কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

জামি‘আহতে সঊদী শায়খদের সফর ও পাঠদান

post title will place here

(১) শায়খ আবূ উসামা যায়দ বিন মুহাম্মাদ আল-গনেম আল-জুহানী : চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ‘নিবরাস ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সালাফী বিদ্যাপীঠ ‘আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ’-তে দেশবিদেশের খ্যাতিমান উলামা ও শিক্ষকগণের শিক্ষক মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ভাষা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, আরবী ভাষার বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক এবং ইতিহাসখ্যাত সঊদী আরবের মাশহূর জুহানী গোত্রের গোত্রপতি শায়খ আবূ উসামা যায়দ বিন মুহাম্মাদ আল-গনেম আল-জুহানী দারস-তাদরীবের জন্যে আগমন করেন। সফরসঙ্গী ছিলেন তার প্রিয় ছাত্র ও ‘নিবরাস ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর সম্মানিত চেয়ারম্যান আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফের জামাতা শায়খ আবূ আহমাদ বাকী বিল্লাহ মাদানী। উক্ত প্রতিষ্ঠানের দেশি-বিদেশি শিক্ষকবৃন্দ ‘বায়তুল হামদ জামে মসজিদ’-এ এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের বরণ করেন। অনুষ্ঠানে তিনি আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহকে নিয়ে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন এবং শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন। আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহর শিক্ষার মান বিশ্বমানের করার প্রত্যয়ে ভারত থেকে যেমন শিক্ষক নিয়ে আসা হয়েছে, ঠিক তেমনি সঊদী আরব থেকেও শায়খদের নিয়ে এসে শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও বিশ্বমানের পর্যায়ে পৌঁছার ধারাবাহিকতার অংশমাত্র তার আগমন। এ মুহাযারাটি ছিল আমাদের দ্বিতীয় ‘দাওরাতুল ইলমিয়্যাহ’। তিনি প্রত্যহ তিনটি বিষয়ে দারস দেন। পাশাপাশি এশার ছলাতের পর মসজিদে বিশুদ্ধভাবে আরবী ভাষায় কথোপকথন, অভিধান ব্যবহারের নিয়ম, শব্দ চয়ন করে এর প্রয়োগ এবং একটি নির্দিষ্ট অভিধান থেকে হাতে-কলমে দারস প্রদান করতেন। এছাড়াও মুসলিম বিশ্বের ভৌগোলিক পরিচিতি, জ্যোতির্বিদ্যা ও ইতিহাস সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেন। তার নিয়মিত দারসের অন্তর্ভুক্ত আরবী সাহিত্যের গদ্য, পদ্য, আরবী সাহিত্যের ইতিহাস ও ইলমুল আ‘রূজ।

ফজর ও এশার দারসের পর তার ব্যক্তিগত কক্ষে শিক্ষার্থীবৃন্দ সাক্ষাৎ করে নানা বিষয়ে অবগত হতো। তিনি ছিলেন ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক। চলতে ফিরতে উঠতে বসতে ছাত্রদের জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করেন। তিনি আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ ও ছাত্র-শিক্ষক, পরিচালকদের নিয়ে কবিতা ও নাশীদ উপহার দেন। তিনি শিক্ষার্থীকে পাঠে উৎসাহিত করতে নিজেই আবৃত্তি করতেন। তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময় করতেন ও দারস দিতেন। আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহর পক্ষ থেকে রাজশাহীর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনা ঘুরে দেখান। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ইং রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার পলাশিতে ‘নিবরাস মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়’-এর ভিত্তি স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগ দান করেন। জমিদাতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মুহাম্মাদ জুয়েল সাহেবের নিমন্ত্রণে অংশগ্রহণ করেন। আপ্যায়ন গ্রহণের পর ক্ষণকাল মৎস্য শিকারে আদিম আনন্দ উপভোগ করেন, যা তার জীবনের এক নতুন অভিজ্ঞতা। মৎস্য শিকারকালে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ, আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক, আবূ আহমাদ বাকী বিল্লাহ-সহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। মাদরাসাতু ঈশাতুল ইসলাম ও আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর এবং বর্তমান আহলেহাদীছ জামাআতের আমীর, দেশবরেণ্য আলেমে দ্বীন শায়খ আব্দুস সামাদ সালাফী মাদানীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এছাড়াও তিনি সাপ্তাহাধিক সময় আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যার নারায়ণগঞ্জ শাখায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দারস দেন। সেখানে তিনি স্বরচিত নাশীদ শেখান, যা পরবর্তীতে সালাফী কনফারেন্সে গাওয়া হয়। জামি‘আতে অবস্থানকালে আনন্দঘন স্মৃতিময় মুহূর্ত ছিল ছাত্রদের সাথে নিয়ে সঊদী আরবের বিখ্যাত ও প্রিয় খাবার ‘কুরসু মাল্লাহ’ (এক ধরনের রুটি) তৈরির আঞ্জাম। রামাযানের শেষের দিকে শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফের মেজো ছেলে আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহর অ্যাকাডেমিক অ্যাফেয়ার্সের প্রধান দেশে ফিরলে মুহূর্তগুলো আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তিনি নিজ হাতে নামাক রোশ তৈরি করে নিমন্ত্রণ জানান শায়খ জুহানীকে। বাঙালি ধাঁচে চাঁদের জ্যোৎস্নায় বসে কলাপাতায় খাবার পরিবেশন করেন যা ছিল অভাবনীয় উপহার। তিনি রামাযান মাসজুড়ে ছিয়াম সাধনার পর জামি‘আহর মাঠে ঈদের ছালাত আদায় করেন। এটি জামি‘আহ ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দীর্ঘ চার মাস দারস শেষে মূল্যায়ন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের তিনি নিজ হাতে শাহাদাহ (সার্টিফিকেট) ও উপঢৌকন প্রদান করেন। বিদায় সংবর্ধনার মাধ্যমে জামি‘আহ ছাড়েন। তিনি ঢাকায় মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সাথে মিলিত হন। অতঃপর তিনি নিজ দেশে ফিরে যান।

