কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

জীবন মরীচিকা!

post title will place here

মানুষের জীবনের অনেক পথ রয়েছে। সে তার অভিপ্রায় অনুকূলে যে কোনো পথ বেছে নেয়। সেই পথে চলতে গিয়ে অনেকে ভুল পথে পা বাড়ায়। অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিজেকে ডুবিয়ে জীবনটাকে নিঃশেষ করে দেয়। মানুষ তার কতিপয় অর্জিত সম্পদ, ঐশ্বর্য আর আভিজাত্যের মায়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ভুলে যায় তার শেকড়ের কথা। দুনিয়ার মোহ-মমতায় মানুষ শেষ গন্তব্যস্থলের কথাও ভুলে যায়। চিরস্থায়িত্বকে উপেক্ষা করে ক্ষণস্থায়িত্বকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে সে ভুলে যায় শেষ পরিণতির কথা। জীবনের বড় বড় বাঁকে নিজেকে হারিয়ে ফেলে ভাবনার এক অচিন দেশে। দুনিয়ার প্রতি তার অফুরান ভালোবাসা। পক্ষান্তরে, পরকাল তার নিকট অনীহায় টইটম্বুর। মানুষ এ দুনিয়ার চিন্তা-ভাবনা অন্তরে পুষে রেখে পরকালের কথা ভুলে যায়। তার সম্পূর্ণ হৃদয় জুড়ে পার্থিব জীবনে উন্নতির হাহাকার! অথচ তার জন্য শোভনীয় হলো দুনিয়াবী চিন্তাচেতনাকে অন্তরের মণিকোঠায় জমা রেখে শুধু চিরস্থায়ী জগতকে স্মরণ করা।

মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে— এ জীবন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। দ্রুতগামী ঘোড়ার ন্যায় ধেয়ে আসছে এর অবসান। এ সফরের যাত্রা শেষ হওয়ার প্রান্তবর্তীতে জায়গা নিয়েছে। ক্রমান্বয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে এ ধরার সুখানুভূতি। বার্ধক্যে প্রবেশের ফলে অন্তিম পৃথিবীর মায়ায় জড়ানো মনের পুলকগুলো ‘বাস্তবে রূপ নেওয়ার’ শূন্যতা অনুভব করছে। পাশাপাশি এটাও উপলব্ধি করতে হবে— তার জন্য ওত পেতে আছে স্যাঁতসেঁতে মাটির অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটি। অথচ, মানুষ রঙিন দুনিয়ার পার্থিব সফলতা অর্জন করতে পরকালের মহাসত্যকে স্বেচ্ছায় বরবাদ করে দেয়। স্বল্প কিছু ধনাঢ্যতায় সে স্রষ্টার স্মরণ হতে বিমুখতা অবলম্বন করে। আর যখন তার মাঝে কোনোকিছুর শূন্যতা বিরাজ করে, তখন ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে রবের স্মরণে মশগূল থাকে। এটাই মানুষের বৈশিষ্ট্য— কেননা, সে পেলে সন্তুষ্ট আর না পেলে রোষে ফেটে পড়ে।

মৃত্যুর তির মানুষের সাথে মোলাকাতের জন্য প্রস্তুত। শুধু অপেক্ষায় আছে রবের ধনুক হতে কখন তা ছোঁড়া হবে? তার চারপাশে সর্বদায় মৃত্যুর দৃশ্য বিরাজমান। যেগুলো তাকে মৃত্যুর ভাবনায় পৌঁছে দেয়। আফসোস হয়, এতদসত্ত্বেও মানুষ মৃত্যুকে সুদূরপরাহত দূরবর্তী সঙ্গী হিসেবেই অনুমাণ করছে। দীর্ঘমেয়াদী স্বপ্ন-সুখের জাল বুননে ব্যস্ত হয়ে ধরাপৃষ্ঠে উন্নতির মায়াজালে বন্দী হয়ে যাচ্ছে।

শয়তান নেক সুরতে তার বাহারি ফাঁদ পেতে রেখেছে। আর যখন মানুষ সেই ফাঁদে পা বাড়ায়, তখনই অধঃপতনের সাগরে হারিয়ে যায়। কথার সাথে সামঞ্জস্যশীল একটি উপমা— দুনিয়াটা অলংকার এবং প্রসাধনী ব্যবহার করা রূপকন্যার ন্যায়। কেননা, মানুষ সুসজ্জিত রূপকন্যার দিকে যেভাবে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়— তার ভাবনার জাগতে শুধু রূপকন্যাই বিরাজ করছে। তেমনি তার নিকট যখন দুনিয়াটা চিরস্থায়ী মনে হয়, তখন পার্থিব জীবনে অগ্রগামিতার প্রতিযোগিতা তার মানসপটে ঘুরপাক খায়। আর সে এই প্রতিযোগিতায় নিজেকে ধ্বংসের সাগরে বিসর্জন দেয়।

