সমস্ত গুণকীর্তন ও স্তুতি সেই মহান প্রভুর জন্য, যিনি আমাদেরকে সুঠাম করে সৃষ্টি করেছেন, আমাদের উপর কৃপা করে ঈমান দান করে ধন্য করেছেন। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর।
ভূপৃষ্ঠের উপরের সকলেরই একটাই লক্ষ্য ‘সফলতা’। কীভাবে সে সবকিছুকে মাড়িয়ে কিঞ্চিৎ হলেও সাফল্য অর্জন করতে পারে; দুনিয়া ও পরকাল কীভাবে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাতে পারে এটা নিয়েই সকলের চিন্তা। কেউ সফলতা বলছে বড় বড় অট্টালিকা আর দালানকে। কেউ বলছে বড় অঙ্কের ব্যাংক-ব্যালেন্সকে, কেউ খুঁজছে মোটা বেতনের চাকরি। এরই নাম কি সফলতা? যারা ইসলামকে গুরুত্ব না দিয়ে পাশ্চাত্য বিশ্বে গমন করে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করছে তারা কি আদৌ সফল হতে পেরেছে? সফলতা কি শুধু তাৎক্ষণিক হাসিখুশি, প্রফুল্লতা আর চিত্তবিনোদনের মাঝেই সীমাবদ্ধ? নাকি সফলতার আরও কোনো অর্থ আছে? তাহলে আমরা কীভাবে বুঝতে পারব যে, প্রকৃত সফল ব্যক্তি কে? এ সম্পর্কে আমাদের মহান প্রতিপালক সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন,
وَالْعَصْرِ - إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ - إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ
‘সময়ের কসম! নিশ্চয় সকল মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিপতিত; তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে’ (আল-আছর, ১০৩/১-৩)।
মহান রব শপথ করে বলেছেন যুগের শপথ, সময়ের শপথ। মহান অধিপতি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যতীত শপথ করে বলেন না অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন যে, নিম্নে যে বিষয়টির বর্ণনা আসছে সেটা একান্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
যারাই এই ভূপৃষ্ঠে দিনাতিপাত করছে সকলেই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা চার শ্রেণির মানুষকে আলাদা করেছেন, যারা এই ক্ষতির অন্তর্ভুক্ত হবে না, যারা দুনিয়া ও পরলোকে সফলতা অর্জন করবে এবং তারা হবে প্রকৃত সফল।
১ম প্রকার: الَّذِينَ آمَنُوا যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে, যারা বিশ্বাস করেছে মহান রব এক, তিনি ব্যতীত আর কোনোই রব নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই। যারা অনেক ইলাহে বিশ্বাসী নয়; তাদের কোনো চিন্তা নেই। মহান রব তাদের সম্পর্কে বলেন,أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ - الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ ‘শুনে রাখো! নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই আর তারা পেরেশানও হবে না, যারা ঈমান এনেছে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করত’ (ইউনুস, ১০/৬২-৬৩)।
২য় প্রকার: وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ যারা সৎকর্মশীল, যারা সকাল হতে আরম্ভ করে রাত পর্যন্ত মহান রবের ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত থাকে। যারা তাদের রবের আদেশ মোতাবেক তাঁর বার্তাবাহক রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহকে আগে রেখে সকল প্রত্যাদেশ, আদেশ, নিষেধসমূহ গ্রাহ্য করে চলে। যারা প্রত্যহ তাদের উপর আরোপিত পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত যথাযথরূপে আদায় করে, যারা ছিয়াম পালন করে, যাকাত প্রদান করে, হজ্জ সম্পাদন করে, সৎকর্মের প্রতি আদেশ ও অসৎকর্ম হতে বেঁচে থাকে এবং অন্যদেরকে বেঁচে থাকার প্রতি উৎসাহিত করে। যারা ক্বিয়ামতের দিন মহান রবকে ভয় করে। সর্বোপরি হারাম কর্ম, সূদ, ঘুষ, যেনা-ব্যভিচার, অশ্লীলতা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি হতে দূরে থাকে; তারাই প্রকৃত সফলকাম।
৩য় প্রকার: وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ যারা পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয়; সত্যের ওপর অটল, অবিচল ও একনিষ্ঠ থাকার উপর উপদেশ দেয়। যারা সেই পথের দিকে পরামর্শ দেয়, যেই পথের উপর অটল থাকতে মহান রব আদেশ করেছেন এবং তাঁর দূত প্রেরণ করে সেই পথ বাতলিয়ে দিয়েছেন। যেই পথের মাঝে নেই কোনো ভ্রষ্টতা, নেই কোনো অন্যায়-যুলুম। যারা কল্যাণের পথের দিকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন, সেই শ্রেণির লোকদেরকে মহান রব সফল হিসেবে গণ্য করেছেন। তিনি বলে দিয়েছেন, তারা বিপথগামী যাত্রী ও ক্ষতিগ্রস্ত নয়; বরং তারাই সফল।
৪র্থ প্রকার: এই শ্রেণির বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে তিনি আলাদা করে বলেন যে, وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ যারা পরস্পরকে ধৈর্যের ব্যাপারে পরামর্শ ও উপদেশ দেয়, তারা সেই ক্ষতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে না আর তারা সফলকাম।
ধৈর্য ধারণ ৩ প্রকার:
(১) সৎকর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে যে কষ্ট আপতিত হয়, সেই কষ্টসমূহ স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করে ধৈর্য ধারণ করা এবং সেই আনুগত্যের কাজগুলো সন্তুষ্ট চিত্তে সম্পাদন করে যাওয়া। কষ্টে নিপতিত হয়ে সেই কর্ম ত্যাগ না করা।
(২) অসৎকর্ম পরিহারে ধৈর্য ধারণ করা। নিজেকে অসৎকর্ম হতে নিবৃত রাখতে আপন নফসের উপর যে কষ্ট আপতিত হয়, সেই দুঃখ-কষ্টকে সন্তুষ্ট চিত্তে খুশি মনে মেনে নিয়ে ধৈর্য ধারণ করা। সদাসর্বদা এই পণ করা যে, যেটাই হোক না কেন আমি অসৎকর্মে জড়িয়ে পড়ব না। এরপর যথাসাধ্য ধৈর্য ধারণ করা।
(৩) মহান রব আমার তাক্বদীরে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন তার উপর বিশ্বাস রেখে তার উপর ধৈর্য ধারণ করা, কখনোই তার প্রতিবাদ না করা ও তাতে অখুশি না থাকা। তাক্বদীরের উপর নির্ভর না করে আপন কর্মের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে চলা। তাই প্রকৃত সফল হলো, যে উক্ত চার প্রকার শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবে।
পরিশেষে বলব, আমরা সকলেই মহান আল্লাহর সৃষ্টি, সকলেই তাঁরই কৃপায় বেঁচে আছি। তিনি যাদেরকে সৎপথ দেখান, তার কোনো অনিষ্টকারী নেই আর যাকে ক্ষতির মধ্যে রাখতে চান, তার নিবৃতকারী কেউ নেই। তাই আমরা তাঁর কাছেই কামনা করছি, তিনি যেন আমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে থেকে বের করে সফলকামদের অন্তর্ভুক্ত করেন- আমীন!
আব্দুল হাসিব বিন আব্দুল হাফীয
অধ্যয়নরত, মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া, উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।