(২) শায়খ আবূ আব্দুর রহমান মানছূর বিন আব্দুল আযীয আল-খালাফ : শায়খ জুহানী বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে। জামি‘আহর আকাশ চকিত ভিন্ন কলরবে মুখরিত হলো। মুহূর্তেই দৃশ্যপট পাল্টে গেল। অঙ্কিত রাযিয়াল্লাহু আনহুমা আকৃতির উপর একটি হেলিকাপ্টার অবতরণ করল। ভিতর থেকে বের হয়ে আসলেন শায়খ আবূ আব্দুর রহমান মানছূর বিন আব্দুল আযীয আল-খালাফ। তিনি মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মা‘হাদুল লুগাহ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত উস্তায। তিনি ড. জুহানীর বাল্যবন্ধু। ড. জুহানীর বিদায়ে যে নিরানন্দ মনোভাব তৈরি হয়েছিল তা কিছুটা প্রশমিত হলো শায়খ মানছূরের আগমনিবার্তায়। এই মুহাযারাটি ছিল তৃতীয় ‘দাওরাতুল ইলমিয়্যাহ’। তিনিও প্রতিদিন তিনটি বিষয়ে দারস দিতেন। এশার ছালাতের পর সিনিয়র ছাত্রদের ‘আত্মশুদ্ধি ও শিষ্টাচার’ বিষয়ে দারস দিতেন। দৈনন্দিন পাঠ্যতালিকায় সকালে হাদীছের দুটি দারস আর বিকালে তাফসীরের একটি দারস। তিনি প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণ কিংবা বৈকালীন ভ্রমণে বের হতেন। সঙ্গে থাকত প্রিয় ছাত্রবন্ধুরা। দেড়-দুই ক্রোশ হেঁটেই তবে ঘরে ফিরতেন যা ছিল তার নিত্যদিনের অভ্যাস। কখনো কখনো হাতের স্মার্টওয়াচে দেখা যেত সারাদিনের হাঁটাহাঁটির হিসাব গিয়ে দাঁড়িয়েছে চার-পাঁচ ক্রোশ। তিনি প্রায়ই বলতেন ‘মান তারকাল মাশয়া, তারাকাহুল মাশউ’ অর্থাৎ যে হাঁটাহাঁটি ছেড়ে দিল, হাঁটাহাঁটি তাকে ছেড়ে দিল।

বৃহস্পতিবার তিনি শিক্ষকদের সাথে কিছু সময় ইলমী আড্ডায় বসতেন। শায়খ জুহানীর মতো তিনিও জামি‘আর তত্ত্ববধানে রাজশাহীর তানোর উপজেলার পলাশিতে অবস্থিত ‘নিবরাস মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়’-এর ভূমি পরিদর্শন করেন এবং মৎস্য শিকারে অংশ নিয়ে আনন্দিত হন। তিনি প্রাচীন গৌড়ের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার উত্তরে শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত সুলতানী আমলে নির্মিত গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ পরিদর্শন করেন। যোহর ছালাতান্তে মোঘল স্থাপনা তাহখানা, সৈয়দ শাহ নেয়ামতউল্লাহর কবরস্থান, দারাসবাড়ি মাদরাসা, দারসবাড়ি জামে মসজিদ প্রভৃতি স্থাপনা পরিদর্শন করেন। ফেরার পথে পদ্মা-মহানন্দার মোহনায় কিছু সময় দখিনা হাওয়া গায়ে মাখেন। অতঃপর সফর শেষ করে ছাত্রদের মাঝে ফিরে আসেন। বন্ধু শায়খ মানছূর ও শায়খ জুহানী উভয়েই নারায়ণগঞ্জ শাখায় অনুষ্ঠিত সালাফী কনফারেন্স-২০২৪ ইং অংশগ্রহণ করেন। তিনিও শিক্ষার্থীদের সঊদী আরবের বিশেষ খাবার তৈরি করে খাওয়ান। তিনি বলেন, কখনো পারিবারিক ভ্রমণে বের হলে তার স্কন্ধেই রান্নার গুরুভার অর্পিত হয়। তার তৈরিকৃত খাবারটি ছিল ‘আসিদাহ’ ও ‘তালবিনাহ’। আরবরা এই সুস্বাদু হালুয়া জাতীয় জনপ্রিয় খাবার দ্বারা মেহমানদের আপ্যায়ন করেন। তিনি বলতেন, যদি জ্ঞান বিতরণ করা আমার উপর ওয়াজিব না হতো, তাহেল আমি বরকতের শহর মদীনা ছেড়ে কখনও বের হতাম না। তিনি আগামীতে স্বপরিবারে জামি‘আতে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি দীর্ঘ এক মাস দ্বীনি জ্ঞান ছাত্রদের মাঝে বিতরণ করে রাজশাহী ত্যাগ করে মদীনার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান।

 

Magazine