ভূমিকা :
পিতা-মাতা হলেন আমাদের এই পৃথিবীতে আসার মাধ্যম। তাদের মাধ্যমেই আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, সেণহ, শাসন ইত্যাদির সমন্বয়েই আমরা আজ কেউ কিশোরে, কেউবা যুবক, কেউবা বৃদ্ধে পরিণত হয়েছি। তাদের অবদান এতোই বেশি যে, তা পরিশোধ করার ক্ষমতা কোনো সন্তানের নেই। তারা হলেন আমাদের খাঁটি হিতাকাঙক্ষী। তারা সর্বদায় আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন। আমাদের ব্যথায় তারা ব্যথিত হন। সেই পিতা-মাতার প্রতি আমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কিছু দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, যা পালন করা আমাদের কর্তব্য।
পিতা-মাতার পরিচয় :
তারাই হলেন আমাদের পিতা-মাতা, যারা আমাদের জন্ম দিয়েছেন। শিশুকালে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন। ব্যথা পেলে ব্যথিত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন। সৎপথের দিকে আহবান করেছেন, ভুল পথে চললে ফিরিয়ে এনেছেন, শাসন করেছেন। যারা তাদের পরিশ্রমের উপার্জন দিয়ে আমাদের প্রত্যেকটি প্রয়োজন মিটানোর চেষ্টা করেছেন, তারাই আমাদের পিতা-মাতা। এই পৃথিবীতে তাদের চেয়ে আপন কেউ নেই; তারাই আমাদের একনিষ্ঠ আপনজন। তারাই শ্রদ্ধা-ভালবাসা পাওয়ার সবচেয়ে বেশী হক্বদার।
পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার :
আল্লাহ তা‘আলা কুরআন অবতীর্ণ করেছেন মানবজাতির হেদায়াতস্বরূপ। এই কুরআনে রয়েছে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় জীবনসহ সকল সমস্যার সমাধান। এরই ধারাবাহিকতায় একজন সন্তান তার পিতা-মাতার প্রতি কেমন আচরণ করবে, সেই দিক-নির্দেশনাও রয়েছে এই কুরআনে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে’ (বনী ইসরাঈল, ১৭/২৩)। এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ইবাদতের পর পিতা-মাতার প্রতি ভালো ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
সুধী পাঠক! পিতা-মাতার প্রতি ইহসান করতে বলা হয়েছে এজন্য যে, অধিকাংশ সন্তান পিতা-মাতার প্রতি বেখেয়াল; তারা তাদের খোঁজ-খবর রাখে না। তাই আল্লাহ তা‘আলা আমাদের উক্ত আয়াত দ্বারা নির্দেশ করেছেন, যেন আমরা তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করি, তাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলি, তাদের সঙ্গে ভালো কথা বলি, তাদেরকে হাদিয়া-উপঢৌকন দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করি। তাদের প্রতি এসব দায়িত্ব পালন করা হলো উক্ত আয়াতে বর্ণিত ইহসান দ্বারা উদ্দেশ্য।
তাদের প্রতি অবহেলা না করা :
এ দেশের অধিকাংশ সন্তান বড় হওয়ার পর সাংসারিক জীবনে পদার্পণ করে তাদের মাতা-পিতার প্রতি অবহেলা করে। তাদের প্রতি বিরক্তিবোধ করে। তাদের খিদমতের কথা ভুলে যায়। তাদের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপই করে না; তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে কেউ কেউ। বৃদ্ধ বয়সে কঠোর পরিশ্রম করে তাদেরকে নিজেদের আহার জোগাতে হয়। এটা কি পিতা-মাতা কর্তৃক সন্তানের উপর পরোক্ষ অভিশাপ নয়? অথচ আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন,
إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا
‘তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে বিরক্তিসূচক কিছু বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না, তাদের সাথে বলো সম্মানসূচক নম্র কথা’ (বানী ইসরাঈল, ১৭/২৩)। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা কুরআন-হাদীছকে খুবই ভালোবাসি, তার অবমাননায় জীবন দিতে প্রস্ত্তত, কিন্তু এর আদেশ-নিষেধ মানতে আমাদের সেই মন-মানসিকতা লোপ পাই। আজকে যদি কুরআনের আয়াতকে মুল্যায়ন করা হতো, তাহলে বৃদ্ধ পিতা-মাতাদের বৃদ্ধ বয়সে শ্রম দিতে হতো না।
তাদের জন্য দু‘আ করা :
দু‘আই হলো ইবাদত। দু‘আর মাধ্যমে তাক্বদীর পরিবর্তন হয়ে থাকে। পিতা-মাতার কল্যাণের জন্য সন্তানের দু‘আ করা আশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে তাদের জন্য দু‘আ করবে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
‘আর বলো, হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করুন, যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন’ (বানী ইসরাঈল, ১৭/২৪)। এ ছাড়া রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখনিসৃত বাণী প্রমাণ করে, সন্তানের কর্তব্য পিতা-মাতার জন্য দু‘আ করা। পিতা-মাতা সন্তানের দু‘আ পাওয়ার অধিক হক্বদার। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ.
