবন মহান আল্লাহর ইবাদত করেছেন এবং মানুষকে এটাই বুঝিয়েছেন যে, মহান আল্লাহ ব্যতীত ইবাদতের যোগ্য কোনো সত্তা পৃথিবীতে নেই। আর এই কাজের জন্যই তারা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়েছিলেন এবং মহান আল্লাহ মানুষের শিরক থেকে পবিত্র (আত-তাওবা, ৯/৩১)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

يَاأَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلَا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَا تَقُولُوا ثَلَاثَةٌ انْتَهُوا خَيْرًا لَكُمْ إِنَّمَا اللَّهُ إِلَهٌ وَاحِدٌ سُبْحَانَهُ أَنْ يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَكَفَى بِاللَّهِ وَكِيلًا - لَنْ يَسْتَنكِفَ الْمَسِيحُ أَنْ يَكُونَ عَبْدًا لِلَّهِ وَلَا الْمَلَائِكَةُ الْمُقَرَّبُونَ وَمَنْ يَسْتَنكِفْ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيَسْتَكْبِرْ فَسَيَحْشُرُهُمْ إِلَيْهِ جَمِيعًا

ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ: হে তাওরাত ও ইনজীল (বুক অব গসপেল)-এর অনুসারীরা! তোমরা তোমাদের দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না। আল্লাহর নামে মিথ্যা বলো না। বরং জেনে রাখো! মারইয়াম (আ.)-এর ছেলে ঈসা আলাইহিস সালাম মহান আল্লাহর প্রেরিত রাসূল আর মহান আল্লাহ তাকে ‘কুন’ এই শব্দ দিয়ে তৈরি করেছেন। আর আল্লাহ কোনো কিছু করতে চাইলে তিনি ‘হও’ বললেই তা সাথে সাথে হয়ে যায়। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর মাধ্যমে মারইয়াম (আ.)-এর পেটে রূহ ফুঁকে দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ ইতঃপূর্বে পিতা ও মাতা ছাড়া আদম আলাইহিস সালাম-কে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন এবং মাতা ছাড়া হাওয়া (আ.)-কে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। সেই তুলনায় তো শুধু পিতা ছাড়া ঈসা আলাইহিস সালাম-কে সৃষ্টি করা অসম্ভব কিছু নয়। অতএব, তোমরা এই দাবি করা ছেড়ে দাও যে, আল্লাহ ঈসা ও মারইয়াম আলাইহিমাস সালাম মিলে এক সত্তা, নাঊযুবিল্লাহ! এর মধ্যেই তোমাদের জন্য কল্যাণ আছে। জেনে রাখো! ইবাদতের যোগ্য একমাত্র সত্তা মহান আল্লাহ। আসমান-যমীন ও তার মাঝে যা কিছু আছে, তার সকল কিছুর একচ্ছত্র অধিপতি হচ্ছেন তিনি। তার সন্তান থাকা তো বহু দূরের কথা, বরং তাঁর শুধু গোলাম ও দাস আছে। ঈসা ও মারইয়াম আলাইহিমাস সালামও তাঁর দাস। শুধু তাই নয়, তারা নিজেরা দুজন এবং মহান আল্লাহর নিকটস্থ ফেরেশতারা পর্যন্ত তাঁর নৈকট্য অর্জন করার জন্য অত্যন্ত আগ্রহের সাথে তাঁর ইবাদত করতে ব্যস্ত থাকে। তারা কখনোই অহংকারী হয়নি আর আসমান ও যমীনে কেউ যদি অহংকারবশত আল্লাহর ইবাদত না করে, তাহলে সে দেখবে কীভাবে আল্লাহ তাদের সকলকেই ক্বিয়ামতের মাঠে একত্রিত করবেন। সেদিন তাদের আর করার কিছু থাকবে না। আর মহান আল্লাহ সকল দুর্বলতা থেকে পবিত্র এবং দায়িত্বশীল হিসেবে তিনি একাই যথেষ্ট (আন-নিসা, ৪/১৭১-১৭২)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ - مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ: পৃথিবীতে যত বাতিল ইলাহ আছে, তাদের ভ্রান্তি স্পষ্ট করতে গিয়ে ইউসুফ আলাইহিস সালাম তার কারাগারের দুই সহবন্দিকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমাদের কী মনে হয় মহাশক্তিশালী ও মহাপ্রতাপশালী একক সত্তা বেশি ইলাহ হওয়ার যোগ্য, না ভাগাভাগি করে কয়েকজন মিলে ইলাহ হওয়া বেশি ভালো? যদি ভাগাভাগি করে কয়েকজন মিলে ইলাহ হয়, তাহলে একদিনও তারা পৃথিবী চালাতে পারবে না, পরস্পরে মারামারি লেগে যাবে। যেমন পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে অসংখ্য দেশ ও অসংখ্য শাসক থাকায় তাদের স্বার্থ ভিন্ন হয় এবং যুদ্ধ ও মারামারি লেগেই থাকে। আসলে তোমরা যে ভ্রান্ত ইলাহগুলোর পূজা কর, এগুলোর বাস্তবে না কোনো অস্তিত্ব আছে, না তাদের জন্য প্রকৃত ইলাহ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো দলীল-প্রমাণ আছে। এগুলো সব তোমাদের নিজেদের অথবা তোমাদের বাপ-দাদাদের মনগড়া বানানো ইলাহ। আর জেনে রাখো! আসমান-যমীনে একমাত্র মহান আল্লাহর একচ্ছত্র শাসন ও আধিপত্য চলে আর তিনিই তোমাদের আদেশ দিয়েছেন যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত বা দাসত্ব করা যাবে না আর এটিই সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ ন্যায় ও সত্যের সহজ-সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞ হওয়ার কারণে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ইবাদতের যোগ্য মনে করে থাকে (ইউসুফ, ১২/৩৯-৪০)

