ফোবিয়া (Phobia) বলতে বুঝায় ভয়, ঘৃণা, আতঙ্ক। ফোবিয়া শব্দটি গ্রীক শব্দ ‘ফোবোস’ (phóbos) থেকে এসেছে, যার মানে হচ্ছে ভয়। ফোবিয়া বা অস্বাভাবিক ভীতিকে বর্ণনা করা হয় একটি স্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী ভয় হিসেবে, যা কোনো বস্তু অথবা স্থান হতে পারে। ফোবিয়া মূলত এক ধরনের অযৌক্তিক ভয়, যেটার পরিমাণ সাধারণ ভয় থেকে কয়েক গুণ বেশি হয়ে থাকে। এর বাস্তব রূপ এমন হতে পারে যে, ব্যক্তি মানসিক চাপে সর্বদা দুশ্চিন্তায় ভোগে, মনের গহীনে ভয়ের লালন করে দিনাতিপাত করে। আর সেটা যদি ইসলামের সাথে যুক্ত হয়, তাহলে এর অর্থ হয় ইসলাম বিষয়ে ভয় বা ত্রাস। তাহলে সহজে বোধগম্য হয় যে, ইসলাম শান্তির বার্তা দেয় না, বরং ইসলাম মানুষকে ত্রাসের শিক্ষা দেয়, ইসলাম সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করতে চায়। আর এই ফোবিয়া শব্দটাই পাশ্চাত্য সমাজ লুফে নিয়ে অন্য ধর্মের সাথে যুক্ত না করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইসলামের সাথে যুক্ত করে মিডিয়ার কল্যাণে একচ্ছত্র ভূমিকা পালন করে বিশ্বব্যাপী ইসলামের ব্যাপারে জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। ফলে মানুষ ইসলাম থেকে দূরে অবস্থান করে এবং ইসলামের ব্যাপারে বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি পেশ করতে আগ্রহী হয়। আর এই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অধুনা বিশ্বে ইসলামবিদ্বেষী পাশ্চাত্য সমাজ দিন-রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামবিদ্বেষীরা ইসলামের বিরুদ্ধে যতই ষড়যন্ত্র করুক না কেন, ইসলাম পৃথিবীর বুকে হাজার কোটি মানুষের হৃদয়ে স্বমহিমায় অম্লান হয়ে থাকবে, ইসলামের গতি আরো শতগুণে ত্বরান্বিত হবে ইনশাআল্লাহ। আর এটাই বিশ্ববাসী খুব ভালো করে অবলোকন করছে। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি ঘটনা নিম্নে উল্লেখ করছি—
(ক) কানাডার খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচারক ডক্টর গ্যারি মিলার কুরআনের ভুল খুঁজতে এসে সূরা আন-নিসার ৮২ নং আয়াত পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্ৰহণ করেন।
(খ) খ্রিষ্টান ফরাসি নারী লায়লা হুসাইন ইসলামের সৌন্দর্যের অন্যতম প্রতীক নারীর হিজাব দেখে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্ৰহণ করে সৌভাগ্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত হন।
(গ) আব্দুর রহীম গ্ৰীন বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে বড় একজন পণ্ডিত। অবশেষে ইসলাম নিয়ে গবেষণা করতে এসে তিনি মুসলিম হন।
প্রিয় পাঠক! এখন প্রশ্ন হলো, কোন্ সেই ফোবিয়া, যা এসব মানুষকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে? কোন্ সেই ফোবিয়া, যা তাদের ইসলাম সম্পর্কে জানতে কৌতূহল, উদ্দীপনা অনেক গুণ বাড়িয়েছে? নিঃসন্দেহে যে বা যারা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণে তা বিবেচনা করবে, অবশ্যই সে সত্য জ্ঞানের আলোয় নিজেকে আলোকিত করে সৌভাগ্যশীলদের কাতারে শামিল করতে সক্ষম হবে। ইসলাম এমনই। যত বেশি ইসলামের উপর আঘাত আসবে, ইসলাম তত বেশি আপন গতিতে নিজের রূপ, সৌন্দর্য, উদারতা, ভালোবাসা অকাতরে পরিস্ফুটিত করবে।
মিডিয়ায় ইসলাম ফোবিয়া সম্পর্কে কারসাজি :