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন মানুষ মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তিনটি আমল বতীত: (১) ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ (২) এমন ইল্ম, যার দ্বারা উপকার সাধিত হয় এবং (৩) সুসন্তান যে তার জন্য দু‘আ করে’।[1] এ হাদীছ দ্বারা সুস্পষ্ট হলো যে, পিতা-মাতা সন্তানের দু‘আর আশাবাদী থাকেন, যা তাদের পরকালে উপকারী হয়। তাই প্রত্যেক সন্তানের উচিত, পিতা-মাতার জন্য কল্যানের দু‘আ করা।
তাদের অবাধ্য না হওয়া :
সুধী পাঠক! তাদের সেবাই শুধু নয়; বরং তাদের আদেশ-নিষেধ মান্য করতে ইসলাম বিধান আরোপ করেছে। কোনোভাবেই তাদের অবাধ্য হওয়া যাবে না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু‘আয ইবনে জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দশটি উপদেশ দিয়েছিলেন। তন্মধ্যে একটি উপদেশ হলো, কখনো পিতা-মাতার অবাধ্য হবে না, যদিও তারা তোমার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলেন।[2] এই নির্দেশ শুধু মু‘আয রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়; সমস্ত উম্মতের জন্য প্রযোজ্য। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিতা-মাতার মর্যাদা যে কতটুকু তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখিয়েছেন উক্ত হাদীছে। আমরা যদি উক্ত হাদীছটি ভালোভাবে অনুধাবন করে আমল করি, তাহলে আমরা পিতা-মাতার অধিকার কিছুটা হলেও দিতে পারবো।
পিতা-মাতার সন্তুষ্টি হওয়া :
সন্তুষ্টি অর্জন করার প্রধান মাধ্যমই হলো সন্তুষ্টিমূলক কাজ করা। সন্তান তখনই সন্তুষ্টিভাজন হবে, যখন তার আচার-আচরণ ও চলাফেরায় পিতা-মাতা সন্তুষ্ট হবেন। পিতা-মাতার সন্তুষ্টিভাজন হওয়া অতীব যরূরী। জান্নাত পাওয়ার শর্ত যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা; ঠিক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার শর্ত হলো পিতা-মাতার সন্তুষ্টি অর্জন করা। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখনিসৃত বাণী,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: رَضِيَ الربِّ فِي رضى الْوَالِدِ وَسُخْطُ الرَّبِّ فِي سُخْطِ الْوَالِدِ
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পিতার সন্তুষ্টিতে রবের সন্তুষ্টি, তার অসন্তুষ্টিতে রবের অসন্তুষ্টি’।[3]
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের প্রত্যেককে পিতা-মাতার খিদমত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার মাধ্যমে জান্নাত লাভ করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৩১০; আবুদাঊদ, হা/২৮৮২।
[2]. আহমাদ, মিশকাত, হা/৬১।
[3]. তিরমিযী, হা/১৮৯৯; মিশকাত, হা/৪৯২৭।