দুনিয়ার জীবনটা খুবই সংক্ষিপ্ত। মানুষ যত ধনসম্পদই সঞ্চয় করুক না কেনো এসবের পেছনে মৃত্যু তার জন্য চরম প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। মৃত্যুর স্পন্দন তার সবকিছু এক নিমিষেই নিঃশেষ করে দেবে। সাথে সাথেই চোখের আড়ালে থাকা প্রতারণার রঙিন পর্দা উন্মোচিত হয়ে যাবে।

মানুষ জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসে। মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনের আদর-স্নেহে সে বেড়ে ওঠে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে শেষে বার্ধক্যে উপনীত হয়। তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব এবং বার্ধক্যের স্মৃতিগুলো যখন হৃদয়পটে জেগে উঠে, তখন বিস্মিত হতে হয় যে, বার্ধক্যবস্থার দুর্বলতার সময়ে কোথায় তার যৌবনাবস্থার রক্তের গরম আর শক্তির দাপট? কী লাভ! দুনিয়ার মরীচিকাময় আভিজাত্যের?

কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে জাগতিক জীবন : আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَعْمَالُهُمْ كَسَرَابٍ بِقِيعَةٍ يَحْسَبُهُ الظَّمْآنُ مَاءً حَتَّى إِذَا جَاءَهُ لَمْ يَجِدْهُ شَيْئًا وَوَجَدَ اللَّهَ عِنْدَهُ فَوَفَّاهُ حِسَابَهُ وَاللَّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ ‘আর যারা কুফরী করে, তাদের আমলসমূহ মরুভূমির মরীচিকার মতো। পিপাসার্ত ব্যক্তি যাকে পানি মনে করে। (অবশেষে) যখন সে তার কাছে আসবে, তখন সে সেখানে কিছুই পাবে না। তবে সে সেখানে আল্লাহকে পাবে। অতঃপর তিনি তাকে তার হিসাব পরিপূর্ণ করে দেবেন। আর আল্লাহ অতি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী’ (আন-নূর, ২৪/৩৯)

উক্ত আয়াতে উদ্ধৃত ‘সেখানে’ বলতে অধিকাংশ মুহাদ্দিছীনে কেরামের নিকট ‘আখেরাত’ উদ্দেশ্য। সেখানে বলতে আখেরাত উদ্দেশ্য হওয়ার প্রমাণিকতা আয়াত থেকেই আমরা খুঁজে পাই। তা হলো- ধরি, কাফের লোকটি পিপাসার্ত। আর তার আমলগুলো মরুভূমির মরীচিকা। সে যখন সেখানে অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে তখন দুনিয়ার স্বার্থে করা আমলগুলোর কিছুই সে পাবে না। তবে সে সেখানে অর্থাৎ আখেরাতে আল্লাহকে পাবে। 

এই আয়াত হতে এ বুঝ-বিচার প্রতিভাত হয় যে, এই পার্থিব জীবনের সমৃদ্ধি-সমাচার পারলৌকিক নিরূপণতায় কিছুই নয়। ঐহিক এই আভিজাত্যের কোনো মূল্য নেই। একটি বর্ণাঢ্য জীবন সাজাতে মানুষের কত পরিকল্পনার ক্যানভাস আঁকা হিয়ার মাঝারে। অথচ নিঃশ্বাসটা থেমে গেলেই এই কার্যকলাপগুলোর ফায়দা সব ইস্তফা। অপেক্ষারত থাকবে শুধু স্যাঁতসেঁতে মাটিঘেরা কুটিরটি। সুতরাং, দুনিয়াবি কর্মগুলোর আড়ালে যদি সেগুলোকে পরকালের ফসল হিসাবে পাওয়ার আশা না থাকে তবে তো সবই নিষ্ফলা। যেভাবে কাফের-মুশরিকদের দুনিয়াবি কাজকর্মে শুধু দুনিয়ার স্বার্থ থাকা এবং পরকালীন কোনো আশা-ভরসা না থাকার কারণে আল্লাহর কাছে সেগুলোর কোনো মূল্য নেই। 

কাফের-মুশরিকদের দুনিয়াবি কাজকর্ম : উক্ত আয়াতে কাফেরদের কর্ম বা আমল বলতে এমন আমলকে বুঝানো হয়েছে, যা কাফের-মুশরিকরা কার্যকরী আমল বা নেকী ধারণা করে থাকে। 