সত্যি বলতে কি বিশ্বব্যাপী ইসলামবিদ্বেষী স্বার্থান্বেষী মহল ইসলামের ব্যাপারে অসার তকমা লাগিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় অবাধে প্রচার করে আসছে যে, ইসলাম একটি চরমপন্থী ধর্ম। ইসলাম তরবারির জোরে মানুষকে বশ্যতা স্বীকার করিয়েছে। ইসলাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণও আসলে তরবারি। এমনি শত খোঁড়া যুক্তি ও অসার বাক্য পেশ করে ইসলামবিদ্বেষী মহল। যার ফলশ্রুতিতে অমুসলিমরা ইসলামকে বড় আতঙ্কের বিষয় মনে করে। যেভাবেই হোক নিজেকে মুসলিমদের থেকে কীভাবে দূরে রাখা যায়, সে ব্যাপারে খুবই সচেতনতা অবলম্বন করে। সাম্রাজ্যবাদীরা বিশেষত বিশ্ব মিডিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখার কারণে ইসলামের ব্যাপারে এ ধরনের হীন, নোংরা ষড়যন্ত্রের কারসাজি চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে ইসলামবিদ্বেষীদের দ্বারা পরিচালিত বিশ্ব মিডিয়ার এই অবাধ বিচরণে স্বভাবতই অমুসলিমরা ইসলাম সম্পর্কে সঠিক বুঝের বদলে ইসলামের ব্যাপারে নানাবিধ বিরূপ ও উগ্ৰ মন্তব্য মনের গহীনে লালন করে। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে কিছু হোক না কেন যদি সেখানে মুসলিম অন্তর্ভুক্ত থাকে বা কোনো গন্ধও পায় তাহলে বিশ্ব মিডিয়ায় খুব বড় ফোকাসে মুসলিমদের সন্ত্রাসী, জঙ্গী, মৌলবাদী ইত্যাদি বলে প্রচারণা চালায়। এক্ষেত্রে মুসলিমরা দোষী হোক আর না হোক, তা তাদের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে থাকে না। মূলত তাদের ষড়যন্ত্রই হলো ইসলামের ব্যাপারে কুৎসা রটানো। তারা আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, কাশ্মীর, সোমালিয়া ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিমরা যখন তাদের জান, মাল ও ন্যায্য অধিকার রক্ষার স্বার্থে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন স্বার্থান্বেষী মহল ঐ সকল নির্যাতিত মুজাহিদদেরকে বিশ্ব মিডিয়ায় সন্ত্রাসী, জঙ্গী, মৌলবাদী বলে প্রচারণা চালায়। অথচ তারা মুসলিম মুজাহিদের ছালাতের দৃশ্য ভুল করেও মিডিয়ায় প্রচার করে না। ধিক! এ সকল স্বার্থান্বেষী মহলকে!
ইসলাম ফোবিয়া সম্পর্কে খোঁড়া যুক্তি খণ্ডন :
(১) ইসলাম তরবারি দ্বারা প্রচার হয়েছে। ফলে ইসলামের অনুসারী সর্বত্র বেশি।
জবাব : ইসলাম শান্তির ধর্ম। পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে, প্রত্যেক জনপদে ইসলাম কেবল শান্তির বার্তা দিয়েছে। ইসলাম অশান্তির দাবানল থেকে শান্তিতে বসবাসের জন্য মানুষকে আহ্বান করে। ফলে মানুষ পরাধীনতার জিঞ্জির থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য, সুখের নীড় গড়ার জন্য, মানুষকে মানুষের প্রভুত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য, নিজের সম্মানকে অটুট রাখার জন্য মানুষ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে এসে আশ্রয় নেয়। ইসলামের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করে নিষিদ্ধ পথের যাত্রীরা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইসলাম তার রূপ, সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে বলেই অমুসলিমদের হৃদয় ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে প্রকাশ্যে তারা ইসলামের যতই বিরোধিতা করুক না কেন অবশেষে ইসলামের মহান আদর্শের কাছে মাথানত করতে বাধ্য হয়।
পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, অন্যান্য ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে বা প্রচারের ক্ষেত্রে যেরূপ জোরজবরদস্তি করা হয়েছে এবং হচ্ছে তা কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে হয়নি। এমনকি তারা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে, অনাহারে রেখে, নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে তাদেরকে সেই সকল ধর্ম মানার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের আয়োজন করে। কিন্তু আপনি কি কখনও ইসলামের ব্যাপারে এমন শুনেছেন যে, অমুক মুসলিম ঐ বিধর্মীকে নির্যাতন চালিয়েছে মুসলিম বানানোর জন্য। আপনি কি দেখেছেন অমুক মুসলিম কোনো বিধর্মীকে অঢেল সম্পদের প্রলোভন দেখিয়ে মুসলিম বানিয়েছে। না, এরকম অপ্রত্যাশিত খবর আপনি কখনো শুনতে পাননি আর আশা করি ভবিষ্যতেও পাবেন না। ইসলাম জোরজবরদস্তির নাম নয়। বরং ইসলাম মানব মনের গহীন থেকে উৎসারিত এক সন্তুষ্টির নাম। যখন কোনো মানুষ স্বেচ্ছায়, সুস্থ বিবেকে ইসলাম গ্ৰহণ করবে, ঠিক তখনই সে মুসলিম বলে বিবেচিত হবে। যেখানে থাকবে না কোনো প্রকারের অর্থের প্রলোভন, থাকবে না কোনো অসহনীয় নির্যাতনের স্টিম রোলার, থাকবে না কোনো প্রকারের জোরজবরদস্তি। আর ইসলাম মানবমণ্ডলীকে এটাই শিক্ষা দেয় (দ্র. আল-বাক্বারা, ২/২৫৬)।
আজকে আফসোসের বিষয় হলো, পাশ্চাত্য সমাজ ইসলামকে তরবারি দ্বারা প্রসারিত হয়েছে বলে বিরূপ মন্তব্য করে। এক্ষেত্রে আমি তাদের দোষ দিব না। কেননা তারা এমন পরিবেশে জীবনযাপন করছে যেখানে তাদের মিডিয়া সব রকমের প্রযুক্তি ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে কটু মন্তব্য, বিরূপ কথা, নেতিবাচক সংবাদ শুনিয়ে শুনিয়ে কান ভারি করে দিচ্ছে। অথচ দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার যে, মুসলিমরা প্রায় ৮০০ বছর স্পেন শাসন করেছে, তারা ভারতীয় উপমহাদেশও প্রায় হাজার বছর শাসন করেছে। অথচ ইতিহাসে কোথাও পাওয়া যায় না যে, অমুসলিমরা তরবারির ভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। বরং সকল ধর্মের মানুষ সুন্দর, স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছে মুসলিমদের শাসনামলে। তারা তাদের ধর্ম নির্দ্বিধায় নিঃসঙ্কোচে মেনে চলত। মুসলিম শাসকগণ তাদের অধিকার সংরক্ষণ করেছেন।
ইসলামের শ্রেষ্ঠ তরবারি হলো, মহোত্তম আদর্শ, উন্নত চরিত্র, মাধুর্যপূর্ণ নম্র আচরণ। ফলে ইসলামের অনুসারী যেখানেই গিয়েছে, ঠিক সেখানেই সোনার ফসল ফলিয়েছে। ইংরেজ লেখক ‘ডি লিসী’ তার বইয়ে ‘Islam At The Cross Road’ বইয়ের ৮ নং পৃষ্ঠায় বলেন, ইতিহাসে এ সত্য প্রকাশিত হয়েছে, ইসলাম সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করা হয়েছে যে, ইসলাম তরবারি দ্বারা প্রসার লাভ করেছে। এ ধরনের অভিযোগ কম বুদ্ধি ও অল্প ধীসম্পন্ন ঐতিহাসিকদের বক্তব্য।
(২)ইসলাম মানুষের জানের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম নয়।
জবাব : ইসলাম সম্পর্কে যে ব্যাপক অধ্যয়ন করবে, সে ইসলাম সম্পর্কে অন্য আর যা কিছু শিখুক না কেন ইসলাম যে মানুষের সর্বপ্রথম জীবনের নিরাপত্তা দেয় সেটা বুঝতে সে মোটেও ভুল করবে না। আপনি যদি ইসলামের বিষয়গুলো ভালোভাবে অবলোকন করেন এবং যদি আপনার জানার কৌতূহল পাহাড়সম হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি ইসলামের এই সুমহান মেসেজটি প্রত্যেক পাতায় পাবেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে অন্য প্রাণের বিনিময় ব্যতীত কিংবা তার দ্বারা যমীনে কোনো ফাসাদ বিস্তার ব্যতীত, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করে ফেলল’ (আল-মায়েদা, ৫/৩২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘যে কেউ সীমালঙ্ঘন ও যুলুম করে হত্যাকাণ্ড করবে, আমি তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব’ (আন-নিসা, ৪/৩০)। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা অপরাধে কোনো যিম্মীকে হত্যা করে, আল্লাহ তাআলা তার উপর জান্নাতকে হারাম করে দিবেন’।[1]
