তাক্বদীর অর্থ নির্ধারণ করা।[1] এটি ঈমান বিল ক্বদার (اَلْإِيْمَانُ بِالْقَدَرِ)। তার মানে, প্রতিটি সৃষ্টির জন্য আল্লাহর ব্যবস্থাপনা যে নির্ধারিত, তা বিশ্বাস করা। ভালো-মন্দ যা কিছু সবই আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছা অনুসারে হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন, إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ ‘আমি প্রত্যেক কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে’ (আল-ক্বামার, ৫৪/৪৯)।
কোনো সৃষ্টির জ্ঞানের সাথে আল্লাহর জ্ঞানের তুলনা হয় না। সৃষ্টির আগেই তিনি বিশ্বের সবকিছু কোথায় কীভাবে সংঘটিত হবে সবই জানেন। এ বিশ্বাস হলো, সবকিছু ‘লাওহে মাহফূযে’ (সংরক্ষিত পত্রে) লিখে রেখেছেন। লিখনের প্রকৃতি আমরা জানি না। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে,وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ ‘অদৃশ্যের চাবি তাঁরই নিকট রয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। জলে-স্থলে যা কিছু আছে, তা তিনিই অবগত। তাঁর অজ্ঞাতসারে একটা পাতাও পড়ে না। মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোনো শস্যকণাও নেই অথবা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোনো বস্তু নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই’ (আল-আনআম, ৬/৫৯)।
তাক্বদীরে যারা বিশ্বাস করে, তারা নিরাশ হয় না। অপেক্ষার প্রহর গুনে মহাসাফল্যের। যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দিয়েছেন। যেমন— যাকারিয়া আলাইহিস সালাম বলেছিলেন, وَلَمْ أَكُنْ بِدُعَائِكَ رَبِّ شَقِيًّا ‘হে আমার রব! আমি তো কখনো আপনাকে ডেকে ব্যর্থ হইনি’ (মারইয়াম, ১৯/৪)।
জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট আসতে পারে, যা জীবনকে এলোমেলো করে দিবে। দুর্দিনে কেউ পাশে থাকবে না। রিযিক্বের কষ্টে ভুগবে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হবে। তবু আশাহত হওয়া যাবে না। এমন সময় রব বলেন,وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُبِينٍ ‘জমিনে বিচরণশীল সকল প্রাণীর রিযিক্বের দায়িত্ব আল্লাহরই। তিনি তাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী অবস্থান সম্বন্ধে অবহিত। সুস্পষ্ট কিতাবে সবকিছুই আছে’ (হূদ, ১১/৬)।
বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া, ভালোবাসা, করুণার কোনো কমতি নেই। পৃথিবীর জীবন সংকীর্ণ হয়ে গেছে, রিযিক্ব কমে গেছে এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,لِكُلِّ أَجَلٍ كِتَابٌ - يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ ‘প্রত্যেক বিষয়ের নির্ধারিত কাল লিপিবদ্ধ। তিনি যা ইচ্ছা মুছে ফেলেন আর যা ইচ্ছা রেখে দেন। আর তাঁর কাছেই আছে উম্মুল কিতাব’ (আর-রা‘দ, ১৩/৩৮-৩৯)।
মানুষকে আল্লাহ বিবেক, বিচারশক্তি ও জ্ঞান দান করেছেন। কাজেই সে তার বিচারবুদ্ধি দিয়ে কর্ম করবে। আর কর্মের ফল ভোগ করবে। এটাই তাক্বদীরে বিশ্বাস। আল্লাহর বাণী এভাবে, أَلَمْ نَجْعَلْ لَهُ عَيْنَيْنِ - وَلِسَانًا وَشَفَتَيْنِ - وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ ‘আমি কি তার জন্য সৃষ্টি করিনি দুটি চক্ষু? আর জিহবা ও দুটি ঠোঁট? আর আমি তাকে কি দুটি পথ দেখাইনি?’ (আল-বালাদ, ৯০/৮-১০)।
মক্কার কাফেররা তাক্বদীরের ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে ছিল। তারা যা বলছে তা অহীর জ্ঞান নয়, বরং তা যুক্তিতর্কভিত্তিক ধারণা মাত্র।
অহীর জ্ঞান তো হলো কুরআনুল কারীমের জ্ঞান। অনেকে মনে করেন ভাগ্য অনুসারেই যেহেতু সবকিছু হয়, তাহলে কর্মের কী দরকার? এটি একটি বিকৃত ধারণা, ভ্রান্ত আক্বীদা। যে অবিশ্বাসী তাক্বদীর নিয়ে বিবাদ করবে, সে মূলত নিজেকে আল্লাহর কর্মের পরিদর্শক ও বিচারক নিয়োগ করবে। সে বলতে চায়, কর্ম করা আমার দায়িত্ব নয়। আমার কাজ হলো আল্লাহর কাজের বিচার করা।
আল্লাহর কাজের বিচার করা মানুষের কর্ম হতে পারে না। তিনি কী জানেন, কী লিখেছেন, কী মুছেন, কী রেখে দেন, তার কিছুই মানু্ষকে জানাননি। এর নামই তাক্বদীর। একেই বলে তাক্বদীরে বিশ্বাস। তিনি বান্দাহকে তার কর্মের চেয়ে বেশি পুরস্কার দিতে চান। তাই মুমিন নিশ্চিন্তে কর্ম করে। ফলাফলের দায়িত্ব তাঁর উপরেই ছেড়ে দেয়।
তাক্বদীরে বিশ্বাসের ফল ভোগ করেছেন ছাহাবায়ে কেরাম। তাক্বদীরের প্রতি তাদের ছিল দৃঢ় প্রত্যয়। অটল অবিচল আস্থা। তাক্বদীরে বিশ্বাসী কর্মবীরকে আল্লাহ ভালোবাসেন। পরাজয়ের হতাশা, হা-হুতাশ ও গ্লানি থেকে রক্ষা করেন। ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা দ্বিধাদ্বন্দ্ব মুক্ত জীবন দান করেন। পরাজয়কে পদতলে মাড়িয়ে মুমিন বিশ্বাসের বলে বলিয়ান হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিন থেকে বেশি প্রিয় ও বেশি ভালো। তবে তাদের উভয়ের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। তোমরা যাতে কল্যাণ ও মঙ্গল রয়েছে, সে বিষয়ে আগ্রহী ও সচেষ্ট হও এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো। অক্ষম, দুর্বল বা হতাশ হয়ে যেয়ো না’।[2]
মহিউদ্দিন বিন জুবায়েদ
মুহিমনগর, চৈতনখিলা, শেরপুর।
[1]. ইবনু ফারিস, মু‘জামু মাকায়িসিল লুগাহ, ৫/৬২।
[2]. ছহীহ মুসলিম, ৪/২০৫২।
 
                             
                        
 
        
    