 سراب বা মরীচিকা; চকচকে বালি-কণারাশির উপর সূর্যকিরণ পড়লে দূর হতে যা দেখে পানি চলার মত মনে হয়। আর سراب এর মূল অর্থ- চলা। যেহেতু ঐ বালি-কণারাশিগুলোকে দূর হতে প্রবাহমান পানি মনে হয়; যদিও তা বালি বৈ কিছুই নয়। অনুরূপ কাফের-মুশরিকদের দুনিয়াবি আমলগুলো ঈমান না থাকার কারণে কার্যকরী আমল মনে হলেও মহান আল্লাহর নিকট তা অকিঞ্চিৎকর বা মূল্যহীন হবে। এজন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কাফেরদের আমলগুলোকে মরুভূমির মরীচিকার সাথে সাদৃশ্যতা বা তুল্যতা দিয়েছেন।

তাই আমাদের উচিত, শুধু দুনিয়া অর্জন করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং পরকালকে কাঙ্ক্ষিত লভ্য হিসাবে পাওয়ার প্রত্যয়ে আমল করে যেতে হবে। 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পুনশ্চ অপর আয়াতে ইরশাদ করেন, وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ ‘আর দুনিয়ার জীবন ধোঁকা-প্রবঞ্চনার সামগ্রী বৈ কিছুই নয়’ (আল-হাদীদ, ৫৭/২০)। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বাণী, দুনিয়ার জীবন শুধুই ধোঁকার সামগ্রী। এর অর্থ হলো, যারা দুনিয়ার জীবনের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ে তাদের এই জীবন, দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী সামগ্রী শুধুই ধোঁকা দেয়। কারণ, তারা এ ক্ষণকাল স্থিতিশীল জীবনের মোহে পড়ে ও সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে এ ধারণা লালন করে যে, এ দুনিয়াই তার শেষ গন্তব্য, এ জীবন ছাড়া আর কোনো জীবন নেই এবং এ দুনিয়ার জীবনের পর কোনো উত্থান নেই। অথচ আখেরাতের চিরস্থায়ী হায়াতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন অতীব নগণ্য ও তুচ্ছ।

সাহল ইবনু সা‘দ আস-সায়েদী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَوْضِعُ سَوْطٍ فِي الجَنَّةِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا ‘জান্নাতে চাবুক পরিমাণ সামান্য জায়গাও দুনিয়া এবং এর মধ্যকার যা কিছু আছে তার থেকে উত্তম ও প্রকৃষ্ট’।[1]
উক্ত হাদীছ হতে এ বুঝ অনুভূত হয় যে, বিশাল মরুভূমির মাঝে এক বিন্দু বালিকণার স্থান যতটুকু, সুবৃহৎ অতলান্ত সিন্ধুর মাঝে একটি জলকণার উল্লেখ যতটুকু তার থেকেও অতীব ছোট্ট-নগণ্য স্থান হলো পরকালীন জীবনের মাঝে ইহকালীন জীবনের। কারণ হাদীছে বলা হয়েছে, জান্নাতে একটি চাবুক রাখার সমপরিমাণ জায়গাও দুনিয়ার সমস্ত কিছু অপেক্ষা উত্তম ও উৎকৃষ্ট। আর একটি চাবুক-ই বা কতটুকু জায়গা ধারণ করতে পারে, সেটা কি আন্দাজ করেছেন? অতএব, একটু চিন্তা করলেই আমরা অনুধাবন করতে পারব যে, পারলৌকিক পরমায়ুর তুলনা নিরূপণতায় এই পার্থিব আয়ুষ্কালের মূল্য কতটুকু হতে পারে?

সুতরাং, প্রত্যকটি মুসলিম বান্দার উপর বাঞ্ছনীয় বিষয় হলো, পরকালকে সামনে রেখে দুনিয়ার স্বার্থে অন্ধ না হয়ে একনিষ্ঠচিত্তে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ইবাদতে মশগূল ও নিবিষ্ট থাকা।

সুধী পাঠক! দুনিয়াবী ভোগবিলাসিতায় পথভ্রষ্টতার চোরাবালিতে আমরা তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। আর এ ধনাঢ্যতাই আমাদেরকে ধ্বংসের কৃষ্ণসাগরে ডুবিয়ে দেয়। অতঃপর সর্বোপরি কথা হলো— আমরা যদি রবের স্মরণে নিমগ্ন হই, তাহলেই অন্ধকারের যাত্রায় মৃদু আলোর পরশ পাব ইনশা-আল্লাহ। আর সেই আলোয় আমরা জীবনকে রাঙিয়ে তুলতে পারব এক সুন্দরময় জীবনে। এ লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে আমাদের উচিত হলো, এই অল্প সময়েই আখেরাতের মুক্তির বীজ এবং পরকালীন পাথেয় সংগ্রহ করা।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে আপনার অবারিত অনুগ্রহ ও দয়ায় সফলতার সোপান আরোহণ করে জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

রিফাত সাঈদ

শিক্ষার্থী, মাদরাসাতুল হাদীস, নাজির বাজার, বংশাল, ঢাকা।

[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৫০।

Magazine