এমনকি ইসলাম মানুষের জানের নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে জীবনের চূড়ান্ত সীমার শেষ মুহূর্তে খাদ্যাভাবের কারণে হারাম বস্তুকে খাওয়ার অনুমতি প্রদান করে, যা দ্বারা প্রমাণিত হয়, ইসলামে জানের নিরাপত্তা সর্বাগ্ৰে।
(৩) ইসলাম খুবই কঠোর, উগ্ৰপন্থাওচরমপন্থার ধর্ম।
জবাব : ইসলামই কেবল সহজ, সরল ও নমনীয় ধর্ম। যা মানুষকে কখনও কঠোরতা, উগ্ৰপন্থা ও চরমপন্থা শেখায় না। এ ব্যাপারে অসংখ্য প্রমাণাদি বিদ্যমান। যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জোরজবরদস্তি নেই’ (আল-বাক্বারা, ২/২৫৬)। আল্লাহ কারো উপর এমন কোনো দায়িত্ব অর্পণ করেন না, যা তার সাধ্যের বাইরে (আল-বাকারা, ২/২৮৬)। আল্লাহ দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি (আল-হাজ্জ, ২২/৭৮)।
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদেরকে মূলত সহজ করেই পাঠানো হয়েছে, কঠিন করে পাঠানো হয়নি’।[2] অন্য হাদীছে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই দ্বীন সহজ সরল, কঠিন নয়। দ্বীন নিয়ে যে বাড়াবাড়ি করে দ্বীন তার উপর বিজয়ী হয়। কাজেই তোমরা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো এবং নিকটবর্তী হও, আশান্বিত থাক’।[3] আরও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ আমাকে একজন সহজপন্থী শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়েছেন’।[4]
এছাড়াও ইসলাম প্রত্যেক বিধানের ক্ষেত্রে মানব জাতিকে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করার জন্য জোরালো দিকনির্দেশনা পেশ করে।
একথা জেনে রাখা উচিত যে, ইসলাম চরমপন্থা আর নরমপন্থার নাম নয়, বরং ইসলাম হলো মধ্যমপন্থার নাম। তাই এই মধ্যমপন্থার ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে জানা, বুঝা আর উপলদ্ধির জন্য পাশ্চাত্য সমাজের কোনো সমস্যা আছে কি?
(৪) ইসলাম প্রগতির অন্তরায়।
জবাব : Progress শব্দটি ইংরেজি। যা ল্যাটিন শব্দ Prograde থেকে উদ্ভূত। প্রগতি অর্থ উন্নতি, অগ্ৰগতি, উৎকর্ষতা ইত্যাদি। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্মীয়সহ যাবতীয় বিষয়ে উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করাই হলো প্রগতির আলোচ্য বিষয়। আধুনিক প্রগতিবাদ আন্দোলন শুরু হয় আঠারো শতকে ভল্টোয়ার, রুশো, হবস, লক প্রমুখের হাত ধরে। ফলে ধর্মবিদ্বেষীদের আস্ফালনে প্রগতিবাদ আন্দোলনে আরো অনেক মতাদর্শ নতুন মাত্রায় যোগ হয়। জন্ম নেয় ডারউজম মতবাদ। আধুনিক প্রগতিবাদীরা ধর্মের ব্যাপারে খুবই গোঁড়ামি ও বিদ্বেষমূলক আচরণ করে বলে, ধর্ম আলাদা বিষয় আর প্রগতি আলাদা বিষয়। এজন্য তারা ধর্মের সাথে আপস না করে নিজস্ব চিন্তা-চেতনার আলোকে প্রগতিবাদকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরালো প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ চরম সত্য কথা হলো ইসলামই কেবল প্রগতির ধর্ম। যদি তারা গভীর দৃষ্টি দিয়ে চিন্তা করে, তাহলে তারা দেখতে পাবে ইসলাম ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত প্রত্যেকটি দিক ও বিভাগে উন্নতি, উৎকর্ষতা চায়। এক্ষেত্রে মোটেও ইসলাম প্রগতির অন্তরায় নয়। বরং ইসলাম প্রগতির সহায়ক। ইসলাম ছাড়া প্রগতি অচল। ইসলাম কখনো প্রগতির বিরুদ্ধে নয়। এজন্য ইসলামে প্রগতিবাদ বুঝতে হবে এবং খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