উপরিউক্ত আয়াতসমূহের সারমর্ম:

আল্লাহ-ই আমাদের সকলের সৃষ্টিকর্তা। আমাদের সকলের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করা সব তিনিই করেছেন। রাত-দিনের আবর্তন, সূর্য-চন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ তাঁরই হাতে। এক কথায় আসমান ও যমীনের সকল সিস্টেম তাঁর নিয়ন্ত্রণে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য যাদের ইবাদত করা হয়, তারা নিজেই আল্লাহর সৃষ্টিজীব। তারা নিজেরা একটা মাছিও সৃষ্টি করতে পারে না। একটা গাছও উৎপাদন করতে পারে না। তারা কেউ খেজুরের বিচির পাতলা আবরণ পরিমাণ তথা অণু পরিমাণ জিনিসেরও মালিক নয়। যাদের ডাকা হয়, তারা কিছুই শুনে না, সাড়া দেয় না; বরং উল্টো ক্বিয়ামতের দিন যারা তাদের পূজা করত, সেই সমস্ত অনুসারীদের থেকে তারা নিজেদেরকে মুক্ত ঘোষণা করবে। এটা অজ্ঞ অনুসারীদের জন্য চরম অপমানজনক হবে।

যত বড় নবীই হোক না কেন, যত বড় অলী-আউলিয়া হোক না কেন, তার একমাত্র পরিচয় সে আল্লাহর দাস। ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেকে এককভাবে আল্লাহর সামনে আল্লাহর দাস হিসেবে হাযির হবে আর তাদের কারো আল্লাহর কাছে মধ্যস্থতা বা শাফাআত করার ক্ষমতা নেই, যতক্ষণ না আল্লাহ অনুমতি দেন। এমনকি আল্লাহর নিকটস্থ নামকরা ফেরেশতাদেরও সেই ক্ষমতা নেই, বরং তারাও সবসময় আল্লাহর ভয়ে তটস্থ থাকে। শুধু তাই নয়, তারা নিজেরাই আল্লাহর নৈকট্য পেতে ব্যাকুল হয়ে থাকে এবং আল্লাহর ইবাদতে ব্যস্ত থাকে। তাদের ইবাদত করতে হবে এই মর্মে পূর্ববর্তী কোনো কিতাবে কোনো কিছু বর্ণিত হয়নি। সম্পূর্ণ দলীলবিহীন ও অযৌক্তিকভাবে তাদের পূজা করা হয়।

(ইনশা-আল্লাহ চলবে)

* ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বিএ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।

Magazine