আধুনিক প্রগতিবাদ ও ইসলামী প্রগতিবাদের পার্থক্য :
১. আধুনিক প্রগতিবাদ সময়, ভূখণ্ডের দাবিতে পরিবর্তনশীল।
ইসলামী প্রগতিবাদ সর্বদা অপরিবর্তনশীল।
৩. আধুনিক প্রগতিবাদের সমস্যা ও সমাধান প্রগতিবাদীরা করে নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক মেজাজে।
ইসলামী প্রগতিবাদের সমস্যা ও সমাধান হয় অহীভিত্তিক সিলেবাসে।
৪. ইসলামী প্রগতিবাদ সকল যুগেই শ্রেষ্ঠ।
৫. জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইসলামী প্রগতিবাদের অবদান সকল যুগেই অতুলনীয়।
৬. আধুনিক প্রগতিবাদ মানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা।
ইসলামী প্রগতিবাদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
৭. আধুনিক প্রগতিবাদ মানে নারীবাদী আন্দোলন, নারীর সম্মান হরণ।
(৫)ইসলাম কি বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম?
জবাব : ইসলাম একটি বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম (Islam is a science based religion)। ইসলাম বিজ্ঞানের বিরোধী নয়। জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান অপরিসীম। সেই বিজ্ঞানের অনেক কিছু ইসলামেরই উৎসমূল থেকে উৎপন্ন। আল-কুরআনে বিজ্ঞানের বহু উৎস রয়েছে। দেখুন ইসলামের বিজ্ঞানভিত্তিক দিক নির্দেশনা যা পাশ্চাত্য সমাজ আজ গবেষণা করে খুঁজে পাচ্ছে এবং এই গবেষণায় কেবল ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বৃদ্ধি পায়। যেমন-
১. চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই, যা সূরা আল-ফুরক্বানের ৬১ নং আয়াতে বলা হয়েছে আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে। আর বিজ্ঞান আজকে এই থিওরি প্রমাণ করছে।
২. চাঁদ ও সূর্য নিজ কক্ষপথে চলে যা বলা হয়েছে সূরা আল-আম্বিয়ার ৩৩ নং আয়াতে। যা আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করছে আজকের যুগে।
৩. বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় অধ্যায় দখল করে আছে ‘বিগ ব্যাং থিওরি’। যা মহান আল্লাহ তাআলা আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে সূরা আল-আম্বিয়ার ৩০ নং আয়াতে বলেছেন। যা আজকের বিজ্ঞান তালাশ করে তথ্য অনুসন্ধান করে আমাদেরকে দিচ্ছে।
(৬) মুসলিমরা সন্ত্রাসী, মৌলবাদী।
জবাব : বর্তমান বিশ্বে অমুসলিমদের দ্বারা সর্বাধিক আলোচিত সমালোচিত বিষয় হলো- মুসলিমরা সন্ত্রাসী, মৌলবাদী, জঙ্গী ইত্যাদি। যখন কোনো ধর্মসংক্রান্ত বিষয় উত্থাপিত হবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড় করানো হয় ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা সন্ত্রাসী, না হয় জঙ্গী! এই পরিভাষাগুলো পাশ্চাত্য সমাজ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জোরালো প্রয়াসে প্রচার করে আসছে। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলিমদেরকে সন্ত্রাসী, মৌলবাদী বলে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করছে। চাই সেক্ষেত্রে মুসলিমরা দোষী হোক আর না হোক।
মহান আল্লাহ ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে যাবতীয় ষড়যন্ত্র থেকে হেফাযত করুন। আমীন!
মাযহারুল ইসলাম
অধ্যয়নরত, দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা দারুস সুন্নাহ, মিরপুর, ঢাকা।
[1]. আবূ দাঊদ, হা/২৭৬০; নাসাঈ, হা/৪৭৪৭।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৬; মিশকাত, হা/৪৯১।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৪৬।
[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৭৬৩; মিশকাত, হা/৩২৪৯।